জ্বলদর্চি

গল্প ধারাবাহিক। দখলদারী পর্ব ১ /বাসুদেব গুপ্ত

গল্প ধারাবাহিক। 
দখলদারী পর্ব ১ 
বাসুদেব গুপ্ত

এমনটিও হয়?
দীপঙ্করের বিশ্বাস হচ্ছিল না কিন্তু দেখতেই পাচ্ছে নিজের চোখে।
দড়িটা ছিঁড়ে গেল। ধপাস করে মেঝেতে পড়ে ঠেলে দেওয়া চেয়ারের কোণে গিয়ে মাথাটা খট করে ঠুকে কপালে একটি নিটোল বেবি পটাটো । 
হাসি পেল। কপালে নেই বলে ভাবাটা মিথ্যে। কপালে এটাই ছিল। হলো। 
কোনমতে হাঁকুপাকু করে উঠতে গিয়ে আবার পাটা গেল পিছলে। চোখের জল বা ঘাম কে জানে? হবি তো হ, চেয়ারটা গিয়ে ধাক্কা মারলো কাঁচের টিপয়টাকে। সে যেন অপেক্ষায় ছিলো। ঝরঝর করে তন্বী টিপয়ের কাঁচের ত্বকে অদ্ভুত এক কাঁপন এসে লাগল। যেন বয়স বাড়তে বাড়তে পুরনো ভালবাসার মত আণবিক বাঁধন কেটে যাচ্ছে তার ক্রিস্টালের। ঝরেই যাচ্ছে ঝরেই যাচ্ছে কাঁচ। ভেঙে যাচ্ছে অণু অণু হয়ে।
আর দরজা হাট করে খুলে সামনে দাঁড়িয়ে দৃশ্য দেখছে মীনাক্ষী। 
আওয়াজ হবে আর মীনাক্ষীর কানে যাবে না তা হয় না। দরজায় দমাদম ধাক্কা দুটো পড়তেই পলকা পাল্লা সটান খুলে যেতে দীপংকর আর কি করে। একটু অপ্রস্তুত হাসি দিল। ওটাই ওর ন্যাচারাল হাসি। মীনাক্ষীর সামনে। 
মীনাক্ষীর পরিচিত অগ্নিময় দৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে দীপঙ্করের আবার মনে হলো
এমনটিও হয়?

এই তো একমাস আগে গায়ে গা দিয়ে ঘন হয়ে বসে মীনাক্ষী অথবা মীনু সেলাই করছিল জামার বোতাম। মীনু এক অদ্ভুত মানুষ। মোবাইল দেখতে ওর ভালো লাগে না, রীল দেখলে চোখ ব্যথা করে, ফেসবুক করে না। এই যুগে একেবারেই মিসফিট। মাঝে মাঝে যখন দীপংকর দেখায় তেষট্টিটা লাইক পড়েছে ওর কান্দোলিম বীচের ছবিতে তখন মীনু শুধু ঠোঁট উল্টে হাসে। ঐ একটা ভংগী যেটা দেখে দীপংকর রেগে যাবে মীনু জানে। আবার এটাও জানে দীপু বেশি রেগে গেলে চুমু দিয়ে দিয়ে ঠোঁট একেবারে সোজা করে দেবে। তখন ও যেন চেন্গিসের বংশধর। দীপঙ্করের চোখ আটকে যায় একটা পোস্টে। 
আমার দাদা তড়িত প্রসাদ সামন্ত কাল আত্মহনন করেছেন। এই পাতায় উনি আর পোস্ট করতে পারবেন না। আমি ওনার ভাই শক্তি। 
দীপংকর খানিকক্ষণ চুপ মেরে গেল, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে হঠাৎ টেনে টেনে নিঃশ্বাস নিল। তারপর স্বগতোক্তি বেরিয়ে এল, কি যে সব হচ্ছে আজকাল!
তড়িত ছিলেন ওদের অআকখ৪৫ গ্রুপের নিয়মিত লেখক। নানা রকম ঘটনা পোস্ট করতেন, নিজের মন্তব্য রাখতেন, কাউকে ট্রোল করতেন না, আবারর ট্রোল হলে জবাব দিতেন না। এমনি করে ধীরে ধীরে তার সম্বন্ধে একটু তাচ্ছিল্যই গড়ে উঠেছিল। শেষ দিকে ওর লেখা কেউ পড়তও না, লাইকের সংখ্যা কমতে কমতে একদিন শূন্য হয়ে গেল। ওনার শেষ পোস্ট ছিল মধ্য প্রাচ্যের যুদ্ধ নিয়ে। হাতের কাছে এত গরম গরম আন্দোলন, ধর্ষণ ছেড়ে উনি কেন যে এমন একটা নিষিদ্ধ এবং বোরিং ব্যাপার নিয়ে লিখতে গেলেন কে জানে। যাই হোক শেষ লাইন উনি লিখেছিলেন, ‘আদিম হিংস্র মানবিকতার আমি যদি কেউ হই, স্বজন হারনো শ্মশানে তোদের চিতা আমি তুলবই।“ 
এই লেখাতে একটা খালি হাহা পড়েছিল। তড়িতবাবুর আর একটা মজার ব্যাপার ছিল ওঁর কোন প্রোফাইল ছবি ছিল না। মাসে মাসে তা পাল্টাতো না। ফলে কেউ ঠিক জানতো না উনি ঠিক কেমন দেখতে, চশমা আছে কিনা, চুল পাকা না আধ পাকা, চোখের তলায় কালি না ঠোঁটে ঝুলনো তাচ্ছিল্য, কেউ জানতো না। এখন তো তাঁর চিতাই উঠে গেল।
তারপর থেকেই এই একটা আলাদা অজানা কেউ শ্বাস নিতে শুরু করে দীপঙ্করের বুকের ভিতর। 
কি লাভ? এই বোগতাড়ুয়ার মত জীবনটা কাঁধে বয়ে নিয়ে যাওয়াতে কার লাভ হচ্ছে?
ক্যান্সার যেমন এক প্রবল উদ্ভিদের মত শরীরের বীজতলায় জন্ম নেয়, পরাক্রান্ত জমিদারের মত খাজনা নিতে থাকে, নতুন ঘৃণার রাজনীতির মত অধিকার করতে থাকে একে একে কোষ, সে এক জান্তব অস্তিত্ব। তার সঙ্গে লড়াই করা যায়, হারি জিতি যাই হোক, একটা তুমুল লড়াই তো শরীর করে, চিকিৎসা বিজ্ঞান যদি হাসপাতালে কর্মবিরতি না থাকে, তারাও তাদের রোগীদের প্রতি অপরিসীম করুণায় মূল্যবান গরম আলোর টিউব লাইট নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলে, তার একটা মজা আছে। নাম হয়, আহা ক্যান্সার রোগী উনি যাচ্ছেন, আর কটা দিন? যে মুখের খোমা দেখে যুবতীদের মনে বিস্বাদ ছাড়া কোন কম্পন ওঠেনি, কেশহীন মাথা আর সরু হয়ে যাওয়া খাঁচা দেখে, তাদের চোখেও মুহূর্তের জন্য বাষ্প ভেসে যায়।

🍂

কিন্তু এই ভাবনা এলো এক আচম্বিত অতিথি। সে অতিথির অধিকার কোন জমি চায় না, ভূমি মাঙ্গে না, সে আত্মার পাশে আর একটা আত্মাকে বসিয়ে দেয়। যেন এক ফুটপাথে দুই কম্পানীর ভিখিরি। যেন এক স্টেজে দুই আরটিস্ট, এক মাঠে দুই দলের প্রতিবাদ সভা। 
মাথার পারলামেন্টে ভীষণ গোলমাল হতে থাকে। দীপঙ্কর যাই বলে নিজের মনের চেম্বারে বসে বসে, এই অনাহূত উকিল উঠে দাঁড়িয়ে বলে, কি লাভ? মোটিভটা কি? কি চান সত্যি করে বলুন দেখি কি লাভ?
দীপঙ্কর একটা জমির জন্য আবেদন করে আসছিল অনেক দিন ধরে। মহামান্য সরকারের প্রতীক বদল হয়, কিন্তু তার পুষ্পবনের বনমালীরা একই পান, একই পান মশলা খায়। তবে নিয়তি কে ন বাধ্যতে? হঠাৎ শিকে ছেঁড়ে, চিঠি আসে কো অপারেটিভ প্লটের এলটমেন্ট হয়েছে তাদের নামে। আরো চারজন প্রতিবেশী এই প্রচেষ্টার শরিক। কয়েক রবিবার মিটিং হয়, চা আর মিরচিরামের নওরতন চানাচুর সহযোগে। সরকারী অফিসে খোঁজ খবর হয়, দাদাদের সঙ্গেও দেখা হয়। কিছু উপরি জনসেবার উদ্দেশ্য দান করতে হবে সেটাও সেটল হয়ে যায়। মাত্র ১০ লাখ টাকা। অমিত সাধুখাঁ খুবই উত্তেজিত ও উল্লসিত হয়ে একদিন মাংস ভাতের নেমন্তন্ন করে বসেন। পরে অবশ্য ফোন করে অনুরোধ করেন, এটাও কোঅপারেটিভ হলেই ভাল হয়। 
বাড়ীতে মিনু সব শোনে, কান দেয় না। তার এমনিতেই উৎসাহ কম। বাবা বোন মা তিনজনেই লাইন দিয়ে বিদেয় হয়েছেন, সরকারের মত ঈশ্বরের হাতেও এজেন্টের অভাব নেই, ব্লাড ক্যান্সার, লাঙ্ ক্যানসার যখন একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছিল, তখন কোভিডের আবিষ্কার করে সুপারবসের নিশ্চয় খুব আহ্লাদ হয়েছিল। তিনি একদিনেই ফ্যামিলির লকডাউন করে দিয়েছেন। মিনুর তাই আর আহ্লাদ আসে না খুব একটা। আড়াই লাখ টাকা ঘুষ দিতে হবে শুনে অবাক হয়েছিল, ‘এত কমে? ভালোই তো?’
-কিন্তু ক্যাশে দিতে হবে, হোয়াইট হলে চলবে না। 
-মানে কালো টাকা? সে এখন কোথায় পাব আমরা?
দীপঙ্করের প্রতিবেশিরা এ ব্যাপারে খুব পটু, তারা বলল, ‘আপনি যদি না দিতে পারেন তাহলে সারেন্ডার করে দিন, নস্করের জামাইকে দিয়ে দেব। ‘
দীপঙ্করের সঙ্গে এ নিয়ে ঝগড়াও হয়ে গেল, কিন্তু টাকার ব্যবস্থা কেমন করে হবে বুঝতে না পেরে সে যখন খুব মনমরা তখন সেই মনের ভিতর মনমরা উকিল কালো শামলা পরে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, বেশ তো আছো, এসব করে কি লাভ ? দীপঙ্কর তাকে তাড়াতাড়ি থামুন তো বলে এক ধমক লাগায়।

মন উকিলের পশার ভালো যায় না অনেক দিন। দীপঙ্কর মনের ভিতর এমন অনেক পেশা বানায় স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে। মন উকিল, মন পেয়াদা, মন জুয়াড়ী, মনকিপ্টে। সবাইকে ও বসে বসে কাজ দেয়, ওদিকে কম্পিউটার এ আই মডেল বানাতে থাকে, এখান থেকে ওখান থেকে চুরি করে অজানা সব মানুষের ছবি, অজানা সব মানুষের অনর্গল ইন্টারনেটে কথা বলা। দীপঙ্কর সবাইকে কাজ দিয়ে পা তুলে বসে থাকে, সামনে ১২ তলার ধুলোমাখা জানলার কাঁচ দিয়ে দেখা যায় মিনি মিনি স্কাইস্ক্রেপার, তার খোপে খোপে বসে স্ক্যামাররা কাজ করে চলেছে মন দিয়ে। ফেক ইন ইন্ডিয়া। একটা লোক একটা দড়ি দিয়ে ঝুলে ঝুলে রঙ করছে। ১২ তলার ওপর থেকে ওর কি মনে হচ্ছে এখন? দড়িটা যদি ছিঁড়ে যায় তাহলে সোজা নীচে। দীপঙ্কর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে কি লাভ?
ওর কপালেও যে দড়ি ছিঁড়বে কে জানতো। 

-ক্রমশঃ-

Post a Comment

0 Comments