স্নেহ
পুলককান্তি কর
গ্রামটির নাম পীরপুর। এখানে খুব সুন্দর একটা পীরের মাজার আছে। মস্ত একটা বটগাছ আর তার ছায়ায় ঢাকা ছায়া সুশীতল একটা বাঁধানো মতো জায়গা। অজস্র মাটির ঘোড়া বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো ছেটানো। আর বটগাছটায় অসংখ্য সুতোয় বাঁধা মাটির ঘোড়া ঝুলছে। পীর নাকি খুব জাগ্রত। আশেপাশের মানুষজন সবাই মানত করে। বহুদিন আগে কী একটা কাজ উপলক্ষ্যে এখানে এসেছিলাম। এই মাজারটিকে নিয়ে একটা গল্পও লিখেছিলাম 'মাজার' নামে। প্রায় বছর বারো বাদে আজ আবার এসেছি। এসেছি অবশ্য সরকারী এক কাজে। এখানে নয়। পাশেই নন্দঘাট বলে এক শহরে। বিকেল বিকেল কাজ হয়ে গেল বলে একটা টোটো ভাড়া করে চলে এলাম এখানে।
এই মাজারটার পরিবেশ আমাকে খুব টানে। সেটা অবশ্য কতটা পীরবাবার কল্যাণে আর কতটা বটগাছটার কারণে– তা বলা মুশকিল। প্রাচীন বটগাছ মানেই একটা ছায়া সুনিবিড় রহস্যঘেরা স্থান। সে বোটানিক্যাল গার্ডেনই হোক অথবা গ্রামের পুকুর পাড়। এই মাজারটার লোক প্রসিদ্ধি যতটা, ভিড় ততটা থাকে না। দু ঘণ্টা বসলে ক্বচিৎ কখনও এক আধজনের দেখা পাওয়া যায়। পাশেই একটা ভগ্নপ্রায় ঝুপড়ির মতো বাড়ী আছে। তারাই বোধহয় এর দেখাশোনা করে। মাঝে মাঝে একটি বারো তেরো বছরের ছেলে এসে উদয় হচ্ছে। ছেঁড়া প্যান্ট, নাক ভর্তি সর্দি। পথচলতি গাড়ী বা পথচারীরা যে খুচরা পয়সা ছুঁড়ে দিচ্ছে এদিকে, সে ওগুলি তুলে গুছিয়ে রাখছে। কেট ঘোড়া, মোমবাতি কিনতে চাইলে তাকেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে আজ। গত বারে যখন এসেছিলাম এক প্রায়-যুবতী মেয়েকে দেখেছিলাম – সেই এসব কাজ করতো। এতদিনে নিশ্চই বিয়ে-থা হয়ে গেছে তার। কালো মতো মিষ্টি চেহারার ছিল সে, দোহারা গড়ন। নাম বলেছিল নাজমা। টোটো বালা এসে বলল, 'স্যর আপনি কি এখন ফিরবেন?'
- না হে! এসেছি যখন ঘন্টাখানেক থাকবো। সন্ধ্যা হলে ফিরবো!
- তবে কি স্যর আমি একটা ট্রিপ দিয়ে আসবো?
- আমি তো তোমায় পুরো সময়ের জন্য রিজার্ভ করেছি জনার্দন!
- সে ঠিক কথা স্যর। তবে কিনা গরিব মানুষ। একটা কাস্টমার পেয়ে গেছি। নন্দঘাট যাবো আর আসবো। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই চলে আসবো স্যর। সেরকম হলে না হয় বিশটা টাকা কম দেবেন।
হাসলাম আমি। বললাম, 'যাও। সময় মতো এসো কিন্তু! গিয়ে হোটেলে চা খাবো।'
বট গাছটার দিকে মুখ করে আদূরেই একটি পরিত্যক্ত গাছের গুঁড়ির উপর আমি বসেছিলাম। খেয়াল পড়ল আমার থেকে হাতচারেক দূরে একটি পনেরো ষোল বছরের মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে বললো, 'আপনি চা খাবেন?'
- খেতে তো ইচ্ছে করছে, কিন্তু এখানে আশেপাশে তো দোকান দেখছি না।
- সে আপনাকে ভাবতে হবে না। ওই যে ছেলেটি দেখছেন হাফপ্যান্ট পরা– ওকে বলছি, ও করে দেবে।
- পয়সা নেবে তো?
-আরে না না! আপনি বাইরের লোক– আমাদের এখানে অতিথি– সামান্য একটু চা খাওয়াতে পারবো না?
- কিন্তু এটা তো তোমার বাড়ী না। তুমিই বা কোন অধিকারে...
- আরে ওর নাম তো ' মোতায়েম'। ও আমার ভাই কাম বন্ধু। ও করে দেবে। আপনি চিন্তা করবেন না। বলেই দৌড়ে চলে গেল সে। সুন্দর একটা হলুদ রঙের ফ্রক পরা পরীর মতো মেয়েটি। মাথার চুল দু’দিকে বিনুনি করে লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা। খানিক বাদে একটা ভাঙা স্টীলের প্লেটে দুটো গ্লুকোজ বিস্কুট আর চা নিয়ে উপস্থিত হল সে নিজেই। দূরে দেখি মোতায়েম নামের ছেলেটি লাজুক লাজুক মুখ নিয়ে উকি দিচ্ছে। হয়তো লজ্জা পাচ্ছে তার ছেঁড়া প্যান্টটির কারনে বা অপরিচিত শহুরে লোকের সামনে আসতে অস্বস্তিও হতে পারে। মেয়েটি এসে বললো, 'নিন, খেয়ে দেখুন! আমি নিজেই বানিয়ে এনেছি। একটু আদা থেঁতো করে দিয়েছি।'
চা টা মুখে দিয়ে একটু অস্বস্তি হল। বাড়ীতে যদিও পাতা চা খাই– তবে বাজার হাটে চা নিয়ে খুব একটা বাছ বিচার করিনা। কিন্তু মেয়েটি ভালোবেসে এত চিনি দিয়েছে, সে কহতব্য নয়। তবে ছেঁচা আদার গন্ধটি বেশ ভালোই বেরিয়েছে। তাকিয়ে দেখি মেয়েটি উৎকর্ণ হয়ে চেয়ে আছে, প্রশংসাসূচক কিছু শুনতে চায়। বললাম, 'খুব ভালো হয়েছে চা।'
- তবে আপনি মুখটা কেমন একটা করলেন দেখলাম যে! ধরা পড়ে গেছি। তবু নরম করে বললাম– আসলে বাড়ীতে কম চিনি খাই তো, তোমায় বলতে ভুলে গেছি!
- শহরের লোক কম চিনি খায়, জানি আঙ্কেল। তবে মোতায়েমের ঘরে চিনি ছিল না তো! বাতাসা দিয়ে চা বানিয়েছি। আন্দাজ পাইনি। পরে না হয় আরেকবার করে দেব!
-তোমার নাম কি?
-লাবণ্য।
-তুমি হিন্দু?
- হ্যাঁ
- তবে যে দেখলাম একটু আগে তুমি বটগাছটার গায়ে ঘোড়া বাঁধছিলে!
- তাতে কী হয়েছে। এই পীর ভারি জাগ্রত। এখানে হিন্দু মুসলমান সবাই মানত করে, ঘোড়া বাধে, সিন্নি চড়ায়।
- তা তুমি কী নিয়ে মানত করলে? পরীক্ষার রেজাল্ট?
- মানতের কথা কাউকে বলতে নেই আঙ্কল। মনে মনে রাখতে হয়। নইলে ফল হয় না।
- তোমার বাড়ী কত দূর?
- ওই তো ওই দিকে। বলেই আকাশের মাঝখানে কোনও একদিকে ইঙ্গিত করলো সে।
- তুমি কি রোজ এখানে আসো?
উত্তরে লাবণ্য ' হুম' জাতীয় কিছু আওয়াজ করল, বুঝলাম না– তার মানে হ্যাঁ, নাকি না।
কথায় কথায় জানা গেল মেয়েটি এবার মাধ্যমিক দেবে। এখানে স্কুল ওই নন্দঘাটেই। এরা কন্যাশ্রীর সাইকেল চড়ে স্কুলে যায়, ওখানে দুপুরে মিড ডে মিল খেয়ে বিকেল চারটে নাগাদ বাড়ি ফেরে। মোতায়েম কাছেই একটা মাদ্রাসায় পড়ে। লাবণ্যের শখ নাচ শেখা। টিভি দেখে সে সিনেমার গানগুলির নাচের স্টেপ সব রপ্ত করে নিয়েছে বটে, তবে সে ক্লাসিক্যাল ডান্সার হতে চায়। এসব অঞ্চলে সে সব শেখার সুব্যবস্থা নেই। ওর বাবা গ্রামের হাতুড়ে চিকিৎসক। উপার্জন ভালোই। মেয়েকে শহরে পাঠিয়ে পড়ানোর ইচ্ছে। নন্দঘাটে হায়ার সেকেন্ডারি পর্যন্ত। তার পরে পড়তে হলে বাইরে যেতে হবে। লাবণ্যের ইচ্ছা কলকাতায় পড়ার। আমি কলকাতায় থাকি শুনে অনেক কথা জানতে চাইলো সে। সেটা কেমন শহর। একা মেয়ে মানুষ থাকতে পারবে কিনা। গুন্ডা বদমায়েশের উপদ্রব কেমন– ইত্যাদি। আস্তে আস্তে সন্ধে থেমে এলো। মোতায়েম কয়েকটি মোমবাতি জ্বেলে বটগাছটার সামনে, মাজারের কাছে আর ঘোড়ার ভগ্নস্তুপের সামনে রাখলো। ধুপ জ্বালালো বেশ কয়েকটা। এখানে ইলেক্ট্রিক বাতি নেই। ওই আলো আঁধারিতে বড় মায়াময় হয়ে গেল চারপাশ। মোমবাতির আলোয় নাকে সিঙনি ভরা মোতায়েমের চোখগুলো দেখে বুকের মধ্যে কেমন যেন করে উঠলো আমার।
লাবণ্য বলল, ‘আঙ্কল আর একবার চা দেব? হাফ বাতাসা দিয়ে?
কথাটার উত্তর না দিয়ে বললাম, ‘মোতায়েমর মা-বাপ নেই?’
- মা মারা গেছে!
- বাবা?
- আর একবার চা খান না আঙ্কল! আগেরটা ভালো হয়নি–
এমন আর্তি নিয়ে বলল মেয়েটি, ‘না’ বলা গেল না। বললাম, ' চলো মোতায়েনের ঘর দেখে আসি!'
ঘর আর কী ! টিন আর খড় মিলে একচালা দেওয়া দেড়খানা ঘর। স্নান পায়খানার ঘর চোখে পড়লো না।
- এর গার্জেন কে?
- ওর নানা– মানে দাদু!
- উনি কোথায়?
- নন্দঘাটে একটা হোটেলে কাজ করে। ফিরতে ফিরতে রাত দশটা এগারোটা বাজে।
- ছেলেটা সারাদিন একা থাকে?
- শুধু থাকে না আঙ্কল। নিজের জন্য রান্না করে, খায়– স্কুলে যায়।
ভারাক্রান্ত মন নিয়ে চা খেলাম। এবার চা এ ত্রুটি নেই। সস্তার চা, তবু এত যত্ন নিয়ে বানানো মনটা আপ্লুত হয়ে গেল। জনার্দন এসে গেছে। পকেট থেকে দুটো পাঁচশো টাকার নোট নিয়ে লাবণ্যকে বললাম, 'এটা দিয়ে ছেলেটাকে ভালো জামা প্যান্ট কিনে দিও।'
লাবণ্য কিছুতেই টাকাটা হাতে নিল না। বললো 'কেন আঙ্কেল মিছিমিছি টাকাটা নষ্ট করছেন? এটা তো সমস্যার সমাধান নয়।'
- সে জানি!
- আপনি শ্রদ্ধেয় মানুষ। মিছিমিছি ছেলেটার লোভ বাড়িয়ে কী করবেন? ওকে এভাবেই থাকতে দিন।
একটি গ্রাম্য বালিকার মুখে এমন কথা শুনে চমকে উঠলাম। টাকাটা পকেটে নিয়ে বললাম, 'চলি তাহলে!' ঘর থেকে বেরিয়ে হঠাৎ যেন কিছু মনে পড়েছে এমনভাবে বললাম, ‘এখানে আমি বছর বারো আগে এই ঘরে একজন শ্যামলা যুবতীকে দেখেছিলাম, লাবণ্য তুমি কি ওর কথা জানো? ওর কি দূরে কোথাও বিয়ে হয়ে গেছে?’
লাবণ্য আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। বলল, ‘মোতেম, বাইরের বাতিগুলো দেখে আয়, জ্বলছে নাকি নিভে গেছে সব!' আমার দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনার পাঁচ মিনিট সময় হবে?'
- নিশ্চয়ই হবে।
- তবে ওই টোটোর কাকুকে বলে আসুন– ও একটু ওয়েট করুক। আর আপনি ওই গুঁড়িটায় গিয়ে বসুন। আমি আসছি।
মিনিট পাঁচেক পরে লাবণ্য ফিরে এসে বসল আমার কাছে। শান্ত গলায় বলল, 'আপনি কি নাজমা পিসীর কথা বলছিলেন?'
- হ্যাঁ। সে কোথায়?
- নাজমা পিসিই মোতায়েমের মা।
- তা ও মারা গেল কী করে?
লাবণ্য মাথা নীচু করে রইল। বেশ খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘দেখছেনই তো এখানকার পরিবেশ। নির্জন, ছমছমে । আনসার দাদু তো রাতে ফেরে। কিছু গুন্ডা বদমাইশ একদিন পিসীর উপর এমন নির্যাতন করে যে ওকে হাসপাতালে দিতে হয়। হাসপাতালে দিন পাঁচেক বেঁচে ছিল, একদিন সকালে খবর পেলাম, মারা গেছে।’
- কদিন আগে?
- বছর তিনেক হল I
- থানা পুলিশ হয়নি?
- তেমন কিছু হয়নি।
- মোতায়েমের বাবা?
লাবণ্য চুপ করে রইল। আমার হাত দুটো ধরে কাতর স্বরে বলল, ‘কাকু। আপনাকে দেখে বড় আপন মনে হচ্ছে বলে এতগুলো কথা বলছি। এই কথা আপনি আগেও জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তখন বলিনি; কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আপনাকে বলা উচিৎ। আপনি মোতায়েমের একটা ব্যবস্থা করে দেবেন শহরে? ছেলেটি বড় ভালো।’
- সে না হয় পরে দেখা যাবে! ওর বাবার কথা শুনি। উনি কি বেঁচে আছেন?
- হ্যাঁ।
- আমি কি তাঁর সাথে দেখা করবো?
লাবণ্য ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘কথা দিন কাকু, আপনি এই কথা কাউকে বলবেন না!’
- সেরকম বিষয় হলে আমাকেই বা বলার কী দরকার ?
- আপনাকে বলাটা দরকার কাকু!
- তাহলে বলো।
- মোতায়েমের বাবা, আমার বাবা এক।
- কে বলেছে একথা?
- নাজমা পিসী আমাকে হাসপাতালে বলেছে।
- তিনবছর আগে তোমার বয়স কত ছিল লাবণ্য?
- তেরো !
-এই বয়সের কোনও মেয়েকে এত বড় কথা কি কেউ বলতে পারে? ওনার অভিযোগ থাকলে গোপন জবানবন্দী দিতে পারতেন ডাক্তারকে। নিজের বাবাকে বলতে পারতেন, নিদেন পক্ষে তোমার মাকে!
-নাজমা পিসী তো কোনও অভিযোগ করার জন্য আমাকে বলে যায়নি কাকু। ও বোধ হয় ভেবেছিল তার মৃত্যু আসন্ন। তার ছেলে যে আমার ভাই– এইটা জানিয়ে বলেছিল আমি যেন ওকে দেখেশুনে রাখি। এবং আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল, এইকথা যেন আমি আমার বাবা-মা, আত্মীয় পরিজন– কাউকে না বলি।
- উনি তোমাকেই বা এত কথা বললেন কেন?
- নাজমা পিসি আমাকে খুব ভালোবাসতো। মেয়ের চোখেই দেখতো। তখন আমি প্রায় দিনই নানা অজুহাতে এই মাজারে ঘোড়া বাঁধতে আসতাম। যেতে যেতে যা হয়– মাঝে মাঝেই আমাকে লজেন্স বা এটা ওটা খেতে দিত। মাথায় তেল দিয়ে চুল বেঁধে দিত। আমিও মোতায়েমের সাথে খেলতাম।
- তা এসব কাণ্ড তোমার মা জানেন না?
- না। আমি তো প্রায়দিনই এদিকে আসতাম– কোনওদিন বাবাকে এ পথ মাড়াতে দেখিনি। অথচ পিসি বলেছে বাবার সাথে নাকি ওর ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল।
মাজারের সব বাতি নিভে গেছে। আজ আকাশে সামান্য এক ফালি চাঁদ। বোধ হয় চতুর্থীর। একটা গাড়ীর আলোয় দূরে দাঁড়ানো জনার্দনের টোটোগাড়ীর পেছনের রিফ্লেক্টারটা চিকমিক করে উঠলো। সেই আলোয় দেখলাম লাবণ্যের চোখে জল। জনার্দন সাহস করে একটা হর্ন দিল। এবার আমার ফেরার দরকার। আবছা আলোয় লাবণ্যর হাতটা হাতড়ে দুটো পাঁচশ টাকার নোট আর আমার ভিজিটিং কার্ডটা ধরিয়ে বললাম, 'বাড়ী যা! এত অন্ধকারে তোরও এভাবে রোজ রোজ বাড়ী ফেরা ঠিক না।' কোত্থেকে একটা টিকটিকি হঠাৎ করে উচ্চৈস্বরে বলে উঠল, ‘টিক্, টিক্, টিক্ !’
0 Comments