জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় /চুয়ান্নতম পর্ব /আবীর ভট্টাচার্য

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় 
চুয়ান্নতম পর্ব

আবীর ভট্টাচার্য 

নব্বইয়ের দশকের গ্রামীণ বাঙালি জীবন বেশ নিস্তরঙ্গই ছিল, বিশেষতঃ মেয়েদের জন্য।তখনও কাজে অকাজে ইন্টারনেটের প্রসার তেমন জনপ্রিয় হয়নি,খুব বেশি মানুষের বাড়িতে টিভিও পৌঁছয়নি, দৈনিক খবরের কাগজ এলেও তা গুটিকয় পুরুষই পড়তেন, মেয়েদের সেসবে তেমন আগ্রহ ছিল না। তবে,প্রাত্যহিক কলকাতা দূরদর্শনের কিছু ধারাবাহিক,শনিবার ও রবিবার সন্ধ্যায় হিন্দি ও বাংলা সিনেমা,সাপ্তাহিক রামায়ন,মহাভারতের কথা অনেকেই জানতো।পাড়ায় যেকোনো একটি ঘরে টিভি থাকলেই সেখানে জটলা করে টিভি দেখা হতো,বিশেষ করে সিনেমা বা খেলা চলার সময়ে। তখনও বেসরকারি চ্যানেলের প্রচলন হয়নি।
 পাড়া প্রতিবেশীর মধ‍্যে প্রাইভেসির পাঁচিল ওঠেনি,না বলে কয়ে অন্যের বাড়ি যাওয়া অসৌজন্যমূলকও ছিল না। এক অর্থে অবারিত দ্বার সবাই সবার জন্য।
ফলে,টিভি দেখতে এলে,বাড়ির মানুষজনের বিরক্ত হাওয়ায় প্রশ্নই উঠতো না,বরং প্রতিবেশি আসবে বলে টিভির ঘরে সতরঞ্জি বিছিয়ে রাখা হতো।

চক্রবর্তী বাড়িতেও অহনার বিয়ের আগে থেকেই টিভি ছিল,সাদা কালো।কাঠের বাক্সসহ টিভি,এই অ্যত্তো বড়ো।তাতে ছবির চাইতে বেশি আসতো এলোমেলো ঝিলমিল,দোতলার টিনের চালের ওপরে মোটা তার দিয়ে লোহার রড ও বাঁশের মাথায় তার অ্যন্টেনা ছিল বাঁধা।প্রায়ই ছবি না এলে,অন‍্য একটি লগি দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছবি আনার চেষ্টা চলতো।কখনো আসতো,কখনো বা আসতো না।তার মধ‍্যেই কখনো আবার লোডসেডিং হয়ে যেত।তবে,ধৈর্য্যচ‍্যূতি কারও হতো বলে মনে হতো না।

🍂

বরং সে সময় ইতিউতি ঘরোয়া গল্প চলতো,কার সংসারে কি হ’লো,কার ঘরের কত্তা বাইরে গিয়ে কি কি শুনে এসেছেন, খবরের কাগজে কি লিখেছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
ছোটদের মধ্যে আবার খুব জনপ্রিয় ছিল 'শক্তিমান 'সিরিয়াল,মুকেশ খান্নার।তিনি আবার মহাভারতে ভীষ্মও সাজতেন। তাছাড়া ছিলেন অরুণ গ্রোভিল; রামায়নের রাম,আবার বেতাল পঞ্চবিংশতির বিক্রমাদিত্য।অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন বাচ্চাদের মধ্যে,তাঁদের নামে স্টিকারও পাওয়া যেত।অহনা বাবার বাড়ি গেলে ভাসুরের ছেলে দুটির জন্য এসব কিনে আনত।তারা জ্যামিতি বক্সে এসব বসিয়ে বন্ধুদের কাছে কৃতিত্ব পেত।
তো এমনই একদিন রবিবারের সকাল।চায়ের পর্ব মিটিয়ে বাড়ির বৌয়েরা দুপুরের রান্নার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত,টিভির ঘরে সাপ্তাহিক মহাভারতের আহ্বান, ঘরভর্তি কচিকাঁচা আর প্রতিবেশীদের আনাগোনা …গানে গানে চলছে বি.আর.চোপড়ার সেই বর্ণাঢ্য অথ-মহাভারত-কথা;
সদর দরজায় প্রতিবেশী ছেলেটির ছায়া…
-‘দাদা,বাড়ি আছো?’
-’কে রে!আয়, ভেতরে আয়’
-’পার্টি অফিসের দাদারা এসেছেন,ভেতরে আনবো!’
-’এখন!কেন রে!আন,আন।’
বাড়ির বড়ো ছেলে সেইমাত্র হাট থেকে ফিরেছেন,তিন কর্ত্রী মিলে টেলিভিশন দেখতে দেখতেই বাড়ির নতুন বৌটিকে সবজীপত্র গুছিয়ে রাখতে সাহায্য করছেন,বড়ো বৌ উনুন জ্বালাতে ব্যস্ত,ভাত বসাতে হবে।
জমজমাট মধ্যবিত্ত গৃহস্থালি সংসার।
তো সেই ছেলেটির পিছে পিছে জনাক’য় মাতব্বর ঢুকলেন, এলাকার পার্টির ঘনিষ্ঠ।ছেলেটিই বসালো সবাইকে।
নতুন বৌকে চায়ের ফরমায়েশ করে তার ভাসুর গেলেন তাদের সঙ্গে দেখা করতে, কিছু পরে ডাক পড়লো মেজ ছেলের,অহনার চা তখনও ফুটে ওঠেনি।
চা বানিয়ে বিস্কিট সাজিয়ে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে করতেই দুই ভাই রান্নাঘরে। খুব প্রয়োজন না পড়লে এবাড়ির ছেলেদের রান্নাঘরে আসার রেওয়াজ নেই।
অহনা ভেবেছিল,চায়ের জন্য তাড়া দিতেই এসেছেন ওনারা। তাড়াতাড়ি চায়ের ট্রে বাড়িয়ে বললে,
-’এই যে।হয়ে গেছে।’
ভাসুর বললেন,
-’না। চা নয়।ওনারা একটা অন্য প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন’
-’কি?’
উনুনের ফুঁকনালায় ফুঁ দিতে দিতে দিদিভাইয়ের প্রশ্ন…
-’দাঁড়াও।আগে চা টা পাঠিয়ে  দিই’
বলেই হাঁক দিলেন প্রতিবেশী ছেলেটিকে।সে চা নিয়ে চলে যাওয়ার পরে, দুই ভাই যৌথভাবে যা বললেন, তার শুনে দুই বৌ চমকে উঠলে;অসতর্কে মুখে ধোঁয়া ঢুকে কেশে হেঁচে দিদিভাই বেচারী জেরবার,অহনাও হতবাক। ইতিমধ্যে তিন গিন্নীও পৌঁছেছেন।
বিষয়টা যা,তা হলো,সামনের ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনে দ্বিস্তর অর্থাৎ জেলা পরিষদের প্রার্থী হিসেবে নতুন বৌটিকে তাঁরা প্রার্থী হওয়ার আবেদন নিয়ে এসেছেন।তখনকার সামাজিক পরিস্থিতিতে যা ছিল প্রায় অসম্ভব। একে তো গ্রাম,তায় রক্ষনশীল বাড়ি। তাছাড়া,তখন তো বামপন্থীদের সর্বাত্মক ক্ষমতা তৃণমূল স্তরেও সুবিস্তৃত ছিল।কোন কারণ ছিল না কোন মহিলা, বিশেষতঃ কোন রক্ষণশীল বাড়ির কমবয়সী বধূকে প্রার্থী করার।
হতেই পারে, অহনার স্বামী কর্মক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য, ভদ্রলোকের মনে মনে বামপন্থার কল্যাণকামী কার্যক্রম নিবিড়ভাবে গ্রথিত হয়ে চলেছে,তবু…

পারিবারিক আলোচনা জোরকদমে চলছিল,ছোট দেবরও এসে যোগ দিয়েছিল,শুধু অহনা ছিল নিরুত্তর। ঘটনার আকস্মিকতায় হোক,অথবা নতুন বধূ জীবনের জড়তায় হোক,এককালের নামী ‘ডিবেটিয়ান’মেয়েটির গলায় স্বর ফোটেনি কোন;অবাক চোখদুটি শুধু বরিষ্ঠ পরিজনদের আলোচনা শুনছিল।

পক্ষে বিপক্ষে মত চালাচালির পরে,সবশেষে সিদ্ধান্ত হয়, শাসকগোষ্ঠী যখন নিজে থেকে প্রস্তাব এনেছেন,তখন রাজি হওয়াই উচিত।তবে পাত্রী বদল হবে। নতুন বৌটি নয়, প্রার্থী হবেন বাড়ির বড় বৌমা।যদি তাঁরা রাজি থাকেন..

রাজি তাঁরা হয়েছিলেন, এবং সে নির্বাচনে দিদিভাই প্রার্থী হয়েও ছিল।
দেওয়াল লিখনে মায়ের নাম দেখে কিশোর ছেলেদুটি নিজেদের বন্ধুমহলে বেশ কেউকেটা হওয়ার ভান দেখিয়েছিল,এমনকি,মা মন্ত্রী হলে ‘শক্তিমান’ বা ‘বিক্রমাদিত্য’যে তাঁদের বাড়িতে দুপুরে খেতে আসবে,চাইলে খেলতেও নিয়ে যাবে বন্ধুদের সঙ্গে তাও ভেবে ফেলেছিল।
হায় রে শিশুমন!কতো সহজ আর অনায়াস তার মনোগমন!...
তবে, সৌভাগ্য বা দূর্ভাগ্য যাই হোক,সে আশা তাদের পূর্ণ হয়নি।ব্যক্তি মানুষ হিসেবে ‘বৌমা’ যতই ভালো হোন‌ না কেন পাড়া প্রতিবেশীর কাছে,,রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় তিনি পিছিয়ে পড়েছিলেন, নির্বাচিত হতে পারেননি। অনালোচিত সেই অধ্যায়ের স্বপ্নফুল প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই ঝরে পড়েছিল,কেউ মনেও রাখেনি।
তবে, অনেক, অনেকদিন পরে, সেদিনকার সেই নববধূ পরিনত চেতনায় মনে করেছিলেন,এ রাজ্যের বামপন্থা হয়তো তখন থেকেই যুগোপযোগী হওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছিল আপনার অগোচরে।নারীর হাতে ক্ষমতায়নের অধিকার দেওয়া, গ্রামীন অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনে সর্বসাধারণের অর্থাৎ উচ্চ -নীচ,নারী-পুরুষ ইত্যাদি স্বাধিকার চেতনার প্রবেশ ঘটানো কি তারই অঙ্গ ছিল না!
কেন্দ্রে তখন সবে ডঃ মনমোহন সিং অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন, নানা বৈপ্লবিক এবং আধুনিক পরিবর্তনের দিকে এগোচ্ছে দেশ।তুমুল বিরোধিতা সত্ত্বেও রাজ্যই বা পিছিয়ে থাকে কেন! নিজের নিজের মতো করে সংস্কার করতে শুরু করে নিজেদের; পরবর্তী বুদ্ধদেব জমানার আগে।
এবং তারই খানিক ঢেউ এসে লেগেছিল হয়তো আরও অনেকের মতো এ বাড়ির দেওয়ালেও।
হয়তো সব সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি,সব সংস্কারও জনমুখী হয়নি,তবু নিয়মতান্ত্রিক অচলায়তন ভাঙার চেষ্টা যে হয়েছিল,তা স্বীকার করতেই হয়। ইতিমধ্যে চীনের ছাত্র আন্দোলন,রাশিয়ায় গর্বাচেভের পতন,এদেশে বাবরি মসজিদের চূড়া ভাঙার মতো অপ্রীতিকর বিষয়গুলি ঘটে গেছে,তাও ভোলার নয়।
ইতিহাস তো সাধারণেরই গল্প,এক সাধারণীর চোখে দেখা এসব মামুলি নৈমিত্তিক ঘটনাবলীও যে কখনও তার উপাদান হবে না,তা কে বলতে পারে!...(ক্রমশঃ)

Post a Comment

0 Comments