ছেচল্লিশতম পর্ব
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
সময়ের গতি একমুখী,অবিরল। প্রতিটি সকাল তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে নতুন হলেও তা গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়,দিন যায়,মাস,ঋতু,বছর।একটি ছোট্ট শিশু মায়ের কোল ডিঙিয়ে হাঁটতে শেখে,ক্রমে তার টলোমলো পদক্ষেপে ঋজুতা আসে,বই-খাতা-পাঠশাল,জীবন চর্যা। আমৃত্যু সে যাত্রা থামে না,সময়ের মতোই। থামার উপায়ও যে তার নেই।
তাই হয়তো প্রায় বছরাধিক কাল বিরজার জীবনগতি থমকে গেলেও তাঁর চারিদিকের জীবনপ্রবাহ স্তব্ধ হয়নি। সেই আগের বছর পুজোর আগে কেমন করে যেন তিনি পড়ে গিয়েছিলেন ঘুমের ঘোরে,তারপর থেকেই বিছানাবন্দী,বাস্তবের জীবন থেকে অনেক দূরে।
সেই যে সেদিন, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, সারা গায়ে অসহ্য ব্যথা, ঘরে খুব ভীড়,কে যেন বারংবার তাঁর হাত ধরে কিছু বলছিল, তিনি কিছুই বুঝতে পারছিলেন না।
জ্যাঠামশাইয়ের কাছে শুনেছিলেন, মৃত্যুর আগে নাকি মানুষ তার জন্ম ঋণের ভার ক্ষণিকের জন্য হলেও শোধ করতে চায়।সত্যিই,নতুন বৌটি বাড়িতে আসার পরে পরে বিরজার এমনই যেন এক ভাবান্তর হয়েছিল।শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তির বিলিব্যবস্হা এবং দানপত্রের জন্য মন উতলা হয়ে উঠছিল।তাছাড়া তাঁর নিজস্ব হিসেবের খাতাটি,যাতে লেখা আছে বন্দকী তৈজসপত্র-গয়নাগাটির তালিকা,সেটিও হস্তান্তরের প্রয়োজন ছিল।
প্রায় পনের বছর আগে বিয়ে হয়ে আসা ছোট দাদার বড়োছেলের বৌটি মানুষ হিসেবে খুব ভালো,সারাদিন সংসারের কাজেকর্মে নিজেকে ব্রতী রাখে।কিন্তু বিষয়ী সে তেমন নয়।ভেবেছিলেন,শিক্ষিত নতুন বৌটিকে আস্তে আস্তে নিজের উত্তরসূরী করে গড়ে তুলবেন।
এমনই কোন এক হেমন্তবেলায় ঠিক যেভাবে জ্যাঠাইমা দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁকে পারিবারিক এই উত্তরাধিকার।
সেও ছিল কোন এক পুজো শেষের কাল। দুগ্গাপুজোয় তেমন ঘটাপটা না হলেও প্রতিবছর লক্ষীপুজোটা জ্যাঠাইমা ভালো করেই করতেন।হয়তো সামান্যই আয়োজন, সারাদিনের আয়াসসাধ্য শ্রমে নিজের হাতে বানানো নারকেল নাড়ু,গুড়পিঠে,লুচি,মোহনভোগ, খিচুড়ি -পায়েসের নৈবেদ্য। কিন্তু সেইসব রাতে,সারা পাড়ার মেয়ে পুরুষের নিবিড় সাহচর্যে পিটুলিগোলা পদ্মলতার মাঝে পদ্মাসনার মুখটি যেন প্রদীপের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠতো।সে আলোর উদ্ভাস এসে পড়তো ব্রতীর মুখে,আকাশভরা চাঁদের আলোও যেন সে আলোয় ম্লান ঠেকতো সবার চোখে।
রাতে সারা পাড়ার লোকের হাঁড়িবন্ধের নেমন্তন্ন থাকতো তাঁদের বাড়িতে,পুজো শেষে হ্যারিকেনের আলোয় দাওয়া জুড়ে কলাপাত পেতে খাওয়া।
আর পাঁচটা সচ্ছল বাড়ির মতো তাঁদেরও তুলসী মঞ্চ একদিকে রেখে তৈরি উঠোনের তিনধার ঘিরে ছিল মাটির দোচালা বাড়ি। দাওয়া পেরিয়ে উঠলেই মাঝে সিঁড়ি,দুপাশে দুটি ঘর।দুইটি তলা বসবাসের জন্য হলেও বাড়ির তৃতীয় তলটি সামান্য নীচু কাঠামো করে চাল ছাওয়া হতো,কয়েকটি ফাঁক ফোকর থাকলেও জানালা ছিল না।সেখানে জমা থাকতো তোলা বাসন,পাথরের,কাঁসা পিতলের।দুভাগ করে।ছোট থেকেই বিরজা লক্ষ করতেন, পুজো আচ্চার আগে জ্যাঠাইমা তাঁকে সঙ্গে নিয়ে তেতলার বাসন নামাতেন। সেই বারেও তার ব্যত্যয় হয়নি।এমনিতে বিরজার কৌতুহল কম,তবু সেবছর, হঠাৎ বাসন নামাতে উঠে জ্যাঠাইমাকে জিজ্ঞেস করেছিল সে,
-’হ্যাঁগো জ্যাঠাইমা, প্রত্যেক বছর আমরা বামদিকের বাসনা নামাই,তুলি।ডানদিকের গুলোয় হাত দাওনা কেন গো!’
একটানে তিনতলায় উঠে আসা সামান্য পৃথুলা মধ্যবয়সিনীর তখন খানিক হাঁপ ধরেছে সিঁড়ির চড়াই ভেঙে;নাকের তলায় ঘাম।
আঁচলে তা মুছে, খানিক জিরিয়ে জ্যাঠাইমা তারপর তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন ডানদিকের মেঝেয়,একটা নীচু তক্তপোষের ওপরে রাখা বাসনকোসন সরিয়ে বসে বলেছিলেন,
-’অনেকদিন ধরেই তোকে বলবো ভাবছিলাম। জিজ্ঞেস করে ভালোই করলি।
আসলে এ বাসনগুলো আমাদের নয়।’
-’তাহলে কাদের?’
-’পাড়া প্রতিবেশীদের। যখন কারও কোন বিপদ হয়, হঠাৎ টাকার দরকার হয়, তাদের কিছু জিনিষ,তার সে সোনা রুপা বা কাঁসার বাসন রেখে টাকা নিয়ে যায় বাড়ির মেয়েরা,অল্প সুদও নিই।
পরে সময় সুযোগমতো টাকা শোধ করে সেগুলো আবার ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
ঐ যে বড়ো হাঁড়িটা দেখছিস,ওর তলায় একটা বিস্কুট কৌটোয় সোনার গয়নাও আছে,একটা হিসেবের খাতাও আছে। ওখানে সব লেখা আছে।’
-’তাই? কিন্তু তুমি কেন এসব করো?এ তো পাপ!’
সুদের ব্যাবসা!’
🍂
সদ্য শরৎচন্দ্র পড়া তরুণীর মনে যেন দেবীস্বরুপিনীর নীচ মানসিকতা প্রকাশ হয়ে পড়ায় স্বপ্নভঙ্গের ক্লেশ…
-’ওরে! মানুষকে এমনি দয়া করলে তাকে খাটো করা হয়।এই যে সে কিছু দিয়ে কিছু নিয়ে যাচ্ছে,তার তাগিদ থাকছে,পরে তার জিনিষ উপযুক্ত মূল্যে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার, আত্মসম্মান নিয়েই সেটা সে করছে।’আমি না রাখলে ওরা শহরে যাবে। দুষ্টু লোকেরা ওদের ঠকিয়ে নেবে।গরীব মানুষগুলোর সামান্য সম্পদটুকুও তো শেষ হয়ে যাবে।’
এখনও মনে পড়ে,শেষ বিকেলের সেই হৈমন্তী আলো-আঁধারি মায়ায় অন্য এক দেবোত্তর ঐশীরূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন বিরজা আপনার সাধারণী মাতৃকারূপের অন্দরে। ঠিক বোঝেননি সেদিন,তবে পরে পরে যখন ঐ কর্মকান্ডের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তখন বুঝতে পেরেছিলেন জ্যাঠাইমা কতোখানি সঠিক ছিলেন।
যাই হোক, সেই শুরু।তারপরে তারসঙ্গে যুক্ত হয়েছে হাঁস পালন,সবজী নৌকায় এলাকার সবজী পরিবহনে নৌকা ভাড়া খাটানো, আরও কতো কি!
যদিও ব্যাপারটার শুরু হয়েছিল হঠাৎ করেই।বিরজা জানেননা তাঁর আগে কেউ এভাবে এমন কাজ এই এলাকায় শুরু করেছিলেন কিনা…
তবে ঘটনা হলো এই যে,সেবছর বর্ষার ফসল হয়েছিল খুব ভালো,ফলে এলাকার হাটে তার দাম মিলছিল না মোটেও। প্রতিদিন হাট থেকে ফিরে ব্যাজার মুখে চাষী বলতো,’বাজার ভ্যাস্তা…’
অথচ তমলুকে ডেলি-প্যাসেঞ্জারী করা ভাইপো বলতো,ওদিকটায় বাজারে সবজী অগ্নিমূল্য।
তখনও তো যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন উন্নত হয়নি,ধান-পাট ইত্যাদি বড়ো ফসল ছাড়া এলাকার সাথীফসল এলাকাবাসীই ব্যবহার করতেন,বাইরে যেত না।কিন্তু তীর্থ ভ্রমণের সময় বারানসীতে দেখেছিলেন,নদীপথে পণ্য পরিবহণের ব্যবস্থা। সেই থেকেই তাঁর মনে হলো, যদি এখানেও তেমন কিছু…
যেমন ভাবা,তেমন কাজ।
নদীমাতৃক গ্রামগঞ্জে মানুষ জন নদী পারাপারের জন্য নদীঘাটের মাঝিকে কিছু তোলা দেয় বাৎসরিক,তাঁকে বলে ‘মাগন’। বছরের কোন একটা সময় এসে সে পাড়ায় বাড়ি বাড়ি ঘুরে তা নিয়ে যায়।সেটুকুই তার উপার্জন।বাকি সময় অন্যের জমিতে বেগার খেটে তার গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা হয়।বিরজা সেবার হারান মাঝি তার পারাণির মাগন নিতে এলে তাকে তার দিয়ে, জলখাবার খেতে দেওয়ার ফাঁকে তার কাছে পেড়েছিলেন সেকথা।শুনে মাথা চুলকে তার উত্তর ছিল,
-হ্যাঁ গো মা ঠাকরেন। শুধু নৌকা বাইয়ে তো সংসার চলেনা। মজুর খাটতেও তেমন পারিনা।এরম কিছু হলে তো…কিন্তু নৌকা যে আমার একটিই,আর সেটা তো লাগে বাপ-ঠাকুরদার পেশায়।’
-’তুই রাজি কিনা বল। টাকা পয়সা লাগলে, আমি দেব, আমাদের সবজী গুলোই নাহয় প্রথম প্রথম পৌঁছা।’
সেই শুরু।তারপরে হারানের নৌকা প্রতি সন্ধ্যায় এলাকার সবজী নিয়ে নদী পেরিয়ে কোলাঘাট যেত, সঙ্গে কিছু চাষী। মহাজনের কাছে মালপত্র বেচে ফিরে আসতো হাসিমুখে, খানিক বেশিই লাভ উঠতো ঘরে। নৌকা যেহেতু তাঁর, তোলা নিতেন তিনি জ্যাঠাইমার আদর্শে,তবে সেসব টাকার বেশ কিছুটা অংশ দিয়ে দিতেন এলাকার গরীব দুঃখী মেয়েদের বিয়ের জন্য অথবা কোন ভালো কাজে,কেউ চাইলে।
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments