পর্ব- ৪৬ ( অন্তিম পর্ব )
স্বপন কুমার দে
তখন আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি। প্রকৃতি সেজেছে বর্ষাস্নাত নব কলেবরে। পরিষ্কার নীল আকাশ, পেঁজা তুলোর মত সাদা মেঘের ভেলা। তার নীচে পৃথিবীর কোলে পুঞ্জ পুঞ্জ কাশ ফুলের চামর দোলা দেয় বাতাসে। ক্রমাগত বর্ষনসিক্ত পৃথিবীর মানুষ স্বস্তি পায়। প্রকৃতির উদারতায় মানুষও নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চায় বন্ধন মুক্তির আবেগে। আকাশে বাতাসে আনন্দময়ীর আগমণবার্তায় মুখর প্রকৃতি। বাঙালি মেতে ওঠে আবেগে, আনন্দে, উৎসবে, আয়োজনে। দৈনন্দিন জীবনের ক্লান্তি ধূসরতার মেঘ মুক্তি ঘটে তার চৈতন্যলোকে।
মণিদীপা ও অমরেশ, দুজনেই এবারের পুজোয় ছেলের কাছে। ইচ্ছা আছে এখানে সপ্তমী, অষ্টমী কাটিয়ে নিজের শহরে যাবেন। মূলতঃ ছেলের অসুস্থতার জন্যই এখানে কিছুদিন থেকেই আছেন। মণিদীপা বুঝতে পেরেছেন, তিনি ভুল করেছেন। ছেলের মানসিক অবস্থান না বুঝেই তিনি মাতৃত্বের অধিকারে অকারণ অভিভাবকত্ব করেছেন। এই ধরনের অভিভাবকত্ব অনভিপ্রেত, এই হস্তক্ষেপ সুখকর নয়। ছেলেমেয়েরা একসময় বড় হয়। তাদেরও নিজেদের মতামত থাকতে পারে, তার জন্য যথেষ্ট পর্যবেক্ষণ ও আত্মসমীক্ষা প্রয়োজন। ভুল হলে সেই ভুল ধরিয়ে দিয়ে সন্তানের শুদ্ধিকরণ করতে হয় কিন্তু সিদ্ধান্ত কখনোই একতরফা যেন না হয়। স্বামী অমরেশ তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তিনি মায়ের অধিকারে কোনও আপত্তি ওজরকে গ্রাহ্য করেননি। তাঁর মনে হয়েছিল, তিনি যা করেছেন সব কিছুই ছেলের এবং তাঁর পরিবারের মঙ্গলের কথা ভেবেই করেছেন। সে কারণে তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে তিনি এক পাও পিছু হটেন নি।
এখন তিনি অনুভব করছেন সবার মঙ্গল করতে গিয়ে তিনি সমুর মারাত্মক ক্ষতি করেছেন। সমু নাবালক নয়, সমাজ-সংসার সম্পর্কে তারও অল্প বিস্তর জ্ঞান আছে। বিশেষতঃ কাজের সুবাদে অনেক রকম মানুষের সাথে তার সাক্ষাৎ ঘটে। তারা সবাই একই পরিবারের বা একই সমাজ বা গোষ্ঠির লোক নয়। এদের চাহিদা, রুচি, মানসিকতা সে উপলব্ধি করেছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে মল্লিকার মধ্যে সে তার জীবনের অর্ধ আকাশ খুঁছে পেয়েছিল। মা হয়ে তিনি সেসব বিচার বিবেচনা না করেই সেপাইয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ছেলের ইচ্ছা আকাঙ্খা সব ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। তাই মনের মধ্যে আক্ষেপ হয় মণিদীপার।
ছেলের বিয়ে দেওয়ার অনেক চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু সমু রাজি হয়নি। স্বেচ্ছায় একাকীত্বের জীবন বেছে নিয়েছে সে। কত সম্বন্ধ এসেছে, সেসব ফিরিয়ে দিয়েছে সমু। মা-বাবা পড়েছেন মহা চিন্তায়। তাঁরা থাকেন এক জায়গায় , ছেলে থাকে অন্যত্র। এই অবস্থায় খাবার, যত্ন, সঙ্গ সবকিছুই অপরের উপর নির্ভরশীল। বাধ্য হয়েই, ছেলে না চাইলেও বাবা-মা এসে থাকেন সমুর কাছে।
একদিন বাবা, মা,ছেলে-- তিনজনই বসে বসে গল্প করছিল। নিজেদের আত্মীয়স্বজনদের কথা, দুই ছেলের ছোটবেলার কথা, আরও কত কী! প্রসঙ্গ পাল্টে মা জিজ্ঞেস করলেন," মল্লিকা এখানে কোথায় থাকে রে?"
সমুও কেমন যেন নিরাসক্তভাবে উত্তর দিয়েছে," ঠিক বলতে পারবো না মা। শুনেছি, দেবীপুর বলে একটা জায়গায় একটি কলেজে পড়ায় সে। এখান থেকে কুড়ি বাইশ কিলোমিটার দূরে। কিন্তু কেন একথা জিজ্ঞেস করলে মা?"
" এর মধ্যে তোর সাথে কি তার দেখা হয়েছিল?"
" না "
"তোর সাথে কথা হয়?"
" তার ফোন নম্বর আমি আমি জানি না মা। "
" একবার তার কাছে আমাকে নিয়ে যেতে পারিস বাবা, তাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে।"
ছেলের চোখ মুখের এক্সপ্রেশন দেখে তার মনের ভাষা পড়তে পেরেছেন। অমরেশবাবু মণিদীপার ইচ্ছার অর্থ অনুমান করতে পারলেন। মুখে বললেন," হ্যাঁ, সে আমরা যেতেই পারি বহুদিন একই জায়গায় থেকে থেকে একঘেয়ে লাগছে। চলো তিনজনই যাই, একদিনের জন্য ঘুরে আসি।"
মা বললেন," আমার পুরানো হিসেবে একটা মস্তবড় ভুল হয়েছিল। সেকথা মল্লিকাকে বলে আসি।"
অমরেশবাবু গম্ভীর হলেন," লাভ হবে কি মণি? মল্লিকা বড্ড জেদি মেয়ে। ঐ জেদই তাকে আজ ঐ জায়গায় বসিয়েছে। তবুও তুমি বলছো যখন, চলো দেখি। চলো তিনজনই যাই।"
" তোমরা যাও বাবা, আমার কাজ আছে, আমি যাবো না।" একটা গোপন বেদনা সম্পূরককে গ্রাস করল।
বাবা সমুর কাঁধ স্পর্শ করলেন। ধীরে ধীরে বললেন," তোর মায়ের মুখের দিকে চেয়ে দেখেছিস? দেখলে বুঝতে পারতিস ওর বুকে এখন অনুতাপের জ্বালা। তোর মাকে তার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে দে।"
" আমার কারও প্রতি কোনও অভিযোগ নেই বাবা,কিন্তু আমি যেতে পারবো না। তার কাছে দাঁড়াতে আমার ভয় হয়।"
বৃদ্ধ পিতা আর চেষ্টা করলেন না।
মল্লিকা এখন কলেজ কোয়ার্টার ছেড়ে পাকাপাকিভাবে এখানেই থাকতে শুরু করেছে। তার পাঠকেন্দ্রের লাগোয়া কিছুটা জায়গা কিনে সেখানেই কয়েকটা রুমের একটা পাকা বাড়িতে অনাথ আশ্রম তৈরি করেছে। নাম দিয়েছে 'জ্যোতি'। সেখানের একটা রুমে নিজের থাকার ব্যবস্থা করেছে। বর্তমানে ওখানে পাঁচজন আবাসিক থাকছে। তাদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কাজের লোক, গার্ড সবই নিজের খরচে চলছে। এলাকার মানুষের কাছে মল্লিকা ম্যাডাম শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত। জাত,ধর্ম, দল নির্বিশেষে এই মানুষটির ডাকে সবাই হাত বাড়িয়ে দেয়। তাদের নিয়ে বেশ আনন্দে আছে মল্লিকা।
সেদিন ছুটির দিন, কাজেই কলেজ যেতে হবে না। এই অবসরটুকু কাজে লাগাতে সকাল থেকেই মল্লিকা খুব ব্যস্ত। বেশকিছু চারাগাছ বনদপ্তর থেকে নিয়ে এসেছে। 'আলো'র ছেলেদের ডাকা হয়েছে সেগুলো সযত্নে লাগানোর জন্য। কিছু অভিভাবক স্বেচ্ছায় কোদাল নিয়ে এসেছে, গর্ত খুঁড়ে মাটি তৈরি করবার জন্য,সেখানেরই পাম্প থেকে জল নিয়ে গাছের গোড়ায় দেওয়ার জন্য। এইসব কাজে এত ব্যস্ত মল্লিকা যে খাবার সময়টুকু পর্যন্ত পায় না। কেউ একজন জোর করে তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে চপ মুড়ি খেতে দিল। সে যখন খাচ্ছে তখন একটি ছেলে খবর দিল কারা যেন দিদিমণিকে খুঁজছে। মল্লিকার তখন খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। বাইরে এসে দেখল সম্পূরকের বাবা, মা। মল্লিকা দূর থেকে দেখতে পেয়েই ডাকল," আসুন,আসুন! আজ আমার কী ভাগ্য, আপনারা এখানে এসেছেন ! এখানের সন্ধান পেলেন কীভাবে?"
অমরেশবাবু মল্লিকার আতিথ্যে ঈষৎ কুণ্ঠিত হলেন। বললেন," তোমাকে এত ব্যস্ত হতে হবে না। আমরা এমনই এলাম। কিন্তু সমু কোথায় গেল?"
" আপনারা আসুন। আমি ছেলেদের পাঠাচ্ছি ওনাকে ডাকতে। বলে তাঁদের ডেকে নিয়ে নিজের ঘরে বসাল মল্লিকা। সে বাইরে যাওয়ার উপক্রম করতেই অমরেশবাবু তাকে ডাকলেন,' আমাদের জন্য ব্যস্ত হয়ো না, তুমি বসো। মল্লিকা ওদের পাশে বসল।
" তোমাকে যতই দেখি ততই অবাক হয়ে যাই। ভাবি, জোড়াদিঘি বস্তির খুব সাধারণ একটি মেয়ের মধ্যে এত তেজ! এতদিন অনেক বাধা বাঁধন দেখেছি। সেসব তোমাকে থামাতে পারেনি। আজ তো সমস্ত বাধা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। আজ আর তোমায় থামায় কে?"
" না জেঠু, এখনও আমি কিছুই করে উঠতে পারিনি, এখনও আমার অনেক কাজ বাকি। আপনাদের আশীর্বাদ মাথায় থাকলে আমি হয়তো আরও এগিয়ে যেতে পারবো।"
🍂
" ছিঃ,ছিঃ, এভাবে কেন বলছেন জেঠিমা। আপনারা আমার গুরুজন। এভাবে বললে আমার অপরাধ হয় আমাকে আদেশ করুন।"
" সে অধিকার যদি আমাদের থাকত,তাহলে," কথা বলতে গিয়ে আটকে গেলেন মণিদীপা। মল্লিকা সম্পূরকের বাবার দিকে চাইল। দেখল, তাঁর চোখে মুখেও অস্বস্তি ও ইতস্তত ভাব। সেসব সরিয়ে রেখে তিনি বললেন," আমরা তোমাকে আমাদের সমুর জন্য ভিক্ষা চাইছি মল্লিকা। তুমি আর না করো না।"
মল্লিকা, তার বসার জায়গা ছেড়ে উঠে পড়ল। চোখ মুখের ভঙ্গি বদলে গেল। প্রাণপণে নিজেকে ধরে রাখল," আর তা হয় না জেঠু। আজ আমি স্বেচ্ছায় যে পথ বেছে নিয়েছি, সেই জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়া সম্ভব নয়। এখন এরাই আমার সন্তান। আমি এদের মা। সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের অন্য কোনো মোহ আমাকে আর ফেরাতে পারবে না।"
" তোমাকে এখান ছেড়ে যেতে হবে না এখানেই সমুর জন্য একটু জায়গা তুমি ছাড়তে পারবে না মা? তুমি ছাড়া সমুর জীবন শূন্য। আমরা অনেক চেষ্টা করেও সমুর বিয়ে দিতে পারিনি। সে মুখে কিছু বলেনি, কিন্তু তার চোখের নীরব প্রতিবাদ আমাকে প্রতি পদে দগ্ধ করছে। আমি মা হয়ে ছেলের এই কষ্ট সহ্য করবো কী করে, বলতে পারো? তাছাড়াও আমি জানি, তুমিও স্বেচ্ছায় ব্রহ্মচর্যের যে কঠিন ব্লত ধারণ করেছো তার পেছনেও আছে সমুর প্রতি অগাধ ভালোবাসা। আমরা বেঁচে থাকতে এভাবে দুটো প্রাণ নষ্ট হয়ে যাবে? তুমিও কি এখনও মুখ ফিরিয়ে নেবে?"
" আমার এই পথে তাল মেলানো সম্পূরকের পক্ষে সম্ভব নয়। তার সুখ আছে, বিলাস আছে, বংশমর্যাদা, সামাজিক গরিমা আছে। সেসব ছেড়ে সে কেন এই কষ্টের জীবন মেনে নেবে? আর আমি সবচেয়ে আশ্চর্য হচ্ছি, সম্পূরক কিনা শেষ পর্যন্ত আপনাদের ডেকে নিয়ে এল।"
" তার কোনও দোষ নেই মল্লিকা। সে আমাকে অনেকবার নিষেধ করেছিল। আমরা তার নিষেধ শুনিনি। এখানে এসেছে ঠিক, কিন্তু দূরে দাঁড়িয়ে আছে।"
" আপনারা ফিরে যান জেঠিমা। আমার পক্ষে আপনাদের কথা দেওয়া সম্ভব নয়।"
সম্পূরক ঘরে ঢোকে, ঝড়ে ভাঙা গাছের মত। কোনও ভূমিকা না করেই বলে," মা! বাবা! তোমাদের আমি বারন করেছিলাম, কথা শোনোনি। এবার চলো, গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।"
একে একে সবাই উঠে পড়ে। একবারও পিছন ফিরে চাইল না সম্পূরক। সহসা কান্না ভেজানো উচ্চ কণ্ঠে মল্লিকা বলে," দাঁড়াও সম্পূরক!" সবাই অবাক হয়ে পিছন ফিরল।
" এভাবে আমাকে হারিয়ে দিয়ে চলে যাবে? জানতে চাইবে না কেন আমি...." কথাগুলো সম্পূর্ণ করতে পারল না মল্লিকা। কান্নায় গলার স্বর আটকে গেল।
সম্পূরক দেখল তার ডান হাতটা জোর করে ধরে রেখেছে মল্লিকা। ( সমাপ্ত )
0 Comments