জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোক গল্প— ২১৮কোরিয়া (এশিয়া)রাজার হাত থেকে রেহাই /চিন্ময় দাশ

চিত্র- অর্ণব মিত্র 
দূর দেশের লোক গল্প— ২১৮
কোরিয়া (এশিয়া)
রাজার হাত থেকে রেহাই
চিন্ময় দাশ

অনেক কাল আগের কথা। 
আমরা যাকে প্রশান্ত মহাসাগর বলি, আদতে তার নাম কিন্তু দক্ষিণ সমুদ্র। সারা দুনিয়া সেই নামেই ডাকে তাকে। দুনিয়ার খুব গভীর আর বড় একটা সমুদ্র। ড্রাগন রাজার বাড়ি ছিল সেই সমুদ্রের তলায়।
একবার সেই ড্রাগন রাজার অসুখ। অসুখ, মানে ভারি অসুখ। বাঁচে কি বাঁচে না-- এমন অবস্থা। কবরেজ-বদ্যির দল কিছু করে উঠতে পারছে না। কত চেষ্টা, কত চিকিৎসা। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। রাজার আর সেরে উঠবার কোনও লক্ষ্মণ নাই।
একদিন হামাগুড়ি দিতে দিতে এক সীল এসে হাজির রাজার দরবারে। সে বলল—কোনও ঔষধে সারবে না রাজার এই অসুখ। একটা পথ্য আছে। সেটা পেটে পড়লে, দুদিনেই সেরে উঠবেন রাজা। 
গোটা দরবার হইহই করে উঠল—কী সেই পথ্য? কোথায় পাওয়া যাবে?
--একটাই জিনিষ। তবে, আমাদের এই জলের রাজ্যের কোথাও নাই। আছে সেই ডাঙায়। সেটা হোল-- খরগোশের কলজে। সেই জিনিষ এনে দেওয়া হোক রাজাকে। নির্ঘাৎ উঠে বসবেন  তাতে।
তিমি হোল রাজার মহামন্ত্রী। সে বলল—জলের রাজা সারবে ডাঙার পথ্যিতে? অন্য কোন নিদান নাই তোমার কাছে? 
সীল এককাট্টা। অবিশ্বাসের কী আছে? পরখ করে দেখলেই হয়। হাতেনাতে প্রমাণ হয়ে যাবে। রাজা বলল—কথা বাড়িয়ে লাভ নাই। যেমনটা বলেছে, পথ্যি আনবার ব্যবস্থা করো।
কিন্তু আনো বললেই তো আর হয় না। আনে কে?
তিমি, হাঙর, স্কুইড, রাজগলদা, পেঙ্গুইন, ডলফিন আর কাঁকড়া—এই সাতজন হোল ড্রাগন রাজার সাত মহারথী। সাতজনকে ডেকে রাজা বলল—তোমরা আলোচনা করে ঠিক করো, কে যাবে পথ্যি আনতে। 
রথী হোক, বা মহারথীই, আসলে কিন্তু এই সাতজনই হোল রাজার চাটুকার। রাজার কথার পোঁ ধরতে এদের জুড়ি নাই। এখন কাজের দায় নিতে হবে, সাতজনেই চুপ। সাতজনেই মাথা চুলকায়। জলের জীব তারা। তাদের যত কেরামতি, সব এই জলে। ডাঙায় যেতে কেউ রাজি নয়। 
ভয়াণক সমস্যা। পথ্যের নিদান পাওয়া গেল। কিন্তু পথ্য আনা যাচ্ছে না।
তখন থপ থপ করে এক কচ্ছপ এসে হাজির। জলের জীবদের মধ্যে, কচ্ছপের আয়ু সবচেয়ে লম্বা। কতকাল যে বেঁচে থাকে কচ্ছপ, লেখাজোখা নাই কোন। তবু ড্রাগন রাজা তাকে মান দেয় না, এই নিয়ে ভারি খেদ তার মনে। সে ভাবল, এইবারে রাজাকে দেখাব আমার কাজ।
কচ্ছপ বলল—দরবার থেকে যদি আমাকে ভার দেওয়া হয়, কাজটা আমি করে দেব। 
সবাই রাজি এ কথা শুনে। রাজা বলল—তাহলে, আর দেরি নয়। এক্ষুণি রওণা হয়ে যাও। 
হাঁটবার বেলায় কচ্ছপের গতি খুবই কম। কিন্তু সাঁতরায় বেশ জোরেই। আর, জলের জীব হলেও, ডাঙাতেও সে দিব্বি বেঁচে থাকতে পারে। কোন অসুবিধা হয় না। সেই কোন অতল পাতালপুরী থেকে, সাঁতরে ভেসে উঠতে লাগল সে।
জল ছেড়ে যখন উঠল, সামনে একটা বালির চড়া। টানা লম্বা চড়ার যেন শেষ নাই। জলের গা ছুঁয়ে ছড়িয়ে আছে। খানিক উপর দিকে এগিয়েছে। সামনে পুঁচকে একটা জীব। দুধের মত ধবধবে সাদা। পিছনের দুটো পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে।
কচ্ছপ বলল—নমস্কার, মশাই। আমার তো মালুম হচ্ছে, তুমি নির্ঘাৎ খরগোশ।
--হ্যাঁ, খরগোশই তো! তা, জানতে চাইছ কেন?
--জলের মহারাজ ড্রাগন পাঠিয়েছেন আমাকে। নতুন বছরের উৎসব হবে তাঁর প্রাসাদে। তাতে তোমাকে যেতে হবে অতিথি হিসাবে। তাই আমি এসেছি, সমাদর করে নিয়ে যেতে।
একজন মহারাজ অতিথি হিসাবে নিয়ে যাবেন তাকে! খরগোশ তো আহ্লাদে আটখানা। এমন সম্মান কেউ কখনও পেয়েছে বলে, শোনেনি সে। 
খরগোশ এক্টু গুমোর দেখিয়ে বলল—মহারাজ ডেকেছেন। না করব না। যাবোও না হয়। কিন্তু আমি তো সাঁতার জানি না। শেষে চোখেমুখে জল ঢুকে খাবি খাই আর কী! 
খরগোশ এক কথায় রাজি হয়েছে, কচ্ছপের তো আনন্দ ধরে না। সে বলল—সেটা তোমার ভাবনা নয়। আমি পিঠে চাপিয়ে নিয়ে যাব। বসে থাকা ছাড়া, কিচ্ছুটি করতে হবে না তোমাকে। জলের নীচে কত সুন্দর একটা জগৎ আছে। তোমরা ডাঙার জীব। সেই অপরূপ জগৎ দেখোইনি তোমরা। আর, আমাদের মহারাজের প্রাসাদ দেখলে, চোখ জুড়িয়ে যাবে তোমার, তিন ভূবনে এমন প্রাসাদ আর দুটি নাই। 
দেরি করে লাভ কী? খরগোশ টুক করে ছোট্ট একটা লাফে, কচ্ছপের পিঠে চড়ে বসল। সমুদ্রের যত নীচে নামছে, ততই আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে খরগোশ। কত রঙ জলের। কত রকমের জীব! একেবারে একটা কল্পনার দেশ!
ড্রাগন রাজার প্রাসাদে এসে যখন পৌঁছল, একটু থমকেই গেল খরগোশ। উৎসবের কোন চিহ্নই নাই কোথাও। হাসি নাই লোকজনের কারও মুখে। সবাই কেমন চিন্তাগ্রস্ত। চোখমুখ গোমড়া করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে একটু খটকা লাগল তার।
তবে একটা ব্যাপার চোখে পড়ল। বিশাল প্রাসাদ। চোখ জুড়ানো রূপ। সে আসাতে, একটা সাড়া পড়েছে প্রাসাদ জুড়ে। সবাই ভীড় করে আসছে, তাকে দেখে যাচ্ছে উঁকি মেরে।
এবার রাজার ঘরে নিয়ে যাওয়া হোল খরগোশকে। বিশাল একখানা পালঙ্কে শুয়ে আছেন রাজা। সেই সাত মহারথী ঘিরে আছে রাজাকে। তাকে দেখে চঞ্চল হয়ে উঠল সবাই। ফিসফাস গুজগাজ শুরু হয়েছে তাদের। তিমি বলে উঠল—যাক, আর কোন দুশ্চিন্তা নাই। রাজামশাই সেরে উঠবেন এবার। 
রাজা বলল—যাও, এবার সীলকে খবর দাও। সে এসে যা করবার করুক। 
মাথায় কিছু ঢুকছে না খরগোশের। ব্যাপারখানা কী? বুঝতে সময় লাগল না। রাজা নিজেই ভাঙল আসল ব্যাপারটা—আমি দুঃখিত, বাপু। আমার নিজের জীবন বাঁচাবার জন্য, তোমার জীবন নিতে হচ্ছে। তবে, মরবার আগে, জেনে যাও, আমাদের এই গোটা জলের জগৎ তোমার কাছে ঋণী হয়ে থাকল চিরকাল। তোমার অবদান আমরা কোন দিন ভুলব না। কোন দিন না।
কিছু একটা বিপদ যে তার সামনে, খরগোশ অনুমান করল। কিন্তু সেটা কী? সেটা কী রকম? সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। সরাসরি রাজাকেই জানতে চাইল খরগোশ—ব্যাপারটা ঠিক কী? একটু খুলে বলা যাবে?
ড্রাগন রাজা নিজের মুখে না বলে, তিমির দিকে তাকাল। তিমি বলল—শোন বন্ধু। আমাদের মহারাজের ভারি অসুখ। কিছুতেই উপশম হচ্ছে না। শেষমেষ একটা নিদান পাওয়া গেছে—খরগোশের কলজে খাওয়ালে, রাজামশাই সেরে উঠবেন। 
বুক ধড়াস করে উঠল খরগোশের। তাকে বোকা বানিয়েছে কচ্ছপ। মিথ্যে কথা বলে, নিয়ে এসেছে এখানে। একটু বাদেই কেটে ফেলা হবে তাকে। আয়ু আর বেশি ক্ষণ নাই।
তিমি বলল—সীলকে খবর দেওয়া হয়েছে। সে আসছে তোমার কলজে বের করবে। একটা কথা বলি তোমাকে। তোমার যদি শেষ ইচ্ছা থাকে কোনও, বলতে পারো। সেটা পূরণ করা হবে।
খরগোশ বুঝে গেছে, বাঁচতে হলে মাথা খাটাতে হবে তাকে। সে বলল—আমি ভাবছি, সীল এই খবরটা জানল কী করে?
রাজা বলল—কেন বল তো?
--আমরা থাকি ডাঙার বনে-জঙ্গলে। গল্প ফাঁদতে শুরু করেছে খরগোশ-- সেখানে বনের রাজা হোল সিংহ। তো একবার এক সিংহিমশাইর কঠিন ব্যারাম হয়েছিল। সেসময় আমারই ঠাকুর্দার কলজে খেয়ে, তবে সেরে উঠেছিলেন রাজামশাই। কিন্তু খরগোশের কলজে খেলে, রাজামশাইরা সেরে ওঠেন, এটা তো খুবই গোপন কথা। সীল জানল কী করে? 
ড্রাগন রাজা সে ভাবনায় গেল না। উলটে, ভারি পুলকিত হয়ে উঠল। খরগোশের কলজে খেলে যে সেরে ওঠা যায়, এটা এখন নিশ্চিত হওয়া গেছে। অতএব, আর দেরি করার দরকার কী। কাজটা সের ফেললেই হয়। 
মহারাজ খরগোশের উপর ভারি সদয় হয়েছে। বলল—কিন্তু তোমার শেষ ইচ্ছাটা বললে না তো? 
খরগোশ বলল—মহারাজ! আমি একটা পুঁচকে জীব। স্বয়ং মহারাজের জীবন বাঁচাবার সুযোগ আমার কপালে জুটতে যাচ্ছিল, এটা ভেবেই আমি ধন্য হয়ে গেছি। সত্যিই যদি তা পারতাম, এই তিন ভূবনে আমার মত গৌরবান্বিত কেউ হোত না।
কেউ বুঝতে পারছে না ব্যাপারটা কী! কী বোঝাতে চাইছে খরগোশ? মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে সবাই। রাজা বলল—বলছোটা কী তুমি? কিছুই তো মাথায় ঢুকছে না। খুলে বলো দেখিনি। 
খরগোশ বলল—বলব আর কী, মহারাজ? এমন সৌভাগ্য হাতছাড়া হয়ে গেলে, কার না কষ্ট হয়? 
--কেন, কেন? হাতছাড়া কেন?
--হাতছাড়া নয় তো, আবার কী? খরগোশ বলল—এমন একটা সুযোগ আমাকে দেওয়া হচ্ছে, সেটাই তো জানতাম না আমি। এমন একজন আকাট মুখ্যুকে পাঠিয়েছিলেন, খরগোশ জাতটাকে সে চেনেই না। মিথ্যে কথা বলে নিয়ে এসেছে আমাকে।
--সত্যি কথা বললে, কী হোত? রাজা জানতে চাইল।
--আসলে হয়েছে কী রাজামশাই। যেদিন থেকে জেনে গেছি, আমাদের কলজে অন্যের প্রাণ বাঁচাতে পারে, সাবধান হয়ে গেছি আমরা। কলজে আমরা সাথে রাখি না। এই যে আমার সাথে সীলের দেখা হোল, আমি ছিলেম সমুদ্রের বালিয়াড়িতে। আমি কি কলজে সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম নাকি? 
--তবে? সবাই একসাথে হামলে উঠল।
খরগোশ বলল—কলজে তো আমরা লুকিয়ে রাখি, যাতে কেউ নিয়ে নিতে না পারে। মিথ্যে না বলে, যদি রাজামশাইর অসুখের খবরটা বলা হোত আমাকে, এই বিপত্তি ঘটত না। আমারও এমন সৌভাগ্য হাতছাড়া হোত না। কলজেটা আমি সাথে নিয়ে আসতাম তা হলে।
রাজা আঁতকে উঠল এমন সংবাদে—হায় হায়। কী হবে এখন? কচ্ছপকে খবর দাও। আবার ডাঙায় যাক সে।
খরগোশ হেসে উঠল ফিকফিক করে—ও তো একটা আকাট মুখ্যু। ওর জন্যই তো এই অনর্থ। তাছাড়া, আমার কলজে ও গিয়ে কোথায় খুঁজে পাবে? আমি ছাড়া, দুনিয়ার আর কেউ জানে না, কোথায় রাখা আছে জিনিষটা। 
রাজা বলল—তা হলে তো মিটেই গেল সমস্যা। তুমিও যাও সাথে। জিনিষটা নিয়ে এসো।
খরগোশ তো এটাই চায়। কোন রকমে বেরিয়ে পড়তে হবে এখান থেকে। সে ভালোমানুষের মতো বলল—আপনি হুকুম করছেন। সে আমি নাহয় গেলাম। কিন্তু ফিরে আসবার কী দরকার আছে আমার? যে যাবে আমার সাথে, কলজেটা দিয়ে দেব তার হাতে, তা হলেই তো হোল।    

🍂

রাজা বলল—না, না। সেটি হচ্ছে না। কলজেটা তো দেবেই। তোমাকেও আসতে হবে সাথে। সেরে উঠে, বড়মাপের উৎসবের আয়োজন করব প্রাসাদে। তুমি হবে একমাত্র অতিথি। উপযুক্ত খাতিরদারী করা হবে তোমার। সীল যেমনটা বলেছিল তোমাকে। 
খরগোশ হাসিমুখ করে বলল—সে আপনি যা হুকুম করবেন, তেমনটাই হবে। আমি কি অমান্য করতে পারি? 
কচ্ছপকে ধরে আনা হোল। তার পিঠে চেপে, আবার ডাঙায় ফিরে চলল খরগোশ। যেই ডাঙা নাগালে এসেছে, ঝুপ করে কচ্ছপের পিঠ থেকে নেমে পড়ল খরগোশ। কচ্ছপকে বলল—বিদায়, বন্ধু। তাড়াতাড়ি ফিরে যাও। তোমাদের মুর্খ মহারাজ পথ চেয়ে শুয়ে আছে তোমার জন্য।
কচ্ছপ বলল— তোমার কলজেটা এনে দাও আমাকে। নইলে, বলো কোথায় আছে, আমি নিয়ে আসছি। 
--কলজে আবার কোথায় থাকে। আমার সাথেই ছিল। এখনও আমার সাথেই আছে। 
কচ্ছপ তো আকাশ থেকে পড়ল—তার মানে, তুমি মিথ্যে বলেছ সবাইকে? 
--তুমি কি সত্যি বলেছিলে আমাকে? যাক সেসব, পুরাণো কথা যেতে দাও। খরগোশ বলল—তোমাদের রাজা মারা পড়বার আগে গিয়ে বোল, ডাঙার জীবরা সরল হতে পারে। তবে, তাদের কলজেগুলো সাথে থাক বা না থাক, মগজটা সাথেই থাকে সব সময়। দরকার মতো সেটা খাটিয়ে নিতে পারি আমরা।
খরগোশ ফিরে যাচ্ছে বালি মাড়িয়ে। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে কচ্ছপ। খরগোশকে তাড়া করে ধরে ফেলবে, সে সাধ্য কি আছে কচ্ছপের? চেয়েই রইল বেচারা।
খানিক বাদেই খরগোশ ফিরে এসেছে। দূরে দাঁড়িয়ে বলল—একটা কথা তোমাকে বলি, বন্ধু। খালি হাতে ফিরে গেলে, রেহাই পাবে তুমি? মেরেই ফেলবে হয়তো। গল্পকথা শুনবে না কেউ। 
খরগোশের মাথা চিড়িক করে উঠল। ঠিকই তো। মহা বিপদে পড়তে হবে। খরগোশ বলল—আমি বলি কী, তার চেয়ে তোমার না ফেরাই ভালো। সাগরের এই কিনারা এলাকায় থেকে যাও। ফিরে গিয়ে কাজ নাই আর। 
কথাটা বেশ মনে ধরল। গভীর সমুদ্রের কথা ভুলেই গেল কচ্ছপ। ডাঙার কাছাকাছিই  থেকে গেল সেই থেকে।

Post a Comment

0 Comments