জ্বলদর্চি

আশুতোষ দাস (অধ্যাপক, পত্রিকা সম্পাদক, তমলুক)/ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৩৩
আশুতোষ দাস (অধ্যাপক, পত্রিকা সম্পাদক, তমলুক) 

ভাস্করব্রত পতি

যাঁরা অনাথ, যাঁদের তিন কূলে কেউ নেই, তাঁদের 'তিনি' আছেন। তাঁদের সাথে তিনি মেশেন। তাঁদের পাশে তিনি থাকেন। তাঁদের নিয়ে তিনি হাঁটেন। তাঁদের জীবন নিয়ে তিনি ভাবেন। 

এরকম 'তিনি' কটিকে গুটিক মেলে। অধ্যাপক আশুতোষ দাস। তমলুকের এক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। কিন্তু তাঁর 'অবসর' নেই। তাঁর ফুরসৎ নেই। তাঁর বিশ্রাম নেই। তাঁর আরাম আয়েস করার মনোবাঞ্ছা বা মনোবাসনাও নেই। বাড়িতে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত সহধর্মিনীর সেবাশুশ্রূষা করার পাশাপাশি তিনি সেবা করেন সমাজের একশ্রেণীর সর্বহারা ছেলেদের। এঁদের সেবায় নিয়োজিত থাকাতেই তাঁর আনন্দ, তাঁর ধ্যানজ্ঞান, তাঁর জীবনের লক্ষ্য। 
নিজের পড়ার টেবিলে আশুতোষ দাস

মেদিনীপুরের মানুষেরা তো এরকমই হন। বিপ্লবের জেলা মেদিনীপুর। সংগ্রামের জেলা মেদিনীপুর। ইতিহাসের জেলা মেদিনীপুর। সেই জেলার একজন বাসিন্দা হিসেবে আজ আশুতোষ দাস নীরবে নিভৃতে নিরলসভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন মহান কাজ। 'শিশু রক্ষা সমিতি' র কর্ণধার তিনি। সেই সমিতির বুকে পিঠে ধারন করে আছেন পঞ্চাশের বেশি সব হারানো দুঃস্থদের। তাঁদের ভরণ পোষণ সহ যাবতীয় দায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়েছেন নিজের মন থেকে। অবসরকালীন আয়েসী জীবনের বাগানে তিনি নিজেকে ঢোকাননি। তিনি চেয়েছেন নিজের পাশাপাশি অন্যদের বাঁচার পথ দেখিয়ে দিতে। এই সমাজে কারও দয়ায়, অনুকম্পায় নয়, মাথা তুলে দাঁড়ানোর শক্তি দিতে তিনি বদ্ধপরিকর। 

১৯৪২ এর ১০ ই জানুয়ারি আজকের বাংলাদেশের নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুর জেলার টুমকুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মুরারীমোহন দাস এবং মা পদ্মাবতী দাস। তবে তাঁর জীবনের সবকিছু আবর্তিত তমলুককে ঘিরে। পারিবারিক দুর্যোগের ঘনঘটায় মাত্র সাত বছর বয়সে নোয়াখালী থেকে চলে আসেন তমলুকে। সেটা ১৯৪৯ সাল। ঠাকুমা অশ্রুমনি দাসের কাছে মানুষ হন। আসলে ১৯৩৭ সাল থেকে এই তমলুক শহরে পি এইচ ই বিভাগে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে কাজ করতেন তাঁর কাকা। সেখানেই থাকতেন ঠাকুমা। 
নিজের সম্পাদিত 'সিগন্যাল' পত্রিকা হাতে নিয়ে অধ্যাপক আশুতোষ দাস

১৯৫০ এ টাউন স্কুলে ভর্তি হন ক্লাস থ্রিতে। সেসময় খুব সাহায্য করতেন এখানকার বিশিষ্টজন কৃষ্ণপ্রসাদ চক্রবর্তী। তখনকার দুজন ছাত্র পরবর্তীতে বিখ্যাত হয়েছিলেন -- রামচন্দ্র ধাড়া এবং আশুতোষ দাস। তমলুক কলেজে ১৯৫৮ তে আই এ পরীক্ষায় ভর্তি হন। ইন্টারমিডিয়েটে কমার্স নিয়ে পড়তে শুরু করেন। এরপর ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স করলেন। ১৯৬৯ এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ করলেন। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে এবার শুরু নতুন জীবন। কর্মজীবন। 
এভাবেই অতি সাধারণ দিন কাটাতে পছন্দ করেন অধ্যাপক আশুতোষ দাস

কোলাঘাটের সাগরবাড় হাইস্কুলে ১৯৬৩ এর জানুয়ারি মাসে সহ শিক্ষক পদে যোগদান করেন। এখানে ছিলেন দেড় বছর। এখান থেকে চলে যান তমলুকের নাইকুড়ি ঠাকুরদাস ইন্সটিটিউশনে। ১৯৬৬ তে WBCS এ সি গ্রুপে পাস করে ওয়েস্ট অ্যাণ্ড মেজারস ডিপার্টমেন্টে চাকরি পান। ছমাস চাকরি করেন। কিন্তু তাও ছেড়ে দেন। ১৯৭৩ এর ১ লা নভেম্বর যুক্ত হন সবংয়ের নারায়নবাড় হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে। এখানে ছিলেন দেড় বছর। দাঁতন ও কাকদ্বীপ কলেজে অধ্যাপনার সুযোগ পান এম এ করার পর। যাননি। 

১৯৭২ এ প্রতিষ্ঠা হয় ময়না কলেজের। সপ্তাহে দুদিন এখানে পার্ট টাইম অধ্যাপনা শুরু করেন। একদিকে প্রধান শিক্ষকতা, অন্যদিকে অধ্যাপনা। অবশেষে পাকাপাকিভাবে চলে আসেন ময়না কলেজে অধ্যাপনা করতে। সেটা ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাস। এরপর থেকে তিনি আরও যুক্ত হয়ে পড়েন সাহিত্য সেবায়। 

১৯৭৬ এর ১ লা জানুয়ারি শুরু করলেন সাপ্তাহিক 'সিগন্যাল' পত্রিকার প্রকাশ। ২০০৫ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রকাশ পেয়েছে তা। যা তমলুকের শিক্ষা সংস্কৃতি সাহিত্য রাজনীতি নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খবর করে গিয়েছে পাঠকদের জ্ঞানার্জনে। প্রথম থেকেই পত্রিকার জন্য সাহায্য করে গিয়েছেন ফনী দাস, বনমালী মাইতি প্রমুখ। বহু বিশিষ্ট এবং বিদগ্ধ লেখক এখানে কলম ধরেছিলেন নিয়মিতভাবে। ১৯৭৬ এর জুনে জরুরি অবস্থা চলাকালীন এই সিগন্যাল পত্রিকার বিরুদ্ধে অনেক কেস দাখিল করা হয়। 
তমলুক থেকে প্রকাশিত আশুতোষ দাস সম্পাদিত পত্রিকা 'সিগন্যাল'

২০০৪ এর আগষ্ট থেকে যুক্ত হন তমলুকের শিশু রক্ষা সমিতির সঙ্গে। সেই হিসেবে আজ কুড়ি বছর অতিক্রান্ত। একদিকে শিশুদের বাঁচিয়ে রাখার মানবিক মুখ, অন্যদিকে সাংবাদিকতার প্রতি আগ্রহ -- অধ্যাপক আশুতোষ দাস ছিলেন নিরলস প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৯ তে মেদিনীপুর জেলা সংবাদপত্র সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। যার প্রথম সম্পাদক ছিলেন বিজয় চক্রবর্তী। এখানে তিনি সম্পাদক নির্বাচিত হন ১৯৮৬তে। সভাপতি হন কিশোরীমোহন মণ্ডল। সেসময় সাংবাদিকদের স্বার্থে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। বাস পাস করে দেওয়া, অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড করে দেওয়া ইত্যাদি তিনি করেছেন জেলার সাংবাদিকদের স্বার্থে। এরপর গঠিত হয় রাজ্য ক্ষুদ্র সংবাদপত্র সমিতি। যার সহ সভাপতি হন আশুতোষ দাস। সভাপতি ছিলেন চিত্তরঞ্জন কুণ্ডু এবং সম্পাদক সদানন্দ দাস। মেদিনীপুর জেলা আঞ্চলিক ইতিহাস কেন্দ্রর সহ সভাপতি পদেও তিনি আসীন। জেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক পরিচয় রক্ষায় তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ এটাই প্রমাণ করে। 

তমলুক ভল্যান্টারি ব্লাড ডোনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হন ১৯৯১ থেকে। তিনি ছিলেন তমলুক রেড ক্রশ সোসাইটির ফাউন্ডার মেম্বার। রক্ত নিয়ে আন্দোলন করতে ছুটে গিয়েছেন হিল্লিদিল্লি। চেন্নাই, ভাবনগর, সম্বলপুর, পাটনা, মুম্বইতে জাতীয় কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেছেন বহুবার। ১৯৯৭ তে হলদিয়াতে প্রথম করেছিলেন রক্ত নিয়ে জাতীয় কনফারেন্স। 

এহেন মানুষটি আজ বয়সের ভারে নুব্জ হয়ে পড়েন নি। এখনও সমানভাবে ছুটে বেড়ান জেলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। রক্ত নিয়ে তাঁর লড়াই সকলের অনুপ্রেরণা। সমাজসেবা নিয়ে তাঁর যুদ্ধ শক্তি দেয় অনেককেই। তিনি হারতে জানেন না। সুকোমল শিশুদের নিয়ে তাঁর বেঁচে থাকা। মর্যাদা এবং মানসম্মান নিয়ে এইসব অনাথদের নিয়ে তিনি আজ তাঁর এক সুখি পরিবার গড়ে তুলেছেন। সেই পরিবার আজ তমলুকের গর্ব, জেলার গর্ব। অধ্যাপক আশুতোষ দাস আজ শুধু একজনের নাম নয়, সমাজসেবার ব্র্যান্ড। মেদিনীপুরের সত্যিকারের মানুষ রতন।

🍂

Post a Comment

0 Comments