চিত্র- শুভম দাস
বয়ঃসন্ধি
পুলককান্তি কর
(১)
রেষ্টুরেন্টে বিলটা পেমেন্ট করে কুশল বললো, তুমি কীভাবে ফিরবে শালিনী, আমি কি তোমায় ড্রপ করে দেব?
তার দরকার হবে না।
তাহলে তোমার কি ওটাই ফাইনাল ডিসিশন?
দ্যাখো কুশল, তুমি আমার ওপর রাগ করোনা। তুমি কি আমার দিকটা ভেবে দেখবে না একবারও?
তোমার এমন মনে হচ্ছে কেন শালিনী, আমি তোমার দিকটা ভাবছি না? আমি তোমাকে বোঝাবার চেষ্টা যেমন করছি, বুঝবার চেষ্টাও তো করছি তেমনি!
বোঝাবার চেষ্টাই করছ কেবল! অন্যটা করছ না!
তাহলে তো আর কোনও কথাই চলে না। ঠিক আছে। তুমি যথেষ্ট সংবেদনশীল, তুমি মেয়েটার কথাটা একবারও ভাবছো না এটাই আমাকে পীড়া দিচ্ছে।
আমার তো এখানেই আপত্তি কুশল। তুমি টোটাল বিষয়টা ওই মেয়েটার অ্যাঙ্গেল থেকেই বিচার করতে চাইছো। হয়তো সেটা অন্যায়ও নয়! কিন্তু আমি বারো চোদ্দ বছরের একটা সোমত্থ মেয়ের সৎমা হয়ে তোমার বাড়ীতে এন্ট্রি নিতে পারবো না। তাও বুঝতাম, তুমি যদি ওর বায়োলজিক্যাল ফাদার হতে!
তাতে কি শালিনী? তাই বলে কি আমি ওকে ফেলে দেব?
ফেলে দেবে কেন? কোনও হোমে টোমে দাও।
তুমি জানো না হোমে কী হয়? কত ধরণের লোক মেয়েদের অ্যাবিউজ করে, পেপারে দ্যাখো না?
দেখবো না কেন? তাই বলে তো আর হোম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে না! ওখানে মেয়েদেরও অভাব নেই।
আমি একজন দায়িত্বশীল লোক হয়ে নিজের সুখের জন্য মেয়েটার উপর এতখানি নির্দয় হতে পারবো না!
তোমার আবার বেশী বেশী কুশল! যার মেয়ে সেই মায়েরই হুঁশ নেই! সে ড্যাং ড্যাং করে পরপুরুষের সাথে আশনাই করে বেড়াচ্ছে, আর তুমি ধর্মপুত্তুর হয়ে অন্যের দায় সামলাচ্ছ!
তুমি তো সবই জানো শালিনী! আজ মিছিমিছি এসব কথা বলে নিজেকে কেন ছোট করছ। আর এসব কথা বলে আমাকে উত্তেজিত করলে আমি কি আমার দায়িত্ব থেকে পিছিয়ে আসবো?
আমিও তো তাই বলছি কুশল। ইটস্ আওয়ার ফাইনাল অ্যাণ্ড ডেলিবারেটিভ ডিসিশন। ইফ ইউ ওয়ান্ট উই ক্যান স্পেণ্ড এগেইন গুড টাইম ইন ফিউচার অ্যাজ আ ফ্রেণ্ড, বাট ডোন্ট্র রিকোয়েষ্ট মি টু বি ইওর ওয়াইফ। ওকে? বাই।
শালিনী আর না দাঁড়িয়ে চলে গেলে গটগট করে। কুশল পার্কিং-এ গিয়ে নিজের গাড়ীতে অন্যমনস্কভাবে স্টার্ট দিল। শালিনী ওর অনেকদিনের বন্ধু, সেই হায়ার সেকেণ্ডারির পর কুশল হায়ার স্টাডিজের জন্য দিল্লী চলে গেছিল পাঁচ ছ-বছর। সে সময় দেখা সাক্ষাৎ কম হলেও চিঠি বা ফোনের যোগাযোগ ছিলই। কুশল নিজে একটু বোহেমিয়ান টাইপের। সব সম্পর্ককে সেভাবে গুছিয়ে জুড়ে রাখার ক্ষমতা ওর আগে বিশেষ ছিল না। শালিনীই মূলত যোগাযোগ রাখতো। সেই তাগিদ সে আজও রেখেছে যদিও কুশলের মনোজগতের অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে বিগত কয়েক বছর। মুন্নিকে নিয়ে তনুশ্রী যখন ওকে বিয়ে করল, বলতে গেলে তখন থেকেই। মুন্নি তখন দেড় বছরের। এই বিয়ের কথা শুনে শালিনী খুব আপত্তি করেছিল - ‘অকারণ ভাবুক হয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিও না কুশল। মেয়েটির সাথে তোমার কদিনের আলাপ? বর ছেড়ে চলে গেছে বলে সিমপ্যাথেটিক্যালি বিষয়টা দেখো না। জীবনটা সিমপ্যাথি দেখানোর জন্য বলি দেওয়া যায় না।
মেয়েটার কী দোষ বলো! জীবনে পিতৃস্নেহ পাবে না?
এরকম তো কত মেয়ে আছে কুশল! তুমি কি পৃথিবীশুদ্ধু সবাইকে উদ্ধার করতে পারবে?
মানুষ কি সবাইকে উদ্ধার করতে পারে?
তুমি তো বিয়েই করতে চাইতে না কুশল। তুমি কি মেয়েটির প্রেমে পড়ে গ্যাছো?
কুশল কিছু বলতে পারে নি। চুপ করে ছিল সেসময়। নিজেকেও প্রশ্ন করে ছিল, কিন্তু সঠিক উত্তরটা ওর মনও ওকে দিতে পারে নি। হয়ত চোখের মোহ ছিল সিম্পলি। তবু অফিসে তনুশ্রীকে দেখলেই ওর ভেতরটা কে্মন করে উঠত। সব সময় মনে হত, আহা, কোনওভাবে যদি ওর দুঃখটাকে ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ হত! তনুশ্রী যে সবসময় দুঃখী দুঃখী মুখ করে ঘুরতো তাও নয়! ইনফ্যাক্ট ও নিজে থেকে নিজের কথা প্রায় বলতই না। পরে আলাপ গভীর হওয়াতে কুশলই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এটা ওটা জিগ্যেস করতো। মানুষের কখন যে কী হয়!
ঘণ্টাখানেক বাদে ও যখন ঘরের ডোর বেল বাজালো, মুন্নিই দরজাটা খুলল। একজন বারো ঘণ্টার আয়া থাকে সকাল আটটা থেকে রাত আটটা। ও আজ চলে গেছে স্বাভাবিক নিয়মে। কুশল সাধ্যমত চেষ্টা করে সাড়ে আটটার মধ্যে ঘরে ঢুকতে, তবে আজকে একটু দেরী হয়ে গেল। মুন্নি অনেকটা বড় হয়ে গেছে বলে যেমন সুবিধা হয়েছে, ভয়ও বেড়েছে অনেক। আজকাল ফ্ল্যাট, বাড়ী কোনও কিছুই আর নিরাপদ নয়। স্বয়ং সিকিউরিটি গার্ডই কখন বিপদের কারণ হয়ে উঠবে বলা যায় না। মুন্নিকে অবশ্য পইপই করে বলা আছে, অপরিচিত কাউকেই কোনও কারণেই দরজা খুলে ভেতরে আসতে দেওয়ার দরকার নেই। পরিষ্কার বলবে, বাপি বাড়ী নেই, পরে এসো। এখন মেয়ে নিজে থেকে বিপদ না ঘটালে ঠিক আছে। আয়া মাসীটিও বেশ ভালো। বয়স্ক, বিশ্বস্ত। মুন্নি ওর থমথমে মুখ দেখে বলল, ‘কী হল বাপি? আন্টি রাজী হয়নি?’
মেয়ে বড় হয়েছে, সুতরাং হুট করে কাউকে বিয়ে করে আনা যায় না। সেকারণেই ওর মতামত নেওয়ার জন্য দু-চারদিন আগেই কথাটা বলেছে কুশল। এখন মুখ একটু স্বাভাবিক করে বলল, ’না’।
কেন?
ইচ্ছে নয়, তাই করবে না।
তুমি ওর মন না বুঝেই কি প্রস্তাব দিতে গিয়েছিলে বাপি? মিছিমিছি আমাকে লুকিও না। আমি জানি, আমার জন্যই আন্টি এতবড় রিস্ক নিতে রাজী হচ্ছে না।
তুই বেশী বুঝিস! বাচ্চা বাচ্চার মতো থাক।
বাচ্চা কোথায় বাপি? চৌদ্দ বছর হতে চলল। তোমার মুখেই শুনেছি তোমার ঠাকুমার তেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল!
আর পাকামি করতে হবে না তোকে।
মুন্নি উঠে এসে কুশলের পাশে দাঁড়ালো। ওর চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলল, তুমি আমাকে কেন হোমে রেখে দাও না?
তাতে লাভ?
তোমার জীবনটা সেট্ল্ড হত তাহলে! আমার জন্য তুমি নিজের জীবনটা কেন নষ্ট করবে বাপি?
তুই নষ্ট কোথায় দেখছিস মুন্নি?
নষ্ট নয় তো কি? ফ্রিলি এখানে ওখানে ঘুরতে পারো না, বন্ধুদের সাথে পার্টি করতে পারো না…
কেন? তোর সাথে তো যাই!
আমার সাথে আর বন্ধুদের সাথে কি একই কথা হল?
প্রায়োরিটিটাই ম্যাটার করে মুন্নি। যদি আমরা বেড়ানো খাওয়াটাকে প্রায়োরিটি দিই - তাহলে কোনও সমস্যাই থাকে না।
তুমি নিজেই জানো বাপি, সবসময় প্রায়োরিটি একই রকম থাকে না। তুমি চাইল্ড কেয়ার হোমের খোঁজ নাও।
সব ব্যাপারে পাকামি করিস না মুন্নি। আমি মরে গেলে কী হবে জানি না, বেঁচে থাকতে তোকে কোনওভাবেই কোনও হোমে ফোমে দেব না। এই নিয়ে আর কোনও কথা শুনতে চাই না।
বেশ তো, হোমে দিতে না চাও নাই দাও, আমাকে বিভিন্ন বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করিয়ে দাও, তোমরাও জাতে উঠবে। হাসল মুন্নি।
তাতে লাভ? ব্যাজার মুখ করে জানতে চাইল কুশল।
দূরে স্কুল তো! বছরে একবার আসব, তোমরা একবার যাবে দেখা করতে। তোমাদের আউটিংও হবে। আমার মনে হয় ওইটুকু দায়িত্ব নিতে আন্টিরও সমস্যা হবে না। আমিও না হয় ছুটিতে টানা একমাস থাকবো না। অল্প দিন থেকেই চলে যাবো।
কুশলের চোখটা ছলছল করে উঠল। ও টান দিয়ে মুন্নিকে কোলে বসিয়ে বলল, অকারণ বেশী ভাবছিস কেন তুই? বললাম তো শালিনীর সমস্যা তোকে নিয়ে নয়। এই বয়সে এসে আর বিয়ে ফিয়ের ঝামেলায় যেতে চায় না।
তাহলে তোমরা লিভ টুগেদার কর।
এবার বেশ রাগত স্বরে কুশল বলল, বেশী কথা বললে কিন্তু মাথায় গাঁট্টা মারব মুন্নি! তুই লিভ টুগেদারের বুঝিস কি?
তুমিও বাপি আমাকে কচি খুকী ভেবো না। ক্লাস এইট হয়ে গেলে এখনকার বাচ্চারা সবই জেনে যায় বাপি! এখন তোমাদের ধ্যান ধারণা নিয়ে বসে থেকো না। আমি সব জানি।
ভারী ধেড়ে গিন্নি হয়েছিস! রাগ করে কোল থেকে মুন্নিকে তুলে দিল কুশল। মুন্নি সামনের সোফাটায় বসতে বসতে বলল, আমি একবার আন্টির সাথে কথা বলব?
কী বলবি?
ওটা আমার উপর ছেড়ে দাও না! দ্যাখো আমি কীভাবে ম্যানেজ করি!
আমার দিব্যি রইল মুন্নি, এই নিয়ে তুই যদি কিছু বলিস!
আমার সাত কর ধরা আছে বাপি, তোমার দিব্যির ভ্যালু নেই।
কিছু ধরা নেই তোর। আমি তোকে বারণ করলাম মুন্নি - এই নিয়ে আন্টির সাথে কোনও কথা নয়। প্রমিস?
চুপ করে রইল মুন্নি। কুশল আবার বলল, কী হল? বল প্রমিস।
আচ্ছা বাবা, প্রমিস!
(২)
অফিস থেকে আজ অনেকক্ষণ এসেছে কুশল। মুন্নির টিউটর এসেছেন। উনি চলে গেলেই খাওয়া দাওয়া। অন্যমনস্কভাবে মোবাইলটা খুটখাট করছিল সে। হঠাৎ ফোনটা দেখে চমকে গেল। তনুশ্রী। ফোনটা তুলে বলল, হঠাৎ? কী মনে করে?
তোমাকে কিছু মনে করেই কি আমি ফোন করি কুশল? মাঝে মাঝেই তো করি। এবার অবশ্য অনেকদিন বাদে করলাম।
তুমি কেমন আছ?
ভালো থাকবো বলেই তো বেরিয়ে এসেছি কুশল। ভালোই আছি।
কথাগুলো হজম করে নিল কুশল। পালটা বাক্য বিনিময় করার স্পৃহা আজ সে বোধ করল না। আর কী কী করলে তনুশ্রীকে ভালো রাখা যেত - সে সব বিতর্কেও ঢুকলো না। বলল, বিশেষ কিছু কথা আছে, নাকি টাইম পাস?
কেন, তুমি কি ব্যস্ত আছো?
ব্যস্ত নেই ঠিক, কিন্তু মুন্নির টিচার এসেছে, চা করে দিতে হবে। কিছু দরকার থাকলে শিগ্গিরি বলো।
মুন্নি কেমন আছে?
ভালোই আছে।
তোমাকে গত পরশু দিন নন্দনে দেখলাম - একটা মেয়ের সাথে। ইনফ্যাক্ট ওই মেয়েটার সাথে তোমাকে এখানে ওখানে আজকাল প্রায়ই দেখা যাচ্ছে। কী ব্যাপার? বিয়েটিয়ের চক্করে আছো নাকি?
তুমি কি আমার পেছনে স্পাইং করছ আজকাল?
স্পাইং করব কেন? বউ হয়ে থাকলে না হয় তোমাকে সন্দেহ করার রাইট ছিল। এখন তো সেসব বালাই!
তাহলে?
আসলে আমি ঠিক স্পাইং করছি না। তুমি এত বেশী বেশী ওই মেয়েটার সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছো, আমার চোখে পড়ে যাচ্ছে - এই আর কী!
তো?
তো কিছু না। বিয়ে-থা করে ফেলতে পারো তো! কদিন আর উপোসী থাকবে? তোমার তো সাধ আহ্লাদ কম ছিল না!
তুমি কি এসব কথার জন্যই ফোন করেছো, তনুশ্রী?
না এজন্য ঠিক না। একটা ফ্রী অ্যাডভাইসও দেওয়ার ছিল!
কী সেটা?
এতবড় ধিঙ্গি একটা মেয়ে ঘরে থাকলে কেউ তোমাকে বিয়ে করবে না চাঁদু! সে তুমি যতই সু-উপায়ি হও না কেন?
কী করতে বলো?
বিদেয় করে দাও। দ্যাখো না, ওর আসল বাবা কেমন ছ’মাসের বাচ্চাকে ফেলে ড্যাং ড্যাং করে বেরিয়ে গেল! ওরই রক্ত আছে ওর গায়ে! দেখবে ও মেয়ে কোনও দিন তোমাকেও খাবে!
তুমি না ওর মা? ছিঃ ছিঃ! তোমার রক্তও তো আছে ওর গায়ে!
শ্লেষটা গায়ে মাখলো না তনুশ্রী। বরং কথাটা লুফে নিয়ে বলল, ‘সেইজন্যই তো বলছি বিদেয় কর ও আপদ!’
তুমি আমার মাথা গরম করে দিও না তনুশ্রী। তুমি নিজে মুক্তি চেয়েছিলে, পেয়ে গেছ। অকারণ মেয়ের শত্রুতা করছ কেন?
জনশ্রুতি কি বলে জানো? মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশী হলে লোকে তাকে ডাইনী বলে।
বলে বলুক।
কদিন আগে দেখলাম তোমার মেয়েটিকে। বেশ ডাগর ডোগর হয়েছে দেখছি। বলি, এত দরদ কেন? রাতের বেলা কি ওতেই কাজ চলে যাচ্ছে তোমার? বলেই খিলখিল করে হেসে ফোনটা কেটে দিল তনুশ্রী।
কুশল তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। স্কাউন্ড্রেল একটা। ফোনটা সোফায় ছুঁড়ে দিতে গিয়ে দেখল মুন্নি দাঁড়িয়ে, ‘কী হয়েছে বাপি?’
কিছু না।
তোমাকে ওরকম দেখাচ্ছে কেন? কার সাথে কথা বলছিলে?
বলেছি না তোমাকে বড়দের কথার মাঝখানে থাকতে হবে না!
মা ফোন করেছিল?
চমকে উঠল কুশল। ‘তুই বুঝলি কী করে?’
ওই যে বলছিলে-‘তুমি না মা’।
মুন্নি বড়দের ফোন এভাবে শোনাও অপরাধ।
কানে এসে গেলে কী করব, বাপি?
তুমি এখানে এসেছ কেন? তোমার না টিউটর এসেছেন?
ওনার যাওয়ার সময় হয়ে গেল, তুমি এখনও চা দিলেনা সেইজন্যই তোমাকে মনে করাতে এলাম।
বেশ তো! তুমি যাও, আমি যা দিয়ে আসছি।
চা বানাতে বানাতে নিজের মনে নানান কথা ভাবতে ভাবতে অবাকই হল কুশল। মানুষের চরিত্র সত্যিই বড় আশ্চর্যের। মুন্নির দায়-দায়িত্ব ও নিয়েছে বলে তনুশ্রীর তো খুশী হওয়ায কথা। ওর উড়ে বেড়ানোতে কেউ পথ আগলে নেই! তাহলে সে এসব কথা বলছে কেন? সর্বোপরি মা হয়ে? লোকে তো বলে ‘কুমাতা’ নাকি কখনও হয় না! নাকি কুশলের এই অতি ভালোমানুষীর জন্য ওর ইগো হার্ট হচ্ছে! সেইজন্য নিজের মেয়েকে কষ্টের এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিতেও দ্বিধা নেই? সত্যি! মানুষের মন বোঝা বিষম দায়!
রাতে খেতে বসে মুন্নি বলল, মা তোমাকে কী বলল বাপি? আমাকে হোমে দিতে?
না।
আমি নিজের কানে শুনেছি বাপি! কেন লুকোচ্ছ? তুমি কি মাকে বলাছিলে আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা?
হঠাৎ এসব কথা কেন বলছিস মুন্নি?
মা নিজে থেকে তোমাকে এসব বলতে যাবে কেন?
যা শুনেছিস তাতে কি তোর মনে হয়েছে আমি তোকে এখান থেকে সরানোর জন্য তৎপর?
সেটা বুঝতে পারছি না। তবে আমার জন্য তোমার অনেক অসুবিধা হচ্ছে বুঝতে পারছি।
বেশী বুঝিস! নে, তাড়াতাড়ি খা। কাল সকালে তোর আবার স্কুল আছে!
বাপি, আমি কথা দিচ্ছি, আমি খুব ভালো করে পড়াশুনো করব, তুমি আমার জন্য কোনও বোর্ডিং স্কুল দেখ।
কুশল মুন্নির মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল, তোকে কোথাও যেতে হবে না মুন্নি। তুই এখানেই থাকবি। তোর জন্য আমার কোনও সমস্যাই হচ্ছে না।
(৩)
রাত্রে হঠাৎ একটা চাপে কুশলের ঘুমটা ভেঙে গেল। ও ঘুমের ঘোরে ‘কে কে’ বলে উঠতে গেল, মুন্নির গলা পেয়ে থমকে গেল। মুন্নি ওর উপর শুয়ে ওর গালে চুমু খাচ্ছে। কুশলও পাল্টা একটা চুমু খেয়ে বলল, কী হল মুন্নি? ঘুম আসছে না?
মুন্নি চুপ করে রইল। কিন্তু ক্রমাগত কুশলের গালে কপালে চুমু খেতে লাগলো। এবার কুশলের অস্বস্তি হতে শুরু করল। বলল, ‘কী হল মুন্নি?’
বাপি তুমি আমাকে বিয়ে করবে?
কেউ যেন চাবুক দিয়ে আঘাত করল কুশলকে। ও জোর করে মুন্নিকে ধাক্কা দিয়ে ওর উপর থেকে সরিয়ে বেড সুইচটা জ্বালিয়ে দিল। হঠাৎ আলোয় মুন্নিকে দেখে ওর চক্ষু চড়ক গাছ। এতবড় মেয়ে শুধু অন্তর্বাস পরে ওর খাটের ওপর চিত হয়ে পড়ে আছে। ও কড়া গলায় বলল, ‘এসব কী নাটক মুন্নি?’
মুন্নি চুপ করে রইল।
কী হল? আবার ধমকে উঠল কুশল।
বললাম তো।
কী বললে?
আমাকে বিয়ে করো!
মুন্নির গালে সপাটে একটা চড় লাগিয়ে কুশল বলল, বেশী পেকে গেছ! যাও নিজের ঘরে যাও। জামাকাপড় পরো গিয়ে!
মুন্নি কোনও কথা না বলে চুপচাপ নিজের ঘরে গেল। কুশল কোনওদিন ওর গায়ে হাত তোলে না। আজ মাথাটা ঠিক রাখতে পারেনি। হঠাৎ করে কী হল মেয়েটার? তনুশ্রীর কথাই ঠিক হল? ওর বাপ-মায়ের রক্ত কথা বলতে শুরু করে দিল এই বয়সে? শিক্ষা, সংস্কারের কোনও মূল্য নেই? সত্যি কথা, এ বিষ ঘনিয়ে ওঠার আগেই একে বিদায় করা দরকার। এসব মেয়ের হোমই যথাযোগ্য জায়গা। ও ওর দায়িত্ব কর্তব্য যথেষ্ট করেছে, ভবিষ্যতেও করবে। কিন্তু এক ঘরে এই সাপ আর পোষা যাবে না। অনেক হয়েছে।
বাকী রাতটা আর ঘুম হল না কুশলের। নানান কথা, মুন্নির ছোটবেলার স্মৃতি এসে ভিড় করতে লাগলো ওর মাথায়। দেড় বছর বয়সে ও যখন এ বাড়ীতে এসেছিল, মনে হত যেন ছোট্ট পরী। একমাথা কোঁকড়ানো চুল, বড় বড় চোখ! তনুশ্রী চলে যাওয়ার পর কুশল ওর টানেই ঘরে ফিরতো। পাগলের মতো বাইরের সব কাজ যে করেই হোক মিটিয়ে নিত সাতটা-সওয়া সাতটার মধ্যে। কুশল উঠে বাথরুমে গেল। হঠাৎ শুনতে পেল, ওর অ্যালার্মটা বাজছে। ভোর সাড়ে পাঁচটায় অ্যালার্মটা দেওয়াই থাকে। কুশল উঠে মুন্নির ঘুম ভাঙায়, ওর ব্রেকফার্ষ্ট তৈরী করে -এটাই এতদিনের দস্তুর। আজ ওর আর মুন্নিকে ডাকতে ইচ্ছে করল না। আজ স্কুলে না যাক। রাতে এতবড় ঘটনা ঘটল, উঠতি বয়সের মেয়ে কোথায় কী করে ফেলবে ঠিক নেই। বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখল মুন্নি উঠে রেডি হয়ে গেছে। ওর মুখটা দেখে বড় মায়া হল কুশলের। ও মুন্নির কাছে গিয়ে বলল, ‘আজ আর স্কুলে যেতে হবে না; আমি স্কুলবাস কে ফোন করে দিচ্ছি’।
আজ ক্লাস টেষ্ট আছে।
থাক। আজ যেতে হবে না। জামা কাপড় ছেড়ে রেষ্ট নে। মুন্নি কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। কুশল অন্যমনস্কভাবে এসে বসল ওর বেডরুমের লাগোয়া বারান্দাটায়। তনুশ্রীর খুব হ্যামকের শখ ছিল। একবার হ্যাণ্ডিক্র্যাফ্ট ফেয়ারে গিয়ে পছন্দ করে কিনে এনেছিল একটা বেতের হ্যামক। সেইটায় বসে বাইরের দিকটায় তাকালো কুশল। সূর্য এইবার উঠবে। ওর আসার সংবাদ নিয়ে রঙগুলো সব আগেভাগেই আকাশকে দিয়েছে ভরিয়ে। দূরের ওই নারকেল গাছটার কোণ দিয়েই সূর্যটা উঠবে এবার। মনটা কিছুতেই স্থির হচ্ছে না ওর। মুন্নি কেন এমনটা করল? একবার কি কোনও সাইকিয়াট্রিস্ট কনসাল্ট করবে? নাকি চুপচাপ কোনও বোর্ডিং এ ভর্তি করার চেষ্টা করবে। হোক না, ও ওর নিজের সন্তান নয়! কিন্তু ওকে তো ভালোবাসে। মোবাইল ডাটাটা অন করে খানিকক্ষণ অন্যমনস্কভাবে হোয়াটস অ্যাপে, ফেসবুকে চোখ বুলাতে লাগল। কনট্যাক্ট লিস্টে গিয়ে দেখল মনসিজের নম্বরটা আছে কিনা। ওর বন্ধুর ভাই। নামকরা সাইকিয়াট্রিস্ট। নেই। পরে জয়ন্ত’র থেকে জোগাড় করলে হবে। এখন শুলেও ঘুম আসবে না। তার থেকে দু-একটা মেসেজে মন দিলে একটু বিষয় থেকে মনটা সরানো যাবে - এই ভেবে হোয়াটস অ্যাপ খুলে বসল। মানুষজনেরও কাজ নেই, এই ভোরে অন্তত দশ-এগারোটা গুডমর্নিং মেসেজ ঢুকে গেছে। এরা কি সারারাত ঘুমোয় না? দু-একটা ভালো মেসেজও আছে। হঠাৎ একটা লেখা ওর নজর কাড়লো। বিদেশের এক ভদ্রলোক গাড়ী ধুতে গিয়ে দেখলেন ওর ছোট মেয়েটা একটা পাথর দিয়ে গাড়ীর পেছনটায় স্ক্র্যাচ করে দিয়েছে। নতুন কেনা শখের গাড়ী। উনি উত্তেজিত হয়ে একটা লোহার স্ক্রুড্রাইভার দিয়ে রাগের মাথায় দিলেন মেয়েটার হাতে জোর বাড়ি। আঘাতে আঙুলগুলো কেটে খসে পড়ল। এসব দেখে মাথা ঠাণ্ডা হতেই উনি মেয়েকে নিয়ে ছুটলেন হাসপাতালে। মেয়েকে হাসপাতালে ওইভাবে শুয়ে থাকতে দেখে অনুশোচনায় ওঁর বুকটা ফেটে যেতে লাগলো। উনি বাড়ী ফিরে ভালো করে স্ক্র্যাচের জায়গাটা দেখলেন। ছোট্ট মেয়েটি আধো আধো অক্ষরে লিখেছে, আই লাভ ইউ ড্যাড। দেখে ওঁর চোখের জল বাধ মানলো না। উনি পাগলের মতো নিজের গাড়ী ভাঙচুর করে সুইসাইড করলেন। গল্পটা পড়ে হঠাৎ করে মাথার ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল কুশলের। মুন্নিরও এরকম কিছু উদ্দেশ্য ছিল না তো? মেয়েটাও তো ওকে খুবই ভালোবাসে। ওর সম্বন্ধে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ওর সাথে একবার কথা বলা উচিৎ। কুশল আস্তে আস্তে উঁকি দিল মুন্নির ঘরে। মুন্নি খাটের উপর চুপ করে বসে আছে। কেমন উস্কোখুস্কো উদভ্রান্ত চেহারা। এখনও গায়ে স্কুলেরই ড্রেস। কুশল এসে ওর পাশে বসতেই ও চোখ তুলে তাকালো। ওর চোখ ছলছল। কুশল ওর মাথায় হাত রাখতেই ও একটু জড়সড় হয়ে দূরে সরে গেল। কুশল বলল, কী হল? দূরে সরে গেলি যে? কাছে আয়!
মুন্নি তাও একই ভাবে বসে রইল। কুশল বলল, ‘কী হল, কাছে আসতে বললাম যে!’
আমি খারাপ মেয়ে বাপি! তুমি আমাকে হোষ্টেলে দিয়ে দাও।
কুশল জোর করে ওর গলাটায় হাতটা জড়িয়ে বলল, ‘দূর বোকা মেয়ে, তুই খারাপ হতে যাবি কেন?’
আমি কাল রাতে যা করেছি, তা তো খারাপ মেয়েরাই করে!
তা করে! তবে খারাপ মেয়েরা বুঝে শুনেই করে। যারা ভালো মেয়ে, তারা না বুঝে অনেক সময় করে ফেলে!
না, না, আমি বুঝে শুনেই করেছি।
কী বুঝেছিস?
তোমার একটা বিয়ে করা দরকার। আমার জন্য কেউ তোমাকে বিয়ে করছে না। তাই ভাবলাম, তুমি যদি আমাকেই বিয়ে করে নাও - তাহলে কোনও দিকেই কোনও সমস্যা হয় না! তোমারও কষ্ট কমবে!
কুশল অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে বলল, ‘তোর এত বেশী বোঝার ঠেলায় যে আমার কষ্ট কতগুণ বেড়ে গেল, সেটা কী করে বোঝাব তোকে? তুই জানিস না, বাবা আর মেয়ের বিবাহ নিষিদ্ধ সম্পর্কের মধ্যে পড়ে?’
আমি তো গুগুলে সার্চ করে দেখলাম বাপি, স্বয়ং ব্রহ্মা তাঁর মেয়ে সরস্বতীকে বিবাহ করেছিলেন। ব্রহ্মা স্বয়ং জগতের সৃষ্টিকর্তা হয়ে যদি এমন করতে পারেন, তবে তোমার অসুবিধা কোথায়? আর সরস্বতী তো স্বয়ং বিদ্যার দেবী!
গুগুলে সার্চ করে কি সব জ্ঞান হয় মুন্নি? ওই গল্পের কনসেপ্ট, তার ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ আলাদা। তুই কখনও জানতে চাইলে আমরা সেসব আলোচনা করতে পারি। সব ঘটনার এতখানি সরলীকরণ হয় না!
শুধু পুরাণে কেন বাপি, মধ্যযুগে বহু সম্রাটের কথাও নেটে আছে যাঁরা নিজের মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখতেন। এছাড়া আমেরিকার দু-একটা ঘটনা আছে যেখানে বাবা-মেয়ের বিয়ের কথা বলা হয়েছে।
তোদের এই এক নেট হয়েছে! সব কিছুর সমাধান নেট দেখে হয় না মুন্নি। আমাদের দেশের সংস্কৃতিতে, আমদের সমাজে আমরা মেয়ের মধ্যে ঈশ্বর দেখি। সে কখনও বিয়ের সামগ্রী হতে পারে না। আর তুই এই বয়সে বিয়ের কতটুকু বুঝিস মুন্নি? বিয়ে বলতে তোদের আলো-আঁধারিতে যতটুকু ধারণা হয়েছে, বিয়ে তার থেকে অনেক বড় কিছু!
মুন্নি চুপ করে রইল। একটু থেমে কুশল বলল, একটা কথা বল দেখি, তোর হঠাৎ করে মনে হল কেন, তোর বাপি বিয়ের জন্য পাগল হয়ে উঠেছে?
তুমিই তো শালিনী আন্টিকে বিয়ে করবে বলে আমাকে বলেছিলে।
সে বলেছিলাম। সেটা যে হচ্ছে না - তাও তোকে বলেছি। আর কোনও নতুন ফ্রন্ট তো খোলেনি! তোর এত সিরিয়াসলি নেওয়ার মত কী হল?
মুন্নিকে কিছু বলতে না দেখে কুশল আবার বলল, কী রে? তুই হঠাৎ এত সিরিয়াস হয়ে গেলি কেন?
আমি জানি।
কী জানিস?
এই বয়েসের পুরুষদের একজন মহিলা সঙ্গী দরকার হয়।
কী করে জানলি?
জানি।
কী করে জানিস, তাইতো জানতে চাইছি। তোর বন্ধুদের সাথে এসব আলোচনা হয়?
মুন্নি নীরব। কুশল আবার বলল, ‘আমার চোখের দিকে চেয়ে বল মুন্নি, কাল তোর ওরকম পোশাক পরে আমার ঘরে আসাটা কার বুদ্ধিতে?’
খুব ধীর গলায় মুন্নি বলল, ‘আমার নিজেরই!’
কেন মিথ্যে বলছিস মুন্নি? আমি তোকে চিনি না! তোর শুধু শরীরটাই বেড়েছে, মন কতটা পেকেছে, আমি বুঝিনা? ঠিক করে বল। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তোর মা নেই, তুই যদি আমাকে সব কথা শেয়ার না করিস, আমি তোকে কী করে বড় করব, বল?
মুন্নি একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘প্রমিস কর, তুমি আমাদের মিসকে বলবে না।‘
প্রমিস।
আমার এক বন্ধু বলেছে।
কী বলেছে সে?
ও বলেছে-ওর বাবার সাথে নাকি ওর এরকম সম্পর্ক হয়। ওর মা যখন থাকে না, তখন। ওর বাবা নাকি এতে ভীষণ খুশী হয়, ওকে খুব আদর করে। সে বলল - আমি যদি তোমার সাথে এরকম করি তবে তুমিও খুব খুশী হবে, আমাকে আদর করবে।
সে তো তোকে আমি এমনিই আদর করি।
তা করো। তবে সেটাই আসল কথা নয়। তুমি যদি খুশী হও, আমাকে দূরে কোথাও পাঠাবার কথা ভাববে না।
সে তো তুই নিজেই বোর্ডিংএ যাবার কথা বলছিলি!
বোর্ডিংটা আলাদা ব্যাপার। আমি ভাবছিলাম তুমি যদি আমাকে মায়ের সাথে পাঠিয়ে দাও, তাহলে মা আর আমাকে কোনওদিন তোমার কাছে নিয়ে আসবে না। বোর্ডিংএ গেলে কমসে কম তোমার সাথে যোগাযোগ তো থাকবে!
কুশল উঠে মুন্নিকে জাপটে জড়িয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। বলল, ‘পাগল মেয়ে। তোকে আমি কোথাও পাঠাবো না। তুই আমার কাছেই থাকবি, আমার কাছে থেকেই বড় হবি। তুই আমাকে কথা দে, ওইসব মেয়েদের সাথে বেশী মেলামেশা করবি না। আর এসব বিষয়ে মাথা ঘামাবি না’। বলতে বলতে ওর গলাটা ধরে এল। ও খেয়াল করল, মুন্নির চোখের জলে ওর বুকের কাছটা ক্রমাগত ভিজে যাচ্ছে।
0 Comments