জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৭৫ / সালেহা খাতুন

সেই সব পত্রিকা : ছাত্ররা যেখানে লিখিয়ে নিয়ে ছিল

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৭৫ / সালেহা খাতুন 

‘কলম খুললে হিংসা চলে যায়’-  কথাটা হয়তো ঠিকই কিন্তু এখন যে স্মার্ট ফোনে স্পর্শ করে লিখি। তাই হয়তো অহংকার আর আত্মম্ভরিতা প্রকাশ হয়ে পড়ছে। এ প্রসঙ্গে একটি কথা না বললেই নয়, তা হলো ছাত্রদের কাছে আমার ঋণ অশেষ। 

একদা আমার ছাত্র বর্তমানে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কৃতি অধ্যাপক ড. ইয়াসিন খান আমাকে বলেছিল, “ম্যাডাম আপনাদের কথা কেউ লিখবে না, নিজেকেই লিখতে হবে।” একথা বলে ‘লেখক জীবন ও মনন মেধার বহিঃপ্রকাশ’ শিরোনামায় ২০২০ তে লিখিয়ে নিয়েছিল একটি আত্মজীবনী মূলক প্রবন্ধ। তিনহাজার শব্দের সেই প্রবন্ধই এখনও পর্যন্ত প্রায় পঞ্চান্ন হাজার শব্দে রূপ পরিগ্রহ করছে ‘শব্দে গাঁথা মণি-মালা’য়। 

ফলে আমার সামান্য যে লেখালেখি তা ছাত্রদের জন্যই প্রকাশের মুখ দেখেছে। মেদিনীপুরে আসার আগে হয়তো দু-একটা লেখা যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়েছি সেখানে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু অধ্যাপনায় যোগ দেবার পর ছাত্ররা আমাকে লেখক করে তুললো। প্রসঙ্গ ভিন্ন হলেও আর একটি কথা এখানে বলে রাখি ছাত্ররা যেমন লেখক সত্তাকে উজ্জীবিত করলো তেমনি আমার কন্যা বললো, ‘মা তুমি খুব সুন্দর’। সুন্দর হলাম আমি। সেই চলে এলেন রবীন্দ্রনাথ – “গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম ‘সুন্দর’/সুন্দর হলো সে”। নিজেকে ভালোবাসতে শুরু করলাম। শাশুড়িমাও বলেছিলেন, নিজেকে ভালোবাসতে। আসলে সৌন্দর্যের অবস্থান তো মানুষের মনে। তবে এ ধারনাও বদলেছে। এখন শিখেছি বিউটিফুল ইজ দি আগলিয়েস্ট ওয়ার্ড ইন দ্য ওয়ার্ল্ড।

শুরুর দিকে কলেজ ম্যাগাজিন ‘প্রাঙ্গণ’- এ কবিতা প্রকাশ পেল। তখন বীতশোক ভট্টাচার্য এ পত্রিকার দায়িত্বে ছিলেন। আমার ছাত্র আবদুল কাইয়ুম মাঝে মাঝে আমার থেকে কবিতা নিয়ে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশের দায়িত্ব নিজেই নিত। ‘আজকের জিজ্ঞাসা’, ‘দিগন্ত’ প্রভৃতিতে প্রকাশ করতো। ফিজিওলজির ছাত্র কালিশঙ্কর ঘোড়াই তার সম্পাদিত ‘সবুজ স্বপ্ন’ পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় আমার বেশ কয়েকটি গল্প কবিতা ছাপে। হাসিম খান সম্পাদিত ‘অনুভব’ পত্রিকায় একটি গল্প প্রকাশ পায়। অবশ্য লেখা নিয়েছিল ইয়াসিনই। 
🍂

ইয়াসিন ছাত্রাবস্থা থেকেই সম্পাদনা করছে ‘নাব্যস্রোত’। ২০০৭ - ২০০৮ থেকে। এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত ‘নাব্যস্রোত’-এর একটি কী দুটি সংখ্যা বাদে সব সংখ্যাতেই আমার লেখা আছে। গল্প, কবিতা এবং প্রবন্ধ। পরে আর একটি পত্রিকা ‘কাঁসাই ও বাঘুই’ সম্পাদনা করছে বেশ কয়েক বছর ধরে। খুবই উদ্যোগী ছেলে। ওর ছাত্রাবস্থার উজ্জ্বল মুখ এখনও জ্বলজ্বল করছে আমার স্মৃতিতে। আমার ক্লাস করেছে। তবে ক্লাসের বাইরে আমার কোয়ার্টারে যাতায়াতের পথটা ওরও যাতায়াতের পথ ছিল। সেটাই বেশি করে খোদাই হয়ে আছে মনে। সে সময় পুথি সংগ্রহের একটা অভিযানে সক্রিয় অংশ নিয়েছিল ইয়াসিন। বিভিন্ন লিফলেট আমাদের হাতে পৌঁছে দিয়েছিল। 

সেই সূত্রে হেলায় হারানো একটা সুযোগ হাতছাড়া করার জন্য এখনও হাত কামড়ানো বোকা আমিটাকে প্রকাশ করে দিতে মন চাইছে। ২০০৮ এর জুলাইয়ে আমার কাছে একটি পোস্টকার্ড এসেছিল। লিখেছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অচিন্ত্য বিশ্বাস। আমার সঙ্গে এখনও মুখোমুখি দেখা হয় নি। কিন্তু আশ্চর্য তিনি আমার কথা জেনেছেন। কীভাবে? না আমার প্রথম প্রকাশিত বইয়ের মাধ্যমে। বই তাহলে বেঁচে থাকতেও জীবিত রাখে! 

তিনি লিখেছিলেন, “ আপনার সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘ সীতারাম দাসের ধর্মমঙ্গল (হস্তীবধ পালা) পাঠ পরিচয় ও মূল্যায়ন’ পেলাম। পুথি নিয়ে কাজ করার লোকজন কম। আমার আগ্রহ আছে বিষয়টিতে। জানেন সম্ভবত।
    আপনি আমাদের সঙ্গে ভবিষ্যতে যোগাযোগ রাখলে বাংলা পুথি নিয়ে গবেষকদের যে মঞ্চটি গড়ার চেষ্টা করছি – তার কাগজপত্র পাঠাব।
    নমস্কার জানাই।”
অমূল্য রতন বলে চিঠিটি সযতনে রেখেছি ঠিকই কিন্তু অকর্মণ্যতার বশে আমি কোনো সাড়াশব্দ করিনি। 

রেট্রোস্পেক্টীভ দৃষ্টিতে জীবনকে যখন ফিরে দেখছি, তখন দেখছি ২০০৮ আমাকে ঝুলি ভরে অনেক কিছু দিয়েছে। গবেষণার জন্য মেদিনীপুর ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরিতে যখন পড়তে যেতাম, ওখানে রেয়ার বইয়ের কাছে থাকতেন আশিসবাবু। তিনি আমার পি এইচ. ডি.- র রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট জমা নিয়ে বললেন, আপনি গবেষণা করছেন অথচ কারোর সাক্ষাৎকার/ইন্টারভিউ নিচ্ছেন না? পরিবারের লোকজন বা তাঁকে নিয়ে কাজ করেছেন এমন কারোর সঙ্গে যোগাযোগ করুন। অনুপ্রাণিত হলাম।

পড়াশোনা করতে করতে দেখেছিলাম অধ্যাপক বারিদবরণ ঘোষ এ বিষয়ে বেশকিছু কাজ করেছেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে গিয়ে দেখতাম ওঁর মনোযোগী পাঠক এবং গবেষকের রূপ। তখনও এতোটা স্মার্ট হই নি, আমার কোয়ার্টারের আর এক কলিগ ভূগোলের অধ্যাপক মণিশ্রীদির ভাষায় ‘নির্লজ্জ’ হইনি। ফলে নিজের প্রয়োজনে কারোর সঙ্গে কথা বলতে গেলে খুব ইতস্তত করতাম। তবুও সাহস করে একদিন বারিদবরণবাবুকে বলেই ফেললাম, স্যার আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। ওঁর এতো ভালো ব্যবহার পেয়েছি যে, আজীবন মনে থেকে যাবে তা। বললেন বেলুড়ের সরস্বতী অ্যাপার্টমেন্টে একদিন চলে এসো। 

২০০৮ - এর তেরো এপ্রিল গেলাম। পর্বত পরিমাণ পত্রপত্রিকা ও বইপত্রের গোলোকধাঁধায় পড়ে গেলাম। ওঁর স্ত্রী যত্ন করে খাওয়ালেন। আমার যা যা তথ্য দরকার সব নিয়ে এলাম। সর্বোপরি তিনি যোগাযোগ করে দিলেন সুনীতিকুমারের পুত্রবধূ ছায়া চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। এবং একদিন দেখা করার ব্যবস্থাও করে দিলেন। যা আমার মতো সাধারণের পক্ষে করা অসম্ভব ছিল। ওঁর স্ত্রী বললেন, “ বাড়ি পৌঁছে আমাকে একটা ফোন করে দিও, নাহলে বড়ো চিন্তায় থাকবো”। এমন তো মায়েরা করেন। অবাক হওয়া ভালো লাগায় মন ভরে গেল।

 ছায়া চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করলাম ১৬.৫.২০০৮ এ সুনীতিকুমারের হিন্দুস্থান পার্কের ‘সুধর্মা’য়। ছায়া চট্টোপাধ্যায়ের ছেলে এবং তাঁর পৌত্রের সঙ্গেও দেখা হলো। সব কথা ডায়েরিতে লিখে আনলাম। কোনো রেকর্ডিং বা ছবি তুলতে পারি নি। আসলে ওসব যন্ত্রপাতি সঙ্গে ছিল না। এখন ভাবি কী বোকামিই করেছি। সুধর্মার অনেকটা জুড়ে ফেব ইন্ডিয়ার ব্যবসা চলছে। দোকানের মধ্যে দিয়ে ওপরে গিয়ে দেখা হলো। তবে তাঁদের সঙ্গে দেখা করা যে খুব একটা সহজ নয় তা বুঝেছিলাম, সিকিউরিটি গার্ডের কাতর কণ্ঠে। তিনি বলেছিলেন, “ দেখুন বকুনি খাওয়াবেন না যেনো, আপনি আগে থেকে মায়ের সঙ্গে কথা বলে এসেছেন তো?” ছায়া চট্টোপাধ্যায় গ্রিন সিগনাল দিতে তবেই তিনি সঙ্গে করে নিয়ে যান।
অমূল্য রতন

পিএইচ.ডি. অ্যাওয়ার্ডেড হওয়ার অনেক পরে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে অধ্যাপক বারিদবরণ ঘোষের সঙ্গে পিংলা কলেজের এক সেমিনারে দ্বিতীয়বার দেখা এবং কথা হয়। যেখানে আমার ম্যাডাম অধ্যাপক নিবেদিতা চক্রবর্তী আমাকে রিসোর্স পার্সন রূপে সম্মান জানিয়েছিলেন। তখন আমার রূপান্তর ঘটে গেছে। পার্সোনালিটি ডেভলপ করেছে। বারিদবরণবাবুকে আমার সাড়ে সাতশো পৃষ্ঠার থিসিসটি দেখালাম। ভূমিকায় তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি, তিনি দেখলেন। সভাগৃহে নিজের হাতে তুলে আমার গবেষণাপত্রটি দেখালেন।

 আমার কলেজে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে কোলাবরেশনে একটা সেমিনার করতে চেয়ে অধ্যক্ষ একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন, আমাদেরই অনুরোধে। বারিদবরণবাবু রাজি ছিলেন কিন্তু তখন যিনি সম্পাদক ছিলেন অত্যন্ত দম্ভভরে জানিয়েছিলেন আমরা যাদবপুর,প্রেসিডেন্সি ছাড়া কারোর সঙ্গে কোলাবরেশনে সেমিনার করি না। কলকাতার বাইরে যেতে পারবো না। অধ্যক্ষ বলেছিলেন অন্তত কাগজে কলমে একটা অনুমতি দিন। অনুমতি আসেনি, অহং প্রকাশিত হয়েছিল। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের আজীবন সদস্য রূপে লজ্জা পেয়েছিলাম।

এস এস সি তে নিজে কোয়ালিফাই করিনি এও এক লজ্জা। কিন্তু বিধাতা অলক্ষে বসে কলকাঠি নেড়েছিলেন। বারকয়েক এস এস সির উত্তরপত্র মূল্যায়নে যেতে হয়েছিল বাঁকুড়ার মাচানতলায়। ২০০৮ - এই সে যাত্রা শুরু হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে ২০০৯ ও ২০১৩ তেও যাই। মেদিনীপুর থেকে একশো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বাঁকুড়ায় রূপসী বাংলা ধরে যাতায়াত করতাম। কত অভিজ্ঞতা যে হয়েছে সে খাতা দেখতে গিয়ে! খাতায় ফোন নম্বর দিয়ে পরীক্ষার্থী লিখেছে পাশ করিয়ে দিলে কত লাখ টাকা দেবে। ইগনোর করে খাতা দেখে নিয়েছি। কেউ কেউ খাতার মধ্যে পাঁচশো টাকার নোট পেয়েছেন। অফিসে সে টাকা জমা দেওয়া আর রিপোর্টিং করার চক্করে শুধু সময়ই নষ্ট হয়েছে। এসব ঘটনা থেকে নীতির ধার না ধারা সাধারণ মানুষ এবং কিছু কিছু চাকরিপ্রার্থীদের তো মনে হয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গলা উঁচু করার কোনো মানে নেই। তবে চোরের মায়ের বড়ো গলা। এ কথা পথেঘাটে হামেশাই সত্য হয়ে উঠে। 

মেদিনীপুরে জোড়া মসজিদের পাশের মাদ্রাসায় মাইনরিটিদের জন্য এস এস সির  কোচিং দেওয়ার ব্যবস্থা করে এক সামাজিক সংগঠন। রহিমদার অনুরোধে ওখানেও বেশ কিছু দিন পড়িয়েছি। রিকশা করেই যেতাম। মোটর বাইকে সাধারণত উঠি না। তবুও আমার এক ছাত্র সেখ রহিম বাইক নিয়ে কোয়ার্টারে চলে আসতো আমাকে নিয়ে যেতে। ওদের পড়াতে গিয়ে অন্য রকম টেকনিক ফলো করি। ওখানে যাদের পেয়েছিলাম তারা খুব মনোযোগী ছিল। আর সাধারণ ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের ধরে বেঁধে মনোযোগী করতে হয়। সবার খবর জানি না, তবে সেখ রহিম এখন স্কুলে শিক্ষকতা করছে। দেখে ভালো লাগে। মনে পড়ে ও ইতিহাস অনার্সে ভর্তি হয়ে পরে বাংলায় চলে এসেছিল। তাই কলেজে কয়েকদিন ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়ার পর অর্থাৎ তখন প্রায় সবাইয়ের সাথে পরিচিতি হয়ে গেছে যখন একদিন ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আসবো ম্যাডাম’। বললাম তুমি কে? সপাটে জবাব,’আমি মানুষ’। তখন সারা ক্লাস হাসলেও, আর সে হাসিতে আমি যোগ দিলেও এখন বুঝেছি মানুষই আসল সম্পদ।

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments