জ্বলদর্চি

পানিফল /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৪৩
পানিফল

ভাস্করব্রত পতি

'তিন তারাঙ্গা ধানের ডাঙ্গা / খাইতে মধু, পাতা রাঙ্গা'! 
পানিফল নিয়ে এই লোকছড়াটি বহুল প্রচলিত। আলোচিত পানিফলের বিজ্ঞানসম্মত নাম Trapa natans। এছাড়াও আরও দুটি প্রজাতি Trapa bicornis এবং Trapa rossica রয়েছে। এটি ট্র্যাপেসি পরিবারের অন্তর্গত।  সংস্কৃতে একে বলে শৃঙ্গাটক। এছাড়াও পানিফলকে বলা হয় শিংড়া, সিংঘরা ফল, শয়তান শুঁটি, বাদুড়ের বাদাম, লিং বাদাম, মহিষের বাদাম ইত্যাদি। ইংরেজিতে বলে Water caltrop, Mustache nut এবং Water chestnut। আফ্রিকা এবং ইউরেশিয়ার উষ্ণ নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে জন্মায় পানিফল। মূলতঃ ভারত সহ বাংলাদেশ, চিন, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, ইতালি, শ্রীলঙ্কা, জাপানের জলাজমিতে জন্মায় পানিফল। অন্তত ৩০০০ বছর আগেও চিনদেশে পানিফলের চাষের তথ্য পাওয়া যায়। করঞ্জা বা CARISSA CARANDAS কে পানিফল, কৃষ্ণ পানিফল বললেও আমাদের আলোচিত পানিফল এটি নয়। 
পানিফল চারা

এটি একটি বর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ। অগভীর জলে জন্মায়। লম্বায় ৫ মিটার পর্যন্ত হয়। জলের নিচেই শেকড় ঝুলে থাকে। আর পাতাগুলো জলের ওপর ভেসে থাকে। এদের পাতাগুলো ২ - ৩ ইঞ্চি চওড়া এবং ৩ - ৪ ইঞ্চি লম্বা। পাতার কিনারাগুলি করাতের ন্যায় বড় দাঁতযুক্ত। পাতার বোঁটা ৪ - ৬ ইঞ্চি এবং তুলতুলে। পানিফলের বৈশিষ্ট্য কে সামনে রেখে খুলনা এলাকায় ব্যবহৃত ছড়াটি হল -- 'বনেতে জন্মিয়া সেই বন নষ্ট করে / স্বভাবতঃ দুই শৃঙ্গ দুই দিকে ধরে / ফেলিলে অঙ্গের ছাল হয় রূপবান / দুই জাতি আছে তাহা বুঝহ জীবন'। 
হাউর রেলস্টেশনের গায়ে নয়ানজুলিতে পানিফল চাষ

ত্রিকোণাকার পানিফলের গায়ে শিংয়ের মতো দুটো কাঁটা থাকে, তাই একে সিঙাড়া ফলও বলে। এদের বীজ ১২ বছর পর্যন্ত অঙ্কুরোদগমের জন্য সক্ষম থাকে। তবে ছোটনাগপুর অঞ্চলে আরেক প্রজাতির পানিফলের ফলগুলির চারকোণে চারটি কাঁটা থাকে। এর মধ্যে দুটি কাঁটা অপেক্ষাকৃত ছোট। এই পানিফলের বিজ্ঞানসম্মত নাম Trapa incisa। সাধারণত সবুজ এবং বাদামি রঙের পানিফল চাষ হতে দেখা যায়। তবে সবুজ পানিফল সবচেয়ে বেশি মেলে। ভাদ্র আশ্বিন থেকে ফল হ'তে শুরু হয় এবং মাঘ ফাল্গুন পর্যন্ত মেলে। 
জলে ভাসমান পানিফলের পাতা

বন্যার দাপটে পানিফল চাষে ক্ষতি না হলে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পানিফল চাষীরা মোটামুটি লাভের মুখ দেখতে পান প্রতি বছর। বাজারে গড়ে ৩০ টাকা কেজি হিসেবে বিক্রি হয় পানিফল। এই চাষে খরচ কম, লাভের অঙ্কে পুষিয়ে যায়। 
পানিফল তোলা হচ্ছে

পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়া থানার হাউর, সুন্দরনগর, রঘুনাথবাড়ি, হরিনারায়নচক, ডোমঘাট, গড়পুরুষোত্তমপুর, রাণিহাটি, চাঁপাডালি ইত্যাদি এলাকায় নিচু জলাজমি ও নয়ানজুলিতে পানিফল চাষ করা হয়। হাউর রেলস্টেশনের কাছে রেলের ভেড়িতেও পানিফল চাষ করছেন কিছু মানুষ। তবে শিশির এবং কুয়াশা পড়লে গাছ নষ্ট হয়ে যায়। মোটামুটি এক কাঠা জমিতে প্রতিবারে ২৫ - ৩০ কেজি করে পানিফল তোলা হয়। লক্ষ্মীপূজা থেকে দেওয়ালি পর্যন্ত মূল সময় পানিফল উৎপাদনের। 
লাল পানিফল

এই চাষে খরচ তেমন একটা নেই। কেবল প্রথমে শুকনো জমিতে খরচ হয় হাল করার জন্য। এরপর এক কাঠা জমিতে ১৫ ঝাড় চারা লাগানো হয়। প্রতিটি ঝাড় পানিফলের চারার দাম পড়ে ২০ টাকা। আর মাঝে মাঝে কীটনাশক স্প্রে করতে হয় পোকার আক্রমণ হলে।
পানিফল বাগান

পানিফল খুব পুষ্টিতে ভরপুর। এর মধ্যে কার্বোহাইড্রেড ও শর্করা ছাড়াও মেলে রাইবোফ্ল্যাবিন, ভিটামিন ‘বি’, পটাসিয়াম, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, আমিষ। 
সবুজ পানিফল

পানিফল থেকে তৈরি আটা খুব সুস্বাদু এবং এ থেকে রকমারি পদ তৈরি করা হয়। চরক সংহিতাতেও ভেষজ হিসেবে স্থান পেয়েছে শৃঙ্গাটক বা পানিফল। রাজনির্ঘণ্টকারের (১৮ দশকের গ্রন্থ) গবেষণায় এটিকে শ্লেষ্মাকর ব'লেই বর্ণনা করা হয়েছে। পিত্তদাহ প্রশমনে, শরৎকালে আমাশা থেকে মুক্তি পেতে, স্মৃতিভ্রংস নিরসনে, এলার্জির মাত্রা কমাতে, মেহরোগ নিরাময়ে, প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গেলে পানিফল নানা ভাবে উপকারী হয়ে ওঠে।
🍂

Post a Comment

0 Comments