পর্ব- ৪৪
স্বপন কুমার দে
সম্পূরকের সঙ্গে মল্লিকার দেখা হয়েছিল প্রায় তিন বছর আগে। তারপর যে সম্পূরক মল্লিকার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেনি, বা হঠাৎ তাদের মধ্যে দেখা হয়ে যায়নি, এজন্য মল্লিকা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। অবশ্য মন্টি একবার তাকে ফোন করেছিল। সে তার নিজের পড়াশোনার কথাই বেশি বলেছিল। বলেছিল, ম্যাডামের কথা খুব মনে পড়ে। সে শুনেছে ম্যাডাম কোনো এক কলেজের লেকচারার, কিন্তু কোন্ কলেজের, তা জানত না। বাবা-মা, দাদু-ঠাম্মির কথা বলেছিল। কাকুর কথাও। বলেছিল, তার কাকু নাকি এখন বাড়ি খুব কম আসে। মল্লিকা শুনেছিল বেশি, বলেছিল কম। অবশ্য, মন্টিকে ভালো পড়াশোনা করার পরামর্শ দিয়েছিল।
মল্লিকার কখনও কখনও নিজেকে খুব একলা মনে হয়। মনে হয়, কেউ যদি পাশটাতে বসে তার সাথে গল্প করত, তার ভুলগুলো ধরিয়ে দিত, নতুন কাজে উৎসাহ দিত, তবে ভালো হত। কখনও কোনও বৃষ্টিমুখর দিনে, কিংবা অন্ধকার রাতে মেঘহীন আকাশের দিকে চেয়ে মনে পড়ত শৈশবের কথা, স্কুল জীবন কলেজ জীবনের কথা। তখন কেমন যেন একা একা লাগত। দিনের বেলায় অবসর পেলে দুখিদির সঙ্গেই কথা বলত। শুনত তার বাল্যজীবনের কথা। পাহাড়তলির এক ছোট্ট গ্রামে খুব গরিব ঘরে আরও কয়েকজন ভাই বোনের সঙ্গে বেড়ে ওঠা, না খেতে পাওয়া, ধুঁকতে থাকা জীবনের কথা। আরও শুনত, পাহাড়ের, জঙ্গলের অপরূপ শোভার কথা।
কখনও কোনো অবসরে সম্পূরকের কথা মনে পড়ে গেলে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করত। মনকে অন্য প্রসঙ্গে নিয়ে যাওয়ার বৃথা চেষ্টা। ভালোলাগা, মন্দলাগার বাইরেও অন্যরকম একটা অনুভূতি আছে যেটা মাঝে মাঝে চেতনাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যায়। তখন সেই জাল ছেঁড়া সহজ হয় না। এক একবার মনে হয়, ভালোই হয়েছে। নিজের জীবনের সঙ্গে সম্পূরকের জীবন জুড়ে দিলে সারাজীবন সম্পূরক শুধু কষ্টই পেত। তখন ভালোবাসার মোহ ঘুচে গিয়ে প্রত্যাশা অনাদায়ের অভিযোগে তিক্ত হত স্বাভাবিক সম্পর্ক। তাই ভালোবাসাকে বাঁচাতে এই দূরত্বটুকু অবশ্যম্ভাবী ছিল। কিন্তু শুধুই কি তাই? সমাজের প্রতি কোনো অভিযোগ কি তার আত্মাভিমানে আঘাত করেনি? আঘাত সে ফিরিয়ে দেয়নি, তবে নীরব প্রতিবাদে সমাজকে বিদ্ধ করেছে।
মল্লিকা ব্যস্ত থাকে তার কাজকর্ম নিয়ে। কলেজ এবং পাঠশালা ছাড়াও বিভিন্ন রকমের সামাজিক কর্মকান্ডের সঙ্গেও সে যুক্ত। সেই কারণে অনেকদিন যাওয়া হয়নি নিজের জন্মস্থান, নিজের শহরে। পৈতৃক বাড়ি যেটুকু ছিল সেটা লাইব্রেরির জন্য দান করে এসেছে। নিজের জমানো টাকা দিয়ে শিক্ষা সহায়ক কিছু বই কিনে তৈরি করেছে লাইব্রেরি।নিজের বাবা মাকে উৎসর্গ করে নাম দিয়েছে ' গৌরি-দিননাথ পাঠভবন'। লাইব্রেরিটি দেখাশোনা ও পরিচালনা করে ক্লাবের ছেলেরা। শিশুশিক্ষা ও বয়ষ্কশিক্ষার বই ওখানে পড়ে ওখানেই জমা দেয় পাড়ার ছেলে,মেয়ে, বুড়োবুড়িরা।
🍂
মল্লিকা উঠে পড়ল হাওড়াগামী এক্সপ্রেস ট্রেনে। জেনারেল কম্পার্টমেন্ট। যেহেতু উইক এন্ড, অনেকের বাড়ি ফেরার তাড়া,তাই পুরুলিয়ার স্টেশনেই সিট ভরে গেল। কোয়ার্টার থেকে বেরোনোর আগে দুখিদি টিফিন তৈরি করে টিফিন বক্সে ভরে দিয়েছে। বারে বারে বলে দিয়েছে," ট্রেনের খাবার খেওনি দিদিমণি। যা করে দিলম, সে গুলানেই খাবে।"
" আচ্ছা" বাধ্য মেয়ের মত বলেছিল মল্লিকা।
অনেকদিন পর মল্লিকা বাড়ি ফিরছে। নাই বা থাকল মা বাবা, তবুও মনের মধ্যে একটা আলাদা অনুভূতি হতে লাগল তার। কতদিন পরে পরিচিত প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেখা হবে। চির পরিচিত জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসার টান তাকে আচ্ছন্ন করল। মনটা উতলা হয়ে উঠল।
ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ পরেই তাদের কামরায় একটা গোলমাল শুনতে পেল মল্লিকা। প্রথমটায় মল্লিকা অতটা গ্রাহ্য করেনি। ট্রেনে এরকম তো হামেশাই হয়। কেউ আনন্দে হল্লা করে, কেউ বা সিটে বসার জন্য ঝগড়া করে, কখনও বা হকারের সঙ্গে তর্ক হয়। এই ভেবে সে বিশেষ গুরুত্ব দিল না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তার ভুল ভাঙল। কারও একটা গোঙানির আওয়াজ পাওয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গেই একটা হৈ চৈ," ডাক্তার ডাকো, জি আর পিকে ফোন করো " ,ইত্যাদি। মল্লিকা পাশের লোকটিকে জিজ্ঞেস করল," কী ব্যাপার বলুন তো? কেউ অসুস্থ হয়েছে নাকি?"
লোকটি একটা কৃত্রিম হাই তোলার ভঙ্গি করে জবাব দিল," কার খবর কে রাখে দিদি? আপনার জানতে ইচ্ছে করছে তো যান না।"
মল্লিকা ভাবল, এইসব লোকের সঙ্গে বেশি কথা বলাটাও অন্যায়। সে উঠল, চলল গোলমালের জায়গায়। একটা লোক শুয়ে আছে, ভেতরের কী একটা যন্ত্রণায় সে কাতরাচ্ছে। মল্লিকার কেমন একটা সন্দেহ হল, আরও কাছে যাওয়ার চেষ্টা করল। একজন উৎসাহী মল্লিকাকে জিজ্ঞেস করল," দেখুন তো আপনার পরিচিত কেউ নাকি? মল্লিকা আরও এগোল, মুখটা দেখতে চায় সে। মুখটা দেখে মল্লিকা ভয়ে শুকিয়ে গেল,তার মুখটা হঠাৎ বিবর্ণ হয়ে গেল, বুকের ভেতরটায় কেউ যেন জোর ধাক্কা দিল। একটা গোঙানি বেরিয়ে এল," সম্পূরকবাবু!"
পাশাপাশি লোকেরা এবার নড়ে চড়ে বসল। সবাই একস্বরে বলল," যাই হোক আপনি চেনেন তাহলে..।"
মল্লিকা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইল," আপনারা কেউ ফোন করেছেন নাকি?"
" হ্যাঁ, করেছি কিন্তু এখন ট্রেনে কোনও ডাক্তার নেই, বলল। সামনেই বাঁকুড়া স্টেশন। ওরা বলেছে স্ট্রেচার রেডি থাকবে, অ্যাম্বুল্যান্সও থাকবে। কেবল ওনার সাথে একজন সঙ্গীর প্রয়োজন। এখন সেটাও পাওয়া গেল। কি দিদি, আপনি থাকবেন তো, নাকি কেটে পড়বেন?"
" সেটা আপনাদের বলে দিতে হবে না, আমি কী করবো।" বলে দু'হাত দিয়ে সম্পূরকের মাথাটা নিজের কোলের উপর রাখল। গায়ে মাথায় হাত বোলাতে থাকল। বাঁকুড়া স্টেশন পৌঁছাতেই তাকে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে চলল।
ট্রিটমেন্ট শুরু হয়ে গেছে। সম্পূরকের বাড়ির লোক রাস্তায় আসছে। মল্লিকাই তাদের খবর দিয়েছে। কিন্তু এখানে পৌঁছাতে এখনও ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগবে। উৎকণ্ঠায় হাসপাতালের করিডরে পায়চারি করছিল মল্লিকা। তারই মাঝে একজন ওয়ার্ড নার্স এসে একটা স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে মল্লিকাকে বলল, হসপিটালের মেডিক্যাল শপ থেকে কিছু জরুরি ওষুধ ইঞ্জেকশন কিনে আনতে। সেসব কিনে এনে দিয়েছিল মল্লিকা।
আরও ঘণ্টাখানেক পরে এসে নার্স বলল," ভয়ের কিছু নেই। উনি এখন অনেকটাই সুস্থ। আপনি দেখা করতে পারেন।"
" ওনার কী হয়েছিল সিস্টার?"
" ডক্টর মনে করছেন, গ্যাস, অ্যাসিডিটি থেকেই প্রবলেম হয়েছিল। অনেকগুলো টেস্ট হয়েছে। দেখা যাক, রিপোর্ট কী বলে?"
সম্পূরকের বেডের কাছে এল মল্লিকা। চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল সম্পূরক। মল্লিকা নিজের হাতটা সম্পূরকের কপালে,মাথায় বোলাতে লাগল। ধীরে ধীরে চোখ খুলল সম্পূরক," মল্লিকা তুমি?"
" হ্যাঁ আমি। এখন ভালো লাগছে? একটু সুস্থ মনে হচ্ছে?"
" অনেকটাই। তুমি ছিলে বলে এবারের মত বেঁচে গেলাম।"
" না, না, আমি কী আর করেছি? যা করার ওরাই সব করেছে।"
" না ওরা সবটা করেনি। ওরা কিছুটা করেছে, সবটা করেছো তুমি। ভেবেছিলাম, তোমার সঙ্গে হয়তো আর কোনোদিনই দেখা হবে না, তাই ভগবান হয়তো এভাবেই দেখা করিয়ে দিলেন।"
" আপনি এখন বেশি কথা বলবেন না, ডাক্তারবাবু বারণ করেছেন। আমি বরং এখন আসি।" মল্লিকা যাবার চেষ্টা করতেই হাতটা ধরে ফেলল সম্পূরক," না, তুমি এখন যাবে না। এই আমি কথা বলা বন্ধ করলাম, শুধু তোমার দিকে চেয়ে থাকার অনুমতিটুকু দাও।"
" একটু পরেই আপনার মা বাবা আসবেন, আমি খবর দিয়েছি।এসে যদি ওঁরা আমাকে এভাবে দেখেন,.. না না , তা হয় না। আমাকে ছাড়ুন।" বলে হাতটা সরিয়ে নিল মল্লিকা। তার দিকে ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে চেয়ে রইল সম্পূরক। চোখ দুটো ছল্ ছল্ করছিল। মল্লিকার হৃদয় তাতে আদ্র হয়ে উঠল," আমি তোমাকে, মানে আপনাকে কষ্ট দিতে চাই না সম্পূরকবাবু। শুধু এটা বলতে চাই, আপনি আমার মান সম্মানের দিকটা একটু বুঝুন। আমাকে সবার সামনে অপদস্থ না করলে কি চলছে না?"
ওরা কথা বলতে বলতেই সম্পূরকের বাবা মা ওয়ার্ডে ঢুকলেন, মল্লিকাকে দেখতে পেয়েই সম্পূরকের বেডে চলে এলেন। মা এসে ছেলের গায়ে মাথায় হাত দিয়ে কাঁদলেন। বাবা জিজ্ঞেস করলেন," কি রে সমু, এখন ভালো লাগছে?"
" হ্যাঁ বাবা, এখন অনেকটাই সুস্থ।"
" মল্লিকা ছিল বলে তুই এতবড় বিপদ থেকে রক্ষা পেলি। ওকে কৃতজ্ঞতা জানাস।"
" ওকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই বাবা। তুমি আমাকে বলে দাও।"
" সে, আমি না হয় পরে বলে দেবো। এখন ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে কথা বলে দেখি, কোনও পরামর্শ দিয়েছেন কিনা। কাল যদি তোর ছুটি হয়ে যায় তখন সবাই মিলে গাড়িতে চলে যাবো। তাহলে গাড়িটাকে একদিন রেখে দিই। আজ একটা লজ দেখে আমি, তোর মা আর মল্লিকা থেকে যাই। না কি বলো মল্লিকা?"
" না, না জেঠু, আমি এখানেই কোথাও থেকে যাবো। আপনারা বরং লজে থাকুন।"
" ওয়ার্ডে তো থাকতে দেবে না মা, তাহলে বাইরে কোথাও থাকতে হবে। দেখেছো মেয়ের কাণ্ড? অতো জেদ ভালো নয় মা, চলো আমরা তিনজন এক জায়গাতেই থাকি।"
এবার বাবার কথায় সায় দেন সম্পূরকের মা," মল্লিকা, তোমার জেঠু যেরকম বলছেন সেটাই করো। উনি তোমার গুরুজন।"
" গুরুজন তো আপনারা দুজনেই, জেঠিমা। সেটা কথা নয়। তবে,..."
" তবে আর কিছু নয়। এবারে বকে দেবো।" বলেই মৃদু হাসেন অমরেশবাবু।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপনের বিকল্প বিজ্ঞাপনই || ঋত্বিক ত্রিপাঠী
0 Comments