পর্ব -৩২
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া
|| মৌরি ফুলের মধু ||
পরদিন থেকেই মা জবরদস্তি তাকে কাজে আটকে রাখার চেষ্টা করে।সব আলমারি থেকে বই বের করে রোদে দে,মলাট পরিয়ে ক্যাটালগ বানা। চার্লস ডিকেন্সের ভারি এক উপন্যাস নামিয়ে রোজ দুপুরে খানিকটে করে অনুবাদ করবি সন্ধেবেলা দেখব আমি বলে টলে মা নিশ্চিন্ত হয়ে স্কুলে চলে যায় আর ঝিনিও গ্যাস বুকিং, ইলেকট্রিক বা টেলিফোন বিল জমা দেবার নানারকম দায়িত্ব লুফে নেয় আর টোটো করে ঘোরে পাঁচজনায়।
রীতা ঠোঁট ফোলায় নিজের নাম নিয়ে।এঃ বিচ্ছিরি এই মোস্ট কমন আমার নামটা কে যে রাখলো মাইরি। দাঁড়া ব্যবস্থা করছি। তুই এতদিন রীতি থেকে রীতা ছিলিসতো। এখন থেকে তুই ঋতা।ঋতু হইতে জাত নারী। এবার বল খুশি? কিন্তু সার্টিফিকেটেতো রীতাই থাকবে,সংশয় যেতে চায় না ওর। তুই কি সার্টিফিকেট কপালে সেঁটে ঘুরবি নাকি?আর ইংরেজি বানানতো একই থাকছে। সমস্যা কী তোর?
এতো সুন্দর করে মেরামত করলাম
নামখানা তবু মন উঠছে না মা?কণা হেঁকে ওঠে,চল, খাওয়া! আমরা সবাই হই হই করে ওর ঘাড় ভেঙে ঘটিগরম খেতে উঠে পড়ি।
ভরদুপুরে বোসেদের আমবাগান, নীলকুঠি,
সুধাস্মৃতি লাইব্রেরির তেঁতুল আর মহানিমের ছায়াপথে, শান্ত বিকেলে ইচ্ছামতীর জলমাখা বাতাসে ভেসে আসে জেলে ডিঙির "সজনী লো দেখে যা উথালি পাথালি হলো মন.."। শুনে শুনে ওলো সই.. গুনগুন করতে করতে ঝিনির মাথায় ক্ষ্যাপামির ক্যারাপোকা চাগিয়ে ওঠে।ডি লা গ্রান্ডি !চ' সই পাতাই। টেনিদা ফেলুদা রেখে তখন তারাশঙ্কর ,বিভূতিভূষণ,রবিঠাকুর সব রচনাবলী গোগ্ৰাসে গিলছে সে।
ফলে সিঁদুর টোকাটুকি খেলার মত চোখের বালি,মৌরিফুল, গঙ্গাজল এইসব নাম সাজেস্ট করে সে ।গঙ্গাজলটা বাদ দে কণা বলে, শুনলেই ঘাটের মড়া মনে আসে।সামনেই ইচ্ছামতী বইছে, তার কথাটাও ভাব একবার। একঝাঁক পাখির মতো খোলামাঠে উড়ে যায় তাদের ঠা ঠা হাসি।
পাঁচজনার পকেট হাতড়ে সাড়ে সাতটাকা জোগাড় হলো।বিজুদার দোকানের ছাঁচের সন্দেশ ছখানা কিনি চ' আর দেড়টাকার চানাচুর নে ,ঋতা বলল ; বাড়ি গিয়ে পেঁয়াজ কুচি কাঁচা লঙ্কা লেবুর রস দিয়ে ঘটি গরম বানিয়ে ফেলবোখন। ফিনিক ফোটা চাঁদের আলোয় ঋতাদের ছাদে বিস্কুট সন্দেশ আর ঘটিগরম সাক্ষী করে তারা সব দল ধরে মৌরি ফুল, ইচ্ছামতী, চোখের বালি হয়ে বসল। সাক্ষীরা অবশ্য থাকল না বেশিক্ষণ।তাড়াহুড়ো করে পেটে গিয়ে ঢুকল।
পরের দিনের কর্মসূচি ঠিক হয় কবে কে গলায় দড়ি দিয়েছিল বলে যে গাছের আম কেউ খায় না,সেটা থেকেই আম পেড়ে খেতে হবে।
বি এল আর ও অফিসে ট্যাক্স জমা দিয়ে আসবি কাল। সে তো বসিরহাট।বড় হয়ে গেছিস কাজ তো করতেই হবে। আচ্ছা যাব। তবে কণাকে সঙ্গে নেব আর মিলনী হলে হারানো সুর দেখবো চারটে সাতটা।একা একা সিনেমায় যাওয়ার মতো বড় তুমি হওনি। দুজন মিলে একা একা কিভাবে হয় আগে বলো।আর এট্টু আগেই বললে বড় হয়ে গেছিস বাইরের কাজকম্ম হাতে হাতে শিখে নে তার বেলা?
বড্ড তোমার চোপা বেড়েছে ঝিনি ধমক টমক দিয়েও শেষ পর্যন্ত একটা চারটের নুন শো দেখে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে বাড়ি ফেরার কথা কবুল করে ট্যাক্সের টাকা, কাগজপত্র নিয়ে সাড়ে দশটায় বেরিয়ে পড়ল দুজন। একটার আগেই কাজ শেষ হলেও নুন শোর চাইতে ইভনিং শো টাই বেটার বলে তারা মিলনী হলের কাউন্টারে লাইন লাগালো।
অহনাদি আর ছোট বুলাদা কলকাতা থেকে ফিরতি পথে তাদের দেখে অবাক।
সাতটার পর যদি বাস না পেতিস তা'লে কী হতো?পালের গোদা এই ঝিনিটা।সব বদ বুদ্ধি এটার মাথা দিয়ে বেরোয় বলে কানে দুই পাক দিয়ে
ওরাও হলে ঢুকল আর বাড়ি ফিরে যথারীতি মা'র চড় চাপড় মাধ্যমিক পরীক্ষেকে ছাড় দিল না মোটেও।
ফাইনেল পরীক্ষে দিয়ে এরা দেখি বড্ডোই পক্ক হয়েছে। ঠিক সেজো জেঠামনির ভঙ্গিতে পা নাচিয়ে মাথা নেড়ে নেড়ে ছোড়দা বলছিল।কাজ না পেয়ে খালি খালি আকামের দোকান খুলে বসেছে সব। আকামের দোকান না একেবারে শয়তানের কারখানা!গার্জেনিতে দানিও যে কম যায় না বোঝাতে সেও দোহারকি দেয়।
কাল থেকে 'খোলা চোখে'র কাজ শুরু। মুকুল ক্লাব থেকে দাদারা মিলে খোলা চোখ বলে ছোট পত্রিকা করে। তাতে ছেলেমানুষ কবিতা লেখা ছাড়া এতদিন কিছুই করেনি তারা।
তাদেরকে পথে আনার জন্যই বোধহয় দাদারা ঠিক করে ফেলে এবার অনুলিখন সংখ্যা হবে।
এনছান ভাই,নছিম চাচা,ভটাই দাদুর মতো চাষি,ভ্যানওলা,মাঝি,জেলে সকলের কাছে যাও, তাদের জীবনের গল্প শোনো আর লিখে ফ্যালো অনুলিখন।যা প্রেসে যা। আমাদের প্রুফ দেখা হলে সে সব জমা দিয়ে তাগাদা দিয়ে আসবি। এসবের মধ্যে তারা ঢুকেও পড়ল বেশ আর এভাবেই খোলা চোখ অনুলিখন সংখ্যা বেরিয়েও গেল।
দাদারা ঠিক করেছে বসিরহাট থেকে শিয়ালদা ট্রেনে বারবার যাওয়া আসা করে কামরায় কামরায় পত্রিকা বিককিরি করে পয়সা তুলবে। যদি পত্রিকা বিককিরি হয় তবে সামান্য কিছু টাকা যাদের কথা শুনে অনুলিখন তাদেরকে দেওয়া হবে।
এই কারণে খাই খরচ বাবদ এক পয়সাও পাওয়া যাবে না। ছোড়দা বলল দরকারটাই বা কী? ফেরিওয়ালাদের মতো করব তো বিনি টিকিটে যাতায়াত। বাড়ি থেকে রুটি আর আলুভাজা নিয়ে যাওয়া হবে দুপুরে খাওয়ার জন্য। আগের রাতে ছোড়দা তাকে নিয়ে পড়ল। পত্রিকা বিককিরি করতে গেলে যাত্রীরা কি কি জিজ্ঞেস করতে পারে সেসব সম্ভাব্য প্রশ্ন ও তার উত্তর ঘন্টা দুই মুকস্ত করিয়ে রিহার্সাল দিয়ে তবে ছাড়ল।
রাত এগারোটা বাজে। তাদের বারান্দার তক্তপোষে তুলি দিয়ে ছোট বুলাদা তাদের কপালে বাঁধার ফেট্টিতে তখনো কবিতার লাইন লিখছে। কোনোটায় "কারা যেন আজ দুহাতে খুলেছে/ভেঙেছে খিল ",কোনোটায় মিছিলে আমরা নিমগ্ন তাই দোলে মিছিল। কোনো ফেট্টিতে লেখা "সবাই এসেছে তুমি আসোনিকো ডাকে মিছিল"।
ছোট বুলাদা আমায় কাল ওই ফেট্টিটা দিবি? কোনটা? ওই যে আকাশে আকাশে ধ্রুবতারায় /কারা বিদ্রোহে পথ মাড়ায়/ভরে দিগন্ত দ্রুত সাড়ায়/জানে না কেউ "লেখা ওইটা। আচ্ছা দেব।রাত সাড়ে এগারোটা।মা,বকুলদি ঘুমে কাদা কিন্তু ভেতরবাড়ির উঠোন পেরিয়ে কাঠের রান্নাঘরে লম্ফর মিটমিটে আলো দেখা যাচ্ছে ।পা টিপে টিপে ঝিনি গিয়ে দ্যাখে পাঁচ জনের মতো রুটি আর আলুভাজা রেডি করছে দানি আর মনসুর ভাই। বাকি পাঁচ জনের খাবার আনবে অহনাদি। রুটি ঠাণ্ডা করে কলাপাতায় মুড়ে রাখল ঝিনি। আলুভাজা টিফিন কৌটোয় ভরে জলের বোতলে জল ভরে মা'র চোখের আড়াল লুকিয়ে রাখল সাইড ব্যাগে।
এ হে ! কড়ার তলায় বড্ডোই কালি পড়েছে যে রে।কাল সকালে মা দেখলে তো কাম সারছে। সব ফিটফাট করে রেখে তবেই শুতে যাওয়া রে। এক্ষুণি এসব কালি ঝুলির প্রমাণ লোপাট করে ফেলতে হবে।এমনিতেই রান্নাঘর থেকে এত আটা আর আলু মিসিং।দানি আর মনসুর ভাই লম্ফো আর কড়াই নিয়ে পুকুর পাড়ে মাজতে চলল। মনসুরের জন্য পুবের ঘরে বিছনা করে দিয়ে তুই শুয়ে পড়গে ঝিনি। আমি এই ফেস্টুনটা শেষ করি। ছোট বুলাকে রুটির ব্যাগটা দিয়ে দে। কাল ওটা ওই নেবেখন। রং তুলি গুছিয়ে ব্যাগ নিয়ে সাইকেল ঠেঙিয়ে বাড়ি চলে গেল ছোট বুলাদা।
🍂
ঝিনি মা'র কাছে পা টিপে টিপে শুয়ে পড়েও উঠে আস্তে করে পায়ের দিককার জানলা খুলে দেখল দানি আর মনসুর ভাই মেজে তোলার বদলে প্রাণপণে ঘাসের ওপর কড়াই ঘসে কালি তুলছে। ঘুমোসনি? ঘুম জড়ানো মা'র গলা শুনেই তড়িঘড়ি জানলা ভেজিয়ে দিল সে। হ্যাঁ মানে না এইতো জল খেলাম বলে বুক ঢিপঢিপ নিয়ে সে শুয়ে পড়ল তক্ষুণি। মা উঠে পড়ে যদি দানিদের ওসব কাজকম্মো দ্যাখে তাইলে রক্ষে রাখবে না।আর মা'র হাতে নয় ছোড়দার হাতে ঝিনি তো মার খাবেই।
পরপর কয়েকদিন তারা পাঁচজন বড়দের সাথে ট্রেনে ট্রেনে ফেরি করল দু'টাকা দামের সেই পত্রিকা। দাদাদের শেখানো বুলি তোতাপাখির মতো বলে যাচ্ছে সবাই। ট্রেনের আওয়াজ, হকারদের নানা সুর, যাত্রীদের কথাবার্তা ছাপিয়ে ঝিনি চেচাচ্ছিল,অন্যরকম গল্প এনেছি আমরা। একেবারেই আলাদা।খুব ইচ্ছে আপনারা সবাই পড়ুন।মাত্র দুটাকা দাম! প্রশ্ন করছিল কেউ কেউ। এইভাবে টাকা রোজগারের উপায় তাদের মাথায় কিভাবে এল?এই টাকা দিয়ে কী করতে চায় তারা?হকারি কবে থেকে করছে? আবার ঝলমলে তাদের কিশোর মুখ দেখে দুম করে কিনেও ফেলছিল কেউ কেউ। একসাথে গেয়ে উঠছিল তারা "নাম তার ছিল জন হেনরি" অথবা মোরা যুবকেরা সকালের সূর্য/যেন আটটা নটার পৃথিবীতে আনবোই /নতুন এক বসন্ত...। ফেরার সময় ওরা প্রতিদিন ইচ্ছামতী এক্সপ্রেসে করে বসিরহাট নামে।
সেদিনকে ফেরার রাস্তায় সূর্য ডুবছিল।তুষারদা ট্রেনের পাদানিতে বসে গলা ছেড়ে মৌরি ফুলের মধু গাইছিল।হু হু হাওয়ায় পাদানিতে তারো বসার ইচ্ছে হচ্ছিল কিন্তু ছোট বুলাদা গম্ভীর মাথা নেড়ে না বলল বলে বকের মতো গলা বাড়িয়ে বাইরেটা দেখে নিচ্ছিল সে। বিকেলের লালচে আলোয় বদলে যাচ্ছিল রেলের গুমটি ঘর,চলন্ত গাছগাছালি,ধান খেত। ঝিনি দেখল সোনার গুঁড়ো ডানায় লেগে চমকে উঠছে ঘরে ফেরা পাখির ঝাঁক।
ট্রেনের কামরাতেই একদিন শোনা গেল রেজাল্ট বেরিয়েছে। যেহেতু ছোড়দাই চালাতো দলটা, বললো এখন জানার দরকার নেই।কাজ শেষ করে বিকেলে দেখা যাবে।কে কোনটায় ফেল করে মরেছে কেজানে। এখন মড়াকান্না জুড়লে সব কাজ পন্ড! ছুটিটা আর ক'ঘন্টা বেড়ে যাওয়াতেই খুশি হয়ে উঠল তারা সবাই।
সারাদিন ট্রেনে ঘুরে শেয়ালদা স্টেশনেই বড়দের কেউ রেজাল্ট দেখতে গেল।
কণা ফার্স্ট ডিভিশন,কলি,ঋতা বুলি সেকেন্ড ডিভিশন আর সবার থেকে একটু বেশি নাম্বার পেয়ে ওদের হুল্লোড়ের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেল ঝিনি।জড়িয়ে ধরলো ওরা। এমন চেঁচামেচি আর নাচতে লাগলো যেন পাঁচজন মিলেই পেয়েছে,জিতে গেছে দারুন কিছু।চুপ এক্কেবারে চুপ ধমকে উঠল ছোড়দা আর ছোট বুলাদা। তাদের সঙ্গে অল্প চেনা,মাত্রই কদিন হলো ক্লাবে আসছে বিশু বলে যে ছেলে আজ দলে ছিল সে নাকি অংকে আর ইংরেজিতে পাশ করেনি।মুখ শুকিয়ে গেছে তার, ঠোঁট কাঁপছে। ঝিনি দৌড়ে গিয়ে হাত ধরে বসালো প্লাটফর্মের বেঞ্চিতে। সারা রাস্তাই ওরা ঘিরে থাকল অল্প চেনা বিষাণকে।
যা হয় এরপর। ওরা দল বেঁধে গেল আর্টসে।আর কিছু নাম্বার বেশি পাবার শাস্তিস্বরূপ সাইন্সে গেল সে।
0 Comments