জ্বলদর্চি

গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত /আত্মারাম খাঁচাছাড়া-পর্ব ১

গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত
আত্মারাম খাঁচাছাড়া। পর্ব ১ 
 
সব ঝুটঝামেলা শুরু হয় ৮ই মে। সেদিন বিকেল থেকে হঠাৎ ভীষণ ঝড় উঠলো । অথচ আগে থেকে কিছুই বোঝা যায় নি। 
আগে শহুরে মানুষ পশ্চিমে হাওয়া বদলাতে যেত। বনভূমির ডাক , পাহাড়ী বিকেলে নিঝুম সন্ধ্যা, নদীতীরে পায়চারি। সে এক দিন ছিল। বাংলা সিনেমার কাকু জেঠুদের দেখা যেত পাহাড়ী সান্যাল বা ছবি বিশ্বাসের মত গাম্ভীর্য নিয়ে হাঁটছেন। আদুরে ফুলহাতা নায়িকা ও ধুতি পরা নায়ক খুঁজে নিত নিজেদের গল্প। সেদিন গেছে। এখন আবহাওয়া বদলের যুগ। পশ্চিমের গরম গনগনে হাওয়া মুখ বদলাতে এসে ঢুকে পড়ে বর্গীদের মত গংগামাটির ডেল্টার জ্যামিতি দিয়ে আঁকা নরম সোঁদা হাওয়ার দেশে। চৈত্রের আকাশের সূর্য ছিল রাগে টকটকে লাল। বৈশাখে গ্রীষ্ম উন্মাদ ক্রোধের ঝোঁকে চড়তে শুরু করল তাপমানের সিঁড়ি । ১০০ ১০১ করতে করতে ১২৭… সেদিন সবার মনে হল এবার সব পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। মনে হল আকাশ থেকে পাখিরা পাতার মত খসে পড়বে, শহরের রাজপথে, ট্রামের লাইনে।
 
অবাক কান্ড। চমৎকার হো গয়া। সেদিনই হঠাৎ সন্ধেবেলা আকাশে দৌড়ে এল বুনো মোষের মত হাজার হাজার ক্রুদ্ধ মেঘযূথ। হৈ হৈ করে ঘিরে ফেলল শহরের আকাশ। কড়াৎ কড়াৎ শব্দ করে তারা তলোয়ারের মত বাঁকা শিং উঁচিয়ে আক্রমণ করলো শহরের ঘিঞ্জি ধুলোমাখা গলি, শুকিয়ে যাওয়া হাউসিং কলোনি, খুবলানো ফুটপাথের ত্রিপলে বাঁধা খাদ্যসত্র। আকাশ ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে, দুমড়ে মুচড়ে কারা টুকরো টুকরো করে দিল দৃশ্যপট। তারপর সেই ভাঙা আকাশ থেকে ঝরতে থাকল হুহু করে বাঁধভাঙ্গা জল। বংশীর মনে খুব কবিতা কবিতা ভাব এলো। লিখে ফেলল, এ যেন নির্বাধ বারিধারার আকুলিত বর্ষণ। কাল ফেসবুকে পড়ে থাকবে ঝড়ে ঝরিয়ে দেওয়া আমের মত অজস্র কবিতা। 
কতদিন হল বংশীর রাতে ঘুম আসে না। গরমে এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে দেয়। চোখ জ্বলতে থাকে ধিকিধিকি অন্ধকারে । চোখদুটো না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হয়েছিল আধপোড়া পেঁয়াজের মত। বৃষ্টি যখন নামল আকাশ ভেঙে, ঘুমও নামল ওর চোখে। ঘুমপাখিরা মোমমাখা ডানা মুড়ে ঘুমোতে এলো ওর চোখের সৈকতে, ওর অনেক দিন পরে খুব গভীর ঘুম এলো। 
 
-ঊ ঊ ঊ বাবাগো মা গো। ঘসঘসে অনেকগুলো গলা। শোবার ঘরের পাশে পাশের ঘর থেকেই আসছে। সেখানে কেউ ঢোকেই না অনেক বছর। সেই ঘরে ছড়িয়ে আছে, পরিযায়ী পরিজনের ফেলে রাখা ভাঙা সংসার, আসবাব ভি আই পি বাক্সে পাট করে রাখা গাদা পুরনো জামা কাপড় শার্ট, প্যান্ট, পুরানা ল্যাপটপ, ভাঙা মোডেম, কি বোরড, দেওয়ালে ঝাপসা হয়ে আসা ভিক্টোরিয়ার সামনে টাঙ্গায় চড়ার ছবি আর ভাঙা একটা আয়নায় সেঁটে থাকা কার একটা ছোট্ট গোল টিপ, টিপটুকু আছে, টিপের মুখটি ভেসে গেছে সময়ের স্রোতে।
 
সেই ঘরে অদ্ভুত গলায় কারা কথা বলছে? স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না। অডিও খারাপ হলে বা হেডফোনে তার কাটা থাকলে যেমন হয় তেমনি ঘড়ঘড়ে শব্দে বংশী যা বুঝলো, কারা যেন কাতরাচ্ছে,
-মাগো বাবাগো কোথায় আমাদের ফেলে গেল মাগো। বড্ড ব্যথা গায়ে। 
এক লহমায় বংশীর শরীরটা যেন রেফ্রিজারেটর। মাথার ডিপ চেম্বারে ভয়ের গ্লেসিয়ারের জন্ম হলো। চোখ ভোল পাল্টে পেঁয়াজ থেকে হয়ে গেল গোল গোল দার্জিলিং লেবু। নিজেকে অনেকবার চিমটি কাটল, কানের লতি ধরে ফটাফট চাপড়ে ভয়ের শব্দগুলো ঝেড়ে ফেলতে গেল। কিছু শোনাকে ঝেড়ে ফেলে নাশোনা করে দেওয়া যায় এমন অবাধ্য আশায়। কিন্তু নাঃ। মানতেই হলো পাশের ঘরে কেউ, না কারা ঢুকেছে। এবং যতদূর মনে হয় তারা চোর ডাকাত নয়। যে কোন কারণেই হোক তারা আর্ত। ব্যথায় কাতরাচ্ছে। 
 
সাবধানের মার নেই। এক হাতে একটা বেসবলের ব্যাট আর এক হাতে একটা পুরনো বেগন স্প্রে নিয়ে কমান্ডো সেজে এগোল বংশী। মাথায় চাপালো অনেকদিনের পুরনো একটা বাইকের হেলমেট, সাবধানের মার নেই। পা টিপে টিপে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দড়াম করে ঘরের দরজাটা খুলে ও যে কোন সাহসে ভর করে ঝাঁপিয়ে পড়ল এখন ভাবলেও ভয়ে ঘেমে যায়। “এই শালারা কি করছিস আমার বাড়িতে” বলে উন্মাদের মত বেসবলের ব্যাটটা ঘুরিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে গেল। ঠিক কি যে হলো বোঝা গেল না। শুধু ঐ খসখসে গলার আওয়াজগুলো উড়ন্ত আরশোলার মত বা পুরলো সিলিং ফ্যানের নত ফ্যাট ফ্যাট করে হাওয়ায় ঘুরতে লাগল ওর চারদিকে। খানিকক্ষণ অন্ধকার হাওয়ায় ব্যাট ঘুরিয়ে ক্লান্ত হয়ে থামাতেই আবার আওয়াজগুলো নেমে এল মাটিতে চেয়ারে সোফায়, আর এক সঙ্গে একশো গলায় কাতরে উঠল
-বাবা গো মাগো কি ব্যথা গো। 

🍂

দুঃস্বপ্নের একটা সীমা থাকে, মাথামুন্ডু থাকে। এমন খাপছাড়া দুঃস্বপ্ন যেন কোন টিভি এঙ্করেরও না হয়। ভয় বাড়তে বাড়তে হঠাৎ কখন সাহস হয়ে উঠল বংশীর বোধগম্য হলো না। কিন্ত এলো, শেষ পর্যন্ত সাহস এলো। কব্জিতে, ঈষৎ কাঁপতে থাকা হাঁটুতে, ধকধক করতে থাকা এওরটা এট্রিয়াম ভেন্ট্রিক্ল সব অদ্ভুত ডাক্তারী যন্ত্র যা সবাই বুকের মধ্যে হয়ে বেড়াই, যেগুলো কিছুক্ষণ পাগলা জগাই হয়ে ছিলেন তাঁরাও ধীরে ধীরে শান্ত হলেন। এই নাতিদীর্ঘ ভূতুড়ে জীবনে মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব প্রেমের পাল্লায় তাকে পড়তে হয়। প্রেম তাকে একা পেয়ে শুকনো মাছধরা জালের মত জাপটে ধরে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধৈর্য আর শান্ততা নিয়ে সে আবার হুস করে জাল ছিঁড়ে ডানা মেলেছে কতবার। শান্ত হওয়াটাই আসল। এখানেও শান্ত হতে হবে। শহীদেরা যেমন যুগে যুগে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় শান্ত হয়ে তেমনি। এই বীরত্বব্যন্জক ভাবনাতে খুব মনে জোর এলো। একটু আগে খিস্তি দিয়েও যা হয়নি। বংশী আর যাই হোক বীর তো নয়। কিন্তু বাঁচতে গেলে বীরের অভিনয় করতে হয়। বংশীও করল। গলায় কাঁপন স্পষ্ট তবুও বলে গেল, 
-তোমরা কারা ভাই! আমাকে না বলে সব ঘরে ঢুকে পড়েছ যে, এই রাত্তিরে? বেল বাজাতে তর সইলো না? জল খাবে কেউ? চা টা কিন্তু আমি করতে পারবো না। 
 
একটা হালকা আওয়াজ হেঁটে হেঁটে সামনে এগিয়ে এলো। হাওয়া আমাদের চারদিকে আছে কিন্তু বুঝতে বা দেখতে পাই না। যদি না পাখা দিয়ে তাড়না করি বা ঝড় ওঠে। কিন্তু হাওয়া হাঁটে? তাই বোধ হল এখন। চোখ ভয়ে বন্ধ বংশীর। সেই অবস্থাতেই শুনল,
-আমরা জল টল খাই না। কোক থাকলে দেখতে পারেন। আমরা আত্মা। ভূত নয় কিন্তু। এটা যেন ভুল না হয়। বর্ডার দিয়ে পাচার হচ্ছিলাম। সামনে বর্ডারে যমপুলিশ দেখে এখানে ফেলে পালিয়েছে। 
 
যেহেতু ধরেই নিয়েছে এটা স্বপ্নের দেশ, বংশীর মাথা এখন সব শোনার জন্য প্রস্তুত। শুধু ভয়ে ভয়ে পুরনো কম্পিউটার চেয়ারটা ধরে বলল-
-বসতে পারি? আপনি মানে আপনারাও বসুন না। অনেক পথ এসেছেন তো। 
খসখস ঘসঘস অনেকগুলো আওয়াজ হলো। হাসছে না রেগে গেছে কে জানে। 
-আর একটু বিশদ করে বলবেন? যেমন ধরুন আপনারা কিসের আত্মা।
বিরক্ত কিনা বোঝা গেল না। উত্তর এলো,
-কিসের আত্মা আবার? মানুষের আত্মা। গরুর শুয়োরের আর বিধর্মীদের আত্মা হয় নাকি ? 
-তা হয়ত হয় না। মানে মানুষ তো কিন্তু কোন কান্ট্রি মানে দেশের? কোন ধর্মের? আপনারা সাদা না কালো আত্মা? সাহেব না দিশি আত্মা? এই আর কি। জানতে পারলে বুঝে শুনে কথা বলতে পারতাম। অবশ্য আত্মার আবার এসব হয় কিনা তা জানা নেই। 
-সব হয় । ঠিক ধরেছেন সব আছে। আরো অনেক কিছু আছে। পার্টি আছে। পয়সাওয়ালা কোটি পতি আর ছোট লোক আছে, ওবিসি, উঁচু জাত নীচু জাত আছে। মাধ্যমিক পাস সিবিএসই পাস আছে। বাংলা মিডিয়ম ইংরিজী মিডিয়াম সব আছে। আত্মা হয়েছি বলে এক জীবনের সব হোয়াইটওয়াশ হয়ে ধুয়ে মুছে যায় না কি? তাহলে কর্মফলের কি করে এপ্রেজাল হবে বলুন। কে কোথায় প্লেসমেন্ট হবে পরের বার, সব এপ্রেসালে লেখা আছে। 
-লেখা আছে? কোথায়! চিত্রগুপ্তের খাতায় ?
এই শুনে সারা ঘর ঘসঘস শব্দে ভরে গেল, তার সঙ্গে ফটফট আওয়াজ, যেন হাজারটা চামচিকে উড়ছে সার ঘরে। বংশী বুঝল আত্মারা হাসছে। 

-ক্রমশঃ-

Post a Comment

0 Comments