জ্বলদর্চি

দেবী দর্শন /তনুশ্রী ভট্টাচার্য

দেবী দর্শন

তনুশ্রী ভট্টাচার্য 


এ গ্রামে দুটো দুর্গাপুজো হয়। সাবেকী । কোনো বাহ্য আড়ম্বর সেখানে এ্যালাও নয়। একটি অষ্টধাতুর মূর্তিতে গ্রামের সম্পন্ন কায়স্থ দত্ত পরিবারের আয়োজনে।  আর একটা  হয় একচালা দেবীমূর্তি  ঘোষাল পরিবারে। সেখানেও বনেদী বাড়ির ছাপ।  কিন্তু কার্তিক মাসের দীপান্বিতা অমাবস্যায় অনেকগুলো কালীপুজো হয়  গ্রামের ব্রাহ্মণ পরিবারগুলোতে। চক্রবর্তী মুখুজ্যে বাঁড়ুজ্যে পরিবারে। ,ভটচায পরিবারেও  বেশ জাঁক করে কালীপুজো হয়। 
সে অনেক কালের কথা। সেবছর ভটচায পরিবারের বড় ছেলে ইস্কুলের মাস্টারী পেয়েছে। খুশির জোয়ার।‌ আষাঢ় মাসে চাকরীতে ঢুকেছে। দেখতে দেখতে কালীপুজো এসে গেল। সে ছেলের কী এক জেদ চাপল সে নিজেই ঠাকুর গড়ে পুজো করবে। বাড়ির পুজোটা অবশ্য বাইরে থেকে পূজক এলেও তন্ত্র ধারকের কঠিন কাজটি সে নিজেই করতো। বারো বছর বয়সে উপনয়নের পর থেকেই  কুলগুরুর‌  সান্নিধ্যে ধীরে ধীরে সব শেখা হয়ে গেছে তার। যজ্ঞ উপবীত ধারণের পর পুজাদি নিত্যকর্মে নিযুক্ত হওয়া সাধু ব্রাহ্মণের একান্ত কর্তব্য। উপনয়ন বেদীতলে পবিত্র হোমাগ্নি সম্মুখে মন্ত্র উচ্চারণ ও প্রাসঙ্গিক  ক্রিয়া কর্মাদি সমাপনান্তে গায়ত্রী মন্ত্র অধিকারী হয়ে  দ্বিজত্ব‌প্রাপ্ত হবার কালে এই অঙ্গীকার  করতে হয়। ব্রাহ্মনত্ব অর্জন করে সেটিকে না প্রয়োগ করা যেমন অকর্তব্য তেমনি তার সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে ব্রাহ্মণত্বের ক্রমান্বয়ে  উন্নীতকরণ একটি অবশ্য কর্তব্য। ঠিক যেমন নার্সিং  ট্রেনিংএর শেষে ল্যাম্প লাইটিং সেরিমনিতে সেবার কর্তব্যের শপথ নিতে হয় প্রতিটি নার্সকে। বি এড‌এর ট্রেনিং নিয়ে উপযুক্ত শিক্ষক হতে হয়, এ ও ঠিক তেমনি। 
"পুরোহিত দর্পণ" গ্রন্থের পুঙ্খানুপুঙ্খ নিয়ম  আচার পদ্ধতি মেনে তাদের বাড়িতে পুজো হতো। সে ছেলে  এবারে জেদ করল কুমারটুলির ঠাকুর না এনে নিজেই মাকালীর প্রতিমা বানাবে। কিন্তু তাতে ত অনেক হ্যাপা! কে শোনে কার কথা। অনেকেই তীব্র আপত্তি করল। নিন্দে মন্দ করতে লাগলো। কুমারটুলির ঠাকুর ছাড়া পুজো হওয়ার বিধান নেই এমন কথাও কেউ কেউ বলল।  মা বাবা মৃদু আপত্তি তুললেও ছেলের জেদের কাছে হার মানল। 
পাড়ার সমবয়সীদের নিয়ে সে টিম তৈরি করল। খড়ের কাঠামো (মেড়) বাঁধা থেকে শুরু করে একমেটে, দোমেটে, খড়ি, রঙ,বার্নিশ  চুলপরানো ডাকের সাজ , চালচিত্র  ---সব সব সে করল ।সঙ্গে আছে পরিজন পাড়া প্রতিবেশী স্বজন বন্ধু বান্ধব এমনকি বাড়ির  অশীতিপর দাদু ঠাকুমারাও। রাশভারী দাদু ত প্রথমটা আমল না দিলেও দু একদিন পর থেকেই উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলো নাতির কাজকর্মে। তারপর থেকে  বেশ উৎসাহ নিয়ে পাশে চেয়ার নিয়ে বসে থাকত। আসলে প্রথমটা সবাই হকচকিয়ে গেছিল এমন নতুন চিন্তাধারায়। ধীরে ধীরে যখন  তা বাস্তবায়িত হলো তখন সবাই অজান্তেই তার সেই ঠাকুর গড়া দেখতে চলে এসেছে আর হাতে হাত লাগিয়ে তাকে সর্বান্তকরণে সাহায্যও করেছে।গ্রামে রটে গেছে ভটচায বাড়ির ছেলে নিজেই ঠাকুর গড়ছে। অনেকেই তাই দেখতে আসছে আগ্রহে আর সে  কাজে যোগ দিচ্ছে আনন্দে। 
ভাই দাদা বৌদি কাকা পাড়ার দুএকজন মিলে কালীপুজোর আগের  সারা রাত জেগে   ফিনিশ হলো  ঠাকুর গড়ার কাজ। তখন ইলেকট্রিক দূর অস্ত।  হ্যাজাক লাইট  বা ডে লাইট জ্বালিয়ে উৎসব অনুষ্ঠান আলোকিত হতো। সে রাতেও জ্বালা হয়েছিল।   কাজ শেষ হলো  প্রায় রাত দুটো। ভূত চতুর্দশীর নিশুতি রাত। চারপাশ  নি:ঝুম । সব গুছিয়ে  ডেলাইট নিভিয়ে মায়ের মূর্তিকে সাদা কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হলো। পরের দিন একেবারে ঘট উত্তোলনের সময় আবার মা কে দেখা যাবে। সামনে একটা বাঁশের বেড়া ঘিরে মন্ডপে একটা ছোট্ট টিমটিমে লন্ঠন জ্বেলে রেখে ওরা সবাই শুতে চলে গেল।
দাদুর ঘুম ভেঙে গেছে রাতে। বুড়ো মানুষ। রাতে দু বার উঠতে হয়। সব ব্যবস্থা করাই থাকে। কিন্তু সেদিন তার ঘরের লন্ঠন টাই  কেউ নিয়ে গিয়ে মন্ডপে রেখেছে। তাই তার ঘর অন্ধকার।  ঘুমের ঝোঁকে তিনি ঠাহর করতে পারেননি। দরজা খুলে ঘুটঘুটে অন্ধকার দেখলেন। ভাবলেন থাক। কষ্ট হলেও এই আঁধারে বাইরে যাবেন না  পড়ে টড়ে গেলে আর এক বিপত্তি। পুজো বাড়িতে ঝামেলা হবে। একটু কষ্ট করে রাতটা কাটিয়ে দিই।কিন্তু খানিক পরেই বুঝলেন,না হচ্ছে না , বড্ড বেগ আসছে। যেতেই হবে। বাড়ি লাগোয়া    পুকুরের পাড়  অবধি যেতে হবে। তিনি সাহস করে আঁধারেই ঘরের বাইরে এলেন। দু এক পা যাবার পরই  কী আশ্চর্য !দেখলেন ডেলাইটটা জ্বলছে। কোথায় আঁধার‌? চারদিক আলোময়। বৃদ্ধ ভাবলেন ঘুমের ঘোরে প্রথমটা হয়তো বুঝতে পারি নি। নিজের কাজ সেরে এসে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন।  সকালে উঠে নাতিকে ডেকে বললেন ,দাদুভাই খরচ একটু বেশী করছ‌ সারা রাত ডেলাইট টা জ্বালিয়ে রাখলে অনেক কেরোসিন পুড়বে। কাল সারারাত ডেলাইট জ্বালিয়ে রেখেছো। 
নাতি অবাক হয়ে বলল, না দাদু আমরা রাত দুটোর পর আলো নিভিয়ে শুতে গেছি। দাদু বলল আমি রাত তিনটের সময় উঠে আলো জ্বালা দেখেছি। সবাই অবাক। যদি আলো জ্বালা থাকত তবে ত এই সকালেও জ্বালা থাকত। তা তো নেই।  সবাই ডেলাইটের কাছে গিয়ে দেখল‌  নেভানো ডেলাইট যেমন রাখা ছিল তেমনটাই রাখা আছে।  দাদু বললেন বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। কালরাতে মা স্বয়ং আলো জ্বেলে আমাকে আলো দেখিয়েছেন। দাদুভাই তোমার নিষ্ঠা সার্থক। মায়ের দেখা পেয়েছি আমি, মায়ের দেখা পেয়েছি ,মা এমনভাবেই দেখা দেন। আমরা মূঢ় ,সময়ে বুঝতে পারি না। আমিও কালরাতে বুঝতে পারি নি।  তুমি যতদিন পারো এই ভাবে নিজে হাতে ঠাকুর গড়ে পুজো করবে। আমি বিধান দিলাম।

বেশ কয়েকবছর কেটে গেছে।পুজো চলে। জাঁকজমক আর  নিষ্ঠা ভরে। আগে পাঁঠাবলি‌ হতো। এখন ওটি বন্ধ হয়ে চালকুমড়ো কাগজীলেবু আদাগাছ আখ  বলি হয়। সে ব্রাহ্মণ শিক্ষকের পুজোর ধরন অত্যন্ত আকর্ষণীয় । সুরেলা কন্ঠে মন্ত্র উচ্চারণে, আচার মেনে নিষ্ঠা ভরে নিখুঁত  সে পুজা  আরতি হোম দেখতে মানুষ ভিড় জমায়। 
🍂

  বিয়ে হয়ে গেছে  তিনবছর হলো। সন্তানাদি না হওয়ায়‌ মায়ের কৃপা ভিক্ষা চলে। মায়ের কাছে প্রার্থনার ফল ফলে। যথাসময়ে এক ফুটফুটে কন্যা আসে ঘর আলো করে। একমাথা কোঁকড়ানো কালো কুচকুচে চুল। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ ।টানাটানা চোখ। পানপাতার মতো মুখ। সে মেয়ে তখন খরখরে  হাঁটতে শিখেছে। দুরন্ত হয়েছে বেশ । সবাইকে ধরধর করতে হয়। চোখের কাজল চুরি করে এখানে সেখানে চলে যায় নিমেষে।   সে বছর সে বেটি বাপের পাশে  বসে  মা কালীর রঙ করা দেখছিল  ছোটো ছোটো খুরিতে  রঙ তুলি নিয়ে খেলা করছিল। বাপ দেবীর  মূর্তিতে রঙ লাগানোয় ব্যস্ত।  হঠাৎই নজরে পড়ল মেয়ে নেই কাছে। খোঁজ খোঁজ । আড়াই বছরের মেয়ে। কোথায় গেল!  এতগুলো মানুষের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সে কোথায় হারিয়ে গেল! এঘর ওঘর সে ঘর এবাড়ি সে বাড়ি গোয়াল পুকুর ধার সর্বত্র লোক খোঁজাখুঁজি  করছে। এই সময় কানায় কানায় ভর্তি পুকুর! কী সর্বনাশ হলো! মেয়ে কোথায় গেল। ও  জল নিয়ে বায়না করছিল।  খুরিতে জল  চাইছিল। কেউ মনে হয় ওর কথা গ্রাহ্য করছিল না সবাই  যে যার নিজের ব্যস্ত ।তবে কি ও জল আনতে পুকুরে গেল? মন্ডপ থেকে একটা পুকুর পঞ্চাশ হাত দূরে,আর  একটা পুকুর  কুড়ি  হাত দূরে। দূরের পুকুরটা অগভীর। কিন্তু কাছের পুকুরটা সদ্য কাটানো এবং অত্যন্ত গভীর এমনকি সেখানে নামার তেমন ঘাট ও নেই। আঘাটা দিয়েই নামা ওঠা করে মানুষ। আর এঁটেল মাটির ভাগ বেশী বলে নামার রাস্তাটা দুরন্ত পিচ্ছিল । পা হড়কালে সোজা জলে। ভয়ানক এই পরিস্থিতি। নতুন কাটা হয়েছে বলে সবাই নতুন পুকুর বলে। নতুন পুকুরে হড়কালে আর আশা নেই এটা সবাই‌ ধরেই নিয়েছে। আর এই নির্জন দুপুরে সে পুকুরে কোনো লোকজন ও নেই যে কেউ তাকে দেখে থাকবে। সর্বনাশের সব সম্ভাবনাই মজুত।

  একদিন পরে মা কালীর আরাধনা। আর আজ এই দুপুরে বাড়ির একমাত্র নাতনীকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাও প্রায় দশমিনিট হয়ে গেছে । খুঁজে পাওয়ার আশা ক্রমশ কমছে। পুকুরে জাল ফেলার  তোড়জোড় চলছে।  মা  দাদু ঠাকুমা পিসিরা উতলা । জাল ফেলার আগে বাবা আরো একবার নতুন পুকুরে দেখতে গেলো যদি কোনো ক্লু পাওয়া যায়। আঘাটার দুধাপ নিচে নেমেই দেখতে পেল একপা  একপা  করে   সেই রঙের খুরি হাতে কাদা চটকে চটকে উঠে আসার চেষ্টা করছে সেই মেয়ে।

বাবা তাড়াতাড়ি নেমে তাকে কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে ওপরে উঠে এলো। সবাই অবাক। ঐ ধাপে ত বেশ কয়েকবার খোঁজ করা হয়েছিল। তবে?‌ সব "তবে" র জবাব মেলে না। মেয়েকে নিয়ে এসে মন্ডপে রেখে সবাই আদর করতে এলো। সবাই তাকে বুকে জড়িয়ে জানতে চাইছে তুই কি করে ঐ ঘাটায় নামলি কেন নামলি‌ আর কোথায়ই বা ছিলি তোকে ওরা দেখতে পেলো না কেন ? উত্তর দেওয়ার বয়স তার হয় নি। হঠাৎ সবাই তার গালে পাঁচ আঙুলের চড়ের দাগ দেখতে পেলো।  তার বাবা জিজ্ঞেস করলো  ঐ নির্জন পুকুর ঘাটে তোকে কে মেরেছে এমন করে? আড়াই বছরের শিশু  মা কালীর দিকে আঙুল তুলে দেখালো--- উই মা মেলেচে।

Post a Comment

0 Comments