পর্ব -৩৩
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া
|| ভেঙে যায় গ্ৰাম,নদীও শুকনো ধু ধু ...||
ইলেভেনে ভর্তি হয়েছে ঝিনি।খুব ভোরবেলা পোলতার খাল ধার দিয়ে বাঁটুল স্যারের কাছে অসীম,দিব্য সবুজদের সঙ্গে কেমিস্ট্রি পড়তে যায়।মসজিদে ফজরের আজান শোনা যায় তখন কুয়াশায় শাদা হয়ে থাকে ভোর।টুপটাপ নেউর পড়ে চারধারে। ধানখেতের ওপর দিয়ে সেই শিশির আর কুয়াশায় ভিজতে ভিজতে আজানের সুরও দূরে ভেসে যায়।ছোট এক ছেলে কাঁথার দোলাই গায়ে কলার বাসনা জ্বেলে খেজুর রসের মাটির ঠিলে পোড়ায়।। ওর নাম ফয়জুল।ফয়জুলের আব্বা এ সময় রস নামায় আশপাশের গাছ থেকে। রসের ভাঁড় জলে ধুয়ে আগুনে শুকিয়ে নিলে বাসি রসের গন্ধ কেটে যায়।
রসের ঠিলে নামাতে দেখলে দলের সব চে' লম্বা আর হুল্লোড়বাজ দিব্য চেঁচায়,ও চাচা রস খাওয়াবা না?পঁচিশ পয়সা করে বড় এক এক গ্লাস টাটকা জিরেন রস খেয়ে শীত লাগছে নাকি বলে হেঁকে ওঠে আর উঁহু মোটেও শীত করছে না বলতে বলতে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে হেসে ওঠে নিজেরাই।ঠিলে থেকে সব রস ঢেলে একখানে করে ফয়জুল।
ও চাচা, ফয়জুলির দ্যাও এক গেলাস। তোমরা খাও।লাগবে না উরির বলেই কুঠে লেগিছ নাই হাতে তোর ? বলে খেঁকিয়ে ওঠে ফয়জুলের ওপর। কপালে নাতি লেগিছ ক্যামন?আব্বার খেঁকানি শুনে আরও জড়োসড়ো হয়ে ফয়জুল রস ঢালে মাটির কলসিতে। চাচা ওর পয়সাডা আমি দিচ্চি।প্রায় দিনই ঝিনি একটা সিকি বের করে দিলে তবে মামুদ চাচা এক গেলাস রস ছেলেকে এগিয়ে দেয়।
রোজকার মতন রসের বান ধরাতে নিচু হয়ে কলার বাসনায় আগুন দিচ্ছিল ফয়জুল।যাই রে আজ।ঠাণ্ডা আঙুল ফয়জুলের গালে ছুঁয়ে দেখেছে সে ঠাণ্ডায় ফেটে একটু খরখরে হয়ে আছে তবু আম পাতার মতো সতেজ বাচ্চাটার মুখ।ফয়জুল আব্বার সঙ্গে গুড় জ্বাল দেয় রোজ।ইস্কুলে যায় না।
🍂
নদীর ধারে বাঁটুল স্যারের বাড়ি।কনকনে ঠান্ডায় হাত জমে যায় বলে সাইকেল থামিয়ে ওরা।হাত সেঁকে নেয় ফয়জুলের রসের বানের ধারে পথের ধারে নয়তো খড়ি জ্বেলে আগুন পোয়ানো মানুষদের সাথে বসে।
বাচ্চাটাকে অত খেঁকায় কেন যে,ঝিনি বলে।সৎ বাপ যে।ওর নিজির আব্বা মরি গিলি আম্মার নিকে করিছ ওই হাঁটা ছেলি সমেত। হাঁটা ছেলি মানে কী? আগের বে'র ছেলি মেয়ি সমেত সাদি হলি তাদ্দের বলে হাঁটা ছেলি বা মেয়ি।কিছুই তো জানিস নে। ঝিনির ওপর আপার হ্যাণ্ড নেয় ফিরোজ।আর এইসব ডেটা ফিরোজের মগজে আ্যতো খড়মড় কচ্ছে যে কেমিস্ট্রির ফর্মূলা সব ঘেঁটে ঘ হয়ি রোজ রোজ মার খাচ্ছে ও ।দিব্যর কথায় সবাই খ্যা খ্যা করে হেসে ওঠে।
সত্যি রে বাঁটুল স্যারের কাঁচা কঞ্চি আর সহ্যি হয় না মাইরি।আজকেই ফেরার সময় দোব নদীর জলে বিসর্জন। চিন্তা করিসনি। স্যারের ঝাড়ে কঞ্চির অভাব নেই।নাইন টেনের ছেলেদের দিয়ে ফের কাটিয়ে নেবেনখন।
বড়দিনের ছুটিতে বাড়ি ফিরে ছোড়দা হৈ চৈ বাঁধালো সেবার। কাল পিকনিক। খিচুড়ি ডিমভাজা চাটনি,বাঁধাকপি আর নলেন গুড়ের সন্দেশ।সোনাই নদীর ধারে। মুকুল ক্লাবের সবাইকে বলেছি। আমি যাব মা? একশ বার যাবি। মা কিছু বলার আগেই ছোড়দা তাকে উঁচু করে তুলেই ধপাস করে ছেড়ে দেয়।এইবার একটু ছাড়ো তো মা।সব কিছু বন্ধ করে হয়েছে তো তোমার রেজাল্ট? আবার তো এইচ এস এর জোয়াল টানতে লেগেছে। একদিন একটু ছাড় দাও। ফাইনাল এম বি বি এস এ পৌঁছে ছোড়দার কথার ওজন বেড়েছে যেন।কী ভেবে মা আর আপত্তি করে না।
চাল ডাল হাঁড়ি ডেকচি নিয়ে ভ্যানে করে যেতে যেতে খুব হৈচৈ করে তারা।,যা খুশি বকবক করে সবাই মিলে গান গায় "বাঁধ ভেঙে দাও..." গায় "তোমার খোলা হাওয়া ..." সবাই ওরা লাফায়, হাসে। তাদের অঞ্চলের ডাকসাইটে পাজি টাক মাথা এক নেতার নামে প্যারডি বানিয়ে তুষারদা গায় টাক ভেঙে দাও...টাক ভেঙে দাও...। ছোট বুলাদা বানায় এমন এক টাক দেখেছি আহারে যার তুলনা নেই...আর হো হো হাসিতে যেন এতদিনের সব অদেখা, না দেওয়া আড্ডা ওরা এক সকালেই পুষিয়ে নিতে চায়।
হঠাৎ করেই উদয়দা জোরে জোরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাঁকোটা দুলছে শুরু করল। সবাই ওরা কথা বলছিল যে যার মতো,হাসছিল কিন্তু শেষ দিকে যেই উদয়দা আমাদের ছুটি মন-বদলের খেলা/আমাদের ছুটি অরণ্যে খোঁজাখুঁজি/আমাদের ছুটি হাসি কান্নার বেলা/আমাদের ছুটি ইঙ্গিতে বোঝাবুঝিতে পৌঁছল , হঠাৎই চুপ করে গেল হইচই। আর বন্ধু হারালে দুনিয়াটা খাঁ খাঁ করে/ভেঙে যায় গ্রাম, নদীও শুকনো ধূ ধূ/খেলার বয়েস পেরোলেও একা ঘরে/ বার বার দেখি বন্ধুরই মুখ শুধু"তে এলে অকারণ মুচড়ে উঠল ঝিনির বুক।
ক্লাস টেনে প্রথম দিকে সেই যে সে ধ্রুবদাকে তাদের বাড়ি আসতে বারণ করেছিল সে আর আসেওনি কোনোদিন।অবরে সবরে তার মুখ মনে পড়েনি এমন নয়, বিশেষ করে মাধ্যমিক দিয়ে অখণ্ড অবসর পেয়ে গেলে।দু' একবার পাঠাগার বা ক্লাবের রবীন্দ্রজয়ন্তীতে দেখেওছে দূরে থেকে কিন্তু কথা আর হয়নি কখনও।
আজ সোনাই নদীর পারে দূর থেকে বটের ঝুরিতে ধ্রুবকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে নিজেই কাছে যায় দৌড়ে। কেমন আছেন ধ্রুবদা?ও তুমি?ভালোই তো আছি। তোমার রেজাল্ট শুনেছি কলির কাছে। অভিনন্দন।থ্যাঙ্কস কিন্তু আপনি এখানে একলা কেন বসে আছেন ?অন্তাক্ষরী খেলা হবে,আসুন সবাই মিলে খেলি।সামান্য হাসে ধ্রুবদা। তুমি তো দেখি বড় হয়ে গেছো স্রোতস্বিনী।বা! ইলেভেন ক্লাস হয়ে গেছে না আমার?
তাইই তো।
কলি ঋতু বনানীদিরা ছুটে আসে।আ্যই ঝিনি, ব্যাডমিন্টন না ফ্রিসবি? বললাম না অন্তাক্ষরী নয়তো মেমরি গেম আগে হবে কণা ঝামরে ওঠে।আয় আয় একঝাঁক ঢেউয়ের মতো ওরা দূরে চলে গেলে ঝিনিও পা বাড়ায়। আরে বোসো বোসো।একটু পরে না হয় খেলতে যেও। কতদিন পর দেখা গান শোনাও একখানা।বাঃ! পথে আসার সময় অত যে গলা ফাটালাম সবার সঙ্গে।সে তো সবার জন্য। এবার নিজের জন্য গাও।"দূরদেশী সেই রাখাল ছেলে"টা হয়ে যাক।
বল্লীর বিলের আদিগন্ত জলে উপুড় আকাশে তাকিয়ে সে গাইল এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলো...।আর একটা ঝিনুক। আচ্ছা বেশ। গুনগুন করে সুরটা একটু ভেঁজে নিয়ে সে ধরল ভেঙে এলাম খেলার বাঁশি...চুকিয়ে দিলাম কান্না হাসি... বেলা গেল তোমার পথ চেয়ে...। গান শেষে ধ্রুবদা উঠে এসে তার সামনে দাঁড়ায়।নীল টিপে তর্জনী ছুঁয়ে দিলে কেঁপে ওঠে সে।
বলে আমি চলে যাচ্ছি স্রোতস্বিনী। কোথায় যাচ্ছেন? খুবই অবাক হল সে ধ্রুবদা যে কোথাও যেতে পারে একথা কখনও তো তার মনেও আসেনি।রেলে একটা চাকরি পেয়ে গেছি যে।ভোপালে পোস্টিং। আপাতত এটাই করি।আর একটা কথা... কী? ঝিনুক উৎকর্ণ হয়ে ওঠে। আমি মানে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
খুব তীক্ষ্ণ একটা শূন্য যেন বিঁধে গেল আমূল। বিদ্যুতের মতো এক ঝলকে সে দেখতে পেল ফাঁক এক রাস্তা অচেনা কোন এক দিকে চলে গেছে যেন।ঝিনির অন্তত তাই মনে হলো। শোনো ঝিনুক, ছোট আছ তো তুমি। তোমাদের বাগানে যত গাছপালা তার ফুল আমি ছিঁড়িনি কখনও।
দূর থেকে শুধু ফুটে উঠতে দেখেছি। তুমি হয়তো ভেবেছ বারবার তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি, বারবার সে ফিরে যাবে... বারবার সে ফিরে আসবেও। হয়তো সেটাই সত্যি। অমনি করেই হয় কিনা আমি নিজেও জানি না ঠিক।ভেবে দেখেছি দূরে না গেলে আমৃত্যু খালি ছুটতেই হবে। আসলে দিতে তো সবাই পারে শুধু নেওয়ার মতো দুটো হাত কোথায় থাকে তাইই খুঁজতে হয় সবাইকে। মানে? এ কথার মানে বুঝতে ঝিনুককে আর একটুখানি বড় হতে হবে যে।
ভালো থেকো স্রোতস্বিনী।বড় হও কিন্তু এরকমই স্বচ্ছ থেকো।ওটাই তোমার অন্তরের মানে। এই যে এত নীল এত জল, ঘাসের ওপর জেগে ওঠা এই রোদ এসবের মতোই সহজ কিছু হয়ে থেকে যেও আমার ভেতরে। আমিও রেখে দেব তা যেমন করে ঝিনুকের ডানা ঢেকে রাখে মুক্তর দানা।
তুমি যখন গাইবে বা পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে বইখাতায় মাথা রেখে চোখ বুজবে, আমি অনেক দূর থেকেও দেখতে পাব এতদিন যেমন দেখেছি।এঘর থেকে ওঘরে যেতে হয়তো হাত থেকে কিছু পড়ে যাবে, দূর থেকে শুনতে পাব যেন তোমার নুপুরের শব্দ.. এতদিন যেমন শুনেছি।
মানে?সব মানে একদিনে বোঝা যায় না ঝিনুক। কিছু কিছু মানে অবশ্য বদলেও যায়।তাই হয়ত সে সব মানে আমাদের সারাজীবন ধরে সব্বাইকে খুঁজে খুঁজে নিতে হয়।
কপালের টিপ থেকে আলতো আঙুল নেমে এল তার চোখে গালে তারপর ঠোঁটে।আর অন্য ঠোঁট দুটো বলল "একটি নিমেষ দাঁড়ালো সরণী জুড়ে/থামিলো কালের চিরচঞ্চল গতি" তর্জনী সরে গেল, চলে গেল, মিশে গেল আর সকলের সঙ্গে।
ফাঁকা এক নি নি করা আকাশের তলায় ভালবাসার মতো শান্ত বট মাটির নিভৃতে যেখানে অজস্র শেকড় নামিয়েছে, সেইখানে বোবা হয়ে বসে থাকে ঝিনি।
আর বাড়ি ফিরে সে রাতে মা ঘুমোলে গীতবিতানের নিচে লুকিয়ে রাখা জানলা পত্রিকাটা বের করে সে পড়ে আরও একবার। পড়ে "সমস্ত সৌন্দর্য্য অলৌকিক হ্রদের মতো/গ্ৰাস করেছিল মৃদু ফুল... নিঃশ্বাসে মেধার গন্ধ... ...দিনে দূরে ঠেলে দিনান্তে কাছে টেনে নেয়/জলে ডোবা কিশোরী আঙুল.../সে আমাকে গোধূলি চেনায়...।
0 Comments