জ্বলদর্চি

সনাতন রায় (স্বাধীনতা সংগ্রামী, ঘাটাল)/ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৪২
সনাতন রায় (স্বাধীনতা সংগ্রামী, ঘাটাল) 

ভাস্করব্রত পতি

১৯৩১ এর ৭ ই এপ্রিল পেডীকে হত্যা করেন বিমল দাশগুপ্ত। নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি খাটিয়ে তাঁকে মুক্ত করেন রাজা দেবেন্দ্রলাল খান। পরবর্তী ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস হত্যার পর সরকারি নির্দেশে পুলিশের চৌকি বসানোর জন্য দেবেন্দ্রলাল খানের বসতবাটি খালি করে দিতে হয়। এরপর বার্জ হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকায় ধরা পড়লেন -- কামাখ্যা ঘোষ, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ রায়, নির্মলজীবন ঘোষ, সনাতন রায়, নন্দদুলাল সিংহ, সুকুমার সেনগুপ্ত, শৈলেনচন্দ্র ঘোষ, বিনয়কৃষ্ণ ঘোষ, পূর্ণানন্দ সান্যাল, ফনীন্দ্রনাথ চৌধুরী, সরোজরঞ্জন দাস কানুনগো এবং শান্তিগোপাল সেন।

১৯৩৪ এর ১০ ই ফেব্রুয়ারি সোশ্যাল ট্রাইব্যুনালের রায় বোরোলো। তাতে রামকৃষ্ণ রায়, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী এবং নির্মলজীবন ঘোষের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয় সুকুমার সেনগুপ্ত, সনাতন রায়, নন্দদুলাল সিংহ এবং কামাখ্যা ঘোষের। বাকিরা বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। ১৯৩৪ এর ৩০ শে আগস্ট বার্জ হত্যার রায় বের হল হাইকোর্টে। তাতে ট্রাইব্যুনালের রায়ই সম্পূর্ণ রূপে বজায় রাখা হল। আসলে দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামীদের পক্ষে হাইকোর্টে আপিল রুজু করা হয়। খ্যাতনামা ব্যারিস্টার এইচ ডি বসু, ব্যারিস্টার বরেণ বসু এবং তাঁর সহযোগী অ্যাডভোকেট শরৎচন্দ্র জানা, ব্যারিস্টার নিশীথচন্দ্র সেন, এন কে বসু, সন্তোষকুমার বসু প্রমুখ আইনজীবিগন বিভিন্ন আসামীর পক্ষে সমর্থন করেন। তাঁরা প্রায় বিনা পারিশ্রমিকে দীর্ঘ ১১ দিন ধরে মামলা লড়েছিলেন। এই মামলার যাবতীয় অর্থব্যয় করেছিলেন নাড়াজোলের রাজা দেবেন্দ্রলাল খান। 

বিপ্লবী সনাতন রায় ছিলেন মেদিনীপুরের বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী কিশোরীপতি রায়ের পুত্র। জন্মগ্রহণ করেন জাড়াতে। মেদিনীপুর কলেজে পড়ার সময়েই স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন। এরফলে বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনা। 

জাড়ার রায় পরিবারের সঙ্গে স্বাধীনতা আন্দোলনের বহু নেতার গভীর সংস্পর্শ ছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের আঁতুড়ঘর ছিল সনাতন রায়দের পরিবার। স্বাধীনতা সংগ্রামী কিশোরীপতি রায়, সাতকড়িপতি রায়, সনাতন রায় এই পরিবারের বীর সন্তান। শোনা যায় এই পরিবারে রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগরের নিত্য যাতায়াত ছিল। একসময় এই রায় পরিবারের সঙ্গে কলকাতার ঠাকুর পরিবারের তুলনা করা হত। 

অনুশীলন সমিতির পাশাপাশি ১৯২৮ এ মেদিনীপুর শহরে বেঙ্গল ভল্যান্টিয়ারের শাখা খোলা হয়। নির্মলজীবন ঘোষের অনুপ্রেরণায় তিনি বেঙ্গল ভল্যান্টিয়ারের দলে যোগ দেন। বেঙ্গল ভল্যান্টিয়ারের সদস্যরাই ১৯৩১, ১৯৩২ এবং ১৯৩৩ সালে জেমস পেডি, ডগলাস এবং বার্জ -- এই তিনজন জেলাশাসককে হত্যা করে।

পেডী ও ডগলাস হত্যার পরের বছর ১৯৩৩ এর ২ রা সেপ্টেম্বর ফের মেদিনীপুরের জেলাশাসক বার্জ হত্যার ঘটনা ঘটে মেদিনীপুর শহরে। তখন নতুন জেলাশাসক কিশোরীপতি রায়কে জেলা থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেন। তিনি তখন হাওড়ায় গিয়ে ওকালতি চালিয়ে দিন গুজরান করতে শুরু করেন। বার্জ হত্যার মামলায় ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৩৩-এ গ্রেপ্তার হন তাঁর ছেলে সনাতন রায়। বিচারে আন্দামান সেলুলার জেলে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দেওয়া হয়। ১৯৩৯ সালের ১৪ ই এপ্রিল আরও অনেকের সঙ্গে তাঁকেও মুক্তি দেওয়া হয়। 

মেদিনীপুর বোমা মামলার আসামী হেমচন্দ্র কানুনগো, বারীন্দ্রনাথ ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়দের দীপান্তর বাস থেকে মুক্ত করার কাজে ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন দাশ এবং সহযোগী সাতকড়িপতি রায় সফল হন। উল্লেখ্য, তাঁর দাদা কিশোরীপতি রায় ছিলেন জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক এবং ভ্রাতুষ্পুত্র সনাতন রায় জেলাশাসক বার্জ হত্যা মামলায় দীপান্তর দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। ১৯২১ সালে বাংলার প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি গঠিত হয়। তাঁর সভাপতি ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। সহ সম্পাদক হন সাতকড়িপতি রায়। ১৯২৩ সালে চিত্তরঞ্জনের নির্দেশে বড়বাজার কেন্দ্র থেকে স্বরাজ্য দলের প্রতিনিধি হয়ে চিত্তরঞ্জনের ভাই অ্যাডভোকেট জেনারেল সতীশরঞ্জন দাশকে ১২০০ ভোটে পরাজিত করেন। বিপ্লবী সনাতন রায় স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে পেয়েছেন তাম্রফলক ও পেনশান।

🍂

Post a Comment

0 Comments