জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প— ২২০ মঙ্গোলিয়া (এশিয়া)নেকড়ের বোকামি /চিন্ময় দাশ

চিত্র- অর্ণব মিত্র 
দূর দেশের লোকগল্প— ২২০ 
মঙ্গোলিয়া (এশিয়া)
নেকড়ের বোকামি
চিন্ময় দাশ


সকাল হয়েছে। সূর্যের রাঙা আলোয় রেঙে উঠেছে পাহাড়-বন, রাস্তা-ঘাট সব। পশুপাখিরা যে যার আস্তানা ছেড়ে বের হতে শুরু করেছে।
এক নেকড়েও বেরিয়েছে ডেরা ছেড়ে। পেটে কিছু দিতে হবে। শিকারের খোঁজে বেরিয়েছে সে। পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে নামছে নেকড়ে। সামনে কিছু একটা চোখে পড়ে গেল তার। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। চেয়ে দেখে, বড় মাপের একটা পুডিং পড়ে আছে রাস্তায়।
গন্ধ নাকে গিয়েছে। নেকড়ে বুঝে গেল, পুডিংটা বানানো হয়েছে ভেড়ার চর্বি দিয়ে। অমনি লালা ঝরা শুরু হোল তার। কী সৌভাগ্য আজ! দিন শুরু হচ্ছে, ভেড়ার চর্বি দিয়ে বানানো পুডিং খেয়ে!
পুডিংয়ে কামড় বসাতে যাবে, নেকড়েকে অবাক করে দিয়ে, পুডিং বলে উঠল—নেকড়ে মশাই, ছোট্ট একটা পুডিং খেয়ে কী হবে? একটা কোণাও তো ভরবে না তোমার পেটের।
নেকড়ে বলল—তাতে কী হয়েছে? শুরুটা তো করা যাক। তার পর দেখব, কী জোটে কপালে।
পুডিং বলল—পুডিং খেয়ে লাভ নাই। যদি লোভ সামলাতে পারো, আমি একটা খবর দিতে পারি। নেকড়ে ভাবল, শোনাই যাক না, খবরটা কী? বলল—বল শুনি, কী খবর?
--এই পথ ধরেই আরও খানিকটা এগিয়ে যাও। একটা বাঁকের মুখে পৌঁছাবে। সেখানে ডান দিকে একটা মজা ডোবা। কাল থেকে একটা ঘোড়া আটকে আছে সেই ডোবায়।
পুডিংকে থামিয়ে দিয়ে, নেকড়ে বলল—কী বললি? ডোবায় ঘোড়া আটকে আছে? সত্যি বলছিস তো?
পুডিং বলল—সত্যি মিথ্যে একটু পথ এগিয়েই দেখো না। একটা হৃষ্টপুষ্ট ঘোড়া আটকে আছে, কি না। আমি তো রাস্তায় পড়েই আছি। মিথ্যে হলে, ফিরে এসে চিবিয়ে খেয়ে নিও।
কথাটা বেশ মনে ধরল নেকড়ের। সে এগিয়ে চলল পাকদণ্ডী বেয়ে। অনেকখানা পথ পেরিয়ে, সেই একটা বাঁক। সেখানে সত্যিই একটা মজা ডোবা। আর তাতে আটকে আছে একটা জলজ্যান্ত ঘোড়া। 
আহা, কী নধর চেহারা ঘোড়াটার! আবার লালা ঝরতে লাগল নেকড়ের মুখ থেকে। পথ ছেড়ে, ডোবার পাড়ে নেমে এল চটপট। 
গতকাল থেকে আটকে আছে ঘোড়াটা। সারাদিন ছটফট করেছে বেরোবার জন্য। যত নড়াচড়া করেছে, ততই কাদায় পাঁকে মাখামাখি হয়েছে গোটা শরীর। দেখলে, ঘোড়া বলে চিনে ওঠাই দায়। 
পাড়ে নেকড়েকে হাজির হতে দেখল ঘোড়া। এ অবস্থায় নেকড়ে তাকে কাবু করতেই পারে। ঘোড়া দেখল, বাঁচতে হলে, মাথা খাটাতে হবে। বোকা বানাতে হবে নেকড়েকে। নইলে রেহাই নাই।

🍂

নেকড়ে এগোতে যাবে, ঘোড়া চেঁচিয়ে উঠল—খবরদার, খবরদার। ভুলেও এক পা বাড়িও না। আমার মত দশা হবে তোমারও। কাদায় আটকা পড়ে যাবে। 
নেকড়ে বলল—তা হলে, তোকে ছেড়ে চলে যাব? এই সক্কাল বেলা। সামনে একেবারে সাজানো খাবার। শুকনো মুখে ফিরে চলে যাব? এই কথা বলছিস তো তুই?
--না, না। সে কথা বলিইনি আমি। এক কাজ করো। আগে আমাকে এই পাঁক থেকে ওপরে তোল। তবেই না খেতে পারবে।
--কিন্তু তুলবো কী করে তোকে? 
-- লম্বা লেজ আমার। বাড়িয়ে দিচ্ছি তোমাকে। সেটা ধরে টান মারো। কাজ হয়ে যাবে।
ঘণ এক গোছা লোম ঘোড়ার লেজে। ঘোড়া পিছন ফিরে দাঁড়াতে, নেকড়ের নাগালে এসে গেল লেজটা। খানিকক্ষণ টানা-হেঁচড়ার পর, ঘোড়াটা উপরে উঠে এল।
নেকড়ের আর দেরি সইছে না। সে কামড় বসাতে যাবে, ঘোড়া বলল—তুমি তো দেখছি বোকার বেহদ্দ একেবারে। উপরে তুলেই খেতে লেগে যাচ্ছো?
--খাবো না তো, কী করব?
--সেটাই তো বলছি তোমাকে। কামড় বসাবার আগে, খাবারটা একটু পরিষ্কার করে নেবে না? আগে তো একটু সাফসুতরো করো তোমার খাবার, তার পরে দাঁত বসাও। নইলে, কাদাতেই তো পেট ভরে যাবে? মাংস খাবার জায়গাই তো থাকবে না।
ঘোড়ার এই কথাটা বেশ মনে ধরল নেকড়ের। সেই সাথে একটু সন্দেহও হোল। ব্যাটা পালাবার মতলব করছে না তো? মুখে বলল—দৌড় লাগাবার ফন্দি করছিস? আমি তোর গা চাটতে থাকি। আর সেই মওকায় তুই ছুট লাগাবি লেজ তুলে? 
--কাল থেকে সারাটা দিন সারাটা রাত কাদায় ছটফট করে, একেবারে কাহিল হয়ে আছি। পায়ে ছুট লাগাবার মত জোর থাকলে, ডাঙায় উঠেই পালিয়ে যেতাম। সে ভয় কোর না। 
ঘোড়ার গা থকথকে কাদায় মাখামাখি। চাটতে শুরু করল নেকড়ে। অনেকটা সময় লেগে গেল কাজ সারতে। এবার আর কোন বাধা নাই। এবার ভোজ শুরু হবে নেকড়ের।
ঘোড়া বলল—একটু বাদেই তো মারা পড়ব। একটা উপকার করে যাই তোমার। অবশ্য যদি তুমি চাও, তবেই।
--আমার উপকার করবি? নেকড়ে বলল—শুনি তা হলে, কী উপকার। 
ঘোড়া বলল—শিকার করে খেতে হয় তোমাকে। শিকারের জন্য কত মেহনত করতে হয়, তা তুমি ভালোই জানো।
নেকড়ে বলল—করতেই তো হয়। তাতে কী হোল?
--সারা জীবন ছুটে বেড়িয়েছি আমি। কতো কতো জায়গায় ঘুরেছি। দেখেছি কতো, শিখেছি কতো কিছু না। কোথায় গেলে, সহজে মনের মতো শিকার পাওয়া যায়, তাও জানি আমি। 
নেকড়ে বলে উঠল—বাহ, এ তো ভারি ভালো খবর। বল দেখিনি শুনি।
ঘোড়া বলল—সে কি এক জায়গায় নাকি গো? অনেক জায়গা আছে এ রকম। সব কি আর মুখস্থ করে রাখা যায়?
--তবে?
--সব লিখে রেখেছি একটা একটা করে। আমার পেছনের দু’পায়ের খুরে, এক দুই করে সব লেখা আছে। নিজে দেখে নাও। মরবার আগে, জায়গাগুলোও সব বুঝিয়ে দিয়ে যাব তোমাকে। 
নেকড়ে তো আহ্লাদে আটখানা। আজ দিনটাই তার একেবারে অন্য রকম। পুডিং তাকে ঘোড়ার হদিশ দিল রাস্তায় বেরুতে না বেরুতেই। ঘোড়া নিজে মারা পড়বার আগে, ভবিষ্যতে শিকারে হদিশ দিয়ে যাচ্ছে তাকে। কার কপালে এমন সুযোগ আসে? 
দেরি না করে, নেকড়ে গিয়ে দাঁড়াল ঘোড়ার পেছনে। খুরের লেখা পড়বে বলে ঝুঁকেছে নেকড়ে। অমনি প্রচণ্ড একটা আঘাত। ঘোড়ার পেছনের পায়ে, ব্জ্রের মত শক্তি। দিয়েছে ঝেড়ে এক লাথি। লাথির চোটে আট-দশ হাত উঁচুতে উঠে গেল নেকড়ের দেহটা। পড়ল যখন, মাথাটা ভেঙে পড়বার জোগাড়। সারা শরীর রক্তে মাখামাখি। 
একটু মুচকি হাসল ঘোড়া। হেলতে দুলতে চলে গেল সেখান থেকে।
রক্তে ধুলোয় মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে নেকড়ে। মরবার আগে, অনুশোচনা হতে লাগল নেকড়ের ঃ আমি সত্যিই মাথামোটা, নইলে কেউ বড় রাস্তা ধরে হাঁটা চলা করে? মাথায় কিচ্ছূটি নাই আমার, নইলে একটা পুডিং আমাকে বোকা বানায়? আমি কি ঘোড়াটার মালিক, যে আমি তাকে কাদা থেকে টেনে তুলতে গেলাম? আমি কি ঘোড়াটার মা, যে তাকে চেটে চেটে পরিষ্কার করতে বসলাম? তাছাড়া, আমি আবার কবে পড়াশুনা শিখলাম, যে বদমাসটার খুরের লেখা পড়তে দৌড়ে গেলাম? আমার এই সব বোকামির জন্যই তো এখন … 
এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে বেচারা নেকড়ে মারা গেল, কেউ জানতেও পারল না।
খানিক বাদে এক পাল হায়েনা এসে জুটেছিল ডোবাটার পাড়ে। তারা দেখতে পেল নেকড়েকে। চেটেপুটে সকালের জলখাবার খেয়ে গিয়েছিল তারা তারিয়ে তারিয়ে।

Post a Comment

0 Comments