বার্লিনের ডায়েরি --৫৯ পর্ব। চিত্রা ভট্টাচার্য্য
(সিস্টিন চ্যাপেল-মাইকেলেঞ্জেলো )
নদীর উত্তাল জলস্রোতের মত সময় ভেসে চলেছে তার চলার সাথেই শ্রীময়ীর প্রতিযোগিতা। যেতে হবে বহু দূরের পথ। কত কিছু দেখার ,পরখ করার এখোনো বাকী। ঋষভ তাড়া লাগায় এত আস্তে হাঁটলে কিছুতেই হবে না ! আরোজোরে পা চালাও। শ্রী দেখতে পায় তিতির ও ঋষভ অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়েছে। তিতির পেছন ফিরে তাকায় , ওর ভয় ও আশঙ্কা এত জনসমুদ্রে পথ ভুলে যদি মা হারিয়ে যায়?
শ্রীময়ীর মনে উত্তাল তরঙ্গ , সৃষ্টির এক ভুবননন্দিত আকর্ষণ সিস্টিন চ্যাপেলের অন্দরমহলের দেওয়ালে সিলিঙে রয়েছে। যার বিশ্ববন্দিত খ্যাতি প্রধানত অতুলনীয় ফ্রেস্কোচিত্র তে চ্যাপেলের অভ্যন্তরকে নিখুঁত শিল্পসৌন্দর্যে তিলেতিলে সাজিয়ে তুলেছে। এত কাছে এসেও তাকে না দেখে কোনোমতে ফিরে যাওয়া চলবে না। বিশেষ করে সিস্টিন চ্যাপেলের সিলিং এবং দ্য লাস্ট জাজমেন্ট -- দুই ই শিল্পী মাইকেলেঞ্জেলোর এক অসাধারণ অনুপম সৃষ্টি ।
ভ্যাটিকান মিউজিয়ামের গ্যালারি এতক্ষণ স্রষ্টা রাফায়েলের সৃষ্টির শিল্প ধারায় মুখরিত ছিল। এখন প্রবাদপ্রতিম শিল্পীদের অন্যতম আর এক স্রষ্টা মাইকেলেঞ্জেলোর সৃষ্টির সাথে ওদের চাক্ষুষ পরিচয় হবে । শ্রী চলেছে প্রায় হাওয়ার গতিতে তবুও এই লম্বা পথ কিছুতেই শেষ হতে চায় না। অবশেষে সরু একটি প্রবেশের গলি পথ ধরে কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে পৌঁছোনো গেল চ্যাপেলের সিংহ দুয়ারে। সেখানে ও স্বল্পপরিসরের জায়গায় যথেষ্ট ভিড়। বিশাল দর্শনার্থীর লাইন টি সর্পিল গতিতে এগিয়ে চলেছে। বাইরে থেকেই দেখা যায় ঘর ভরে আছে মানুষের মাথার ভিড়ে। তবু ও একঅখন্ড নিস্তব্ধতা চারিদিক বিরাজ করছে।
🍂
ঢুকতেই নিরাপত্তারক্ষী দের সতর্কবার্তা ক্যামেরা বা মোবাইল ফোন ব্যবহারে কোনো ছবি তোলা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। নীরবতা এবং শৃঙ্খলা বজায় রেখে চলতে হবে। দর্শকের জনসমুদ্রের ঢেউ কেমন করে এসে উপাসনা গৃহের পূজাবেদী তলের সামনে ক্লান্তি বিহীন ভাবে নীরবে আছড়ে পড়ছে। তবুও নিবিড় নিস্তব্ধতায় শুধু মানুষের নিঃশ্বাস মৃদুলয়ে পায়ে চলার শব্দ। চ্যাপেলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে শ্রী ও অদ্রিজার ভারী চমক লাগে, ওরা নীরব চোখে তাকিয়ে থাকে। অসামান্য মানব প্রতিভার এমন শৈল্পিক বিকাশের ধারায় স্তব্ধ বিস্ময়ে শুধু বিস্ফারিত চোখে দেখার পালায় যেন খামতি না থাকে। বিশ্বভুবন নন্দিত আকর্ষণটির যেদিকে তাকিয়ে দেখাযায় --ধীরেধীরে তার গভীর রহস্যের জাল শ্রীময়ীর চোখের সামনে ছড়িয়ে পড়ে। সর্বইন্দ্রিয় দিয়ে তাকে খুঁটিয়ে পরখ করে চলেছে ঋষভ ও । সেই মুহূর্তে বাস্তব ছেড়ে বিশাল এক স্বপ্নময় কল্পলোকের জগতের বাসীন্দা হয়ে শ্রী চলে গিয়েছিল আধুনিক যুগের ইন্টারনেটের সভ্যতা থেকে রেনেসাঁসের যুগ--যুগান্তর পেরিয়ে পৃথিবীর সৃষ্টির কোন আদি রহস্যের কাণ্ডে। বাইবেলের সৃষ্টিদূতের সেই অন্তহীন মায়ার জগতের আদিতত্ত্বে। আদম-ঈভের স্বর্গোদ্যানের মহাসভায়। অদৃশ্য সৃষ্টি কর্তার নির্দেশে মানব জন্মের শুভ লগ্নের ইতিহাস রচনার অলিখিত তথ্যের কালে।
সিস্টিন চ্যাপেল
সিস্টিন চ্যাপেলের কথা লিখতে বসে শ্রীর প্রফেসর অন্বেষণ কে বারবার মনে পড়ছিল।প্রাগের পথে বেড়ানোর সময় সিস্টিন চ্যাপেল ও ভ্যাটিকান সিটির আলোচনায় ও বলেছিল --অ্যাপোস্টলিক প্রাসাদের একটি চ্যাপেল যা ভ্যানসাইড সিটিতে পোপের সরকারি আবাসস্থল। যিনি এটি ১৪৭৩ সাল থেকে ১৪৮৩ সালের মধ্যে তৈরি Sacellum Sixtinum ; সেটি মূলত ক্যাপেলা ম্যাগনা ('গ্রেট চ্যাপেল') নামে পরিচিত ,পোপ সিক্সটাস IV থেকে এর নামটি নেওয়া হয়েছে। সেই সময় থেকে,এটি ধর্মীয় এবং কার্যকরী উভয় ধরনের ক্রিয়াকলাপের স্থান হিসাবে কাজ করেছে। বর্তমানে এটি পোপ কনক্লেভের স্থান , যে প্রক্রিয়াটির মাধ্যমে একটি নতুন পোপ নির্বাচন করা হয়। চ্যাপেলের খ্যাতি প্রধানত ফ্রেস্কোতে রয়েছে যা এর অভ্যন্তরের প্রতিটা দেওয়াল থেকে ছাদ পর্যন্ত অপরূপ শিল্প সম্ভারে নিখুঁত সাজিয়ে তুলেছে। বিশেষ করে সিস্টিন চ্যাপেলের সিলিং এবং'' দ্য লাস্ট জাজমেন্ট'' শিল্পী মাইকেলেঞ্জেলোর অনবদ্য সৃষ্টি।
চ্যাপেলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকর্ম হল ফ্রেস্কো দ্বারা বেদীর পিছনেরছাদে এবং পশ্চিমদেয়ালে মাইকেলএঞ্জেলো অঙ্কিত অনুপম চিত্ররাশি। সিলিং সিলিং নামে পরিচিত ফ্রেস্কোগুলি, পর্যবেক্ষণে দেখা যায় ১৫০৮ সাল থেকে পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস দ্বারা চালু করা হয়েছিল এবং ১৫১২ সাল পর্যন্ত মাইকেলেঞ্জেলো এঁকেছিলেন ওল্ড টেস্টামেন্টের ঘটনা এবং ব্যক্তিত্বকে চিত্রিত করে। অন্বেষণ আরো বলেছিল এই চ্যাপেলের দক্ষিনপশ্চিম দেয়ালে শেষ বিচারের ফ্রেস্কোগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ১৫৩৪ থেকে ১৫৪১ সালের মধ্যে পোপ পল তৃতীয়র জন্য মাইকেলেঞ্জেলো এঁকেছিলেন যে দুটি বিশাল ফ্রেস্কো পাশ্চাত্য শিল্পকলার ক্ষেত্রে সে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য অন্যতম গর্বের স্থান অধিকার করে আছে।
সিস্টাইন চ্যাপেলের বর্ণনা দিতে বসে শ্ৰীময়ীর কৌতূহলী মন আপাততঃ হেঁটে চলেছে সেই শতশত বছরের প্রাচীন ঐতিহাসিক পাতায়। যেখানে সিস্টিন চ্যাপেল প্রথম ভ্যাটিকান প্রাসাদে ঐ ১৪৭৩ থেকে ১৪৮১সালে স্থপতি জিওভান্নি দেই ডলসি দ্বারা নির্মিত হয়েছিল পোপ সিক্সটাস চতুর্থর নামানুসারে। চ্যাপেল অর্থাৎ একটি খৃষ্টান উপাসনালয় যেখানে প্ৰশাসনিক এবং আবাসিক উদ্দেশ্য ও সাধিত হয়।
বাইবেলে বর্ণিত সোলেমানের মন্দিরের আদলে তৈরী লাল ইটের চারকোনা সিস্টিন চ্যাপেল সাধারণ ভাবে পোপের বাসস্থান ছিল। এই বাড়িটি ছিল আয়ত ক্ষেত্রের আকারে লাল ইটের তৈরী। যার সাথে দুটি প্রধান এবং প্রতিটি দেওয়ালের ছয়টি খিলান যুক্ত এবং একটি ব্যারেল ভল্টেড সিলিং ও রয়েছে । চ্যাপেলের বাইরের অংশ টি দ্রাব( drab ) এবং
অলংকৃত। তবে এর অভ্যন্তরের প্রাচীর এবং সিলিংটি বহু ফ্লোরেন্টাইন রেনেসাঁ চিত্র কর্মের বিখ্যাত শিল্পীদের ফ্রেস্কো ও ম্যুরাল দ্বারা সজ্জিত।
ইতলীতে জন্ম নেওয়া পোপ চতুর্থ সিক্সতাস (জন্ম ১৪১৪খ্রীষ্টাব্দে ) যিনি পোপ দ্বিতীয় পলের মৃত্যুর পর ১৪৭১ সালে এই পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর আমল থেকেই সিস্টাইন চ্যাপেল কাৰ্য্যত পোপেদের পাকা পোক্ত নিবাস হিসাবে ব্যবহৃত হয় আসছে। ইতিহাসে উল্লেখিত ভ্যাটিকান সিটিতে তৎকালীন সময়ের সর্বপ্রধান ও সর্বময় শ্রেষ্ঠকর্তা ছিলেন পোপ এবং তিনি বিপুল অর্থের অধিকারী ও ভোগ বিলাসী ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর পছন্দ মত বাসস্থান টি তেমনই বিলাস বহুল করে তুলতে। এই কারণে মহামান্য পোপেরই আদেশে ইতালীর সেরা সব চিত্রকর গণ তাঁদের মেধা ও শ্রম দিয়ে পোপের মনোবাসনা পরিতৃপ্তির জন্য এই বাসস্থান টিকে সমগ্র দুনিয়ার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সমৃদ্ধশালী করে তুলতে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন।
রেনেসাঁ যুগের বিখ্যাত চিত্রকর ও ভাস্করগণ বিশেষ করে রাফায়েল বর্ণিনী ,বত্তিচেলী মাইকেলেঞ্জেলোর সেরা শিল্প কর্ম দিয়ে সাজানো ছিল এই সিষ্টিন চ্যাপেলের প্রতিটি দেওয়াল। প্রথম দিকে চ্যাপেলের অভ্যন্তরে পাশের দেওয়াল গুলো ১৪৮১ থেকে ১৪৮৩সাল পর্য্যন্ত এই রেনেসাঁ যুগের ৬ জন শিল্পী দের আঁকা ফ্রেস্কো তে সজ্জিত ছিল। সিস্টিন চ্যাপেলের দক্ষিণদিকের প্রাচীরের মধ্যে পেরুগিনো ,পিন্টুরিচিও বেতিচেল্লি ,ডোমেনিকো ,বেনেডেটা ঘিরল্যান্ডাই ও লুকা সিগনোরেলি এবং বার্তালেমিও ডেলা গাট্টার দ্বারা চিত্রিত অন্যান্য ছয়টি সুন্দর ফ্রেস্কো রয়েছে দেখতে পাওয়া যায়। এই কাজ গুলো ছোটছোট ফ্রেস্কো এবং দেওয়ালের নীচের দিকের অংশ গুলো গস্পেলসের ঘটনা চিত্রের মাধমে বর্ণনা করা হয়েছে।
ডানদিকের অংশের দেওয়ালে চিত্রের মাঝে বিখ্যাত শিল্পী বেতিচেল্লির একটি চিত্র অদ্রিজার মন স্পর্শ করে ছিল। লিখতে বসে শ্রীর আজো সে ছবিটির কথা মনে পড়ে,যা পরবর্তী কালে তিতির যত্ন করে ওর রাইটিং প্যাডে পেন্সিল দিয়ে স্কেচ এঁকেছিল।
'কোরাহ ও তাঁর পুত্র দের শাস্তি ! '' পরস্পর তিনটি দৃশ্যে বর্ণনা করা হয়েছে। ডানদিকে মিশর দেশ থেকে আগত মোজেস ও আরোন বিদ্রোহী ইহুদিগনের বিরোধিতার মোকাবিলা করছেন ---শ্বেত শুভ্র দীর্ঘ গোঁফদাড়ি যুক্ত হলুদ রঙের গাউন ও অলিভ সবুজ রঙের আলখাল্লা বস্ত্র পরিহিত বৃদ্ধ মোজেস ও বিদ্রোহীগনের মাঝে দাঁড়িয়ে যোসুয়া মোজেস কে বিদ্রোহীদের ছোড়া পাথর বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করছেন। মধ্যস্থলে মোজেস ও করাহো সব বিদ্রোহী দের বিতাড়িত করছেন। বেদীর পাশে সম্রাট কনস্টানটাইন নির্মিত বিশাল তোরণ টি দেখা যাচ্ছে। বামে দ্বিধা বিভক্ত ধরণীতে প্রধান ষড়যন্ত্রকারীদের পাতালে নিমজ্জিত হওয়ার পর ডুবে যাওয়ার করুণ দৃশ্য চিত্রিত হয়েছে ।
এই সিস্টিন চ্যাপেলের স্বর্ণ যুগের সূত্রপাত হয়েছিল পোপ জুলিয়াস দ্বিতীয়র শাসন কাল থেকেই। তাঁর বিলাসী চরিত্রে শিল্পকলা ও বিশাল স্থাপনা তৈরীর প্ৰতি অপরিসীম অনুরাগ এবং দূরদর্শী বিদেশ নীতি তাঁকে বিশেষ ঐতিহ্যশালী গৌরবান্বিত করেছিল। তাঁর মৃত্যুর পর ,পরবর্তীকালে পোপ দশম লিও এই উন্নতির ধারা বজায় রেখে এর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করে ছিলেন। সেন্টপিটার্স ব্যাসিলিকা ছিল যার উজ্জ্বল নিদর্শন। নতুন পোপের অভিষেক ও বরণের অনুষ্ঠান উৎসব অত্যন্ত জাঁকজমক ও আড়ম্বরের সাথে এখানেই পালন করা ছাড়া ও প্রতি বছর খৃষ্ট ধর্মের ৫০টি অনুষ্ঠানের মধ্যে ২৭টি অনুষ্ঠান এই সিস্টিন চ্যাপেলে বর্তমান কালে ও অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
পোপের নির্বাচন নিয়ে রোমের ফোরামের পথে ক্যাপ্টেন মল্লিক যে গল্প টি বলেছিলেন শ্রীময়ীর তা ও লিখতে বসে,বেশ মনে পড়ে যায় । পোপের আসন শূন্য হলে নতুন পোপ নির্বাচনের সময় সারা পৃথিবীর কার্ডিনালদের এখানে আমন্ত্রণ ও একত্রিত হতে হয়। "বুঝলে অদ্রিজা ম্যাডাম --কার্ডিনাল হলো সারা বিশ্ব থেকে বিশপ এবং ভ্যাটিকান কর্মকর্তা যারা ব্যক্তিগত ভাবে পোপ দ্বারা নির্বাচিত ,তাদের স্বতন্ত্র লালপোশাক দ্বারা স্বীকৃত। তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব নতুন পোপ নির্বাচন করা। তাঁরা বিশ্বব্যাপী ক্যাথলিক চার্চের মুখোমুখি চাহিদা এবং চ্যালেঞ্জগুলি নিয়ে আলোচনা করে।"
পোপ নির্বাচনের সময় সর্ব সমর্থনের মতানুযায়ী সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে নেতা নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত সেখান থেকে পোপেদের বাইরে বেরোনো নিষেধ থাকে। যতক্ষণ পোপ সঠিক নির্বাচিত না হন চ্যাপেলের চিমনি দিয়ে কালো ধোঁয়া বেরোতে থাকে এবং নতুন পোপ নির্বাচিত হয়ে গেলে ধোঁয়ার রঙ বদলে সাদা হয়ে যায়। তবে বড়দিন এবং ইস্টারের উপলক্ষ্যে বিশাল উৎসবের ও আয়োজন অনুষ্ঠান উৎযাপিত হয় সেন্টপিটার্স ব্যাসিলিকা গীর্জায়। এই বিশাল গীর্জাটির পিছনের অংশে ডানদিকে রয়েছে সিস্টিন চ্যাপেল।
সিস্টিন চ্যাপেল নির্মিত হওয়ার পর রেনেসাঁ যুগের বিভিন্ন শিল্পীদের এই দেওয়াল চিত্রগুলো আঁকার বেশ কিছুদিন অতিক্রমের পর চ্যাপেলের পুরানো উপাসনালয় সংস্কার করে আজকের চ্যাপেলের অংশবিশয়গুলি আঁকার জন্য মহামান্য পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস তখন মাস্টার শিল্পী মাইকেলেঞ্জেলো কে আমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলেন এবং চিত্রঅঙ্কনের আদেশ দিয়েছিলেন। পোপের নির্দেশে দায়িত্ব ভার গ্রহণ করে তিনি ১৫০৫সাল থেকে সিস্টিন চ্যাপেলের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজের পূর্নস্বাধীনতা পেয়েছিলেন এবং একটানা ৪০ বছর ধরে চিত্র অঙ্কনের কাজে নিজেকে সমর্পন করেছিলেন।তাঁর কালজয়ী অসাধারণ শিল্প সম্ভারে সিস্টিন চ্যাপেলের ১২ হাজারবর্গ ফুট দেওয়াল চিত্র অঙ্কন করে শিল্পী মাইকেলেঞ্জেলো পরিপূর্ণ করে তুলে ছিলেন। অনেক শিল্প সমালোচক দের মতে সিস্টিন চ্যাপেল বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত শিল্প কর্ম আর সেই সাথে অবধারিত ভাবেই এটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সিলিং বা ছাদ। ঋষভ অবাক হয়ে বলে মাইকেলেঞ্জেলো এই সুবিশাল ছাদ টি এঁকেছেন উল্টো ভাবে উপুড় হয়ে এক হাতে টানা চারবছর ধরে ভাবলে বিস্মিত হতে হয় ! কি অপরিসীম যন্ত্রণা সহ্য করে আগামী পৃথিবীর মানুষ কে এই অনন্য সুন্দর শিল্প সামগ্রী তথা বিস্ময় উপহার দিয়ে গিয়েছেন।
ভ্যাটিকান সিটির ভাস্কর্য্য
বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাস্কর রেনেসাঁ যুগের অন্যতম সেরা স্থপতিবিদ মাইকেলেঞ্জেলো ছিলেন একাধারে ভাস্কর ,চিত্রকর,স্থপতি কবি ও প্রকৌশলী। সে যুগে একমাত্র তিনিই ছিলেন শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির সমতুল্য বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ।খুব সম্ভবত তিরিশ বছর বয়সের আগেই তিনি "পিয়েতা" এবং "ডেভিড" নির্মান করেছিলেন। তাছাড়া এই গীর্জার দেওয়ালে ও ছাদে মূল যে নয়টি দৃশ্য অঙ্কিত আছেতা শোনাযায় প্রাচীন হিব্রু বাইবেলের চিত্র রূপ। এর অন্যতম হোলো সূর্য চন্দ্র এবং পৃথিবীর সৃষ্টি আদম এবং ইভ এর সৃষ্টি ও তাঁদের স্বর্গ থেকে বিতাড়ন। তাঁর অন্যতম অসাধারণ সৃষ্টি এই ফ্রেস্কোগুলি মাত্র সাড়ে চারবছরে আঁকা হয়েছিল। দি ক্রিয়েশন অফ আদাম এবং দ্য লাস্ট জাজমেন্ট যে ফ্রেস্কো দুটি -- মূল বিষয় সিস্টিন চ্যাপেলটির সিলিং এবং বেদীতে বিখ্যাত হয়ে রয়েছে।
মাইকেলেঞ্জেলোর অসাধারণ শৈল্পিক চেতনা দিয়ে গড়েতোলা অনবদ্য শিল্পকর্ম তা এতকাল পরে ও শিল্পীর অন্যতম সেরা সাফল্য হিসাবে বিবেচিত হয়। অদ্রিজা বলে --শুনেছি ,তাঁর জীবনীকার দের মতে ছবি আঁকার থেকে ও ভাস্কর্য্য ছিল সবথেকে বেশী পছন্দের কাজ। তাই সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদে ছবি আঁকার নির্দেশ পেয়ে নিতান্ত অনিচ্ছায় তিনি সেই কাজটি গ্রহণ করেছিলেন। এবং অঙ্কন শিল্পে তিনিও যে বিশেষ পারদর্শী তাও প্রমাণিত করার জন্য প্রচন্ড অনীহা সত্ত্বেও রঙ তুলি হাতে তুলে নিয়ে বিশ্বের শিল্প সংস্কৃতির দরবারে অসাধারণ এবং একাধিক চমৎকার শিল্পের সৃষ্টি করে অমর ও অপরাজেয় হয়ে রইলেন।
সিস্টিন চ্যাপেলে এক পোপের মৃত্যুর পর আর এক পোপ আসেন ,যুগের পর যুগের অবসান ঘটে কিন্তু স্বমহীমায় মাইকেলেঞ্জেলো প্রতিষ্ঠিত থেকে যান। এরপর সেন্ট পিটার ব্যাসিলিকা তৈরীতে ও তার মূল গম্বুজের অলংকরণের কাজ করা শুরু করেছিলেন। কিন্তু ১৫৬৪ সালে ৮৮ বছর বয়সে এই কর্মরত উদ্যমী শিল্পী মৃত্যু মুখে পতিত হন। তাঁর হাতের রঙ তুলির টানে গড়ে তোলা অত্যাশ্চর্য অনিন্দ্য সুন্দর ফ্রেস্কো অঙ্কন বা বাটালি ছেনি হাতুড়ির ঘায়ে নন্দন শিল্পের কর্মস্পৃহা চির তরে রুদ্ধ হয়ে গেলেও পৃথিবীর আকাশে উজ্জ্বল এক জোতিস্ক রূপে তিনি চিরকাল বিরাজিত হয়ে থাকবেন।
0 Comments