জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদ/পর্ব- ৪৫/স্বপন কুমার দে

এক মুঠো রোদ
পর্ব- ৪৫


স্বপন কুমার দে

পরদিন সকালে হাসপাতালের বেডে শুয়ে সম্পূরক অপেক্ষা করছে মা বাবার, অপেক্ষা করছে মল্লিকার।  সকাল ন'টা থেকে ভিজিটিং আওয়ার্স। তখন রোগীদের বাড়ির লোক এসে ভিড় জমাবে। কিছুক্ষণ আগে ডাক্তার ভিজিট করে গেছেন। সম্পূরকের সব রিপোর্টই ভালো। আজকেই ছুটি হয়ে যাবে। তবে কিছুদিন বাড়িতে রেস্টে থাকতে হবে, তারপর কাজে জয়েন করতে পারবে। আসলে সম্পূরকই এতদিন শরীরের ওপর অত্যাচার করেছে, ঠিক সময় মত খাওয়া দাওয়া করেনি। হোটেলের রান্না সবদিন পেটে সহ্য নাও হতে পারে, কিন্তু তার একার রান্না করে দেওয়ার মত কেউ নেই। অগত্যা হোটেলই ভরসা। অফিসে কাজের চাপ তো আছেই, সেইসঙ্গে অনেক সময় একস্ট্রা লোড নিয়েছে। খাওয়া এবং বিশ্রামের যথাযথ অপরিপূর্ণতাই তার অসুস্থতার কারণ।

সম্পূরক ভাবছে কালকের ঘটনার কতক স্পষ্ট কতক অস্পষ্ট স্মৃতি। শরীরের ভয়ানক অস্বস্তির মধ্যে মাথা কাজ করছিল না। পাশাপাশি লোকেদের হট্টগোল, তিরস্কার, কোনোটাই তার ইন্দ্রিয়কে সজাগ করতে পারছিল না। কেউ বা কারা তাকে সিটের উপর শুইয়ে দিয়েছিল। তারপর একটা মানবিক হাত, একটা দীর্ঘ প্রতীক্ষার আদৃত সহানুভূতি তাকে স্পর্শ করেছিল। তার জন্য নিয়ে এসেছিল সেই সঙ্গ, সেই স্পর্শ, যা তার সারাজীবনের অমূল্য প্রাপ্তি। খুব ইচ্ছে করে আবার সেই সঙ্গ, সেই স্পর্শ।
" সম্পূরকবাবু! কেমন আছেন?"
হঠাৎ ডাকে চমক ভাঙে সম্পূরকের। ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে মল্লিকার দিকে চেয়ে থাকে।
মল্লিকা আবারও বলতে থাকে," জেঠু, জেঠিমার হোটেল থেকে বেরোতে একটু দেরি হচ্ছে। আমি আগেই চলে এলাম। একটু পরেই আমার ট্রেন আছে। আপনি ওঁদের খুজছেন?"
" আমার কাছে একটু বসবে মল্লিকা?"
" কেন?"
" তোমার হাতে আমার হাতটা রাখতে চাই। প্লিজ, ফিরিয়ে দিওনা।"
মল্লিকা কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আলতোভাবে নিজের হাতটা সম্পূরকের দিকে বাড়িয়ে দিল। সম্পূরক কোনও কথা না বলে মল্লিকার হাতটা নিজের দুই হাতে ঢেকে রাখল। একটু পরে মল্লিকা মৃদুস্বরে বলে," এবার ছাড়ুন। আমাকে যেতে হবে।"
" কোথায় যাবে?"
" যেখানে যাচ্ছিলাম, নিজের জন্মস্থান, জোড়াদিঘি বস্তিতে।"
" আমারও আজ ছুটি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সঙ্গেই  যাবে।"
" না, আপনাদের দেরি হবে। আমাকে তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে হবে। আমার অনেক কাজ আছে।"
" জানি, তুমি ইচ্ছে করেই আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছো।"
মল্লিকার মনে হল, এই আর্ত মানুষটির অন্তত একটি অনুনয়, একটি সকাতর অনুরোধ সে রক্ষা করবে। কিন্তু মল্লিকা এটাও জানে, তার নিজস্ব অনুভূতি, চাওয়া পাওয়া থাকতে নেই। ছোটবেলা থেকেই ভালোলাগা, ভালোবাসার মুহূর্তগুলো সযত্নে এড়িয়ে গেছে। অসংযত জীবন আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এলোমেলো করে দিতে পারে, তাই কঠোরভাবে নিজেকে আত্মসংযমের বাঁধনে বেঁধে রেখেছিল। তারপর একদিন হঠাৎ করেই সম্পূরক এল তার ত্রাতা হয়ে। শুধুমাত্র এই ভূমিকাটাই তার ভালোলাগার কারণ নয়, সম্পূরককে দেখে মনে হয়েছিল,এই মানুষটা যেন তার বহু প্রতীক্ষিত মনের মানুষ, যার ওপর ভরসা রাখা যায়, যাকে দু'চোখ বন্ধ করেও বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু সেখানেও ভাগ্যের পরিহাস। সম্পূরকের পরিবার চায় না, একজন সাদামাঠা বস্তির মেয়ে তাদের বাড়ির পুত্রবধূ হোক। মল্লিকার রাগ হয় এইরকম উন্নাসিক, আত্মগর্বী মানুষগুলোর প্রতি। নিজেদের কী ভাবে এরা? চিরকাল ধরে ধনগর্বী, সভ্যতাগর্বী সমাজের উঁচু তলার মানুষ যে একাধিপত্য কায়েম করেছে সেই মানসিকতার ফসিলটাকে এরা এখনও বয়ে চলেছে।

এদিকে, সম্পূরক মল্লিকার হাতটা ধরে একদৃষ্টে তার দিকে চেয়ে আছে সকাতর অনুরোধ নিয়ে। মল্লিকা হেসে বলল," সম্পূরকবাবু, হাতটা ছাড়ুন, আমার সময় হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া এ অবস্থায় আপনার বাড়ির লোক দেখলে ভালো হবে না।"
হাতটা ছেড়ে দিল সম্পূরক। মল্লিকা একটা টুল নিয়ে সম্পূরকের বেডের পাশে বসল।
" সম্পূরকবাবু, এবার থেকে নিজের শরীরের যত্ন নেবেন। সময়ে খাবেন, প্রয়োজন মত বিশ্রাম নেবেন। দেখলেন তো অনিয়ম করলে কী হয়।"
" হয়তো ভগবান মঙ্গলের জন্যই এটা করেছেন। তাই তো তোমার সাথে এমনভাবে দেখা হয়ে গেল।"
" কিন্তু আবার এরকম হলে আমি তো নাও থাকতে পারি।"
" যদি সেরকম কিছু হয় তবে জানবো, সেটাও ভালোর জন্যই হয়েছে।"
" কেন?"
" কারণ, তোমাকে কখনও পাবো না বলেই তিনি আয়োজন করে রেখেছেন।"
মল্লিকা হতাশার নিশ্বাস ফেলল। মুখে বলল," সম্পূরকবাবু, আমি আসি। ট্রেনের সময় এগিয়ে আসছে।"
বিহ্বল দুটি চোখ মল্লিকার গতি রোধ করছিল।
" আর একটু বসবে না মল্লিকা? আর হয়তো এমনভাবে দেখা নাও হতে পারে।"

🍂

মল্লিকার চোখ দুটি জলে ভরে এল।
" সম্পূরকবাবু, আমার সঙ্গে নিজেকে জড়াবেন না। আমি স্বেচ্ছায় যে পথ বেছে নিয়েছি সে খুব কষ্টের পথ। আপনি কেন সে পথের পথিক হবেন কেন? আপনার ঘর আছে, বাবা-মা আছেন, সুখ সম্পদের প্রাচুর্য আছে। আপনি কেন আমার ভাগ্যের সঙ্গে নিজের ভাগ্যকে জড়াবেন? আর আপনি চাইলেও আমি তা হতে দিতে পারি না।"
" কেন পারো না মল্লিকা? তুমি কী ভেবে আমাকে প্রত্যাখ্যান করছো?"
" আমি যে তোমার মাকে কথা দিয়েছি সম্পূরক।" কথাটা আবেগের বশে মুখ থেকে বেরিয়ে গেল। তারপরেই সংযত হয়ে গেল," যাক্ ওসব কথা।"
" কেন থাকবে? বলো মাকে তুমি কী কথা দিয়েছিলে?"
" না। সে কথা তোমার মা বাবার কানে গেলে তাঁরা দুঃখ পাবেন। মা বাবার চোখের জল নিয়ে কোনও সন্তান সুখে থাকতে পারে না।"
" কথা দিলাম, একথা আর কাউকে বলবো না।"
মল্লিকা খানিক ইতস্তত করে বলল," জেঠিমা আমাকে বলেছিলেন, আমি যেন তাঁর ছেলের সাথে মেলামেশা না করি। আমি সেটাই কথা দিয়েছিলাম।"
সম্পূরক একটুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর কিছু একটা বলতে যাবে তখন দেখল, বাবা মা আসছে। তাঁদের দেখে মল্লিকা বলল," আপনারা চলে এসেছেন, এবার আমার ছুটি। আজই সম্পূরকবাবুর ছুটি হয়ে যাচ্ছে। আপনারা রিলিজ করে ওঁকে নিয়ে যাবেন। আমি আসি।"
সম্পূরকের বাবা হৈ হৈ করে উঠলেন," যাবে মানে? আমাদের গাড়িতে সবাই মিলে একসঙ্গে যাবো।"
" না জেঠু, আমাকে আগে যেতে হবে। অনেক কাজ আছে। আপনারা ছুটি করে পরে আসুন।"
" আরে না না। বলতে বলতেই মল্লিকা পা বাড়াল গেটের দিকে। সম্পূরক তার মায়ের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল।

সেদিনটা মল্লিকার খুব ব্যস্ততায় কাটল। দীর্ঘদিন পর নিজের জন্মভিটেয় এসেছে। পাড়ার সকলেই তাকে খুব ভালোবাসে। তাদের সঙ্গে কথা বলে, ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গে তার প্রতিষ্ঠানের খোঁজ খবর নিয়ে, অন্যান্য কাজকর্ম করে সে ক্লান্ত। প্রতিবেশিনী বিনতা কাকিমার বাড়িতে খেয়ে সোজা বিছানায় টানা ঘুম। ঘুম ভাঙল সকাল সাতটায়। আজ আবার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খবর নেওয়া, তাদের কিছু দরকার কি না সে বিষয়ে খবর নেওয়া, এইসব যখন করছে তখন মন্টির ফোন থেকে তার দাদুর কল। বৃদ্ধ অমরেশবাবু বললেন," কোনও অজুহাত শুনতে চাই না, আজ আমাদের বাড়িতে দুপুরে একবার আসতেই হবে। এখানে তোমাকে লাঞ্চ সারতে হবে।"
" না, না জেঠু। এখানে আমার রান্না হচ্ছে। আমি এখানে কাকিমাদের বাড়ি খেয়ে নেবো।"
" তুমি আমাদের বাড়িতে আসবে না?"
" না, ঠিক তা নয়। এই তো পুরো চোদ্দ পনের ঘণ্টা আপনাদের সঙ্গে ছিলাম। আবার কোনোদিন এখানে এলে না হয় আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে যাবো।"
বৃদ্ধ মাস্টারমশাই কী বলবেন, খুঁজে পেলেন না। ফোনটা কাটবার আগে বললেন," ভালো থেকো মল্লিকা।"
" হ্যাঁ, আপনিও আমার প্রণাম নেবেন।"
" তোমার নতুন কাজকর্ম নিয়ে কৌতূহল ছিল, তাই তোমাকে ডেকেছিলাম।"
" ঠিক আছে আমি আসছি, তবে বেশিক্ষণ থাকতে বলবেন না, প্লিজ।"
" এসো।"

মল্লিকা হাজির হতেই সর্বপ্রথম উল্লাসে মাতোয়ারা হল মন্টি অর্থাৎ সৃজিতা। তার কথাবার্তা শুনে, আন্তরিকতা দেখে মল্লিকার মনে হল মন্টি পাল্টায় নি। অমরেশবাবু, তাঁর স্ত্রী মণিদীপা, মন্টি, সম্পূরক এবং মল্লিকা বসেছে ড্রয়িং রুমে। সুদেষ্ণা সকলের জন্য টিফিন, চা, স্ন্যাক্স পরিবেশনে রত। মল্লিকা তাকে বসতে বলল," বৌদি, আপনিও বসুন না। কতদিন দেখা হয়নি বলুন তো!"
" হ্যাঁ, আপনি তো ভুলেই গেছেন।"
এইসব হালকা কথাবার্তার মধ্যে অমরেশবাবু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মল্লিকার কলেজ, তার সেবা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে অনেকটাই জেনে নিলেন। তারপর যে প্রশ্ন টা অনিবার্যভাবে এসে যায়, ঠিক সেটাই করলেন অমরেশবাবু," এতকিছু করার জন্য যে অনেক অর্থের প্রয়োজন, সৃদিকটার কথা ভেবে দেখেছো?"

মল্লিকা বলল," ভাবিনি যে তা নয়, তবে তার জন্য নিজের মাস মাইনে আছে, ওতেই হয়ে যায়। ভবিষ্যতে ওখানে একটা অনাথ আশ্রম করবার ইচ্ছে আছে। দেখা যাক, কতটা কী করতে পারি।"
সব কথা শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন মাস্টারমশাই অমরেশবাবু। মুখে বললেন," তুমি জয়ী হও।"
সম্পূরকের সঙ্গে মাঝে মাঝে চোখাচোখি হতেই হেসে ফেলল মল্লিকা," জেঠিমা, সম্পূরকবাবুকে আর একা একা যেতে দেবেন না। এবার জোর করে বিয়ে দিয়ে দিন তো, তাতে যদি শরীরটা ঠিক থাকে।"
একসময় সেখান থেকে উঠে পড়ে মল্লিকা।


 

Post a Comment

0 Comments