দূর দেশের লোক গল্প— ২১৩
সাভানা (আফ্রিকা)
বেবুনের পেছনে লোম নাই
চিন্ময় দাশ
[ বেবুন— বানর জাতীয় প্রাণী। আফ্রিকা জুড়ে খোলা সাভানা এলাকার বনভূমি এবং পাহাড়ে এদের বসবাস। এরা সর্বভূক-- গাছের শেকড়, বীজ, পাতা, পোকামাকড়, মাকড়সা, ইঁদুর কিছুই বাদ নেই। তবে, এরা ভীষণ সুবিধাবাদী এবং স্বার্থপর। অন্য প্রাণীদের কথা ভাবেই না। এই অবিবেচনার ফল কীভাবে ভুগতে হয়েছে বেবুনদের, তাই নিয়ে বহু গল্প আছে গোটা আফ্রিকা জুড়ে।
সেগুলি থেকেই একটি গল্প এখানে শোনাব আমরা। এটি দক্ষিণ আফ্রিকা এবং কালাহারি মরুভূমি এলাকার, শিকারজীবি আদিবাসী ‘সান’ জনগোষ্ঠী সমাজে প্রচলিত আছে। ]
অনেক কাল আগের কথা। তখন সবে মাত্র কিছু জীবজন্তু এসেছে পৃথিবীতে। মানুষ তো আসেইনি। বাতাস ভীষণ রকম গরম। টিকে থাকা বেশ কঠিন। দূরে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোটখাটো দু’-চারটে ডোবা কিংবা নালা ছাড়া, কাছেপিঠে কোথাও জল নাই।
এক জেব্রার ভারি সমস্যা। কাছাকাছি জল বলতে একটা ডোবা। কিন্তু একটা ধেড়ে বেবুন সেটা আগলে রেখেছে। যখনই যায়, হেঁকে ওঠে—এটা আমার জল। আমিই এই জলের মালিক। এক ফোঁটা জলও পাবে না কেউ। ভাগ এখান থেকে।
বয়স হয়েছে জেব্রাটার। তাছাড়া, বেবুন জাতটাই যা বিদরাগী! কামড়ে রক্তারক্তি করে দিতে পারে। তাই জেব্রাটা যায়, আর ধমক খেয়ে ফিরে আসে। সামনে গরমকাল আসছে। জল না পেলে, বাঁচা যাবে কী করে?
ঘরে এক যুবক ছেলে ছিল জেব্রার। সে বাবাকে ডেকে বলল—চলো তো ডোবায়। আমি যাচ্ছি তোমার সাথে।
বাবা ছেলে দুজনে নেমে এসেছে জলের জন্য। ডোবার পাড়ে আগুন জ্বলছে। পাশে বসে জল পাহারা দিচ্ছে বেবুন। দুটো জেব্রাকে দেখে, তড়াক করে লাফিয়ে উঠেছে বেবুন—ভাগ এখান থেকে। যত্তোসব আপদের দল। এটা আমার পুকুর। আমিই এর মালিক।
যুবক জেব্রাটা বেশ তেজিয়াল। সে ওসব ধমক শুনবার পাত্র নয়। সেও হেঁকে উঠল—জল কারও বাপের নয়। বিধাতার সৃষ্টি। জলে সবার অধিকার। তুমি কোথাকার মালিক হে?
এমন হুঙ্কার কখনও শোনেনি বেবুন। এমনকি, তাকে কেউ ধমক দিয়ে কথা বলতে পারে, এটা সে জীবনে ভাবেনি কখনও। এতদিন যারাই এসেছে জলের জন্য, ধমক খেয়ে সবাই চুপচাপ ফিরে গিয়েছে। এভাবে রুখে দাঁড়ায়নি।
বিশেষ করে বাপ তুলে হাঁক দিয়েছে হতভাগাটা। বড্ড আঁতে লেগেছে বেবুনের। মাথা গরম হয়ে গেল তার। বলল—বড্ড বেয়াদব ছেলে তো? তো সাহস তোর? আমার বাপ তুলে কথা বলিস?
যুবক জেব্রা বলল—বাপ কেন গো? ঠাকুর্দা বা তার ঠাকুর্দাও তুলতে পারি।
🍂
আর সহ্য করা যায় না। বেবুন বলল—তবে রে, হারামজাদা। আজই তোর শেষ দিন। সব হম্বিতম্বি বন্ধ করে দিচ্ছি এখুনি।
যুবক জেব্রা হেসে উঠেছে তা শুনে—মানে? লড়াই করবে আমার সাথে?
--করবই তো। না লড়ে, এক ফোঁটা জলেও জিভ ঠেকাতে পারবি না তুই।
বেবুন তো জানে না। জেব্রার গায়ে কতো জোর। তার জানাই নাই, জেব্রার যত শক্তি তার পেছনের পায়ে। তাছাড়া, জোড়া পায়ে লাথি কষাতে পারে তারা। যুৎসই করে মারতে পারলে, জেব্রার জোড়া পায়ের লাথিতে অনেক সময় বাঘ, সিংহ বা চিতাও কাবু হয়ে যায়।
বেবুন তেড়ে এসেছে। লড়াই চলছে দুজনের। জেব্রাটা এক সময় পেছনে পেয়ে গেল বেবুনকে। আর যায় কোথায়? প্রচণ্ড এক লাথি। বাঘ সিংহরা জানে, সে লাথির কী ভয়ানক জোর। তাদের তুলনায় বেবুন তো অনেক ছোট। জোড়া পায়ের লাথি খেয়ে, বেবুনটা শূণ্যে উঠে গেছে। যেন বাতাসে উড়ে উড়ে যাচ্ছে। একটা পাহাড় ছিল খানিকটা পেছনে। সেই পাহাড়ে গিয়ে আছড়ে পড়েছে বেচারা।
ঢালু পাহাড়। তাতে ঘষটে ঘষটে নেমে যাচ্ছে বেবুন। মুখের কথা বাদ দিলে, সারাটা শরীর নরম আর ঘন লোমে ঢাকা বেবুনদের। কিন্তু পাথরে ঘষা খেয়ে নামতে নামতে, পাছার সব লোম ছিঁড়ে উপড়ে খতম। রক্তে লাল দগদগে হয়ে উঠল পেছনটা।
হয়েছিল কী, বেবুনকে জোরে লাথি কষাতে গিয়ে, নিজের ভর রাখতে পারেনি জেব্রাটাও। আছাড় খেয়ে পড়েছিল। আর, পড়বি তো পড়, সেই আগুনের উপর। তাতে তার শরীরও পুড়ে গিয়েছিল।
সেদিন থেকে, জেব্রার শরীর জুড়ে ডোরা কাটা পোড়া দাগ। আর, বেবুনদের পেছনে, মানে দুটো পাছায় কোনও লোম নাই।
0 Comments