জ্বলদর্চি

রাত জাগা তারারা /মিলি ঘোষ

রাত জাগা তারারা

 মিলি ঘোষ


অভাগীনির জানলা দিয়েও মাঝেমাঝে পূর্ণিমার চাঁদ দেখা যায়। সে ঘরে না আছে কবিতা, না আছে স্বপ্ন। তবু চাঁদ আসে ঘুরতে ঘুরতে। জং ধরা লোহার শিকের ফাঁক দিয়ে এক ফালি জ্যোৎস্না আঁচল পেতে দেয় রেবার ঘরে। বৈদ্যুতিক বাতির আলোতে চন্দ্রিমার রূপ যে মাধুর্য হারাবে তা রেবা জানে। তবু ঘরের আলো ওকে জ্বালতেই হয়।


পাশের ঘর থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ পেয়ে থমকে গেল রেবা। ফর্সা

গোলগাল চেহারার বাবুটি তখন রেবার শরীর নিয়ে নিপুণ হাতে খেলা করছিল। ক্ষণিকের জন্য রেবার চোখ যে দেওয়াল ভেদ করে পাশের ঘরে পারুলের কাছে পৌঁছে গেছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি বাবুটির। বিরক্ত হলো।

   বলল, "কে কাঁদছে কে হাসছে তা দিয়ে তোমার কী? এদিকে মন দাও।"


পারুল এবারে বাড়ি থেকে ঘুরে আসার পর থেকেই কেমন চুপচাপ। অনেকটা শীতল জলের নদীর মতো। বয়ে চলেছে প্রতিদিনের মতোই। শুধু হাত ছোঁয়ালে বরফ ঠান্ডা। বিকেল হলে মুখে রঙ মেখে দরজায় দাঁড়িয়ে হা হা হি হি করা ছাড়া সারাদিনে পারুলকে কেউ হাসতে বা গল্প করতে দেখে না। আজ ওর ঘর ফাঁকা। কদিন ধরে জমাট বাঁধা কালো মেঘের আড়ালে কী লুকিয়ে রেখেছে পারুল? কোন্ যন্ত্রণা লাঘব করতে আজ আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি!

🍂

দিগন্তরেখার ধার দিয়ে হালকা আবির মেশানো আকাশ তখন সবেমাত্র উঁকি দিয়েছে। রাতের চাঁদ অভিমানে ডুবে গেছে পশ্চিম আকাশের শেষ রেখাটির ওধারে। জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়াল রেবা। পাড়াটা ঘুমে জড়িয়ে আছে। এই ভোরটুকুই ওদের ঘুমের সময়। একটু আগেও বাড়িগুলো থেকে হাসি গানের শব্দ ভেসে আসছিল। তার মধ্যেই প্রায় নীরবে বেজেছিল পারুলের কান্না। হঠাৎ একদল লোককে আসতে দেখল রেবা। হরে রাম হরে কৃষ্ণ গাইতে গাইতে ওরা খঞ্জনি বাজিয়ে চলেছে। মুখ বাড়িয়ে এই দলটিকে যতদূর দেখা যায় দেখল রেবা। নিজের মনেই বলল, "এরা কি আজকেই প্রথম গেল এ রাস্তা দিয়ে? নাকি সারা রাতের পাপকে ধুয়ে দিতে রোজই যায় ভোর ভোর?" হয়তো যায়। রেবা টের পায় না। ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীরটাকে বিছানায় একবার এলিয়ে দিলে বহির্বিশ্ব নাগালের বাইরে। যে সৃষ্টিকর্তা দুটো গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য শরীরকে জীবিকা করতে বাধ্য করেছেন, যে সৃষ্টিকর্তা শহরের নামজাদা অঞ্চলের ধোপদুরস্ত নরখাদকদের বানিয়েছেন, সেই সৃষ্টিকর্তাই কি ওই মানুষদের তৈরি করেছেন, যারা প্রায়ান্ধকার ভোরে সুক সারির গান গেয়ে রাস্তা পরিক্রমা করে? রেবা অত বোঝার চেষ্টা করে না। নিজেকে এত প্রশ্ন করার সময় কোথায় ওদের? রেবা শুধু এটুকু বোঝে মনের বেশি গভীরে গেলে যন্ত্রণা বাড়ে, যা ওর কাজকে ব্যাহত করে।

আজ কী মনে করে যে জানলায় এসে দাঁড়াল রেবা। ফুলের একটা একটা করে পাপড়ি খোলার মতো করে আলো ফুটছে। রবির প্রথম আলো। নিজের জন্য আক্ষেপ হলো রেবার। জীবন থেকে কতোগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। কেন যে এতদিন এ দৃশ্য থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেছি! তারপরেই সোজা হয়ে দাঁড়াল রেবা। নিজের মনেই বলল, "এ প্রকৃতি বড়ো ভয়ঙ্কর। এর অমোঘ টানে জীবনের স্বাদ আছে। মানুষের মতো বাঁচার হাতছানি আছে। আমি চাই না, চাই না পেতে এ স্বাদ।"

প্রায় টলতে টলতে নিজের বিছানায় ফিরে গেল রেবা।


সকাল দশটা নাগাদ দরজায় জোর ধাক্কা। 

   সীমার গলা, "কী রে, আর কতক্ষণ ঘুমোবি?"

রেবা ঘরের ভেতর থেকেই বাইরে অনেকের গলা পেল। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। সোনাগাছিতে এ আর নতুন কী। দরজা খোলা মাত্রই এক সঙ্গে কয়েকজন মেয়ে রেবাকে বলল, "তোর ওই লাল টুক টুক বাবুটাকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে। এখান থেকে বেরিয়ে বড়ো রাস্তায় পা দিতেই সোজা শ্বশুরবাড়ি।"

   চুলটা মুঠোয় ধরে উঁচু করে খোঁপা করতে করতে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে উত্তর দিল রেবা, "ধরুক। মেরে ফেলুক। আর সহ্য হয় না।"

তারপরেই পারুলের ঘরের দিকে উঁকি দিয়ে বন্ধ দরজার দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইল, "ওঠেনি?"

   দলের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলল, "উঠেছে। ভেতরে আছে।"

   "কাল রাতে কান্নার আওয়াজ পেয়েছিস?"প্রশ্নটা দলের দিকে ছুঁড়ে দিল রেবা।

   "কান্না?" তিন চারজন এক সঙ্গে বলল।

সিঁড়ি দিয়ে চটি ফটাস ফটাস করে মাসিকে নামতে দেখে মেয়েরা চুপ।

   "এই যে সখীরা,কী শলাপরামর্শ চলছে?" 

মাসির বাজখাঁই গলার উত্তরে মেয়েরা বোকা বোকা হাসল।

এবার রেবার দিকে ফিরে বলল মাসি, "চিন্তা করিস না রেবা। কাত্তিক ঠাকুরের শ্রীঘরে যাওয়া অভ্যেস আছে। পয়সা ফেলে বেরিয়ে আসা ওর বাঁ হাতের খেল।"

   রেবা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, "মরণ! ওর জন্য ভাবতে আমার বয়েই গেছে।"

সেই সময় পারুল ওর দরজা খুলে জামাকাপড় নিয়ে দুম দুম করে পা ফেলে বাথরুমের দিকে গেল।     

  পারুল বেরিয়ে যেতে মাসি বলল, "কপালপুড়িটার জন্য দুঃখ হয়। মা ঠোঙ্গা বানিয়ে সংসার চালায়। আর ভাইটা বন্ধুদের নিয়ে মোচ্ছব করে বেড়ায়। বেয়াড়া ছেলে! পারুলকেও ছাড়েনি। 

বলেছে, 'তুই কত সতী জানা আছে। এ বাড়িতে পা দিবি না তুই।'

চলে এসেছে পারুল। মাকে বলে এসেছে, 'আর আসব না মা। এই শেষ দেখা তোমার সঙ্গে।'

মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কান্না ভেজা গলায় মা বলেছে, 'প্রতি বছর আসতে হবে না। দু'তিন বছর বাদে বাদে আসিস। টাকা লাগবে না। শুধু একটু দেখা করে যাস।'

   'তা আর হয় না মা। আজ ভাই বাড়িতে বলেছে। কাল রাস্তায় চিৎকার করে বলবে। কোন্ মুখ নিয়ে আসব আমি, মা?'

আসার সময় রাস্তা থেকেও মায়ের কান্না শুনতে পাচ্ছিল পারুল।"

অখন্ড নিস্তব্ধতার মাঝে মেয়েরা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে। হয়তো সবাই ফিরে গেছে নিজেদের ছোটবেলায়, মা-বাবার কাছে। যেখানে ওদের একটা ঠিকানা ছিল, পরিচয় ছিল। একটা জীবন ছিল। হয়তো কিছু স্বপ্নও ছিল।


প্রথম প্রথম পারুল মা'র কাছে যাবার জন্য খুব কাঁদত। বলত, "একবার মা'র সঙ্গে দেখা করেই চলে আসব, থাকব না।" 

মাসি রাজি হবে কেন? পারুলকে বেচে কড়কড়ে নোটগুলো গুনে নিয়েছিল ওর স্বামী। মাসি জানত, কান্না না থামালে ওকে বশে আনা মুশকিল। বাধ্য হয়ে এক পরিচিতের সঙ্গে পারুলকে যেতে দিয়েছিল মাসি ওর মায়ের কাছে। এখন ও বছরে দু'বার যায়, একাই। মাসিও বুঝে গেছে পারুলের না ফিরে উপায় নেই। বেলার দিকে রান্না বসিয়ে এসব কথাই ভাবছিল রেবা। নিজের অতীতের পাঁক আর ঘাঁটতে মন চায় না। সেখানে তো গাঢ় অন্ধকার ছাড়া আর কিচ্ছুটি নেই। তবু নিজের অজান্তেই পিছনে তাকাল রেবা। 

বাবাকে ও দেখেনি। বোধহয় হদিস নেই। সেলাই করে মেয়েকে ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়িয়েছে রেবার মা। তার অকস্মাৎ মৃত্যুতে উপযাচক হয়ে কাকা সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। পাড়া প্রতিবেশীরা খুশি হয়েছিল। একটু দূর থেকে দেখা আত্মীয়রা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। আহা উহু করার লোকের সংখ্যাও কমতে শুরু করেছিল। কিন্তু কাকার অতি ভালোবাসা সইতে না পেরে রেবা পালিয়ে এসেছিল নিজেই এই পেশায়। সেই শরীরই যখন দিতে হবে, এখানে নয় কেন? ভদ্র পাড়ার মানুষ যা'ই বলুক, এখানে প্রাণ আছে, ভালোবাসা আছে। রেবার মনে পড়ে করোনা আবহে প্রায় না খেয়ে ওরা দিন কাটিয়েছে। অসুস্থ হয়ে মারা গেছে সঙ্গীদের কতজন। খুন্তি নাড়তে নাড়তে ওদের কথা ভেবে ডুকরে উঠল রেবা। নিজের মনেই বলল, "পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে, তোদের যেন আবার আমরা ফিরে পাই। এই সোনাগাছির ইট বের হওয়া শ্যাওলা ধরা বাড়িতে আবার আমরা বাঁচব। নতুন ভোর দেখব। ভাঙ্গা জানলা দিয়ে আকাশে সোনার থালা দেখব। তবু এখানেই বাঁচব।"


উত্তর কলকাতার সোনাগাছি। রাতটুকু পেরোলে যাদের মুখ দেখে দিন শুরু হয়, তারা সবাই সবার সমব্যথী। একজন অসুস্থ হলে বাকিরা নিজের রান্না থেকে খাবার দিয়ে যায়। দুর্বার সমিতির দিদিদের খবর দেয়। ডাক্তার দেখায়।

সুপ্রীম কোর্ট বারবনিতাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। হাই কোর্ট থেকে ওরা দুর্গাপুজোর দাবি আদায় করেছে। কিন্তু সভ্য সমাজের মানুষ যখন দুর্গাপুজোর জন্য মাটি চাইতে আসে, ওরা নারাজ। কেন দেবে ওরা মাটি? নিজের ভাই দিদিকে অসতী বলে দাগিয়ে দেয়। আর সৎ হলো ওই আপাদমস্তক ভদ্রলোকেরা? না, দেবে না ওরা মাটি। লড়াই ওদের রক্তে। আজ আবার এক নতুন লড়াইয়ের সম্মুখীন এই মেয়েরা। সকাল থেকে চলছে প্ল্যাকার্ড বানানো। তথাকথিত ভদ্রলোকদের পা পড়বে না আজ সোনাগাছিতে। যে বিশ্ববাসী ওদের ঘৃণা  করে, লাল বাতির মেয়ে বলে দাগিয়ে দেয়, সেই বিশ্ববাসী আজ দেখবে সীমা, পারুল, রেবারা এক ডাক্তার বোনের জন্য পথে পথে পা ফেলছে। মোমবাতি ওদের মানায় না। ওদের হাতে থাকবে মশাল। গলায় থাকবে স্পর্ধা। আজ কেউ ওদের অসম্মান করবে না। ওদের মিছিলের দিকে উড়ে আসবে না কোনও চটুল মন্তব্য। মুখে স্বীকার না করলেও রাস্তার দু'ধারের কৌতূহলী চোখে কিছুটা সম্ভ্রম হয়তো থাকবে ওদের প্রতি। জয় আসবে কী না জানা নেই। তবে সব রকম শ্রেণী বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে ওরা আজ সৈনিক। 

Post a Comment

0 Comments