ভাঙা আয়নার মন
পর্ব -৩১
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া
|| কফি হাউস বনাম কমলা মিষ্টান্ন ভান্ডার ||
নিত্য গোপাল হলে ক্রান্তি চলছিল তার আবার এক ঘন্টা হয়েও গেছে। হিন্দি সিনেমা ঝিনির খুব একটা দেখা হয়নি। সত্যি বলতে কি সিনেমা জিনিসটাই খুব বেশি দেখা হয়নি। মাঝে কিসের গোলমালে নিত্য গোপাল বছরদুই বন্ধও ছিল।অবশ্য শীতের কালে জমির ধান কাটা হয়ে গেলে শুকনো নাড়ার মাঠে মাসখানেক ধরে খোদাবক্সের টিনের হলে যে সব সিনেমা দেখানো হত সেখানেও মা কিংবা ছোড়দার সঙ্গে তিন চারটে বই সে দেখেছে।
আ লো সুশীল্যা! নিত্য গোপাল হলের দিকে মা বা সেজো রওনা দিলেই বড় মাসি রেগে রেগে পান ছেঁচতে ছেঁচতে ছোট পিসিমাকে সাক্ষী মানে। আক্কেলখান দ্যাখছোসনি? পোলাপাইন থুইয়া কয়দিন হইছে ক' দেহি মাইজ রাততিরে যাততারা দেইহা ফেরছে অরা?আইজ আবার আ্যগো বই দ্যাহোনের হাউস হইছে। হেই যে কতায় কয় না আদেখলার ঘডি হইল/ জল খাইতে পরাণ গ্যালো আ্যগো আজাইরা কাম দেইখ্যা হেয়াই মনে কয়।ছোট পিসিমা যদিও পান চিবিয়েই খায় তার পানের নিজস্ব বাটাও সঙ্গে মজুত তবু সেজে গুজে মা আর সেজোর এই বেরিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে খুল্লে আর বরিশালের গলাগলি একাত্মতায় বড়মাসির ছেঁচা পানের ভাগ মুখে পুরে পানের বোঁটার চুনটুক দাঁতে কেটে বলে কতাকান কতিছো তো ঠিকই বড়োদ্দি,অশল্যি আর দেকতি পারতিছি নে। কি ওগে ছবি দেকপার নেশা কতি পারিনে।কাজকাম ছড়ায় রাহে তাগেদা অরতি অরতি যাতিছে ক্যাম্বায় দ্যাহো।
সিনেমাকে বই নাইলে ছবি বলে কেন রে?দিবে মাতাল বিকেলে হাটখোলায় আলুর চপ বেঁচে আর রাতে বিককির না হওয়া চপ দিয়ে নিজেই মদ খায়।চপের নাম যমবড়া।হাটের পয়সা থেকে অল্প কিছু সরিয়ে সিঁড়ির তলায় হাট ফেরতা দাদারা চুপচাপ মন দিয়ে সেই নিষিদ্ধ চপ খাচ্ছিল।বাদ দে।ওর'ম বলে তাই বলে মুখভর্তি চপ নিয়ে দানি উত্তর দিলো।জানিস নে সেটা বললেই হয়।
কোত্থেকে ফিরছিল তাদের বাবা। দানির হাতে গরম উত্তরে তর্ক একটা বেঁধেই যাচ্ছে দেখে বাবা এগিয়ে এসে বলল আসলে কোনও একটা কাহিনি থেকে সিনেমা তৈরি করা হয় তো আর কাহিনি থাকে বইয়ে। সিনেমা দেখা মানে সেই বইটাকেই দেখা এই ধারণা থেকেই বলে বোধহয় আর আগে তো নির্বাক ছবির অভিনয় চলতো তাইই ছবি।দানি বলে ওঠে আর টক শুরু হলেই আমাদের গ্রেট নিত্য গোপাল টকিজ।আর ছবিরা চললেই এক্কেরে চলচ্চিত্র! বলেই দানির আধখানা চপ মুখে পুরে দিল ঝিনি। বেআইনি চপ এবং তার জবরদখল না দেখার ভান করে বাপি মুচকি হেসে ভেতরে চলে গেল আর ওরে আমার চলোচিত্তোচঞ্চোরীইইই বলে বাহবা দেবার ভঙ্গিতে পিঠে খুবই জোরালো থাবড়া দিয়ে শোধ তুলল দানি।ইচচ্ পোলাপাইন! দিছে পিঠখান চলা কইরা? চার মূর্তির হাবুলের নকল করে খ্যাক খ্যাক হাসি দিল ছোড়দা।
বাবার ব্যখ্যাটা দাদাদের সঙ্গে তারো ঠিক লেগেছিল তবে ওই টিনের হলে মা'র সঙ্গে গেলে মা'র চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো কারণ অল্প কিছু চেয়ার শুধু নামি দামি বড় মানুষদের জন্যই বরাদ্দ আর ছোড়দার সঙ্গে গেলে মাটিতে বসতে হতো। মাটিতে খড় বিছিয়ে তার ওপর তেরপল পেতে বসার জায়গা। কথাও ভালো শোনা যায় না। তেরপলের ওপর বসতে সমস্যা না শুধু সামনে বড় মানুষ বসার কারণে কিছুই দেখা যেত না বলে খালি খালি ছোড়দা বলত ঝিনিইই আমার কোলে বসে দ্যাখ। কোলে বসেও তেমন কিছু উঁচু হওয়া যায় না কাজেই থেকে থেকে তাকে হাঁটু ভর দিয়ে উঁচু হতে হতো। আবার তিন ঘণ্টা নিলডাউন হওয়াও চাড্ডিখানি নয় বলে সিনেমা ব্যপারটাই সে এড়িয়ে চলতো।
পলেস্তারাহীন তাদের গার্লস ইস্কুল প্লাস্টার করতেও ইস্কুলের মাঠেও টিন ঘেরা দিয়ে দিন দশের জন্য সিনেমা দেখানো হয়েছিল। সেখানেই সে দাদাদের সঙ্গে রাজেশ খান্নার হাতি মেরে সাথী দেখেছিল।আর আজ দ্বিতীয় হিন্দি ছবি এই ক্রান্তি। তাদের বাড়ি হিন্দি গান শোনাও বারণ। কথা বুঝতে তাই বেশ অসুবিধেই হচ্ছিল তবুও শেষের দিকে সে ঢুকে পড়ল জবরদস্ত নাচ গান আর কাহিনির মধ্যে। যদিও ঢুকে অবধি রিতা থেকে থেকেই ডুকরে উঠছিল কাটিং শোটাই দেখা হলো না। আদিখ্যেতা !সিনেমা টাই আদ্দেক হয়ে গেছে !আশ্চর্য! কাটিং শোর জন্যই ওনার শোক উথলে উঠছে! খেঁকিয়ে উঠছিল কণা। যতটা সম্ভব চেপেচুপে ধমকাচ্ছিল ওকে।আরে এক রিলের ওই দু তিনটে কাটিং শোই তো আসল।ওই গমগমে লোকটার গলা শুনতেই আমি হলে ঢুকি। রিতাও ফিসফিসিয়ে বোঝাচ্ছিল কণাকে। সেসবে কান না দিয়ে ঝিনি মন দিয়ে নাচগান দেখছিল।
🍂
খোঁচাচ্ছিস কেন? বিরক্ত হয়ে কণার দিকে ফিরে দেখল খোঁচার আঙুলটা দিয়ে ওপাশের কলিকে দেখাচ্ছে সে।চেয়ারের ওপর উবু হয়ে পেছন ফিরে বসেছে কলি।ই কি রে! সিনেমা না দেখে ওর'ম জুলজুল করে পেছনে কী দেখছিস? কলির বেপরোয়া স্বভাবের সব বীরত্ব ফুস হয়ে গেছে ততক্ষনে। আরশোলা যে রে! আম্বা দেখো না।কেটিছিস তো পঁচাত্তর নয়ার টিকিট! ওই পয়সায় তেলাপোকা না তো কি জলহস্তী থাকবে সিটে? আরশোলা নিয়ে ন্যাকামো বন্ধ কর
ওরে ম্মা! বলে নিজের মাথাতেই ল্যান্ড করা আরশোলাটাকে এক ঝটকায় মাটিতে ফেলে উঠে দাঁড়ালো কণা।
এসব আউপাতালি ঝঞ্ঝাটদের মধ্যে ভালো একটা জিনিষ দেখার উপায় আছে? আরশোলা নিয়ে মাতামাতি থেকে মুখ ফিরিয়ে আবার সে ছবিতে মন দিলো কিন্তু তার বাঁ দিকে বসেছে রিতা আর তার পাশের সিটে কম বয়সী এক মা বছর পাঁচ -ছ'য়ের ছেলে কোলে দিব্যি সিনেমা দেখছিল। ওখানেই ওই রো টার শেষ। ঢালু আর সরু প্যাসেজটা পর্দার দিকে চওড়া হয়ে নেমে গেছে। দেওয়ালের গায়ে দুটো দরজার একটা দিয়ে বেরিয়ে হলের সামনের দিকে যাওয়া যায়। ছবি শেষ হলে সামনের গেট ছাড়াও এই পাশের দরজাটা খুলে দিয়ে দর্শকদের বেরোতে দেওয়া হয়।আর একটা বাথরুমে যাওয়ার।
তা সত্ত্বেও বাচ্চা ছেলেটা গা মুচড়ে কোল থেকে নেমে মা ! মা রে!মোতপো!বলায় তার মা বলল দেওয়ালে সরি গে মোত! বাথরুমে নিয়ে যান!হলের মধ্যে পেচ্ছাপ করাচ্ছেন কেন! লাফিয়ে উঠে ঝিনি মহিলাকে স্বাস্থ্য বইয়ের ভালো ভালো কথা বোঝাতে লাগলো।এইটুকু নাবাল ছেলি তো। এদের মুত ধরো গে গঙ্গার জল। সে র'ম বাড়ন্ত হলি বাইরি কি নে যাতাম না?বাচ্চার মা উত্তর দিল। ততক্ষণে বাচ্চাটা দেওয়ালে কম্মো সেরে হাঁচড়ে পাঁচড়ে আবার মা'র কোলে চড়ে বসেছে।আর থাক।আর বলতে হবে না।ওই দ্যাখ গঙ্গাজল দিয়ে কেমন চমৎকার লম্বা পানা শ্রীলঙ্কার ম্যাপ তোয়ের করিছ! রিতা তার কনুই ধরে ফের সিটে বসিয়ে দিলো। আশেপাশের দর্শকরা হিমালয়ের মতো মৌন অটল ধৈর্য্যে ছবি দেখছিল।
সিনেমা শেষে খানিক জবুথবু পেচ্ছাপ ডিঙিয়ে তারা বেরিয়ে এলো হল থেকে।
গলা খাঁকরে বুলি বলল একটা জিনিষ খেয়াল কর,মানুষের নামের শুরুতে না হয় শ্রী টি থাকে কিন্তু এই হলটারো নামের আগে শ্রী!
স্বপ্নপুরী সিনেমা হল যার আদত নাম শ্রী নিত্য গোপাল টকিজ এবং সরু মতো সেই টাক মাথার লোকটা রোজ বেলা নটা দশটা নাগাদ সাইকেলে সিনেমার ছবি সাঁটা প্লাকার্ড বেঁধে নিয়ে মাইকে সিনেমার নাম ধাম বলে যখন সে হলের দুখানা
নামই বলতে বলতে যায়। মাইক নিয়ে শুরুটাই হলো বেলগড়িয়া শ্রী নিত্য গোপাল টকিজ স্বপ্নপুরী হলে নাচে গানে মাতোয়ারা করে দিয়েছে সম্পূর্ণ রঙিন ইত্যাদি ইত্যাদি।
এর মানে হলো হলের মালিক নিজের অথবা বাপ ঠাকুদ্দা কারো নামে এই হল চালান এবং চাদ্দিকে ভালো ভালো সব হলের নাম কাগজে পড়ে নতুন নাম স্বপ্নপুরী রাখলেও পুরোনো নামটা প্রাণে ধরে বাদ দিতে পারেনি এবং পুরনো নামের আগে শ্রী টুকুন বাদ দিতে তার বড্ডোই মায়া করেছে প্রাণে।বড়ই যুক্তিসঙ্গত টিকা এবং ব্যখ্যা শুনে শুনে খিদে পেয়ে গেল রে।চ' কিছু খাই। কণার কথায় সত্যি রে খিদেটা পেটে বড্ডোই চাগান দিয়েছে রে!
কিন্তু বিরাট বড় হয়ে আজ তো তারা সবাই সাপের পাঁচ পা দেখেই ফেলেছে। কাজেই কিছু একটা করতেই হচ্ছে বড়দের মতো। কলি বুদ্ধি দিল,কফি হাউস। তখন মান্না দের "কফি হাউসের সেই আড্ডাটা" গান সবার মুখে মুখে ফেরে। ঝিনি আবার শিস দিয়ে গানটা তোলার চেষ্টায় আছে। প্রস্তাবটা লুফে নিলো সবাই।এটাও বড়দের মতোই ব্যপার।তাদের গাঁ গেরামে কফিহাউস নেইতো কী, তারা গম্ভীর মুখে কমলা মিষ্টান্ন ভান্ডারে ঢুকে গেল।
চা আর দুটো করে সিঙ্গারা। চাটনি দেবে বেশি বেশি।দোকানের মালিক বিজুদা খুব চেনে সবাইকে।কানের গোড়ায় হাত এগিয়ে এনে আ্যই দোকানে এলি যে! তোদের না পরীক্ষে চলছে? শেষ!শেষ! তারা হাত ঝাড়তে থাকে। জীবনের যাবতীয় পরীক্ষেই শেষ করে ফেলেছে এমনই হাবভাবে বিজুদাও হাসে। চাটনি বেশি বললাম আর দিলেই না যে ও বিজুদা? চাটনি নেই।ওই তো কড়ায় দেখতে পাচ্ছি। ওরে ও চাটনি খাসনি কো বিজুদা খুব ষড়যন্ত্রের মতো গলা নামিয়ে
ফিস ফিসিয়ে বলে চারদিন হইছ ও চাটনিতি পোকা হই গেছ।খেলিপ্পর পেট লাবব্যান।তো রেখি দোছ কেন ও জিনিস? খদ্দেরদেরুতো পেট লাবব্যান।ফেলি দ্যাও।ফেলতিছ।দিনির ব্যালায় ফেলিনে কিছু।সনঝে হই গেছ এইবার ফ্যালবো।তোরাও বাড়ি যা। রাত হচছে বলো। তারা অবিশ্যি মোটেও সে কথায় কান দেয় না।বিজুদার চা- সিঙারা খেয়ে কণাদের বাড়িতে লুকিয়ে সিগারেট টেনে হেঁচে কেশে একশা হয়ে শেষ মেষ ক্ষ্যান্ত দেয় সব।
বাড়ি ফেরে লাফাতে লাফাতে।দাদামনিকে রুদ্ধশ্বাসে শোনায় প্রথম দেখা হিন্দি সিনেমা 'ক্রান্তি'র আধখানা গল্প। আরে দূর ওই পাতি সিগারেট কেউ খায়?গোপনে প্রথম তাদের ফেলুদার ব্র্যান্ড খাবার চমকদার উত্তেজনা দাদামনি একেবারে নস্যাৎ করে দেয়। প্যাকেট পুরো শেষ হয়নি। চারমিনারের আধ প্যাকেট কণাদের বাড়ি কাকিমার সুতোয় বোনা সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে বাঁধানো ফটোর পেছনে লুকিয়ে রেখেছে তারা পরে আর একদিন খাবে বলে কিন্তু দানির কথায় দমে গেল সে।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপনের বিকল্প বিজ্ঞাপনই || ঋত্বিক ত্রিপাঠী
0 Comments