জ্বলদর্চি

ওয়ারিশ /পুলক কান্তি কর

চিত্র- শুভম দাস 

ওয়ারিশ 

পুলক কান্তি কর

-এই যে শুনছেন! একজন দীর্ঘদেহী সুঠাম মাঝারি রঙের ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল অবন্তিকা। ভদ্রলোক ওর দিকে ফিরে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘অবন্তিকা, না?’

-আমি তো ভাবছিলাম চিনেও না চেনার ভান করছেন।

-ভান করবো কেন? তোমায় না চিনে কোনও লাভ আছে কি?

একটু থতমত খেল অবন্তিকা। সত্যি তো! সে তো এখন এই ভদ্রলোকের কাছে লাভ ক্ষতির ঊর্দ্ধে। তবু মুখে স্বাভাবিক সৌজন্যের হাসি এনে বলল, ‘ওটা একটা কথার কথা! সিরিয়াসলি নেবেন না।

-ইটস ওকে! তা তুমি এখন কেমন আছো?

-ভালোই আছি। আপনি?

-ফার্স্ট ক্লাশ। আমি সবসময়ই ভালো থাকি অবন্তিকা। যে কোনও ক্ষেত্রে, যে কোন পজিশনে।

-এটাও বুঝি মিলিটারি ট্রেনিং এর অঙ্গ?

-না, না, তা নয়! তবে আমি সবকিছুই সামরিক ইমার্জেন্সি ট্যাকল করার মতো করে নিই। এতে জীবন নির্বাহ করা সহজ হয়ে যায়।

-কবে এলেন এখানে?

-আমি আজ সকালেই এসেছি। তোমরা?

-আমরা গতকাল এসেছি।

-তোমার স্বামী বা অন্য কাউকে দেখছি না তো!

-অন্য কাউকে বলতে?

-তোমার বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ী! অবশ্য তোমার শ্বশুর-শাশুড়ীকে দেখে হয়তো চিনবো না, এক ঝলকই দেখেছি।

-আমার বাবা-মা এসেছেন, বোধ হয় উপরের ঘরে আছেন। শ্বশুর-শাশুড়ী আসেন নি।

-আর তোমার হাজব্যান্ড?

-ও আসবে না।

-তোমার ছেলেমেয়ে নেই?

-আপনি বোধ হয় আমার কোনও খোঁজ খবরই রাখতেন না, না?

-জানোই তো আমাদের জীবন! আজ এখানে, কাল ওখানে। সত্যি তোমাদের খবর রাখতাম না। মাঝে মধ্যে দু-একবার তোমার কথা কানে আসেনি, তা নয়। তবে এতদিন আর মনে রাখিনি সব কথা।

-আপনার রিটায়ারমেণ্ট হয়ে গেছে?

-কবে! তোমার সাথে দেখা হওয়ার আট বছরের মধ্যেই। চেষ্টা করলে এক্সটেনশন পাওয়া যেত। নিইনি।

-কী করেন তবে?

-কিচ্ছু না। যা পেনশন পাই, চলে যায়। একার আর খরচ কত?

-বিয়ে করলেন না কেন?

-বিয়ের জন্য যে কোনও দিন ব্যাকুল ছিলাম তা তো নয়। মা জোর করে একবার লাগিয়েছিল। হল না যখন, আর ওদিকে মন দিইনি। আর তাছাড়া মাও মারা গেল হঠাৎ বছর তিনেকের মধ্যে। ফলে আর ওদিকে পা মাড়ানো হল না। যাইহোক, ছেলেমেয়ের কথা জিজ্ঞাসা করলাম, বললে না তো!

-এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে বড় - বি.এস.সি পড়ছে। মেয়েটা টুয়েলভ দেবে।

-ওরা কোথায়? আসেনি?

-না। ওরা বাড়ীতে আছে।

-সে কি গো! এরা তো তোমাদের একেবারে কাছের আত্মীয়। এদের বিয়েবাড়ীতে ওরা এলো না, কথা উঠবে না? অবশ্য পরীক্ষা-টরীক্ষার বাহানা থাকলে আলাদা ব্যাপার।

-না, না। ওসব কিছু না। বোঝেনই তো এখনকার ছেলেমেয়ে! ওদের মুড অনুযায়ী চলতে হবে আমাদের। 

দু পক্ষই চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ। অবন্তিকা বলল, আপনাকে তো কোনওদিন কোনও সম্বোধনে ডাকিনি, বুঝতে পারছি না কী বলে ডাকবো?

-আজ আর ডাকার দরকার কী অবন্তিকা? প্রায় বাইশ বছর বাদে দেখা হল, হয় তো বাকী জীবনে আর দেখাই হবে না।

-তবু আজ আর কাল তো থাকবেন এখানে। এ দুদিনই বা কী বলবো?

-আমি না হোক বছর পাঁচেকের বড় তোমার থেকে। দাদা বলেই ডাকতে পারো। ইচ্ছে না হলে শুধু ‘চন্দন’ও বলতে পারো। অবশ্য আমার মনে হয়, নাম ধরে ডাকলে বিসদৃশ লাগবে। তুমি বয়সের তুলনায় যথেষ্ট যুবতী আছো, আর আমি উত্তর-প্রৌঢ়। মানুষের অকারণ কৌতুহল বাড়বে তাতে।

-ঠিক আছে। মনে রাখার চেষ্ট করবো। আমার বাবা-মা’র সাথে দেখা হলে কথা বলবেন তো?

-আমাকে কি তোমার অভদ্র মনে হয় অবন্তিকা?

-না, মানে ওঁদের জন্যই তো এতকিছু!

-আমি পুরোনোকে বয়ে নিয়ে বেড়াই না অবন্তিকা। ‘রাত গই, বাত গই’।

-নিজের মধ্যে একটা অতিমানুষীয় বা টু সাম এক্সটেন্ট ঈশ্বরীয় ভাব বয়ে বেড়ানোর বিলাসিতায় ‘আমি’ ‘আমি’ বোধটা বেশ প্রকট বোধ হয়, না চন্দনবাবু?

অবন্তিকার অকারণ খোঁচার জন্য প্রস্তুত ছিল না চন্দন। একটু চুপ থেকে বলল, ‘এটাই আমার স্বভাব অবন্তিকা। আমি বানিয়ে কিছু করি না। আগ বাড়িয়ে নিজের মহত্বের ঢাকও পেটাই না। তুমি জিজ্ঞাসা করলে বলেই বললাম। ঠিক আছে, চলি এখন। চা-কফি কি এখানেই পাওয়া যাবে? নাকি তেতলায় প্যান্ডেলে যেতে হবে?’

-এখানেই পাওয়া যাবে। আপনি এখানে বসুন, আমি দেখছি।

রান্না ঘরে অবন্তিকা আসতেই ওর মাসতুতো বোন পর্ণা বলল, হ্যাঁ রে দি’ভাই, কার সাথে কথা বলছিলি? ভদ্রলোককে তো আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না!

-আরে ও তো চন্দন মুখার্জী। তোদেরই সম্পর্কে কী এক রিলেটিভ হয়। সম্ভবত মেসোর খুড়তুতো ভাই এর শালির দেওর বা এই জাতীয় কিছু!

-তুই চিনলি কী করে?

-তোর কী হয়েছে রে পর্ণা? নাম বললাম, পরিচয় দিলাম, তাতেও মনে পড়লো না?  

-না।

-আরে এর সাথেই তো আমার বিয়ে হয়েছিল। তোর তখন কী একটা পরীক্ষা চলছিল, বোধ হয় মাধ্যমিক, সেজন্য তুই দেখিসনি।

-সত্যিরে দি’ভাই। কতবছর আগের কথা! ভুলেই গেছি সে সব। তুই এক কান্ড করেছিলি বটে!

  উপায় কী ছিল বল! তখন তো রুবির বাবার সাথে আমার ভরপুর প্রেম। এদিকে ওর চাকরী নেই। বাবা-মা কোনও মতে ওর কথা শুনবে না। কী করতাম আমি?

-তুই ওনাকে জানাতে পারতিস তোদের রিলেশনের কথা। তাতে উনি বিয়েতে রাজী নাও হতে পারতেন।

-তুই কী ভাবিস পর্ণা, তোর দি’ভাই এর এই বুদ্ধি ছিল না! অন্তত দশটা সম্বন্ধ আমি এই করে ভেঙেছি। ছেলেকে আলাদা করে অনুরোধ করেছি সে যেন সম্পর্কটা ভেঙে দেয়। এভাবে ফলও ফলছিল। শেষের দিকে মা-বাবা বুঝে যায় ব্যাপারটা। পাত্রের সাথে নিভৃতে আলোচনার সুযোগ দেয়নি এর বেলা। আমিও ভেবে দেখলাম বাবা-মা’র সংসারে থাকলে এরা কোনও না কোন ভাবে আমার বিয়ে দেবেই। আমিও ভাবলাম, একবার ভাগ্য পরীক্ষা করে নিই। কাউকে একটা বিয়ে করে নিই। তখন তো বাবা-মা জোর খাটবে না। তাকেই অনুরোধ করবো সে যেন কিছু একটা ব্যবস্থা করে।

-দাঁড়া দি’ভাই। ভদ্রলোককে চা টা দিয়ে আয়। তারপর না হয় শুনবো বাকীটা। 

-তুই দিয়ে আয় না পর্ণা। আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।

-কেন দি’ভাই? আমার তো বেশ রোমাঞ্চ লাগছে। পুরোনো বর –  হোক না একরাতের, তার সাথে...

-তুই থাম। আমি এক্ষুনি ওকে কটু কথা বলে এসেছি।

-কেন রে?

-বেশী ভালো মানুষী! সবসময় মহৎ হওয়া!

-তুই এমনভাবে বলছিস, যেন ভালোমানুষ হওয়াটা অপরাধ!

-অপরাধই তো! মানুষ হয়ে জন্মেছে যখন মানুষের মতই দোষগুণ থাকা ভালো। অতি ভালো ভালো নয়! 

ফ্যালফ্যাল করে খানিকক্ষন তাকিয়ে পর্ণা বলল, ‘বুঝিনা রে বাবা তোর কথা! যাই, আমিই দিয়ে আসি। ভদ্রলোক কোথায় বসে আছেন?

-ওই তো তোদের উত্তর দিকের ঘরটায়!

-ঠিক আছে। তুই আমার ঘরটায় গিয়ে বোস। চা টা দিয়ে আমি আসছি।

খানিকক্ষণ বাদে পর্ণা এসে বলল, কী এমন বলেছিস দি’ভাই? ভদ্রলোক মুখ কালো করে বসে আছেন?

-ও তুই চিন্তা করিস না পর্ণা। ওঁর নাকি সব পরিস্থিতিতেই ভালো থাকার ক্ষমতা আছে। মন খারাপ করে বসে থাকার লোক উনি নন!  

-তাই বলে মেশিন তো নয়! পাঁচ মিনিট সময় তো লাগবে খারাপ লাগা থেকে বেরিয়ে আসতে! কী বলেছিস শুনি?

-তোর শুনে কাজ নেই।

-ঠিক আছে, আগেরটাই বল।

-কী বলবো?

-তারপরে কী হল? 

-দ্যাখ, বাড়ীতে যখন সম্বন্ধটা এলো, তখন আমি রাজী হয়ে গেলাম। শুনলাম মিলিটারী তে চাকরী করে। বছরে দশমাস বাইরেই থাকবে। নেহাৎ যদি আমাকে ডিভোর্স দিতে রাজী নাও হয়, তবে বছরের দশমাস তো রুবীর বাবার সাথেই সম্পর্কটা চালাতে পারবো।

-তখন অনুপমদা কী করতো রে?

-বেকার। ভেরেন্ডা বাজাতো।

-অনুপমদা বিয়ের কথা শুনে কী বললো?

-মুখটা শুকিয়ে গিয়েছিল। পরে আমি যখন আমার প্ল্যানটা জানালাম, রাজী হল। তবু দ্বিধা নিয়ে বলল, ‘কিন্তু ডিভোর্স দেওয়ার আগে যদি তোকে ছোঁয় টোঁয়?’ আমি বললাম, ‘আমার উপর ভরসা নেই?’

-সত্যি চন্দন বাবু ছোঁননি তোকে? পর্ণার মুখে মেয়েলি কৌতুহল। 

-আগে শোন না পুরোটা। চিন্তাটা তো একটা বিন্দুতেই আটকে তোর! কপট রাগ দেখালো অবন্তিকা।

-আচ্ছা বাবা, বল।

-বিয়ে তো হয়েই গেল। ফুলশয্যার রাতে ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করছি, কখন উনি ঘরে ঢোকেন। উনি ঢুকে দরজায় খিল দিতেই তড়াক করে খাট থেকে লাফিয়ে উঠলাম আমি। তারপর একদম নাটকীয় ভঙ্গিতে ওনার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে বললাম, আমার একটা প্রার্থনা আছে; আপনাকে রাখতেই হবে।

-কী প্রার্থনা?

-আমি একজনকে ভালোবাসি। তাকেই বিয়ে করতে চাই। আমি আপনাকে একটুও ভালোবাসি না। আপনি আমায় স্পর্শ করুন, আমি চাই না। 

-একেবারে ফিল্মি ডায়লগ দিয়েছিলি রে দি’ভাই। এমন একটা সিনেমাও দেখলাম তো কদিন আগে। পর্ণা বলল।

-ঠিকই বলেছিস পর্ণা। আমিও বেশ ড্রামা করেই কথাটা বলেছিলাম। একটু সেন্টিমেন্টাল সুড়সুড়ি দিয়েছিলাম, পাছে জোর টোর করে।

-তা উনি কী বললেন?

- বললেন ‘তুমি আমাকে চেনো না, জানো না, ভালোবাসবেই বা কেন? আর তুমি ভালো না বাসলে আমিই বা স্পর্শ করবো কেন?’ এসব শুনে টুনে আমার তো তখন ধড়ে প্রাণ এল। তখন উনি বললেন, খাটে গিয়ে বসো, কোনও ভয় নেই। শুধু আমাকে বল, একথা আগে আমায় কেন জানাও নি। এত ধূমধাম, লোক জানাজানি হ’ত না তাহলে। সর্বোপরি আমার মা-বাবাও দুঃখ পেতেন না।

-আপনাকে বলার কোনও সুযোগ পাইনি, বিশ্বাস করুন। আপনি বোধ হয় একবারই আমাদের ল্যান্ড ফোনে কল করেছিলেন বিয়ে ঠিক হয়ে যাবার পর। তখন আমাকে বাবা-মা কড়া পাহারায় রেখেছিলেন যাতে বেফাঁস কিছু না বলে ফেলি।

-তোমার বাবা-মাকে তোমার রিলেশনের কথা জানাওনি?

-জানিয়েছিলাম। ওঁরা রাজী ছিলেন না। তাই জোর করেই বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন বহুদিন।

-তোমার প্রেমিকের নাম-ঠিকানা দাও। ফোন নাম্বার দাও। বাই দা বাই, ওর বাবা-মা মানবেন তো?

-শুনেছি তো ওর বাবা-মায়ের অমত নেই।

-প্রেমিক পুরুষটি করেন কী?

-আপাতত বেকার।

-তুমি তাতেও ঝুঁকি নিচ্ছ?

-ও কিছু একটা ঠিক করে নেবে। ভালো ছেলে ও।

-ঠিক আছে, ওটা তোমার ব্যাপার। আমি মাথা ঘামাতে চাইনা। তুমি আপাতত খাটে শুয়ে যাও। আমি রাতটুকু নীচে শুয়ে যাচ্ছি। একঘরে থাকলে আপত্তি নেই তো?

-দ্যাখ পর্ণা, মুখে আমি ভদ্রতার খাতিরে না বললাম বটে, কিন্তু মনে মনে বলছিলাম, কেন অন্য কোনও ঘর নেই? ভদ্রলোক যেন আমার কথা শুনতে পেলেন। বললেন, অন্যঘর গুলোয় তো আজ আত্মীয় স্বজনে ভর্ত্তি। আর তাছাড়া একরাতে এসব কথা বেশী কানাকানি হলে অনর্থ হবে। ঠান্ডা মাথায় কাল সকালে যা করার করবো। তুমি উপরে শুয়ে যাও।

-একঘরেই তোমরা শুলে দি’ভাই?

-কী আর করা! ভয়ে ভয়ে তো শুয়েই পড়লাম। সবসময় ভাবছি এই বুঝি ঘাড়ের উপর কেউ এসে পড়ে। ঘন্টাখানেক বাদে নিশ্চিত হলাম ভদ্রলোক ঘুমিয়ে পড়েছেন।

-কী করে বুঝলি রে দি’ভাই? নাক ডাকতো নাকি? তাহলে ছেড়ে ভালোই করেছিস। ইন্দ্রনীলের সাথে বিয়ের আগে যদি একটা রাতও কাটাতাম, ওকে জীবনে বিয়েই করতাম না। বাব্বা, একেই বলে নাক ডাকা! যেন কাড়া-নাকাড়া বাজছে! 

🍂

-না, না। তেমন কিছু নয়। তবে বোঝা যায়। অবশ্য ঘুমানোর ভান করে পড়ে ছিল কিনা মনে নেই। নিয়ম মেনে যথাসময়ে সকাল হল। ভোরের দিকে আমার চোখেও ঘুম ধরে এসেছিল। উঠে দেখি উনি  নেই। বাথরুম সেরে নীচে এসে দেখি ঘরে বীভৎস নিস্তব্ধতা। অনুপম ওর বাবা-মাকে নিয়ে বসে আছে। ম্যারেজ রেজিস্টার এসেছেন। আর আমার সদ্য স্বামী ভদ্রলোকটি সমানে ওনাকে বুঝিয়ে চলেছেন অনুপমের সাথে আমার রেজিস্ট্রিটা তখুনি করিয়ে দিতে। 

-কী করে সম্ভব এটা? একমাস আগে নোটিস দিতে হয় তো! পর্ণা বললো।

-আমাদের সময়ে অত কড়াকড়ি ছিল না পর্ণা ।ব্যাকডেটে সব হত।

-রেজিস্ট্রি হয়ে গেল সেদিন?

-ম্যারেজ অফিসার সমানে বলে চলেছেন, গতকালই তো আপনার বিয়ে হল। আপনি ডিভোর্স না দিলে নতুন বিয়েটা হবে কী করে? আবেগের বশে কাজ করবেন না চন্দনবাবু। বিয়ের সাতফের, মালাবদল – এসবের ফটো তো মেয়ের বাড়ীর লোকের কাছে আছে। আপনি বিপদে পড়ে যাবেন। ম্যারেজ রেজিস্ট্রার পরামর্শ দিলেন।

-কিন্তু আপনার কথা মতো যদি আমি আগে ডিভোর্স দিয়ে দিই, তবেও তো ব্যাপারটা মিটতে মাসখানেক লাগবে। আমি এতদিন ছুটি পাবো না। আমার আর বারোদিন ছুটি আছে। তার মধ্যে ব্যাপারটা না মেটালে ঝুলে যাবে তো। সর্বোপরি মেয়েটি থাকবে কোথায়?

-সত্যি তো! তুই ছিলি কোথায়? পর্ণার চোখে কৌতুহল।

-অনুপমের বাবা-মা রেজিস্ট্রি না করে মেয়ে তুলতে নারাজ, তাহলে তাঁদের পাড়ায় দুর্নাম রটবে। কদিন সময় পেলে না হয় একটা ছোট খাটো অনুষ্ঠান করে লোক মানানোর প্রসহন করে নেবেন। আপাতত চন্দনবাবুর বাবা বললেন, বৌমা আমাদের বাড়ীতেই থাকুক। যদিও ওর মা খুব রেগে গেছিলেন আমার উপর। কিন্তু উপায়ও কিছু ছিল না। আমি ওদের বাড়ীতেই থেকে গেলাম।

-কদিন ছিলি দি’ভাই? 

-দ্যাখ, ভারতে টাকা দিলে সব হয়। চন্দনবাবু অনেক টাকা ফাকা খরচা করে দিন দশেকের মধ্যেই ব্যাপারটা মিটিয়ে দিলেন। আমিও নাচতে নাচতে অনুপমের সাথে ঘর করতে চলে গেলাম।

-এতো একেবারে ‘হাম তো দিল দে চুকে সনম’ ফিল্মটার মতোই হচ্ছিল রে। শেষে চলে গেলি কেন? এমন সুপার হিরো মিলিটারি ক্রপ। পাগল আছিস তুই দি’ভাই।

-সত্যিরে পর্ণা, অনুপমের প্রেমে আমি পাগলই ছিলাম তখন।

-ওই দিন দশেকের মধ্যে চন্দনবাবুর সাথে তোর কথাবার্তা হত না?

-ওই বাড়ীতে একমাত্র ওনার সাথেই দু-একটা কথাবার্তা হত। বাকীরা কেউ আমার সাথে কথা বলতেন না। না বলাটাই স্বাভাবিকও, বুঝি! তবে ভদ্রলোক ভীষনই ডিসিপ্লিনড এবং অর্গানাইজড্‌। একটাও লঘু বাক্য বা আমাকে ইমপ্রেস করার মতো কোনও কথা বলতেন না। নিজে বিরাট একটা উদারতার কাজ করেছেন – এমন দেখনদারিও ছিল না। বরঞ্চ আমার জন্য ওদের লক্ষাধিক টাকা জলে গেল, এই খারাপ লাগা আমাকে এখনও পীড়া দেয়।

-ভদ্রলোক খুবই ভালোমানুষ দি’ভাই, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। তুই খামোখা এখন অসম্মান করে এলি কেন?

-একটু টোনা মেরে এলাম আর কি!

-ভদ্রলোক ভাবছেন এখন নিশ্চই, এই মেয়ের জন্য আমি এত কিছু করেছি। মান খুইয়েছি, টাকা খুইয়েছি, শালা কারোর ভালো করতে নেই!

-ঠিক বলেছিস পর্ণা! আমি ঠিক এই উপলব্ধিটাই ওকে দিতে চেয়েছিলাম। ও ভাবুক, এত ভালোমানুষি করার ওর কোনও দরকার ছিল না!

-এভাবে বলছিস কেন দি’ভাই?

-দ্যাখ পর্ণা, এই সম্বন্ধটা তোর বাবাই করেছিলেন। আত্মীয়ের মধ্যেই যখন, আমি ওর সব খবরই পেতাম। আমার বিয়ের পর বহুদিন অপেক্ষা করেছি ওর বিয়ের খবর পাবো; কিন্তু কোনও দিন পাইনি। তখন আমি দেখতে খুব একটা খারাপ ছিলাম না রে!

-সে তুই এখনও সুন্দরী দি’ভাই। আমাদের তো তোর পাশে মাসীটার মতো লাগে!

-যাঃ! কী যে বাজে বকিস! যাইহোক, যা বলছিলাম। আমার দু-একজন ঘনিষ্ট বান্ধবী বলতো, ও নাকি বিয়ে করল না আমার জন্যই। প্রত্যেক মেয়ে এমনটা বিশ্বাস করতে ভালোবাসে। আমিও করতাম। এরপর ওর মা হঠাৎ করে ষ্ট্রোকে মারা গেলেন। দুইছেলের একছেলে বিদেশে থাকে - ওর ছেলেপুলে হয়নি; আরেক ছেলে মিলিটারীতে। এমনিতেই মিলিটারীতে জীবন মরণ নিয়ে উদ্বেগ, তার ওপর ছেলে বিয়ে করবে না -এমন চিন্তাতেই নাকি ষ্ট্রোক হয়ে গেছিল তাঁর – এমন কথা আমার কানে এসেছে। অথচ ওকে দ্যাখ –নির্বিকার ... অ্যাটলিস্ট দেখায়। তারপর চাকরী বাকরী ছেড়ে ঘরে বসে মদ গেলে, গান শোনে, গল্প বই পড়ে। এটা কোনও জীবন?

-কী করতো তাহলে সে? পর্ণার চোখে কৌতুহল।

-আমি হলে তো বাবা ডিভোর্স দিতাম না। এত ঝামেলা করে ছুটিছাটা জোগাড় করে বিয়ে করেছি। দু-চার রাত জোর করতাম, পাখি সুড়সুড় করে খাঁচায় পোষ মানতো।

-তাহলে কি সে কখনও তোর চোখে বড় হ’ত দি’ভাই? তুই কি তাকে শ্রদ্ধা করতিস? জোর করে পোষ মানিয়ে কি লাভ হয়? 

-কতশত বাঙালী মেয়ে তো এভাবেই সমঝোতা করে ঘর করছে পর্ণা!

-তুই সেদিনের মতো করে ভাব দি’ভাই। সেদিন তোর যা পরিস্থিতি ছিল, তাতে যদি সে তোর প্রতি জোর করতো, তোর ভালো লাগতো?

অবন্তিকা চুপ করে রইল। খানিক পরে বলল, আমার কাছে শ্রদ্ধা আদায় করে নিয়ে সে বা কোন ভালোটা আছে? কিছু না হলেও অন্তত আমাকে তো পেত! 

-ও তো দেহ পাওয়া হত দি’ভাই! ওতে কী আছে?

-মেয়েদের মন রে পর্ণা! দেহ পেতে পেতে মনও একদিন দখল হয়ে যায়। 

-তোকে আজ ঠিক বুঝছি না রে দি’ভাই। এমন কথা আমি জীবনে শুনিনি, অন্তত তোর মতো মেয়ের কথা এগুলো নয়! কী হয়েছে তোর দি’ভাই? 

-কিছুই হয়নি। চল, পার্লারের লোকজন আসার সময় হয়ে গেছে।

-একটা কথা বলবি দি’ভাই?

-বল।

-অনুপমদা’র সাথে তোর কি সম্পর্কটা সুখের হয়নি?

-একথা বলছিস কেন, পর্ণা? আজকে এমনধারা কথা বলছি বলে?

-না, ঠিক তা নয়! আজকাল কোনও গ্যাদারিংস এ অনুপমদা বিশেষ আসে না।

-ও এখন রিয়েলি ব্যস্ত রে!

-স্পষ্ট করে বলতো দি’ভাই, তোর সাথে অ্যাট প্রেজেন্ট অনুপমদা’র রিলেশন কেমন?

-অন্য পাঁচটা বাঙালী দম্পতির মতো! বিয়ের বাইশ বছর বাদে সম্পর্ক যেমন থাকে তেমনটা।

-তোর কথার টোনটা থেকে কিছু বুঝতে পারছি নারে দি’ভাই। এটা নৈর্ব্যক্তিক নাকি অন্য কিছু?

-অনুপমের বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ করার কিছু নেই পর্ণা। চল, এবার সত্যি সত্যি যাওয়া দরকার।

                                           (২)  

  বিয়ে বাড়ী-টাড়ীতে এজন্যই খুব একটা যায়না চন্দন। ও এমনি একটু গম্ভীর প্রকৃতির, মানুষ জনের সাথে খুব একটা মিশতে পারে না। সর্বোপরি এই বাড়ীতে ওর চেনা শোনা মানুষজনও বড় একটা কেউ নেই। তবে বাদল বাবু মানে পর্ণার বাবা এবার এত করে বলেছিলেন যে, না এসে উপায় ছিল না। তিনি যদিও মাঝে মাঝে এসে এর তার সাথে ওর আলাপ পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন, তবু কোথাও যেন একটা খারাপ লাগা কাজ করছিলই। কাল অবন্তিকা এমন করে কথা বলে গেল কেন, সে ভাবনাটাই মাঝে মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছিল; তবে কিনা ও আবার বেশী জটিল করে কিছু নাগাড়ে ভাবতে পারে না – এটাই রক্ষে! কাল থেকে অবন্তিকাকে যদিও বারকয়েক মুখোমুখি দেখেছে সে, তবু কথা হয়নি আর। ওর এখন মনটা একটু চা-চা করছিল, হঠাৎ দেখে কালকের মেয়েটি একটা প্লেটে পকোড়া আর চা নিয়ে এসেছে। বলল, ‘চন্দনদা, আপনি তো আমায় চেনেন না। আমি পর্ণা। বাদলবাবুর ছোট মেয়ে।’

-ওঃ। তোমার সাথে আগে পরিচয় হয়নি, সত্যি কথা।

-আপনি আমার দিদিদের বা আমার বিয়েতে আসেন নি?

-আসিনি মনে হয়। এলে নিশ্চিত আলাপ হ’ত!

-আপনি মিলিটারীতে চাকরী করতেন?

-হ্যাঁ।

-জানেন তো আমার মিলিটারীদের খুব ভালো লাগে। খুব থ্রিলিং এবং অ্যাডভেঞ্চারিং লাইফ। মানুষ হাসতে হাসতে দেশের জন্য প্রাণ দিতে পারে তা একমাত্র মিলিটারীদের দেখলেই বোঝা যায়। 

-এটা একটা নতুন ফ্যাশন হয়েছে, পর্ণা। ওই কার্গিল যুদ্ধের পর দেশে এক একটা অ্যাকশন হয়, আর জনমানসে মিলিটারীদের প্রতি শ্রদ্ধা-সমবেদনা জেগে ওঠে। আমাদের কালে এসব ছিল না। বিরাট একটা লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নিয়ে যে আমরা গেছি তা নয়, একটা চাকরীর অপশন হিসাবেই আমি এটায় জয়েন করেছি।

-আচ্ছা, আপনি কি রেগুলার এক্সারসাইজ করেন এখনও?

-কেন বলো তো?

-না মানে এখনও এত মেইনটেনড! আমি মোটা-সোটা তো, তাই নির্মেদ মানুষ দেখলে আমার খুব জানতে কৌতুহল হয় সে এটা কি করে বজায় রাখে!

চন্দন পর্ণার দিকে ভালো করে এবার চাইল। যতটা বলছে ঠিক ততটা না হলেও একটু পৃথুলা, তবে মুখটি ভারী মিষ্টি এবং সরল। চন্দন হেসে বলল, ‘তুমি কি রোগা হতে চাও?’

-ডায়েটিং না করে যদি কোনও উপায় থাকে তো বলুন। ওর কথায় হেসে উঠলো দুজনেই। হঠাৎ করে পর্ণা বলল, ‘চন্দনদা আপনার সাথে আমার দি’ভাই এর বিয়ে হওয়ার গল্পটা শুনলাম’।

-কে বলল? অবন্তিকা?

-সে যেই বলুক, বিয়েটা টিকলে আমি কিন্তু  আপনার শ্যালিকাই হতাম! 

-তাতে কি?

-না। তাতে আমার আপনার সাথে যে কোনও ধরনের ইয়ারকি ফাজলামি মারার অধিকার জন্মাতো। আপনি রাগ করতে পারতেন না। 

-ইয়ারকি ফাজলামি আমার সাথে বিশেষ কেউ মারে না পর্ণা। সবাই ভয় পায়। আমার গোঁফটা দেখেছো তো! তোমার যদি আমাকে কিছু বলতে ইচ্ছে করে অকপটে বলতে পারো। তোমার তো শ্যালিকা হওয়ার অভিজ্ঞতা আছে; আমিও শুনি, কেমন ইয়ারকি মারতে পারো। তবে মনে রেখো, মিলিটারি লোক তো, মাথাটা আমার তুলনায় নিরেট, বেশী সূক্ষ্ম নিতে পারবো না কিন্তু।  

-আমিও নিরেটই। মাথামোটা বলে তো বি.এ পেরোলাম না, বিয়ে হয়ে গেল। নেহাত ইন্দ্রনীল ছিল ছোটবেলা থেকে, নইলে বিয়ে হতেই সমস্যা হত।

চন্দন মিটিমিটি হাসতে লাগলো।

-জানেন তো চন্দনদা, দি’ভাই এর জায়গায় আমি হলে কিন্তু ছেড়ে যেতাম না; সে যতই ইন্দ্রনীল থাকুক।

-সো কাইন্ড অফ ইউ! কিন্তু কী করবে বলো, বিধির নির্বন্ধ! তোমার দি’ভাই এর সঙ্গেই ঘটনাটা ঘটলো। আমার অনেক পরে তুমি জন্মেছ।

-একটা সত্যি কথা বলবেন চন্দনদা, কাল দি’ভাইকে দেখে আপনার মনে হয়নি, ঘটনাটা অন্যরকম হলে ভালো হ’ত!

-হ’তো হয়তো। তবে পর্ণা,আমি ঠিক ওরকম করে ভাবতে পারি না। আমি না তো অতীত নিয়ে বাঁচি,  না তো ভবিষ্যতে। অবন্তিকা যা চেয়েছিল, আমি একজন মানুষ হিসেবে সেটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

-আপনি কোথায় থাকেন চন্দন দা?

-আলিপুরে।

-আমরা চারুমার্কেটে থাকি। আমাকে খুব  অপছন্দ না হলে ফোনটোন করবেন। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হলে আসতেও পারেন। আমি একটু বাচাল, সব কথা বুদ্ধি করে বলতে পারি না। আমার আপনাকে খুব ভালো লেগেছে। আপনার?

চন্দন মুখে কিছু বলল না। হাসলো শুধু। একটা কাগজে ওর নাম্বারটা লিখে এগিয়ে দিল পর্ণার দিকে।

                              (৩)

  দিন তার নিজের নিয়মেই চলে। অবন্তিকার বয়স বেড়েছে। ছেলের বিয়ে হয়ে ঘরে বৌমা এসেছে। মেয়েরও বিয়ে হবে সামনের মাসে। দেখতে দেখতে ওর এখন  তিপান্ন বছর বয়স। একদিন দুপুরের ঘুম দিয়ে বিকেলের চা বসাতে যাবে, হঠাৎ  পর্ণার ফোন এল, ‘দি’ভাই কী করছিস এখন?’

-এই তো চা বসাচ্ছি। তুই? হঠাৎ এসময়ে?

-একটা খবর দেওয়ার জন্য ফোন করলাম রে!

-কী হয়েছে? ভয় পাওয়া গলায় বলল অবন্তিকা।

-চন্দন’দা এই মাত্র মারা গেল।

-কোন চন্দন’দা!

-তুই ক’টা চন্দনকে চিনিস দি’ভাই? তোর সাথে বিয়ে হয়েছিল যার – সেই চন্দন’দা।

-কীভাবে মারা গেল?

-পরশু রাতে ষ্ট্রোক হয়েছিল। নার্সিংহোমে দুদিন ভেন্টিলেটারে রেখেছিল। আজ খুলে নিয়েছে।

-তুই কবে জানতে পেরেছিস?

-কাল বিকেলে।

-আমাকে জানাসনি কেন?

-কী হত জানিয়ে দি’ভাই? সামনের মাসে মুন্নির বিয়ে। তোরা ওসব নিয়ে মেতে আছিস। এখন বলা কি ভালো হত? তাছাড়া যদিও বা বলতাম, গিয়ে দেখি ভেন্টিলেটার লাগানো। অতবড় চেহারার মানুষটাকে এরকম অবস্থায় দেখতে মোটেও ভালো লাগতো না তোর। তাছাড়া...

-এ কী করলি পর্ণা? একবার শেষবারের মতো চোখের দেখাও তো দেখতে পারতাম! দাহ কাজ কখন হবে?

-চারঘন্টা বাদে বডি ছাড়বে। তারপর হবে।

-ওর ভাই কি আসবে কানাডা থেকে?

-না। খবর দেওয়া হয়েছে। দাহ করে দিতে বলল। সমস্যা এখন একটাই, মুখাগ্নি কে করবে? ওর তো কেউ নেই।

-আমি কি কিটো কে বলবো?

-তোর ছেলে মেয়েরা কি তোর জীবনের এই অধ্যায়টা জানে?

-না।

-তাহলে আর ঝামেলা বাড়াস না দি’ভাই।

-তাহলে আমিই করবো।

-ভেবে দ্যাখ দি’ভাই। অনুপম’দা আবার কিছু মাইন্ড করবে না তো?

-করলে করবে। আর তাছাড়া ওর ওইটুকু কৃতজ্ঞতা তো থাকা উচিৎ। চন্দন যদি মহানুভবতা না দেখাতো, তবে ওর কি আজকের দিন এরকমটা হত?

-তুই অনুপমদা’র সাথে কথা বল দি’ভাই।

-আমি অনুপমকে জানাচ্ছি বটে, তবে ও যাই বলুক না কেন আমি আসছি। নার্সিংহোমের ঠিকানাটা পাঠা।

কোনওরকম একটা সালোয়ারে নিজেকে ঢুকিয়ে নার্সিংহোমে হাজির হল অবন্তিকা। পর্ণাকে দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল সে।

-শান্ত হ’ দি’ভাই।

-তুই জানলি কী করে পর্ণা? চন্দনের সাথে কি তোর যোগাযোগ ছিল?

-ছিল। আমার তরফ থেকেই ছিল মূলত। আমি ফোনটোন করতাম। নেমন্তন্ন করলে বাড়ীতেও আসতো।

-ক’বার এসেছে তোর বাড়ীতে?

-এ ক’বছরে পাঁচ-সাতবার তো এসেছে।

-তোকে কে জানালো?

-ওদের পাশের বাড়ীর কেউ ফোন করে জানালো। হয়তো চন্দনদা’র মোবাইল টোবাইল ঘেঁটে আমার নামটাই কনভেনিয়েন্ট মনে হয়েছে বা আরও কাউকে জানিয়েছে।

-ষ্ট্রোকটা কখন হয়েছিল?

-রাত ন’টা নাগাদ। ওর কাজের লোকটা তখনও ছিল। ওরাই পাশের বাড়ীতে খবর দিয়েছে।

-নার্সিংহোমের বিলটিল?

-ও তুই চিন্তা করিসনা দি’ভাই। চন্দনদা নাকি ইমার্জেন্সি টাকা-ফাকা কোথায় আছে, কাজের লোককে বলে দিয়েছিল। তাতেই হয়ে যাবে সব।

 

শ্মশান ঘাটে যখন পুরোহিত জিজ্ঞাসা করলেন,মুখাগ্নি কে করবে,অবন্তিকা এগিয়ে এল।

-মৃত ব্যক্তির সাথে আপনার রিলেশন?

-স্বামী।

-ছেলেপুলে নেই বুঝি?

-না।

-তাহলে তো আপনাকেই করতে হয়। নিন। বলুন, নমঃ বিষ্ণু, নমঃ বিষ্ণু, নমঃ বিষ্ণু!

পর্ণা বলল, ‘দি’ভাই, কী করলি তুই? অনুপমদা বেঁচে আছে, তোর ব্যাপারটা ক্ল্যারিফাই করা উচিৎ ছিল।‘ 

-তাতে কি হত? প্রাক্তন স্বামীর জন্য কি আলাদা মন্ত্র আছে? আর অনুপমের সাথে তো আমার মন্ত্র পড়ে বিয়ে হয়নি, রেজিস্ট্রি হয়েছিল। মন্ত্র পড়ে এর সাথেই তো বিয়ে হয়েছিল!

-জানিনা রে বাবা তোর মতিগতি! তুই কি নিয়ম সংযমও পালন করবি নাকি?

-যতটা সম্ভব করবো।

-অনুপম’দা রাগ করবে না তো রে!

-মানুষের রক্ত গায়ে থাকলে করবে না।

-আসলে এসব নিয়ে মানুষের নানান সংষ্কার থাকে তো! দ্যাখ বাবা, বিয়ের এত বছর পরে এই নিয়ে সমস্যা পাকাস না! সামনেই মেয়ের বিয়ে, হইচই না হয়!

-সে তুই ভাবিস না পর্ণা। আচ্ছা পর্ণা, তোর সাথে তো ওর ভালো রিলেশন ছিল, আমার কথা কিছু বলতো?

-সিগনিফিকেন্ট কিছু না।

-তোর কি মনে হয়, আমার জন্যই ও আর বিয়ে করেনি পর্ণা? সত্যি কথা বলবি কিন্তু!

-দ্যাখ দি’ভাই, আমি মন রাখার জন্য কিছু বলব না। আমি সত্যি কোনওদিন কিছু বুঝতে পারিনি রে! আমি নানান কথায় ওর ভেতরটা বোঝার চেষ্টা করতাম, তবে কোনও তল পাইনি কোনওদিন। যেটুকু বুঝেছি, লোকটা আদৌ গম্ভীর ছিল না। অনেকটা নারকেল ফলের মতো - বাইরে শক্ত, ভেতরে নরম!


  বেশ কিছুদিন বাদে একটা মোটা খাম পেল অবন্তিকা। উকিলের চিঠির সাথে চন্দনের উইল। সে তার সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি অবন্তিকার নামে লিখে দিয়ে গেছে। সঙ্গে একটা ছোট্ট চিঠি -‘অবন্তিকা, বেশী ভাবার মতো ধৈর্য্য তো আমার কোনও কালেই ছিল না। তাই বোধ হয় তোমায় বিড়ম্বিত করলাম। আসলে বিয়েটা টিকলে তো সবকিছু তোমারই হত, তাই প্রথমে তোমার নামই মনে পড়ল। তোমার বোঝা মনে হলে যা খুশি করো, যাকে খুশি দিও। আমার কোনও বক্তব্য থাকবে না। চন্দন মুখোপাধ্যায়।’ চিঠিটা ভালো করে দু-একবার পড়ে টেবিলের উপর রেখে দিল সে। সিলিং ফ্যানের হাওয়ায় কাগজটা উড়ে জানলার দিকে গেল, অবন্তিকা কুড়োবার চেষ্টা করলো না। খানিকবাদে সত্যি সত্যি হাওয়ায় উড়ে গেল লেখাটি। অবন্তিকা আনমনে সেদিকে শুধু তাকিয়েই থাকলো। 

Post a Comment

1 Comments

  1. ভাস্কর সেনNovember 3, 2024 at 12:55 PM

    ভালো লাগলো।

    ReplyDelete