জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প—২১৬/জাপান (এশিয়া)নেকড়ে আর কুকুরের বন্ধুত্ব /চিন্ময় দাশ

চিত্র- অর্ণব মিত্র 

দূর দেশের লোকগল্প—২১৬
জাপান (এশিয়া)
নেকড়ে আর কুকুরের বন্ধুত্ব
চিন্ময় দাশ

এক চাষির একটা কুকুর ছিল। যেমন বিশ্বস্ত, তেমনি কর্মঠ। বহুদিন মালিকের সেবা করেছে কুকুরটা। কিন্তু এখন বয়স হয়েছে। শক্তিও কমে এসেছে শরীরে। 
একদিন রাতের বেলা। চাষি তার বউকে বলল—কুকুরটা তো আর কোন কাজই করতে পারে না। শুধু শুধু পুষে লাভটা কী। কালকেই খতম করে দেব ওটাকে।
বউ বলল—বলছটা কী তুমি? এত দিন ধরে সেবা করেছে আমাদের। আজ বয়স হয়েছে বলে, ওকে মেরে ফেলবে তুমি? হাত উঠবে তোমার?
--সেবা করেছে, আমিও খাইয়েছি। আমিও খাইয়েছি। যত্নআত্তি করেছি। চুকেবুকে গেছে। কালই ওর সব খেল খতম হয়ে যাবে।
ঘরটার বাইরে, দাওয়ায় এক কোণে শুয়ে ছিল কুকুরটা। সব কথাই কানে গিয়েছে তার। বুঝতে কিছু বাকি রইল না। চুপি চুপি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে।
বেরিয়ে তো এলো। কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়? নেকড়ের কথা মনে পড়ল তার। বনের নেকড়েটার সাথে অনেক দিনের বন্ধুত্ব। সে নিশ্চয় কিছু একটা বিহিত করতে পারবে। নেকড়ের ডেরায় গিয়ে হাজির হোল কুকুর। 
সব কথা শুনে নেকড়ে তো অবাক। এমন অন্যায় করতে পারে কেউ? ঠিক আছে। দাঁড়াও, আমি তোমার পাকাপাকি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
--কী ব্যবস্থা করবে, বন্ধু?
নেকড়ে বলল—তোমার মালিক খেতের কাজে যায় কখন? 
কুকুর বলল—কখন আবার? সকালে উঠে।
--আর কে যায়।
-- মালকিন যায়, বাচ্চাকে নিয়ে।
--তুমি কী কর তখন?
--পিছন পিছন যাই। 
--গিয়ে কী কর?
 কুকুর বলল—বাচ্চাটার পাশে বসে থাকি। পাহারা দিই তাকে। 
নেকড়ের মুখে হাসি। বলল—তোমার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। যা বলি, মন দিয়ে শোন।
কুকুর উৎসুক হয়ে বলল—বলো, কী বলছো?
নেকড়ে বলল—কালকেও তাই করবে। মালিক খেতে পৌঁছে যাওয়ার কিছু সময় পর, তুমি গিয়ে হাজির হবে। চুপটি করে পাহারায় বসে যাবে। 
--তাতে কী হবে? দেখতে পেলেই তো মেরে ফেলবে! কুকুর কিছু বুঝতে পারল না। 
-- কিছু সময় পরে আমি গিয়ে হামলা করব বাচ্চাটার  উপর। তুমিও আমার উপর হামলে পড়বে। তার পরে, নিজের চোখে দেখবে কী হয়। মালিক খেতে পৌঁছনোর কিছু পরেই যাবে তুমি। মনে থাকে যেন।
সকাল হোল। খানিক বেলা হতে, কুকুর গিয়ে হাজির মালিকের খেতের কাছে। মালিক মালকিন তখন  খেতে কাজ করছে। বাচ্চাটা গাছের তলায় শোয়ানো। কুকুর গিয়ে বসে পড়ল তার পাশে। যেমনটা প্রতিদিন সে করে থাকে।

🍂

কতক্ষণ বাদে নেকড়ে এসে হাজির। লাফিয়ে পড়তে যাবে। গাঁক-গাঁক করে উঠল কুকুর—সাবধান, এক পা-ও এগোবে না এদিকে। যতক্ষণ আমার শরীরে প্রাণ আছে, বাচ্চার কোন ক্ষতি পারবে না তুমি। ভালোয় ভালোয় সরে পড়ো এখান থেকে।
কুকুরের ডাক কানে গিয়েছে চাষির। চমকে উঠে, চোখের সামনে যা দেখল, বিশ্বাস করতে পারছে না । এদিকে নেকড়েও ভয় পাওয়ার বান্দা নয়। ঝটাপটি লেগে গেছে দুজনের।
ভয় পেয়ে, চাষি দৌড়ে আসাতে, যুদ্ধ ছেড়ে, সরে পড়ল নেকড়ে।
তার পর যা হয় আর কী। বউটা এসে জড়িয়ে ধরেছে ছেলেকে। গালমন্দ করছে চাষিকে—এবার বুঝেছ তো, বুড়ো হলেও কুকুর কখনও অকর্মন্য হয় না। আর, তুমি কি না বেকুবের মত কাজ করতে যাচ্ছিলে? 
চাষিও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। এই বুড়ো কুকুরটা না থাকলে, আজ ছেলেকেই হারাতে হোত তাকে।
কুকুরকে আবার যত্ন করে ঘরে নিয়ে গিয়ে রাখল চাষি। সেদিনই রাতের বেলায় নেকড়ে এসে হাজির চাষির বাড়িতে। কুকুরকে বলল—চিরকালের জন্য হিল্লে করে দিয়েছি তোমার। এবার বলো, তার বদলে, তুমি কী উপকার করবে আমার?
কুকুর বলল—একেবারে ঠিক কথা বলেছ। খাওয়া-দাওয়া বা অযত্নের ভয় নাই আর আমার। বলো, কী চাই তোমার? 
--গোয়ালঘর থেকে একড়া ভেড়া নিতে এসেছি আমি।
কুকুর বলে উঠল—না, ভাই। সেটা হবে না। বেইমানি আমার রক্তে নাই। তুমি অন্য কিছু বলো। 
--কথা ফিরিয়ে নেওয়ার লোক আমি নই। ভেড়াই চাই আমার।
--আমি বেঁচে থাকতে, এ বাড়ির ভেড়া তুমি পাবে না।
--তাহলে, আজই বন্ধুত্বের শেষ আমাদের। আজ চলে যাচ্ছি। কাল আসবো। এই তো তোমার বুড়ো শরীর। বাধা দিলে কিন্তু আমি মানব না। ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলব। কী করবে, ভেবে রেখো।
পরদিন। রাতের বেলা নেকড়ে এসে হাজির। কিন্তু কুকুরকে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। যাক, বাবা। বিবাদ করতে হোল না। ভালোই হয়েছে। 
সুড়ুৎ করে গোয়ালে ঢুকে পড়ল নেকড়ে। অমনি সপাং করে এক লাঠির বাড়ি পড়ল তার পিঠে। শিরদাঁড়া একেবারে ভেঙে যাওয়ার জোগাড়। ছিটকে উঠে এক লাফ। ককাতে ককাতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল নেকড়ে। 
নেকড়ের বুঝতে বাকি রইল না, এটা কুকুরের কেরামতি। আগেভাগে মালিককে বলে রেখেছিল তার আসবার কথা। তাতেই মার খেরে পালিয়ে আসতে হোল। 
ডেরায় ফিরে, নেকড়ে ভাবতে লাগল, এর প্রতিশোধ নিতেই হবে আমাকে। ভালুকের সাথে বেশ মিলমিশ আছে। ভালুককে বুঝিয়ে সুঝিয়ে, কুকুরের কাছে পাঠাল। সে  যেন একবার জঙ্গলে আসে। 
পরদিন রাতে ভালুক এসে কুকুরকে বলল--  নেকড়ে তার ভুল বুঝতে পেরেছে। ভারি দুঃখিত সে। একবার জংগলে যেতে অনুরোধ করেছে। দুই বন্ধুর মধ্যে একটা বোঝাপড়া করে নিতে চায়। 
কুকুর রাজি হোল। কিন্তু মনটা খচখচ করছে। বোঝাপড়া বলতে ঠিক কী বোঝাতে চায় নেকড়ে। কুকুরের আর এক বন্ধু ছিল বেড়াল। পিছনের একটা পা নাই তার। লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে হয় তাকে।  জঙ্গলে যাওয়ার সময় বেড়ালকে সঙ্গে নিল কুকুর।
দূর থেকে কুকুরকে আসতে দেখেছে নেকড়ে। কিন্তু তার সাথে আর একজন কে? লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। পেছনে আবার কিছু একটা উঁচিয়ে রেখেছে দেখছি।
ভালুককে জিজ্ঞেস করল—কুকুরের সাথে ওটা কে বল তো? 
কুকুর যে কাউকে সাথে নিয়ে আসবে, ভালুক জানত না। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল রাস্তার দিকে। 
আসলে হয়েছে কী, একটা পা নাই বেড়ালের। লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে হয় তাকে। তাই শরীরের ভারসাম্য রাখবার জন্য, লেজখানা বাতাসে উঁচিয়ে রাখে সে। তখন একেবারে উঁচানো তরোয়ালের মত লাগে লেজটাকে। 
চোখে পড়তেই, ভয়াণক ঘাবড়ে গেল ভালুক। বলল—আরে, ওটা তো বেড়াল। দেখছ না, পাথর তুলে আনছে আমাদের মারবে বলে। পিছনে আবার একটা তরোয়াল এনেছে লুকিয়ে। তোমার বন্ধু কুকুরও মনে হয় খুব খেপে আছে।  এক্ষুনি সরে পড়তে হবে আমাদের। নইলে আজ আর রেহাই নাই।
ভালুক তাড়াতাড়ি একটা ঝোপের আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল। নেকড়ে আর কী করে। আঁচড়ে কামড়ে একটা গাছে চড়ে পড়েছে। কুকুর আর বেড়াল যখন এসে পৌঁছল, কেউ নাই কোথাও। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। 
এদিক ওদিক তাকাতে গিয়ে, ভালুকের একটা কান চোখে পড়ে গেল বেড়ালের। ঝোপের উপর উঁচিয়ে আছে কানটা। বিড়াল ভাবল সেটা ইঁদুর। সে গিয়ে কপ করে কামড়ে ধরেছে। ভালুক ককিয়ে উঠল—আমাকে ছেড়ে দাও গো। আমার কী দোষ? তোমরা যাকে খুঁজছো, তাকিয়ে দেখো, সে তো তোমাদের ঠিক মাথার অপরে। 
ধরা পড়ে গিয়ে, গাছ থেকে নেমে এল নেকড়ে। নিজের বন্ধুর সাথে এমনটা করবার জন্য, নেকড়ে খুব দুঃখ প্রকাশ করল। আর কখনও এমন ভুল হবে না। এইসব নানা কথা বলে, মিট্মাট করে নিতে চাইল। কুকুরও কোন আপত্তি করল না।
সেদিন থেকে কুকুর, নেকড়ে, ভালুক আর বেড়ালের মধ্যে কোন বিবাদ নাই। মিলে মিশেই বাস করে চার জনে।

Post a Comment

0 Comments