জ্বলদর্চি

মহাভারতে নির্বাচিত পঞ্চনারীর ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের অনুসন্ধান /লাবনী বৈদ্য

মহাভারতে নির্বাচিত পঞ্চনারীর ব্যক্তি  স্বাতন্ত্রের অনুসন্ধান 

লাবনী বৈদ্য 

‘যাহা নাই ভারতে তাহা নাই ভারতে’ অর্থাৎ আরেকটু প্রসারিত অর্থে এটা বলা চলে যে, মহাভারতে যেটা নেই ভারতবর্ষের কোথাও সেটা পাওয়া যাবে না। পৃথিবীতে যে চারটি ধ্রুপদী মহাকাব্য রয়েছে তাদের মধ্যে ‘মহাভারত’ বিশেষভাবে উল্লেখ্য। কারণ এই কাব্যটিতে ভারতবর্ষের চিরন্তন জীবন-যাপনের একটি অসাধারণ রূপরেখা মহর্ষি ব্যাসদেব অঙ্কন করেছিলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই মহাভারতের অনুবাদ ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষায় সগৌরবে এগিয়ে চলেছে। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও যার কোন ব্যতিক্রম হয়নি। মূল মহাভারতের বঙ্গানুবাদ করেছিলেন কাশীরাম দাস। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য ‘মহাভারত’-এর কাহিনির মূল উপজীব্য পাণ্ডব এবং কৌরবের সংঘাত। যার মূল রস বীর। মহাভারতে অঙ্কিত প্রায় প্রতিটি পুরুষ চরিত্রের মধ্যে সেই বীরভাবের বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু পুরুষ চরিত্রের পাশাপাশি মহাকবির মহাকাব্যে নারী চরিত্রেরাও উপেক্ষিত হননি। তাদের মধ্যে যারা বিপুল প্রতাপে ও ব্যক্তিত্বের অনুপম স্বাতন্ত্রে ভাস্বর, আমার অণু-গবেষণাপত্রে সেই রকম পাঁচজন মহাভারতের নারী যথাক্রমে— গঙ্গা, সত্যবতী, গান্ধারী, কুন্তী এবং দ্রৌপদীকে নির্বাচিত করে নেওয়া হয়েছে। যাদের অনুপম ব্যক্তিত্বের একটা ছায়া শুধু সে যুগেই নয়; চিরন্তন ভারতীয় জীবনকে আবেশিত করে রেখেছে। তাদের চরিত্রগুলির স্বাতন্ত্র ও স্বরূপের মূল্যায়নের জন্য ব্যাসদেবকৃত মূল মহাভারত ও কাশীরাম দাসের অনুবাদকে আকর গ্রন্থ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। তারপর—

(ক) মহাভারত বিষয়ক নানা আলোচনা গ্রন্থ; (খ) মহাভারতের উপর ভিত্তি করে লেখা বেশ কয়েকটি উপন্যাস; (গ) মহাভারতের উপর ভিত্তি করে লেখা বেশ কয়েকটি নাটক; (ঘ) বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ গ্রন্থ, যেখানে মহাভারতের নারী চরিত্রগুলিকে নতুন করে পুনর্মূল্যায়ন 

    করা হয়েছে এবং (ঙ) ইন্টারনেট সহ বেশ কিছু ডিজিটাল মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্যের উপর নির্ভর করা হয়েছে 

    উক্ত পাঁচটি মহাভারতের চরিত্রকে তাদের নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে, নতুন নতুন আলোক- পাত করতে।


আশা করি উপরোক্ত বিষয়গুলি থেকে প্রাপ্ত নানা তথ্যের আলোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণের ভিতর দিয়ে, মহাভারতের এই পঞ্চনারীর শুধু বাইরের আচরণ নয়; সেই আচরণ পেরিয়ে আরো একটা নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে তাদের চিনে নেওয়া যেতেই পারে। যেখানে সেকালের নারীরা একালের পটে তাদের সমস্ত রকমের সত্তা নিয়ে যেন প্রাণময় হয়ে উঠেছে।

মহাভারতকে বলা হয় ভারতবর্ষের চিরকালের ইতিহাস। এখানে যেন কালের কোনো বিবর্তন নেই, পরিবর্তন নেই। মহাভারত আসলে মানব সভ্যতার সার্বিক আচার-আচরণ ও চিন্তা-ভাবনার উৎস। এই মহাকাব্যে মানবচরিত্রের যে জটিল রহস্য ও বৈচিত্রের কথা রয়েছে ভারতীয় সাহিত্যে তা তুলনারহিত। সেই সঙ্গে মহাভারতের বিভিন্ন বিস্ময়কর মানব চরিত্রের উদ্‌ঘাটন ও তাঁদের পরিণতি আমাদের কাছে বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয়। আসলে সমস্ত চরিত্রের পরিণতির মধ্যে সত্যের সাধনায় জীবনের পূর্ণ হয়ে ওঠার কাহিনি থাকায় তা মানুষের চিরকালের উপজীব্য হয়ে উঠেছে। কিভাবে যাপন করলে মানুষের জীবন সার্থক হয়ে ওঠে, কোন কোন গুণাবলীর অনুশীলন মানুষের চরিত্রকে উন্নত করে আর কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মানুষকে হীনচরিত্র হিসেবে চিহ্নিত করে-ব্যাসদেব এই সমস্ত কিছুই তাঁর মহাভারতের মধ্যে অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন। বলা হয় মহাভারত হিমালয়ের মতো উঁচু, মহাসাগরের মতো গভীর, এবং বহুমূল্য রত্নের ভাণ্ডার। বিশাল আয়তন এই মহাকাব্যের চরিত্র সমাবেশও তাই অসংখ্য। দীর্ঘ সময়কাল ধরে লিখিত হওয়ার ফলে মহাভারতের প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে অনেক সময় অলৌকিকতার মিশ্রণ ঘটেছে। প্রকৃতপক্ষে বহু অপ্রাকৃত ব্যাপার বর্ণিত হলেও সমগ্র মহাভারতের মধ্যে যে সকল নর-নারী চরিত্রের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনেকখানি বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া। তবুও এ সমস্ত চরিত্রের মধ্যে দিয়েই কখনো- কখনো মহাভারতকার মানুষের মঙ্গল ও কল্যাণের দিক নির্দেশ করেছেন। মহাভারতের বেশ কিছু চরিত্র তাঁদের চারিত্রিক দৃঢ়তা, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য, তীক্ষ্ণ মর্যাদাবোধে মানুষকে বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়।


🍂

 এই প্রসঙ্গে মহাভারতের বহু বৈচিত্রময় অসংখ্য চরিত্রের মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া হয়েছে পাঁচটি নারীচরিত্র- গঙ্গা, সত্যবতী, গান্ধারী, কুন্তী, দ্রৌপদী। মহাভারতের সমগ্র নারীচরিত্রগুলির মধ্যে যাঁরা স্বকীয়তায় অনন্য। আধুনিক কালের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখলে তাই এই দুটি চরিত্রকে একালের আধুনিক মানুষ বলেই মনে হয়। কেন-না ‘আধুনিকতা’ শব্দটি আপেক্ষিক। আসলেই বহু বিচিত্র কাহিনীর আখ্যান হল মহাকাব্য মহাভারত। আর সেই প্রাচীন মহাকাব্য হল চরিত্রদের রঙ্গশালা, যেখানে একের পর এক শক্তিশালী চরিত্রেরা ভিড় করে রয়েছে। আবার প্রধান চরিত্রগুলির ভিত হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে এমন কিছু চরিত্র যারা প্রথম সারিতে না এলেও মহাকাব্যের অনেক বড় বড় দায়িত্ব সামলেছেন। এদের সংখ্যাটা তুলনামূলক বেশি। চরিত্রের মহারণ্য থেকে বিশেষ কিছু চরিত্র এবং ঘটনা নির্বাচন করে মহাভারত ও একটি পরিবারের নামের নেপথ্যে গোটা ভারতের যে সাম্রাজ্য রাজনীতি ও কূটনীতি কাজ করেছে, তার লক্ষণগুলো বহন করছে মহাভারতের চরিত্রেরা। তাঁর সৃষ্ট অসংখ্য নারী চরিত্র   সত্যিই স্বতন্ত্র।


গঙ্গা একটি নদী। হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে তার উন্মেষ। তার টলটলে সাবলীল ধারা সারা ভারতবর্ষের লাইফ লাইন বলা যেতে পারে। কারণ, গঙ্গার দুই তীরভূমিকে উর্বরা করে তুলেছে এই গঙ্গা নদী। স্বাভাবিক কারণেই তিনি ভারতীয় জনমানসের কাছে দেবী রূপে পূজিতা। কিন্তু সেই দেবী যখন মহাকাব্যের কোন চরিত্র হয়ে উঠে আসেন; তখন দেখা যায় তিনি মহারাজ শান্তনুর প্রেমে মগ্ন এবং তাকেই বিবাহ করেছেন। পৌরাণিক মত অনুসারে, গঙ্গা শিবের অন্যতম স্ত্রী। যাকে তিনি শিরে ধারণ করে রাখেন। কিন্তু মহাভারতে যে গঙ্গার চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে, সেই অর্থে পৌরাণিক গঙ্গার সঙ্গে মহাভারতের গঙ্গার একটা বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। গঙ্গার অপর নাম জাহ্নবী। কথিত আছে, মর্ত্যে ভগীরথকে অনুসরণ করার সময় গঙ্গা ঋষি জহ্নুর আশ্রম প্লাবিত করেন। উগ্রতপা জহ্নু ক্রুদ্ধ হয়ে গঙ্গার সমস্ত জল পান করে ফেলেন। তখন দেবগণ গঙ্গার মুক্তির জন্য ঋষির কাছে প্রার্থনা করতে থাকলে নিজের জঙ্ঘা বা জানু চিরে গঙ্গাকে মুক্তি দেন। এইরূপে গঙ্গা জহ্নু ঋষির কন্যা রূপে পরিচিতা হন এবং তার অপর নাম হয় জাহ্নবী।


গঙ্গা-কুরুরাজ শান্তনুর স্ত্রী ও দেবব্রত ভীষ্মের মা। একদিন হঠাৎ হস্তিনাপুরের পরম ধার্মিক রাজা শান্তনু মৃগয়ার জন্য বনে যায়। বিভিন্ন স্থান ঘুরে একসময় গঙ্গাতীরে উপস্থিত হন তিনি ঠিক তখনই গঙ্গা শান্তনুর সামনে প্রকট হয়। এই প্রসঙ্গে কাশীরাম দাস লিখেছেন—


“ধর্ম্মেতে ধার্মিক রাজা মহা-ধনুর্দ্ধর/ মৃগয়া করিয়া ভ্রমে বনের ভিতর॥ 

জাহ্নবীর দুই তটে ভ্রমে রাজা একা/ পাইল দৈবাৎ তথা জাহ্নবীর দেখা॥ 

পদ্মের কেশর-বর্ণ সুসিক্ত বসনা/ রূপেতে নিন্দিত যত বিদ্যাধরাঙ্গনা॥ 

আশ্চর্য্য কন্যার রূপ শান্তনু দেখিয়া/ জিজ্ঞাসিল নরপতি নিকটেতে গিয়া॥”১


 গঙ্গার রূপে মুগ্ধ হয়ে রাজা শান্তনু গঙ্গাকে পত্নীরূপে পেতে ইচ্ছা পোষণ করেলে গঙ্গা শান্তনুকে শর্ত দেয়—


ক. বিবাহের পর গঙ্গার কোন কাজে শান্তনু বাধা প্রয়োগ করবে না। 

খ. যেদিন বাধা আসবে সেদিন সে শান্তনুকে ত্যাগ করবেন। কিন্তু গঙ্গাকে কমানায় রাজা শান্তনু এতটাই বিভোর যে গঙ্গার সব শর্ত নির্দ্বিধায় মেনে নেয়। ফলে শান্তনুর সঙ্গে গঙ্গার বিয়ে সম্পন্ন হয় পরম সুখে দিন অতিবাহিত হতে থাকে। একসময় গঙ্গা এক পুত্র সন্তান প্রসব করে। কিন্তু শান্তনু অবাক হয়ে লক্ষ করে গঙ্গা সদ্যজাত সন্তানকে নিয়ে নদীতে নিক্ষেপ করেআর তার বর্ণনায় কাশীরাম দাস লিখেছেন—


“জন্মিল গঙ্গার পুত্র যেন পূর্ণশশী/ পুত্র দেখি শান্তনুর আনন্দিত মন।

হেথা পুত্র লয়ে গঙ্গা গেল গঙ্গাজলে/ জলেতে ডুবিয়া মর পুত্র প্রতি বলে॥…

এক দুই তিন চারি পাঁচ ছয় সাত/ একে একে গঙ্গাদেবী করিল নিপাত ॥

পুত্রশোকে শান্তনুর দহে কলেবর/ কত দিনে হৈল জন্ম অষ্টম কুমার॥

পুত্র লৈয়া গঙ্গাদেবী যায় নিজ জলে/ ক্রুদ্ধ হৈয়া নরপতি গঙ্গা প্রতি বলে॥

আপনার গর্ভে যেই জন্মিল কুমার/ কেমনে এমন পুত্রে করিলা সংহার॥ 

পাষাণ শরীর তব বড়ই নিৰ্দ্দয়।”২


  নিজের সন্তানকে কিভাবে এত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করতে পারলো! তখন গঙ্গা স্বমূর্তি ধারণ করে ও বলে আমি ত্রিধারা গঙ্গা। আপনার ঔরসে আমার গর্ভে যে আটজন পুত্র জন্মগ্রহণ করেছে এরা হলো স্বর্গের অষ্টবসু। মহর্ষি বশিষ্ঠের অভিশাপে মানবজন্ম গ্রহণ করতে হয়। সাতজন বসু জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিলাভ করে স্বর্গে চলে গেছে। কিন্তু অষ্টম পুত্রকে মানবজন্ম অতিবাহিত করতে হবে। এই গঙ্গা চরিত্র সম্পর্কে ধীরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য লিখেছেন— 

“মহারাজা শান্তনুকে বিবাহ করবার সময় তিনি প্রথাগত নারীদের ন্যায় শান্তনুর প্রতি নিজেকে সমর্পণ করেননি। সেকালে গঙ্গা একজন নিজের ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রে পরিচালিত এক নারী।”৩

শান্তনু শর্ত ভঙ্গ করায় গঙ্গা নবজাতক শিশুকে নিয়ে প্রস্থান করে। তার মাতৃসত্তার মধ্যে কতখানি নিষ্ঠুরতা জড়িয়ে আছে, সে বিষয়টি বিতর্কিত। কিন্তু একের পর এক সন্তান বিসর্জন দেবার পর, যখন শান্তনু আপত্তি করেন, তখন গঙ্গা, ভীষ্মকে নিয়ে তার সেই দাম্পত্য জীবনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। ছত্রিশ বছর পরে রাজোচিত শিক্ষা দিয়ে পুত্রকে শান্তনুর হাতে অর্পণ করে। গঙ্গার এই পুত্রই দেবব্রত ভীষ্ম নামে জগতে অসাধারণ খ্যাতি লাভ করে। তাই গঙ্গা চরিত্রটির পরিপূর্ণ রূপ ফিকে হয়ে গেছে। মায়ের মমতার খানিক প্রকাশ ঘটলেও গঙ্গা হয়ে স্রোতযুক্ত হয়েই কেটেছে। সেখানে মানবী নয় বরং দেবী রূপেই থেকেছে! মহাভারতের গঙ্গা নীরবে বয়ে গেছে ভীষ্মের সেবাধর্মের মধ্যে দিয়ে। যে নবজন্ম সৃষ্টি করে একটি বংশের মূল রক্ষক সেই গঙ্গাও থেকেছে নীরবে, নিভৃতে। এক্ষেত্রে বলা চলে গঙ্গা এক ব্যতিক্রমী নারী সত্তা বটে।

সত্যবতী মহাভারতে বর্ণিত হস্তিনাপুরের কুরুরাজ শান্তনুর মহিষী। তিনি কৌরব এবং পান্ডবদের প্রপিতামহী ও বেদব্যাসের জননী। তাঁর উপাখ্যান মহাভারত ছাড়াও হরিবংশ এবং দেবী ভাগবত্‌পুরাণে বর্ণিত হয়েছে। সত্যবতী চেদীরাজ উপরিচর বসু এবং শাপগ্রস্তা মৎস্যরূপিণী অপ্সরা অদ্রিকার কন্যা। শাঁওলী মিত্র তার ‘কথা অমৃতসমান’ নাটকে সত্যবতীর নামে গান ধরেছেন—

“রুপসী কন্যা সে যে নাম সত্যবতী/ কুরুকুলের তারিণী সে, শান্তনু তার পতি। 

ধীবরের কন্যা ছিল, ছিল মৎস্যগন্ধা/ পরাশরের বরেতে সে

আর পরাশরের বরেতে সে হইল পদ্মগন্ধা। 

অপরূপ কাহিনী তার, সেই সত্যবতী/ যুগ যুগ বিতাইল দুঃখে কষ্টে সতী/ আহারে...।”৪

নারী সম্পর্কীয় আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সত্যবতী চরিত্রটির বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে   দেখা যাবে কূটকৌশল, স্বার্থপরতা, ধর্মাচার, যৌনতা প্রভৃতি বিভিন্ন প্রসঙ্গে সত্যবতীর চিন্তা-চেতনা, অভিসন্ধি এবং প্রকরণ কত স্পষ্ট এবং যথাযথ। এক্ষেত্রে মহাভারতের সামগ্রিক নারী-চরিত্রগুলির আলোচনায় সত্যবতীর স্বাতন্ত্র্য চরিত্র। নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে সত্যবতী উচিত-অনুচিত কোনো কাজ করতে পিছপা হননি। সত্যবতীকে   নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তিনি কখনও পিছপা হননি। বরং প্রয়োজনে বারবার নিজের সিদ্ধান্তকে অবস্থা অনুযায়ী পাল্টে নিয়েছেন। তার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—  

“প্রকৃতি তাকে যে হৃদয়সম্পদ দিয়েছেন নিত্যকৌতূহলপ্রবণ বুদ্ধির হাতে তাকে নূতন নূতন অধ্যবসায়ে পরখ করতে দেওয়া হয় নি। নারী পুরাতনী।”৫

মহাভারতের অন্যতম নারী চরিত্র সত্যবতীর জন্ম বৃত্তান্ত সম্পর্কে জানা না গেলেও নারীর সৌন্দর্যকে ত্বকের রঙের সংকীর্ণতায় আবদ্ধ না করলে দেখা যায় সত্যবতী ছিলেন অসামান্যা সুন্দরী।রূপে-গুণে অতুলনীয় কালো মেয়ে সত্যবতী পিতার কাজে সাহায্য করার জন্য যমুনার জলে নৌকা বাইতেন। এমনই একদিনে পরাশর মুনি তীর্থপর্যটন করতে করতে সেখানে আসেন। সত্যবতীর রূপে মুগ্ধ হয় এবং  পরাশর-সত্যবতী দুজনের ইচ্ছাতেই  তাঁদের মিলন হলে জন্ম হল মহাভারতের স্রষ্টা কৃষ্ণদ্বৈপায়নের। একজন সাধারণ পাটনি থেকে ক্রমশ রাজ-পরিবারের বধূ হিসেবে সত্যবতীর উত্তরণ, তাকে একজন সংগ্রামী নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবে স্বামী পরাশর এবং পুত্র ব্যাসকে হারিয়ে সেই অসহায় অবস্থা থেকে সত্যবতীর উঠে আসা, একটা নারীর যুগান্তকারী ব্যতিক্রমী সত্তার প্রতীক। 

শান্তনুর বংশ রক্ষা করবার জন্য তিনি যেমন বিচিত্রবীর্যকে সিংহাসনে বসিয়ে, ভীষ্মকে প্রতিরক্ষার দায়িত্ব দিয়েছিলেন; ঠিক তেমনি তিনি আবার রাজ্য পরিচালনার যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। সত্যবতীর গর্ভজাত পুত্রই হস্তিনাপুরের সিংহাসনের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী হবে। পরবর্তীকালে মহাভারতের এই নারী নিজের স্বার্থে কখনও ভীষণভাবে মৌন থেকেছেন আবার নিজের স্বার্থে ভীষ্মকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছেন—  

ক. তিনি কখনোই রাজপদেঅভিষিক্ত হবেন না।

খ. সারাজীবন ব্রহ্মচর্যব্রত পালন করবেন।

সত্যবতী ভীষ্মের এই প্রতিজ্ঞার উপর ভিত্তি করেই  হস্তিনাপুরে রানী হয়ে এলেন। এর বেশ কিছুদিন পর শান্তনু-সত্যবতীর সন্তান চিত্রাঙ্গদ এবং বিচিত্রবীর্যের জন্ম হল। এর কিছুকাল পরেই শান্তনুর মৃত্যু হয়। তখন চিত্রাঙ্গদকে সিংহাসনে বসিয়ে সত্যবতীর আদেশে ভীষ্মই রাজ্য চালনা করতে লাগলেন।কাশীরাজের দুই কন্যা অম্বিকা ও অম্বালিকার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বিচিত্রবীর্যের। অসংযত জীবনযাপন করে বিয়ের সাত বছর পর বিচিত্রবীর্যের অকালমৃত্যু হলে  সত্যবতী ভীষ্মের কাছে গিয়ে তাকে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ ও পুত্রবধূদের গর্ভে সন্তান জন্ম দিতে বললে  ভীষ্ম অস্বীকার করায় তিনি তার বিবাহের পূর্বপুত্র ব্যাসকে ডেকে পাঠান এবং সত্যবতীর ইচ্ছায় কৃষ্ণদ্বৈপায়নের ঔরসে জন্ম হল ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং বিদুরের। সেক্ষেত্রে বলা চলে, সত্যবতী একজন রাজনীতির ক্ষেত্রে উচ্চাকাঙ্ক্ষী রমণী। যিনি বিচিত্রবীর্যের মৃত্যুর পর, অম্বা ও অম্বালিকার সঙ্গে একপ্রকার জোর করেই ব্যাসদেবকে মিলিত হতে বাধ্য করেন। যার ফল স্বরূপ ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডুর জন্ম। সেক্ষেত্রে বলা চলে, পাণ্ডব এবং কৌরবের সংঘাতের যে ক্ষেত্র, সেখানে সত্যবতী সেই একজন নারী, যিনি তার রাজনৈতিক সচেতনতায় একটি ভারতবর্ষব্যাপী রাজবংশের নিয়ামক।এই প্রসঙ্গে নিবেদিতা বিশ্বাস লিখেছেন—

“তাঁর সুপরিকল্পিত, সুদূরপ্রসারী চিন্তাচেতনা আমাদের সমীহ আদায় করে নেয়। একজন আধুনিক নারীর মতোই নিজের চিন্তাভাবনা এবং কাজের প্রতি তাঁকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে দেখি। মহাভারতের সুবিশাল প্রেক্ষাপটে আমরা দেখি সত্যবতীর সেই বিরাট ব্যক্তিত্বকে। পুরুষদের কোলাহলে অনেক সময় হয়তো তাঁর কথা আমাদের কানে ঠিকঠাক পৌঁছায় না। তবুও রাজকীয় ব্যক্তিত্বে সত্যবতীর চরিত্র মহাভারতের অনেক অনেক চরিত্রের থেকে ব্যতিক্রমী এবং অনন্য।”৬

মহাভারত একটি বিশাল চরিত্র প্রধান গ্রন্থ আর সেখানে বর্ণিত নারী চরিত্রের মধ্যে গান্ধারির চরিত্রটি বিশেষভাবে উল্লেখ্য। গান্ধারী আক্ষরিক অর্থে, গান্ধার দেশের মেয়ে মহাভারতের অন্যতম প্রধান চরিত্র। তিনি গান্ধার রাজ্যের রাজকুমারী, হস্তিনাপুরের রাজা ধৃতরাষ্ট্রের পত্নী এবং দুর্যোধন সহ শতভাই ও এককন্যা দুঃশলার মাতা। তিনি বিবাহের পর স্বামী ধৃতরাষ্ট্রের মতো জীবনযাপনের জন্য চোখ বেঁধে রাখতেন। মহাভারতে যে অর্থে গঙ্গা, সত্যবতী কিংবা কুন্তী প্রসারিত হয়ে আছেন, সেখানে গান্ধারী নারী চরিত্রটি একটু ব্যতিক্রমী – একথা বলা যেতে পারে। তাকে কোন রাজনৈতিক ওঠাপড়ার আবর্তে আবর্তিত হতে দেখা যায়নি। তার চরিত্রের মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে—(ক) সীমাহীন স্বামী প্রেম। (খ) পুত্র দুর্যোধনের প্রতি এক অন্ধস্নেহ; এবং (গ) অন্যায় যুদ্ধে দুর্যোধন অবতীর্ণ হয়েছে জেনেও তিনি মনে প্রাণে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে দুর্যোধনের জয় প্রত্যাশা করেছেন।

 মূল মহাভারতের আদি আদিপর্বে ধৃতরাষ্ট্র পান্ডু ও বিদুরের বিবাহ প্রসঙ্গে গান্ধারীর প্রথম পরিচয় পাওয়া যায়। কাশীরাম দাস সেখানে গান্ধারী সম্পর্কে লিখছেন—

“যদুবংশে সুবল নামেতে নৃপমণি/ গান্ধারী-নামেতে কন্যা তাঁহার নন্দিনী॥

ভগবানে আরাধিয়া কন্যা পায় বর/ একশত পুত্র হবে মহা-বলধর॥...

গান্ধারী শুনিল, অন্ধ-বরে সমর্পিল/আপন স্বকৰ্ম্ম ভাবি চিত্তে ক্ষমা দিল॥ 

শুক্ল পট্টবস্ত্র দেবী শতপুর করি/ আপন নয়ন-যুগ্ম বান্ধিল সুন্দরী॥

পতি-গতি অনুসারি মুদিল নয়ন/ পতিব্রতা গান্ধারী যে জগতে ঘোষণ॥”৭


এক সময়ে গান্ধারী গর্ভবতী হলেন। কিন্তু গর্ভবতী হবার পর কুড়ি মাস কেটে গেলেও তাঁর প্রসব হলোনা। এদিকে ধৃতরাষ্ট্রের ভাই পান্ডুর স্ত্রী কুন্তী তাঁর প্রথম পুত্র যুধিষ্ঠিরের জন্ম দিয়েছেন। সেই খবর পেয়ে কুন্তী অত্যন্ত বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। তারপর একদিন রগে দুঃখে গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রকে না জানিয়ে একটা লোহার মুগুর দিয়ে নিজের পেটে আঘাত করে গর্ভপাত করালেন। এর ফলে তাঁর গর্ভ হতে এক লৌহকঠিন মাংসপিণ্ড নির্গত হল। একবছর পর দুর্যোধন এবং একবছর এক মাসের মধ্যে দুঃশাসন, দুঃসহ, বিকর্ণ প্রভৃতি শতপুত্র ও দুঃশলা নামে একটি কন্যার জন্ম হল। জন্মমাত্রই দুর্যোধন গাধার ন্যায় চীৎকার করেছিলেন এবং নানা অমঙ্গলের চিহ্ন দেখা গিয়েছিল। বিদুর ও ব্রাহ্মণগন তখন দুর্যোধনকে ত্যাগ করতে বলেছিলেন। কিন্তু পুত্রস্নেহের জন্য ধৃতরাষ্ট্র তা করতে পারেন নি।

পুত্রস্নেহে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে গান্ধারী বহুবার পুত্রগণের অশিষ্টতা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ধৃতরাষ্ট্রকে বার বার সতর্ক করেছেন যে, দুর্যোধনকে ত্যাগ না করলে কুরুকুল ক্ষয় বন্ধ করা যাবে না। পুত্রকেও তিনি কঠোর বাক্যে পাপকর্ম থেকে বিরত থাকতে বলেছেন, পাণ্ডবদের অর্ধরাজ্য ফিরিয়ে দেবার নির্দেশ দিয়েছেন। অবশ্যই তাতে কোনও ফল হয় নি। পুত্রকে আস্কারা দেবার জন্য ধৃতরাষ্ট্রকেও তিনি ভর্ৎসনা করেছেন। তবে গান্ধারীর মধ্যে ন্যয়ের প্রতি, সততার প্রতি দুর্বলতা অনেক ক্ষেত্রেই তাঁকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে। অন্যদিকে  যুধিষ্ঠিরের যে  কুন্তী ও বিদুরের অবৈধ প্রণয়ের সন্তান, এঘটনা গান্ধারীর নারীদৃষ্টিতে ধরা পড়েছে। দেবর বিদুরের ব্যবহারের তারতম্য তাঁর এই ধারণাকে আরও বদ্ধমূল করে। রীতিমত ষড়যন্ত্র করে রাজনৈতিক প্রতিশোধের জন্য যে এক বিস্তৃত প্রেক্ষাপট প্রস্তত করা হচ্ছে, সেই বিষয়ে স্বামীকে সাবধান করে গান্ধারী বলেছেন—

“স্বামী, মেয়েমানুষ বলে অবহেলা কর না, শ্রদ্ধা কর। মনে রেখ, মেয়েদের একটা অতিরিক্ত ইন্দ্রিয় আছে। আগে থেকে সে বিপদ টের পায়। আমার সমস্ত অনুভূতি দিয়ে অনুভব করতে পারছি একটা ঝড় আসছে। শতশৃঙ্গ পর্বতের চূড়ায় তা কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। একদিন হস্তিনাপুরের ওপর আছড়ে পড়বে।”৮

অতঃপর সবার প্রতীক্ষিত যুদ্ধ শুরু হল। এতদিনের ধারণা অনুযায়ী পাণ্ডবদের যুদ্ধই ন্যয়যুদ্ধ, আর যেটুকু ছলের সাহায্য তারা নিল সেটা হয়েই থাকে। দীপক চন্দ্রই তাঁর লেখায় চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন পাণ্ডবেরা যেটা করেছে সেটা কত বড় অন্যায় ছিল। যে কোন যুদ্ধে অল্প বিস্তর ছল চাতুরির প্রয়োগ হয়েই থাকে, কিন্তু কুরুক্ষেত্রে ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ এবং সর্বোপরি দুর্যোধনের উরু ভেঙ্গে যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল, সেটা যে কত বড় অধর্ম ছিল, তা একটু বিচার করলেই বোধগম্য হয়। জয়লাভের উদ্দ্যেশে শ্রীকৃষ্ণের প্ররোচনায় ক্ষাত্রধর্ম ত্যাগ করা পাণ্ডবদের যুদ্ধকেই এতদিন সকলে সমর্থন করে এল। আধুনিক সমালোচকেরা, সাহিত্যিকেরা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যে অধর্মের যুদ্ধে পরিণত হয়েছিল, সকলেই একথা একবাক্যে স্বীকার করেন।পাণ্ডবদের রাজ্যলাভের পর ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী পনের বছর পাণ্ডবদের আশ্রয়ে থাকেন। পাণ্ডবরা তাদের যথেষ্ট সম্মান করলেও ভীমের কারণে ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী বাণপ্রস্থ অবলম্বন করে গঙ্গাতীরে রাজর্ষি শতযুপের আশ্রমে উপস্থিত হন। অতঃপর কুন্তী, বিদুর ও সঞ্জয় তাদের সাথে বনে গমন করেন। তবে গান্ধারীর মধ্যে যে একটা ইতিমূলক ভাবনা ছিল, কিন্তু তার জীবনের ট্রাজেডি এই যে, ধৃতরাষ্ট্র ও তার অনুগামীদের জেদ ও পরিকল্পনায় সেটা কখনোই পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়নি।

  কুন্তী ভোজরাজার পালিতা কন্যা, হস্তিনাপুরের রাজা পান্ডুর প্রথমা পত্নী এবং সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সত্যবতীর পৌত্র পাণ্ডুর স্ত্রী কুন্তী। সিদ্ধিদেবীর অংশে এই রূপবতী নারীর জন্ম। যদু বংশীয় রাজা শূরের কন্যা ও বসুদেবের ভগিনী কুন্তীর আরও একটি নাম ছিল পৃথা। সন্তানহীন কুন্তী ভোজরাজের কাছে প্রতিপালিত হয়েছিলেন বলে পৃথার আরও একটি নাম কুন্তী। কুন্তীর জীবনে একাধিক পুরুষের আবির্ভাব। পরশুরাম থেকে শুরু করে সূর্য সান্নিধ্য তার জীবনের একটা অধ্যায়।এই প্রসঙ্গে কুন্তী পূর্ব জীবনের বর্ণনায় কাশীরাম দাস লিখেছেন—

“মন্ত্র পেয়ে পৃথা দেবী হরিষ অন্তর / পরীক্ষা করিতে মন্ত্র ভোজের নন্দিনী।

মন্ত্র জপি স্মরণ করিল দিনমণি/ পৃথার স্মরণে তথা এল দিনকর। 

সূর্য্য দেখি পৃথা হৈল বিরস-অন্তর/ করযোড় করি কুন্তী প্রণাম করিল।

 সবিনয়ে পৃথাদেবী বলিতে লাগিল.../ সূর্য্য-বরে কুন্তী-গর্ভে হইল নন্দন। 

দেখিয়া ভোজের কন্যা সচিন্তিত মন/ অকুমারী কন্যা আমি বিবাহ না হয়। 

তাহে গর্ভ অসম্ভব লোক-লাজ ভয়/ বয়সে বালিকা তাহে গর্ভ উদরেতে।...

পুত্র দেখি পৃথাদেবী হইল বিস্মিত/ লোকে খ্যাত হবে বলি হইলা বিরস।

কুলেতে কলঙ্ক রবে, লোকে অপযশ/ এতেক চিন্তিয়া পৃথা পুত্র লৈয়া কোলে।

তাম্রকুণ্ড করি ভাসাইয়া দিল জলে।।”৯

 কর্ণকাণ্ডের পর কুন্তীর পাণ্ডুর গলায় মালা দেওয়া। পাণ্ডু নামে রাজা হয়েছিল বটে, কিন্তু ঠিক ঠিক রাজত্ব করা বলতে যেটা বোঝায় তিনি সেটা করেননি। তাইতো কুন্তীর পাটরাণী হয়ে ওঠা হয়নি। কিমন্দ মুনির অভিশাপ ছিল কোনো নারীর সঙ্গে মৈথুনে প্রবৃত্ত হলেই পাণ্ডুর মৃত্যু ঘটবে। সুতরাং স্বামীর ছোঁয়াচ বাঁচিয়েই কুন্তীকে কাটাতে হয়েছে অনেকখানি সময়। তার প্রতি পাণ্ডুর উপেক্ষা কুন্তীকে বারংবার বিচলিত কখনোবা ক্ষুব্ধ বা রুষ্ট করে তুলেছে। তার মধ্যে সবসময় ছিল একটা হারানোর ভয়। ড. দীপক চন্দ্র কুন্তীর আত্মকথায় কুন্তীর সেই অসহায়তাকে প্রকাশ করেছেন অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায়—

“পাণ্ডুর নিষ্ঠুর ঔদাসীন্যই তার প্রতি আমাকে ক্ষুব্ধ ও রুষ্ট করে তুলল। তবু এই মানুষটিকে ছাড়া আমি আর কিছু ভাবতে পারি না। তাকে বাদ দিয়ে তো আমার কোন আলাদা মর্যাদা কিংবা স্বীকৃতি নেই। হস্তিনাপুরে তার রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে যে দুঃসাহসিক পরিকল্পনা করেছিলাম, পাণ্ডুকে ছাড়া সে পরিকল্পনার মানে হয়ও না হয়তো জোর করে কিছু করতে চেষ্টা করা হবে হঠকারিতার সমান।”১০

প্রথম সন্তানকে জন্ম দেওয়ার পর সমাজ ও পরিবারের মুখ চেয়ে ভাসিয়ে দিতে হয়েছিল কুন্তীকে।  কুন্তীকে পুত্র হারানোর অব্যক্ত যন্ত্রণা নিজের মধ্যেই চেপে রাখতে হয়েছিল। কুমারী অবস্থায় পুত্রলাভ ও পুত্রত্যাগ কুন্তীর মনে এক তীব্র অনুশোচনা সৃষ্টি করেছিল।  তিনি ধর্ম এবং ব্রতচারণের মধ্যে বেঁচে থাকার আশ্রয় খুঁজে পেলেন। যথাসময়ে রাজা কুন্তীভোজ কুম্ভীর স্বয়ংবর সভার আয়োজন করলেন। স্বয়ংবর সভায় পাণিপ্রার্থী রাজাদের মধ্যে পাণ্ডুকে দেখে কুন্তী মুগ্ধ হন এবং তাঁর গলায় বরমাল্য পরিয়ে দেন। পরে রাজা পাণ্ডু মাদ্রীকে বিয়ে করলেও অন্য নারীর মতো কুম্ভীর ক্ষেত্রে সপত্নী সমস্যা দেখা যায় না। রাজা পাণ্ডু যখন পত্নীদের ছেড়ে বনে তসপ্যা করার সিদ্ধান্ত নেন তখনও কুন্তী কিন্তু স্বামীসঙ্গ ত্যাগ করেননি। রাজবধূ হয়েও সমস্ত আবরণ-আভরণ ত্যাগ করে বল্কল পরে স্বামীর সঙ্গে বনে বনে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এখানে চরিত্রটির স্বাভাবিকতা রক্ষা পেয়েছে। যথাসময়ে ধর্মরাজ, পবনদেব ও ইন্দ্রকে আহ্বান করে তাঁদের প্রসাদে কুন্তী লাভ করলেন তিনপুত্র-যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুনকে। ওই একই মন্ত্রবলে মাদ্রী লাভ করেছিলেন দুই পুত্র নকুল ও সহদেবকে। স্বামীকে মুনির অভিশাপ থেকে রক্ষার জন্য কুন্তী সবসময় তাঁর পাশে থেকেছেন। তবুও মাদ্রীর কারণে পাণ্ডুর মৃত্যু হলে নিজেকে সংযতরাখতে পারেননি তিনি। আর এই দুর্ঘটনার জন্য মাদ্রীকে দোষারোপ করতেও ছাড়েননি—


“রক্ষিতব্যো জনাধিপঃ।

সা কথং লোভিতবর্তী বিজনে ত্বং নরাধিপম্।”১১


কুন্তী তাঁর জীবনের এতবড় সর্বনাশের জন্য সপত্নীকেই দায়ী করেছেন। একজন সদ্য স্বামীহারা নারীর পক্ষে হয়তো এই আচরণই যথার্থ ছিল। পাণ্ডুর সঙ্গে মাদ্রী সহমৃতা হলে কুন্তী রয়ে গেলেন পাঁচ পুত্রের প্রতিপালনের জন্য। স্নেহপ্রবণ চিরন্তন মাতৃমূর্তিরূপে তিনি সন্তানদের বিপদে উদ্বিগ্ন হয়েছেন। তাঁদের রক্ষা করার জন্য ব্যাকুল হয়েছেন। কুরু-পাণ্ডবের অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা সমাপনের পর প্রকাশ্য মঞ্চে অস্ত্রকৌশল প্রদর্শনের চিত্রে কবচ ও কুণ্ডল দেখে পুত্রকে চেনা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছে। কিন্তু কর্ণ-অর্জুন পরস্পর শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলে কুন্তীর মাতৃহৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। তবে কুন্তী শুধু তার পুত্রদের জন্য চিন্তা করেছেন তা নয়; তিনি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে কর্ণের কাছে গিয়েছিলেন তার মাতৃত্বের নিয়ে। সেখানে কুন্তী চরিত্রের একটা দারুণ বিনির্মাণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তার ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’ কবিতায়। তবে কবিতায় ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদে’র সংলাপ রচিত হলেও এর মধ্যে ছিল অসাধারণ একটা নাটকীয়তা।সুতরাং সেদিক থেকে মহাভারতের সমগ্র নারীচরিত্রের মধ্যে কুন্তী সবচেয়ে বেশি দ্বান্দ্বিক চরিত্র। 


মহাভারতের আর একজন উল্লেখযোগ্য নারী দ্রৌপদী। দ্রৌপদী মহাভারতের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র। তিনি পঞ্চপাণ্ডবের সহধর্মিনী। তিনি দ্রুপদের কন্যা বলে তাঁর নাম দ্রৌপদী। তিনি পাঞ্চালী ও যাজ্ঞসেনী নামেও পরিচিতা। মহাভারতে দ্রৌপদী অনিন্দ্য সুন্দরী ও তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ নারী রূপে চিত্রিত হয়েছেন। তিনি তার ধর্মশীলতা, সাহসিকতা‌ ও বহুপতিত্বের জন্য পরিচিত। তবে রাজশেখর বসু তার মহাভারতের বাংলা সারানুবাদের ভূমিকাতে দ্রৌপদী সম্পর্কে লিখেছিলেন—

“প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে অন্য কোনো নারী তাঁর তুল্য জীবন্ত রূপে চিত্রিত হননি।…দ্রৌপদী অবলা নন, জয়দ্রথ ও কীচককে ধাক্কা দিয়ে ভূমিশায়ী করেছিলেন। তিনি অসহিষ্ণু তেজস্বিনী স্পষ্টবাদিনী, তীক্ষ্ণ বাক্যে নিষ্ক্রিয় পুরুষদের উত্তেজিত করতে পারেন। তাঁর বাগ্মিতার পরিচয় অনেক স্থানে পাওয়া যায়।”১২

দ্রৌপদীকে কেন্দ্র করে মহাভারতের অনেক পুরুষের জীবন আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বেআবর্তিত হয়েছে এবং কাহিনি দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় ও তীব্র গতিসম্পন্ন হয়ে উঠেছে। পাঞ্চালরাজা সন্তানলাভের জন্য যজ্ঞ করেন, সেই যজ্ঞের আগুন থেকে এক কুমারী আবির্ভূত হন। তাঁর আবির্ভাব মুহূর্তে উচ্চারিত দৈববাণী থেকে জানা যায় দ্রৌপদী নারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এই নারী ক্ষত্রিয়দের ধ্বংস করার জন্য আবির্ভূত হয়েছেন। দ্রৌপদী কৃষ্ণবর্ণা ছিলেন বলে তাঁর নাম কৃষ্ণা। পাঞ্চাল রাজকন্যা বলে তিনি পাঞ্চালী নামেও পরিচিত। মহাভারতে  দ্রৌপদীর জন্মবৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে—

“দ্রুপদ-রাজার কন্যা কৃষ্ণা নাম ধরে। 

রূপে গুণে তুল্য নাহি পৃথিবী ভিতরে॥ 

অযোনি-সম্ভবা কন্যা জন্ম যজ্ঞ হৈতে। 

যাজ্ঞসেনী নাম তাই বিখ্যাত জগতে॥”১৩

  আবির্ভাব মুহূর্তের পর দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে বিবাহযোগ্যা দ্রৌপদীকে আবার পাওয়া যায় স্বয়ংবরসভায়। ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে পঞ্চপাণ্ডব সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন। এরপর ব্রাহ্মণবেশী অর্জুন সেই লক্ষ্যে বাণবিদ্ধ করলে দ্রৌপদী তাঁর গলায় বরমাল্য পরিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য জননী কুন্তীর একটি অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য পঞ্চপাণ্ডবের পাঁচজনকেই পতিত্বে বরণ করতে হয়েছে দ্রৌপদীকে। এক্ষেত্রে তাঁর স্থৈর্য, সহনশীলতা ও পরিস্থিতিকে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। পঞ্চপাণ্ডবকে পতিত্বে বরণ করলেও তিনি অর্জুনকেই সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। এখানে অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদীর পক্ষপাত বলা যাবে না, কারণ স্বয়ংবর সভায় সবার মধ্যে অর্জুনকেই তিনি পতিত্বে বরণ করেছিলেন। তাই দ্রৌপদীর এই মানসিকতা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ‘সভাপর্বে’ রাজসভায় সর্বসমক্ষে দ্রৌপদীর চূড়ান্ত অপমান মহাভারতের একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। পাশা খেলায় সর্বস্বান্ত যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে পণে হারালে দুর্যোধন যখন নির্দেশ দিয়েছেন দ্রৌপদীকে প্রকাশ্য রাজসভায় নিয়ে আসতে। তখন দৃপ্তকণ্ঠে তাকে তিরস্কার করেছেন দ্রৌপদী— 


“সাকৃষ্যমানা নমিতাঙ্গযষ্টিঃ শনৈরুবাচাথ রজস্বলামি। 

একঞ্চ বাসো মম মন্দবুদ্ধে। সভাং নেতুং নাইসি মামনার্য্য।”১৪


মন্দবুদ্ধি দুঃশাসনকে দ্রৌপদী তাঁর একবস্ত্রা এবং রজঃস্বলা অবস্থার কথা বলে তাঁকে সভাস্থলে নিয়ে যাওয়া অনুচিত বলে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং সমগ্র কৌরবসভার প্রতি ধিক্কার জানিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণের শরণাপন্ন হয়ে এবং তাঁর কৃপায় বস্ত্র দ্বারা নিজেকে আবৃত করে লজ্জা নিবারণ করেছেন। পঞ্চস্বামীর স্ত্রী হয়ে দ্রৌপদী বারবার লাঞ্ছিত হয়েছেন অন্য পুরুষের দ্বারা। পঞ্চস্বামীর স্ত্রী, কৃষ্ণ সখা যার, যিনি ধৃষ্টদ্যুম্নের বোন তার রাজসভায় এই অবস্থা কেন হল? দ্রৌপদীর এই উক্তিতে আত্মমর্যাদা ও বংশমর্যাদাবোধ প্রকাশিত। দুঃশাসনের বুকের রক্তে ভীম যতদিন না পর্যন্ত তাঁর বেণি বেঁধে দেবেন ততদিন তিনি চুল খোলাই রাখবেন। এখানে অত্যাচারীর প্রতি তাঁর তীব্র ঘৃণা, ক্রোধ এবং প্রতিশোধস্পৃহা ফুটে উঠেছে। ‘বিরাট পর্বে’ বিরাট রাজসভায় কীচকের কাছে নির্যাতিত হয়েছেন দ্রৌপদী। দ্রৌপদীর ব্যক্তি জীবনেও এ এক চরম ট্রাজেডি। তবে ভীমের প্রতি তার ছিল একটা বিশেষ আস্থা। তাইতো দ্রৌপদীর মহাপ্রস্থানের বর্ণনায় কাশীরাম দাস লিখেছেন—


“আচম্বিতে সমাচার শুনিল দুরন্ত।

মূর্ছিত হইয়া পড়ে, শোকে নাহি অন্ত ॥

ঘোর সিন্ধু মধ্যে যেন ডুবিল তরণী।

ঘোরবন মধ্যে যেন বেড়িল আগুনি॥”১৫


দ্রৌপদীর এই আচরণের মধ্যে দিয়ে তাঁর আধুনিকতার অন্যতম ব্যক্তিত্ব ও আত্মসম্মানবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। তবে এই কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে দ্রৌপদীর চরিত্র মহাভারতের এক উজ্জ্বল পরাকাষ্ঠা। 


মহাভারতের এই পাঁচটি নারী তাঁদের চারিত্রিক দ্বন্দ্ব, দীপ্তি ও আত্মস্বাতন্ত্র্যবোধ নিয়ে স্বমহিমায় উজ্জ্বল।  তীক্ষ্ণ আত্মমর্যাদাবোধ ও বংশমর্যাদাবোধ সম্পন্ন তেজস্বিনী এই ক্ষত্রিয় নারী তাঁদের নিজ চরিত্রগুণে মহাভারতের নারীচরিত্রের মধ্যে শুধু আকর্ষণীয় হয়ে ওঠেননি, সেই সঙ্গে আধুনিক নারীচরিত্রের গুণাবলীও তাঁদের মধ্যে প্রকাশ পেয়ে তারা চিরন্তন হয়ে উঠেছে। আপাতত দৃষ্টিতে মনে হয় মহাভারত বীরর রসাত্মক উত্তর ভারতের যুদ্ধবিগ্রহ কেন্দ্রিক একটি মহাকাব্য বিশেষ। যেখানে পুরুষ সিংহাসন কে কেন্দ্র করে কুরু এবং পাণ্ডবের যুদ্ধে উভয় পক্ষের পুরুষেরা প্রাণ দান করেছেন। 


কিন্তু গঙ্গা থেকে শুরু করে বংশপরম্পরায় কৌরব এবং পাণ্ডবদের বংশে যে পাঁচ জন নারী এসেছেন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে উপনীত হবার নেপথ্যে তাদেরও গুরুত্ব একেবারে কম নয়। তবে গঙ্গা চরিত্রের মধ্যে দেখা গেছে যে নিজস্বতা এবং স্বাধীনতার সুর তা সেকালের পক্ষে ছিল যথেষ্ট চোখে পড়বার মতো একটা বিষয়। কিন্তু সত্যবতী গঙ্গার মতো কোনো দেবী ছিলেন না। তিনি সাধারণ মত নারীর প্রতিনিধি, সে ক্ষেত্রে তার মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে অসামান্য একটা রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার পরবর্তী প্রজন্মের যে অগ্রগতি সেই অগ্রগতিকে বারংবার ক্ষতবিক্ষত করেছে। ভীষ্ম সিংহাসন লাভ না করে তিনি কৌরব সিংহাসনকে রক্ষা করবার প্রতিজ্ঞা ধারণ করেছেন। কিন্তু যখন ধৃতরাষ্ট্র এবং পান্ডুর মধ্যে কে সম্রাট হবেন সেটা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে সেখানে দেখা গেছে গান্ধারী চরিত্রটি ঠিক ততখানি রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষীনি ছিলেন না যতটা ছিলেন কুন্তী। সে ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে সত্যবতীর পর যদি কোন নারী কুরু এবং পাণ্ডব বংশের সিংহাসন কে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সংঘাতের মধ্যে নিজেকে আবর্তিত করে থাকেন তিনি অবশ্যই কুন্তী। তিনি যত বড় না রানী তার চেয়ে বড় তিনি পাণ্ডবদের জননী তাইতো প্রতি মুহূর্তে তার চরিত্রে লক্ষ্য করা গেছে তার পুত্রদের জন্য সিংহাসনের পথ থেকে যাবতীয় কন্টক সরিয়ে দিতে। 

তবে তিনি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ যে চেয়েছিলেন তা নয়, যুদ্ধ চাননি সত্যবতী যুদ্ধ চাননি কুন্তী কিন্তু শেষ পর্যন্ত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে গান্ধারী কিম্বাকুন্তির মাতৃত্বের হাহাকার বারংবার লক্ষ্য করা গেছে। আর যুদ্ধ শেষে গান্ধারী যখন যুদ্ধক্ষেত্রে এসেছেন তখন তিনি দেখেছেন কি ভয়ংকর এক মৃত্যু লীলা। তিনি তার শত পুত্রের মৃত্যুতে হাহাকার করছেন। তবে শেষ পর্যন্ত রাজা হয়েছে কুন্তীর পুত্রেরা। মহাভারতের কর্মফল বাদ অর্থাৎ ধর্মের জয় এবং অধর্মের পরাজয় নির্দেশ করা হয়েছে। স্বাভাবিক কারণে পান্ডবেরা রাজা হলেও তারা গান্ধারীকে কোনদিন অসম্মান কিংবা অযত্ন করেননি। তবে এ কথা অস্বীকার করা চলে না যে মহাভারতের বীর রসাত্মক যুদ্ধের নেপথ্যে কুরু এবং পাণ্ডবের অন্দরমহলে যে নারী জগত, সেখানে এই পাঁচটি নারীর অসামান্য রূপায়ণ ব্যাসদেবকে যেমন যুবতীর্ণ এক চরিত্র নির্মাতার অভিধা দান করেছে তেমনি কাশীরাম দাসের নারী চরিত্র নির্মাণের নিপুণতাকেও অস্বীকার করবার নয়। 

_____________

তথ্যসূত্র:

১.  কাশীরাম দাস, মহাভারত, অক্ষয় লাইব্রেরী, সেপ্টেম্বর ২০২২, পৃষ্ঠা–৯৪।

২. বেনীমাধব শীল, কাশীদাসী মহাভারত, অক্ষয় লাইব্রেরী, ১৯৯৪, পৃষ্ঠা–৯৫।

৩. ধীরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, মহাভারতের নারী, আনন্দ প্রকাশন্‌ মে ২০১৫, পৃষ্ঠা–৭৭। 

৪.  শাঁওলি মিত্র, নাথবতী অনাথবৎ, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, ২০১৩, পৃষ্ঠা – ৩৭। 

৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘নারী’, কালান্তর, বিশ্বভারতী, বৈশাখ ১৩৪৪, পৃষ্ঠা -৩৬৩।

৬. নিবেদিতা বিশ্বাস, মহাভারত: প্রসঙ্গ প্রসঙ্গান্তর, দে পাবলিকেশন, ২০১৫, পৃষ্ঠা–৭৩।

৭. বেনীমাধব শীল, কাশীদাসী মহাভারত, অক্ষয় লাইব্রেরী, সেপ্টেম্বর ২০২২, পৃষ্ঠা–১০৯।

৮.  দীপক চন্দ্র, গান্ধারী, কুরুক্ষেত্রের গান্ধারী, দে’জ পাবলিশিং, ২০০৫, পৃষ্ঠা–৩৬।

৯. বেনীমাধব শীল, কাশীদাসী মহাভারত, অক্ষয় লাইব্রেরী, সেপ্টেম্বর ২০২২, পৃষ্ঠা–১১১।

১০. দীপক চন্দ্র, সম্রাজ্ঞী কুন্তী, দে’জ পাবলিশিং, ১৯৯৩, পৃষ্ঠা–১২৯।

১১. মহর্ষি-শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়নবেদব্যাস ‘মহাভারতম্’, বিশ্ববাণী প্রকাশনী, ১৩৩৮বঙ্গাব্দ পৃষ্ঠা–১৩৩১।

১২. রাজশেখর বসু, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস কৃত মহাভারত সারানুবাদ, এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স 

    প্রাইভেট লিঃ, ১৪১৮, ভূমিকাংশ পৃষ্ঠা–০৬।

১৩. বেনীমাধব শীল, কাশীদাসী মহাভারত, অক্ষয় লাইব্রেরী, সেপ্টেম্বর ২০২২, পৃষ্ঠা–১৬৩।

১৪. মহর্ষি-শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়নবেদব্যাস ‘মহাভারতম্’, বিশ্ববাণী প্রকাশনী, ১৩৮৪বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা–৫৩১।

১৫. কাশীরাম দাস, মহাভারত, অক্ষয় লাইব্রেরী, সেপ্টেম্বর ২০২২, পৃষ্ঠা.১১৭০। 








গ্রন্থপঞ্জি


আকর গ্রন্থ :

১. ব্যাসদেব : মহাভারত (সংস্কৃত), ২০২০, গোরক্ষপুর, গীতা প্রেস।

২. কাশীরাম দাশ : মহাভারত (বাংলা), ২০১৬, অক্ষয় লাইব্রেরী।


সহায়ক গ্রন্থ :

১. কঙ্কর সিংহ : মনুসংহিতা এবং নারী, নভেম্বর ২০১০ র‍্যাডিক্যাল।

২. কাশীরাম দাস : মহাভারত, সেপ্টেম্বর ২০২২ অক্ষয় লাইব্রেরী।

৩. দীপক চন্দ্র : দ্রৌপদী চিরন্তনী, ডিসেম্বর ১৯৯৬, দে’জ পাবলিশিং।

৪. দীপক চন্দ্র : সম্রাজ্ঞী কুন্তী, এপ্রিল ১৯৯৩, দে’জ পাবলিশিং।

৫. নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ি : মহাভারতের নীতি অনীতি দুর্নীতি, ২০১৪, পত্রলেখা।

৬. নিবেদিতা বিশ্বাস : মহাভারত : প্রসঙ্গ, প্রসঙ্গান্তর, জানুয়ারি ২০১৫, 

দে পাবলিকেশন্‌স।

৭. মহর্ষি- বেদব্যাস : মহাভারতম্’, ১৩৮৪বঙ্গাব্দ, বিশ্ববাণী প্রকাশনী।

৮. শাঁওলী মিত্র : দিদৃক্ষা, কলকাতা, ১৯৯২, আনন্দ পাবলিশার্স।

৯. শাঁওলী মিত্র : ‘শাঁওলী মিত্রের গল্পসমগ্র’, প্রথম প্রকাশ ১৪২১,

মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স।

১০. শাঁওলী মিত্র : নাথবতী অনাথবৎ ও কথা অমৃতসমান, ফাল্গুন ১৪২৬,

মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স।


পত্র-পত্রিকা :

১. শারদ সংখ্যা ভিস, ২০১৮, সম্পাদক : চন্দন বাঙ্গাল ও অভীক প্রধান।

২. নাট্য আকাদেমী পত্রিকা, ২০০৬-৭, সম্পাদক : নৃপেন্দ্র সাহা।

৩. এবং মহুয়া, ২০১৯, সম্পাদক : মদন মোহন বেরা।

৪. চান্দ্রভাষ, ২০১৭, সম্পাদক : অজিত ত্রিবেদী।

৫. কবিতীর্থ, ২০২১, সম্পাদক : উৎপল ভট্টাচার্য।

৬. এবং মুশায়েরা (ফ্রয়েড সংখ্যা) ২০২০, সম্পাদক : সুবল সামন্ত।

আরও পড়ুন 

বিজ্ঞাপনের বিকল্প বিজ্ঞাপনই || ঋত্বিক ত্রিপাঠী 

Post a Comment

0 Comments