শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৭৮ / সালেহা খাতুন
দশ দিন মেয়েকে ছাড়া কাটানো বেশ মুশকিল ছিল তখন। মা বাবা মেদিনীপুর চলে আসায় চিন্তা অনেকটা কমলো ঠিকই কিন্তু ওর সঙ্গে কানেকটেড থাকার জন্য নোকিয়ার একটি মোবাইল সেট কিনে দিল আমার এন. এস. এস.- এর সহায়ক নয়ন। নয়ন আর আমি তখন এন. এস. এস.- এর বিভিন্ন জিনিস সংগ্রহ করার জন্য প্রায়ই বাজারে ঘুরতাম। বিশেষ করে ক্যাম্পের সময় মেদিনীপুরের বড়োবাজারে একবার চুনীলাল, একবার ভুতড়া অ্যাম্পোরিয়াম, একবার ট্রাঙ্ক হাউস একবার ল্যাম্প হাউস এই করে বেড়াতাম। কেনাকাটা করতে করতে জিনিসপত্র বেড়ে গেলে আমাকে একটি রিকশায় চাপিয়ে দিত আর জিনিসপত্রের পাহাড়ে আমি ঢেকে যেতাম। কলেজে এনে স্টোররুমে জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতাম।
আমাদের এন.এস.এস.- এর স্টোররুমে থাকতো কোদাল, ঝুড়ি, ট্রাঙ্ক, শতরঞ্জি, হারমোনিয়াম, তবলা, পঞ্চপ্রদীপ, ফুলদানি, টেবিলক্লথ, জলের লম্বা পাইপ, বেশ কিছু ডেকরেটার্স সামগ্রী, স্টীলের লম্বা মই আরো কত কী! অতিথিদের বরণের জন্য বিষ্ণুপুরী অথবা বাটিকের চাদর। কখনও কখনও এমনও হয়েছে যে ইউনিভার্সিটির এন.এস.এস. অফিস আমাদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়েছেন এগুলি কোথায় পাওয়া যায় বা কোথা থেকে আমরা সংগ্রহ করেছি। কোনো জিনিস সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে শুধু অর্থ থাকলেই হয় না পছন্দটাও বড়ো কথা। আমি তখন একেবারে বাজার সরকার হয়ে গিয়েছিলাম। ফলে সারা মেদিনীপুরে কোথায় কী পাওয়া যায় তা আমার একেবারে নখদর্পণে চলে এলো।
আন্তর্জাতিক নারীদিবস উদযাপনে আমরা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের নারীদের খুঁজে খুঁজে নিয়ে আসতাম। খেলোয়াড় মেয়েকে সংবর্ধনা দিতে চাই তো খবর নিয়ে চলে গেলাম কলেজিয়েট গার্লস স্কুলে। সেখানে মুনমুন নামে ক্লাস নাইনের একটি মেয়েকে এনে বড়োদের সঙ্গে মঞ্চে বসিয়ে দিলাম। ওকে উপহার দেওয়া হলো কেডস সহ খেলার সম্পূর্ণ পোশাক। সার্থকতা এখানেই, যখন সেই মেয়ে আমাদেরই সময়কালে কলেজে ভর্তি হলো এবং স্বেচ্ছায় এন. এস. এস. - এ যোগ দিল। নির্যাতিত শোক সন্তপ্ত নারীকে খুঁজে আনা হলো রাজার পুকুরের পাড় থেকে। সেই প্রৌঢ়ার একমাত্র কন্যাকে পণের টাকা দিতে না পারায় পুড়িয়ে মারা হয়েছে। ছাত্র সমাজকে যথার্থ বার্তা দিতে তিনিই পারেন। ভবিষ্যত প্রজন্মকে তিনিই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করালেন – পণ দেবো না, পণ নেবো না মন্ত্রে। মহিলা শ্রমিককে নিয়ে এলাম, আনা হলো সমাজসেবীকে এবং তৎকালীন জেলাসভাধিপতি অন্তরা ভট্টাচার্যকে। তাঁকে আমন্ত্রণ জানাতে আমি আর মণিশ্রীদি গেলাম মেদিনীপুর জেলা পরিষদের অফিসে। তিনি চেম্বারে বসে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং করছিলেন। মিটিংয়ের সদস্যদের অনুমতি নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বললেন, আমন্ত্রণপত্র নিলেন এবং জানালেন ঠিক সময়মতো তিনি অনুষ্ঠানে চলে আসবেন। তাঁর বক্তব্যে তিনি অনুপ্রাণিত করে গেলেন আমাদের ভলান্টিয়ারদের।
🍂
প্রত্যেক জুলাইয়ে লিটারেসি উইক পালন করতে ভলান্টিয়ারদের আমরা নিয়ে যেতাম অ্যাডাপ্টেড স্লামে। হরিজন পল্লির প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ওরা পড়াত। ফললাভ দুতরফেরই হতো। ক্লাস ফোরের একটি মেয়ে ‘ভ’ লিখতে পারত না। তাকে থ এর মতো ভ না লিখে সঠিকটা শিখিয়ে দিতে আমাকে বলে দিদিমণি তুমি আমাদের পড়াও না গো। ওদের যথার্থ গাইড করার কেউ নেই,বুঝতাম! ওদের মধ্যে শিল্প প্রতিভাও ছিল। একটি বাচ্চা মাটি দিয়ে সুন্দর প্রতিমা বানাতো। তাকে উৎসাহিত করার জন্য দুলালদার ইচ্ছা অনুযায়ী মেদিনীপুরের পরিচ্ছদ ভবন থেকে প্যান্ট শার্ট কিনে উপহার দেওয়া হয়।
অরণ্য সপ্তাহও এই জুলাইয়েই পালন করা হতো। ভলান্টিয়াররা ডি এম অফিসে গিয়ে চারাগাছ নিয়ে আসতো আর তা ক্যাম্পাসে এবং স্লামে লাগানো হতো। একবার একটি মেহগিনির চারাগাছকে বাঁচাতে না পেরে কয়েক রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি।
শিশু দিবস উদযাপন উপলক্ষে স্লামের বাচ্চাদের মধ্যে কালচারাল কম্পিটিশন আয়োজন করা হতো। টিচিং এডস খাবার দাবার উপহার দেওয়া হতো। সম্ভবত ২০১১ তে শিশু দিবস উদযাপনে অধ্যক্ষ ড.প্রবীরকুমার চক্রবর্তী এবং প্রাতঃবিভাগের ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপক সুধীন্দ্রনাথ বাগকে আমরা আমাদের অ্যাডাপ্টেড স্লামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে যাই। স্কুলের শিক্ষকরা যারপরনাই আনন্দিত হন। বলেন আমাদের স্কুলের ইতিহাসে এই প্রথম একজন অধ্যক্ষ এলেন। অদ্ভুত ব্যাপার! স্কুলের শিক্ষকরা আমাদের প্রত্যেককে বই উপহার দিলেন। আমরা ইতস্তত করায় তাঁরা বলেন আমাদের ছাত্রছাত্রীদের জন্য আপনারা সারাবছর কাজ করেন আমরা আজ এটুকু করতেই পারি। আমাকে তাঁরা দিয়েছিলেন অস্কার ওয়াইল্ড- এর একটি ছোটোগল্প সংকলন।
ডিসেম্বরের এক তারিখে এডস ডে পালনের নিমিত্ত পদযাত্রা, সেমিনার ইত্যাদি আয়োজন করতাম।মনে পড়ে ২০০৯ – এ ডা. দিবাকর সামন্ত লেকচার দেন “ফার্স্ট এইড টু এডস” বিষয়ে। ২০১১ তে অধ্যাপক ড. দেবদুলাল ব্যানার্জি বক্তৃতা দেন এইচ আই ভি / এডস গেটিং টু জিরো” ( এডস ফ্রি ওয়ার্ল্ড) শিরোনামায়।
২০০৯–এ বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিভিন্ন কলেজ থেকে যে বাইশ জন প্রোগ্রাম অফিসারকে “১২৭ তম ওরিয়েন্টেশান কোর্স ফর এন. এস. এস. প্রোগ্রাম অফিসার্স” – এ পাঠানো হয়, সেই দলভুক্ত ছিলাম আমি আর সোমদত্তা ম্যাডাম। সেই কোর্সে ত্রিপুরা, মণিপুর, দার্জিলিং এবং আরো অন্যান্য জেলা থেকে, বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি থেকে অধ্যাপকরা-শিক্ষকরা এসেছিলেন। একসঙ্গে ক্লাস করা, থাকা খাওয়ার মাধ্যমে সংস্কৃতির এক সমন্বয় লক্ষ করি। দার্জিলিংয়ের এক মহিলা অধ্যাপক আমাদের সঙ্গে রাতে ছিলেন, তিনি এখানকার গরম সহ্য করতে না পেরে ঘরের মেঝেতে বালতি বালতি জল ঢেলে দিলেন। দোতলা থেকে জল নেমে একতলা পুরো ভেসে গেল। সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি।
অমূল্যরতন
ত্রিপুরার এক দিদির থেকে মেয়েদের জীবনযাত্রার কতরকম দিকের কথা জানতে পারলাম। বিশেষ করে তিনি বলছেন যে তাঁর স্বামীকে নিয়ে তিনি বাবা মার কাছে আসেন না, তাতে নাকি তাঁর প্রাইভেসি নষ্ট হয়। বাবা মার সঙ্গে মন খুলে কথা বলা যায় না। সত্যিই তো একটু তলিয়ে দেখলেই কথাটার সারবত্তা যে অতি গভীর ভুক্তভোগীর পক্ষে তা বোঝা অসাধ্য নয়। ক্লাসের শেষে বৃষ্টি নামায় গেস্টহাউসে আসতে পারছেন না মণিপুরের এক দিদি। আমরা অবাক হলাম। ছাতা দেওয়া সত্ত্বেও বৃষ্টিতে পথে নামবেন না। কী ব্যাপার! জানা গেল মণিপুরী যে ঐতিহ্যবাহী পোশাকটি তিনি পরে আছেন সেটি অত্যন্ত দামী। জল লাগলেই নষ্ট হয়ে যাবে। অনেকেই মুখ টিপে হাসছে, ভাবছে এই সামান্য ইন্নাফি আর ফানেকের কতই বা দাম হবে! জানা গেল ফানেক বা স্কার্টটির দামই সাতহাজার টাকা।
প্রতিদিন সকালে টি.ও.আর
সি.-র ক্যাম্পাসের মন্দিরে সোমদত্তা ম্যাডামের সঙ্গে ধ্যানে বসতাম, নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের চত্ত্বরে হেঁটে বেড়াতাম, ওদের মেডিসিনাল প্ল্যান্টের বাগানে ঘুরতাম। বিশাল এক জলাশয়ের ধারে নাগকেশর গাছের তলায় পড়ে থাকা ফুল কুড়োতাম। সোমদত্তা বোটানির অধ্যাপক, নানান গাছপালা চেনাতেন এবং তার গুণাগুণ সম্পর্কে আমাকে ওয়াকিবহাল করতেন। আর দশটা থেকে পাঁচটা রুটিন মেনে ক্লাস চলতো আমাদের। একদিন কোঅর্ডিনেটররা আমাদের কলকাতা ভ্রমণে নিয়ে গেলেন। যাঁরা প্রথমবার কলকাতা এসেছেন তাঁরা ভিক্টোরিয়া ও অন্যান্য দর্শনীয় স্থানে ঘুরলেন। আমরা গেলাম নিউমার্কেট। রামকৃষ্ণ মিশনের আউটলেট থেকেও অনেক জিনিস কিনলাম। বিশেষ করে ব্লাইন্ডদের হাতে বানানো বিভিন্ন জিনিসপত্র।
টানা চার বছর এন. এস. এস.- এ যাপনের খুঁটিনাটি সব মনে নেই কিন্তু শেষ করেছিলাম থ্যালাসেমিয়া ডিটেকশন ক্যাম্প দিয়ে। ভলান্টিয়ারদের অনেকেই বাহক ছিল। তাদের সার্টিফিকেট আলাদা দেওয়া হয়েছিল। গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছিল। গাইড করা হয়েছিল আর এক বাহককে যেন ওরা বিয়ে না করে। ওদের সাথে সাথে আমিও নিজেকে চেক করে নিই। না আমার ভয় পাওয়ার মতো কিছু ছিল না।
0 Comments