জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৭৯ /বিজন সাহা

দুবনায় লেনিনের স্ট্যাচু যা পৃথিবীতে দ্বিতীয় বৃহত্তম

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৭৯ 

বিজন সাহা 

দুবনা – ইতিহাসের পাতা থেকে  

দুবনা, ভোলগা তীরের ছোট্ট এক শহর, ১৯৯৪ সাল থেকে আমার স্থায়ী নিবাস। বাংলাদেশে আমার জন্ম কালীগঙ্গা নদীর তীরে তরা গ্রামে। সেই নদীর তীরে খেলাধুলা করেই আমার বেড়ে ওঠা। তাই এখানে যখন ভোলগার তীরে হাঁটি, মনে হয় আমি যেন আমার কালীগঙ্গার তীরেই হাঁটছি। তাই দুবনার সাথে আমার মনে হয় এক আত্মিক সম্পর্ক যার শুরু ১৯৯৪ সালে নয়, ১৯৬৪ সালে আমার জন্মের সময় থেকে। ছাত্রজীবনে ইয়ারোস্লাভল থেকে জাহাজে করে মস্কো যাই। তাই দুবনা হয়েই যে গেছি তাতে সন্দেহ নেই। তবে সেই সময়ের দুবনার কথা আমার কিছুই মনে নেই, মনে নেই কখন কীভাবে এই শহরের ভেতর দিয়ে চলে গেছি। এ ছাড়াও ছাত্র জীবনে একবার দুবনায় এসেছিলাম। তৃতীয় বর্ষের ছাত্র হিসেবে। আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কোলাইডার দেখাতে। সে সময় দুবনা ছিল বদ্ধ শহর, বিদেশীদের আসতে মানা। কেন, সে গল্পে পরে আসছি। আমরা এসেছিলাম বাসে করে। গেছিলাম লেনিনের মূর্তির পাদদেশে। দুবনার লেনিনের স্ট্যাচু দ্বিতীয় বৃহত্তম। সবচেয়ে বড় স্ট্যাচু ভোলগাগ্রাদে ভোলগা-দন কানালের মুখে। সে বিষয়ে আমরা আগেই জেনেছি। দুবনা থেকে শুরু হয়েছে মস্কো কানাল। কানালের দুই দিকে দুটো স্ট্যাচু – একটি লেনিনের, আরেকটা স্তালিনের। তবে স্তালিনের কাল্টের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় তাঁর স্ট্যাচু ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। সেখানে রয়েছে সুন্দর বেদী। লেনিনের বেদী অবশ্য সাদামাটা, তবে ইতিহাস প্রমাণ করল – দীর্ঘস্থায়ী। সেদিনের কথা এখনও মনে আছে। আমি আর আমার রুমমেট শ্রীকুমার বেশ মজা করছিলাম এই স্ট্যাচু নিয়ে। সেখান থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় নিউক্লিয়ার রিয়াক্টর ল্যাব্রেটারিতে কোলাইডার দেখাতে। এরপর আমার পড়াশুনা শেষ হয়। পিএইচডি করার সময় আমার সুপারভাইজার ইউরি পেত্রোভিচ রীবাকভ বলেছিলেন এক বছরের জন্য হলেও যেন দুবনায় কাজ করে যাই। আমি রাজী হইনি। তবে ১৯৯৩ সালে যখন থিসিস ডিফেন্ড করলাম তখন ব্যক্তিগত কারণে রাশিয়ায় থাকা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ালো। এবার আমি রীবাকভের শরণাপন্ন হলাম। এভাবেই আমার দুবনা আসা। মনে আছে প্রথম দিনের কথা। এটা মনে হয় মার্চের কোন এক সোমবার। ইউরি পেত্রোভিচ ব্যস্ত থাকায় আসতে পারেননি। কীভাবে যেতে হবে সেটা জানিয়ে একটা নম্বর দিয়ে পাঠালেন। সে সময় আমরা লোকাল ট্রেনে সাধারণত যাতায়াত করতাম না। এক্সপ্রেস ছিল সকাল সাতটার দিকে। তখনও টিকেটের অভাব ছিল বলে মনে হয়েছিল। তাই খুব ভোরে রওনা হলাম সাভিওলভস্কায়া স্টেশনের দিকে – প্রথম মেট্রোয়, মানে ভোর ৫.৪০ এ। গিয়ে দেখি সব বন্ধ। এক ভদ্র মহিলা সেখানে বসা। ওনাকে জিজ্ঞেস করায় বললেন কোন ট্রেন যাবে, কখন যাবে। দেখি ৪ বগির ছোট্ট একটা ট্রেন। খেলনা ত্রেনের মত। যাহোক, ঘণ্টা দেড়েক অপেক্ষার পরে ট্রেন ছাড়ল। দুবনায় এসে ভ্লাদিমির মিখাইলোভিচ দুবোভিককে ফোন করায় বাসায় যেতে বললেন। উনি হবেন এখানে আমার প্রথম মেন্টর। সে এক বিরাট গল্প। যদি কখনও দুবনায় আমার জীবন নিয়ে লিখি তখন বলব। পরের সপ্তাহে একটি সেমিনারের আয়োজন করা হল। এভাবেই আমি দুবনায় স্থায়ী হয়ে গেলাম। কাজের শুরু ১৯৯৪ সালের ১৮ মে। দুবনায় প্রথম বারের মত দুবনা ডে বা দুবনার দিন পালন করা হয় ১৯৮৬ সালে। যদিও ১৯৩৭ সালে মস্কো সাগর ও মস্কো কানালের জন্মের সাথে দুবনার জন্মও ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং সে সময় ইভানকোভা শহরের গোড়াপত্তন, তবে বর্তমানে দুবনার জন্ম সাল ধরা হয় ১৯৫৬ সাল, যখন এখানে জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ গঠন করার ব্যাপারে সোভিয়েত মন্ত্রী সভার নির্দেশ জারি হয়। সেদিক থেকে দুবনার বয়স এখন মাত্র ৬৮। তবে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে জানি দুবনা মস্কোর প্রায় সমবয়সী। একদিক দিয়ে এটা ঠিক। কেননা আমাদের ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পরেই দুবনা তার বর্তমান নাম পায় আর আশেপাশের সব জনপদ দুবনার অন্তর্ভুক্ত হয়।  

    শুধু গরমের সময় এখানে ভোলগার বুকে জাহাজ চলতে দেখা যায়

তবে সেটা আধুনিক ইতিহাস। ঐতিহাসিকরা ভিন্ন কথা বলেন। ঐতিহাসিক উসপেনস্কায়ার মতে প্রাচীন রাশিয়ায় দুবনা নামে জনপদের উপস্থিতি ছিল যার উদ্ভব দ্বাদশ শতকের শুরুতে। দুবনার উপকণ্ঠে রাতমিনো নামক জনপদে দ্বাদশ – ত্রয়োদশ শতকের এক জনপদ পাওয়া গেছে খননকার্যে। সেই শহরের আয়তন ছিল ৬ হেক্টর। এ থেকে প্রমানিত হয় যে প্রাচীন কালে দুবনা ভেলিকি নভগোরাদ ও উত্তরপূর্ব রাশিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত শহর ছিল। স্থানীয় ঐতিহাসিকদের মতে দুবনার সম্পর্কে প্রথম লিখিত উল্লেখ পাওয়া যায় ১১৩৪ সালে পঞ্জিকায়। রোস্তভ-সুজদাল ও নভগোরাদ রাজ্যের সীমান্তে এই শহরের গোড়াপত্তন করেন যুবরাজ ইউরি দলগোরুকি। উল্লেখ করা যেতে পারে যে যুবরাজ ইউরি দলগোরুকি ১১৪৭ সালে মস্কো ও ১১৫৪ সালে দ্মিত্রভ প্রতিষ্ঠা করেন। সেদিক থেকে দুবনা মস্কোর চেয়েও পুরানো। ১২১৬ সালে নভগোরাদের রাজা মস্তিস্লাভ উদাতি দুবনা পুড়িয়ে দেন। তখন দুবনার রাজা ছিলেন ইয়ারোস্লাভ। তবে দুবনা সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ১২৩৮ সালে মঙ্গোলদের আক্রমণের সময়। পরবর্তীতে এখানে সীমান্ত ফাঁড়ি ছিল। আর দুবনা নদী যেখানে ভোলগায় পড়ছে সেখানে গড়ে উঠেছিল গরদিশে নামে এক গ্রাম আর জমিদারের গ্রীষ্ম প্রাসাদ। 

🍂

মস্কোয় নিয়মিত জল সরবরাহের জন্য ১৯৩২ – ১৯৩৭ সালে মস্কো কানাল তৈরি করা হয়। এ জন্যে দ্মিতলাগ বলে এক গুলাগ তৈরি করা হয়। এর কেন্দ্রীয় অফিস ছিল দ্মিত্রভে। আর বন্দীরা বাস করত কানাল ববাবর অস্থায়ী বাসস্থানে। ১৯৩৫ সালে এই বন্দীরা ভেরবিল্কি থেকে বলশায়া ভোলগা পর্যন্ত রেললাইন স্থপন করে। এখনও সেই লাইনেই দুবনা – মস্কো ট্রেন চলাচল করে। সেই সময়েই তৈরি হয় দ্মিত্রভ থেকে বলশায়া ভলগা পর্যন্ত হাই ওয়ে এ-১০৪। ১৯৩৭ সালে মস্কো কানাল দিয়ে নৌযান যাতায়াত শুরু করে। কথিত আছে মস্কো কানাল তৈরি করতে শত সহস্র বন্দী প্রাণ হারিয়েছে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত বিমান যার ইতিহাস দুবনার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত

১৯৩৭ সালের ১০ অক্টোবর রাশিয়ার মন্ত্রী সভা ইভানকভা ও আশেপাশের জনপদকে শ্রমিক পল্লী হিসেবে ঘোষণা করে। সেই সময় ৩০ নম্বর ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়ে যায়। ১৯৪০ সালে বলশায়া ভোলগা স্টেশন মস্কো রেলওয়ের কাছে হস্তান্তরিত করা হয়। এভাবেই গড়ে ওঠে শ্রমিক পল্লী ইভানকভা। পরবর্তীতে ভোলগার বাম তীরে হাইড্রোপ্লেন কারখানা তৈরি হয় আর এর সাথে জড়িত শ্রমিক পল্লীর নাম হয় নভস্ত্রইকা। ভোলগার বাম তীরের এলাকার নাম হয় পাদবিরিওজা আর দক্ষিণ তীরের – বলশায়া ভোলগা। পরবর্তীতে এখানেই গড়ে ওঠে নতুন শহর। ১৯৪১ সালের নভেম্বর মাসে যখন ইভানকভা জার্মান সেনাবাহিনীর দখলে চলে যাবার সম্ভাবনা দেখা দেয় তখন ভোলঝস্কায়া বাধ সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য বিশেষ বাহিনী তৈরি   করা হয়। ১৯৪৩ সালের মে-জুন মাসে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী জার্মানির একটি বাধ ধ্বংস করলে দুবনার বাধের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করা হয়। ১৯৪৩ সালে শেষ থেকে ১৯৪৪ সালের মে মাস পর্যন্ত ইভানকভায় মহিলা সেনাবাহিনী অবস্থান করে। ১৯৪৫ সালে ১৮ অক্টোবর নাগরিক কমিসারদের সোভিয়েত এখানে ডাইরেক্ট কারেন্টের বৈজ্ঞানিক গবেষণা কেন্দ্র  ও একটি ফ্যাক্টরি তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তীতে এই প্রতিষ্ঠান মস্কোয় স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসে জার্মানির ইউঙ্কারস ও জিবেল কোম্পানির প্রায় ৫০০ বিশেষজ্ঞ এখানে আসে। কথিত আছে সেই সময় ফ্রাউ-২ মিসাইল তৈরির পুরো কারখানা জার্মানি থেকে দুবনায় স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানে তৈরি হতে থাকে বিভিন্ন বিধ্বংসী মিসাইল। বিশেষ করে সী টু সী – যা আমেরিকান নৌবহরের মৃত্যু বাণ বলে আখ্যায়িত করা হয়। এ কারণেই শহর তখন বিদেশীদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। আর ৩০ নম্বর কারখানার নাম থেকে এখনও দুবনার বাম দিকের অংশকে ত্রিসসাদকা বলে ডাকা হয়। এখানে যেসব জার্মান বিশেষজ্ঞ কাজ করেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্রুনলফ ব্যাডে আর হাইন্স রেইসিং। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে দুবনায় গবেষণা কেন্দ্র গড়ে ওঠে ১৯৫৬ সালের আগেই, ১৯৪৬ সালে। আর প্রথম দিকে এখানে যারা কাজ করেন তাদের একজন ছিলেন ইয়াকভ পেত্রোভিচ তেরলেৎস্কি। উনি পরবর্তীতে গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান অনুষদ প্রতিষ্ঠা করেন। আমিও তাঁর ছাত্র ছিলাম। তবে দুবনা তার বর্তমান রূপ পেতে শুরু করে ১৯৫৬ সালে জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ প্রতিষ্ঠা হবার পর থেকে। সে গল্প আমরা পরের পর্বে করব।                        

ছবিতে দুবনা    

http://bijansaha.ru/album.php?tag=61

দুই প্লেনের কাহিনী 

http://bijans.ru/album.php?tag=296

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇


Post a Comment

0 Comments