উগাণ্ডা (আফ্রিকা)
সারস পাখির গান
চিন্ময় দাশ
চিত্র- অর্ণব মিত্র
ছোট্ট একটা নদী বয়ে গিয়েছে পাশ দিয়ে। তা থেকে বড়সড় একটা জলাভূমি গড়ে উঠেছে নদীর গায়ে। বক, মাছরাঙা আর সারসদের মেলা বসে যায় সেই জলায়।
এক সারস থাকে সেখানে। বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে তার বহুকালের বাস। চোখে পড়বার মত চেহারা তাদের। লম্বা আর ছিপছিপে শরীর। গলাখানার ভারি বাহার। ইয়া লম্বা গলাটি কী মনোরম! আর তাদের ঠোঁট জোড়া? যেমন সরু, তেমনি লম্বা। সারসদের পুরো পরিবারটাই ভারি দয়ালু।
জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে যখন, মুখে রা-টি নাই। এমনকি হাসিটিও না। ঘন্টার পর ঘন্টা স্থির দাঁড়িয়ে থাকবে। সামনে দিয়ে মাছ ব্যাঙ কিছু একটা পার হয়ে যেতে দেখলেই, অমনি ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে, গলায় চালান করে দেয়।
নদীর মাছেরা উঠে আসে জলাটায়। মাছ ধরবার জন্য একটা মাচা বানিয়ে রেখেছে গাঁয়ের লোকজন। মাচায় বসে ছিপ ফেলে মাছ ধরে তারা।
একদিন হয়েছে কী, বুড়ো সারস দাঁড়িয়ে আছে মাচাটার কাছাকাছি। একটু দূরে দূরে অন্য সারসগুলি। বড়সড় একটা সোনা ব্যাঙ সেখানে এসে হাজির। ঠিক তখনই সরসর করে এক সাপের উদয়। একেবারে ব্যাঙটার সামনে এসে গেছে সাপটা।
ব্যাঙের তো ভয়ে বুক ধড়ফড় করতে লাগল। কার মুখ দেখে যে বেরিয়েছিলা। একেবারে সাক্ষাৎ যমের সামনে। আজ আর ফেরা হল না প্রাণ নিয়ে।
সাপ জিজ্ঞেস করল—কিরে, হতভাগা! কোথায় চললি?
মনে ভয় পেলেও, মুখে সে ভাব দেখানো চলবে না। ব্যাঙ সাহস করে, সাপকে জবাব দিল—আমার মামাতো পিসতুতো ভাইয়েরা সব শহরে থাকে। তাদের সাথে দেখা করতে গেছলাম। এখন ঘরে ফিরছি। এই জলাটার ওপারেই তো আমার ডেরা।
--শহর থেকে এলি? সাপ বলল—বাহ, এ তো দারুণ কথা। তা, শহরের খবর-টবর কী শুনি?
ব্যাঙ দেখল এই মওকা। চটপট বলে উঠল—শহরে একটা নতুন আইন হয়েছে শুনে এলাম।
সাপ জানতে চাইল—তাই না কি? আইনটা কী, শুনি।
ব্যাঙ বলল—যে কেউ তার পাড়া-পড়শিকে পথেঘাটে হয়রান করবে, তাকে মেরে ফেলা হবে।
সাপ মুচকি হেসে বলল—তাই না কি? তা মারবেটা কে তাকে? সেটা শুনে আসিসনি?
--শুনব না কেন? পথে-ঘাটে পাড়ায়-পাড়ায় সবাই বলাবলি করছে যে। সেপাইরা সব আছে না রাজার। তারাই মারবে।
--খুব ভালো কথা। তাহলে ডাক তাদের। আসুক তারা। বলেই বিরাট হাঁ করে, সাপ ব্যাঙটাকে খেতে গেল।
পাশেই দাঁড়িয়েছিল বুড়ো সারস। চুপচাপ সব দেখছিল আর শুনছিল সে। ব্যাঙকে ধরবার আগেই, লম্বা গলা বাড়িয়ে, কপ করে সাপকে ধরে ফেলল সারস।
ঠোঁটে কামড়ে সাপটাকে বাতাসে পাক খাওয়াতে লাগল সারস। দেখে ব্যাঙ চেঁচিয়ে উঠল—এই তো এসে গেছে রাজার সেপাই। কে কোথায় যে রাজার লোক, সে তো আর আমরা জানি না। এবার বোঝ। বলেছিলাম না, পড়শিকে হয়রানি করলেই মৃত্যুদণ্ড। হুঁ হুঁ, বাবা। রাজার আইন বলে কথা। অন্যায় করে রেহাই পেয়ে যাবে, সেটি হবে না।
সারস এবার পেটে চালা্ন করে দিল সাপটাকে। তা দেখে, ধড়ে প্রাণ ফিরে এলো ব্যাঙের। অনেক বার করে ধন্যবাদ দিতে লাগল সারসকে।
একেবারে মরণের মুখ থেকে ফিরে এসেছে। মনে বেশ পুলক ব্যাঙের। রইল তার ঘরে ফেরা। সারসের সাথে খোশগল্প জুড়ে দিল। শহরে এই শুনেছে। শহরে ওই শুনেছে। এই সব নানান কথা, নানা কাহিনী।
একজন বলছে, একজন শুনছে। গল্প আর শেষ হয় না। এমন সময় একটা ঈগল উড়ে যাচ্ছে মাথার উপর দিয়ে। মোটাসোটা একটা ডাল বয়ে নিয়ে যাচ্ছে পাখিটা।
হোল কী, মাচাটার উপর দিয়ে যাচ্ছে যখন, ডালটা খসে পড়ল ঈগলের মুখ থেকে। সারসের চোখ দুটো তো জলের দিকেই। গলা বেঁকিয়ে জলেই তার চোখজোড়া। সে দেখতে পেল না ব্যাপারটা।
এদিকে ব্যাঙের চোখ তো থাকে ওপর দিকে। সে দেখতে পেয়ে গেল, মোটাসোটা একটা ডাল নেমে আসছে দুজনের মাথার উপর। ঘাড়ে পড়লে আর রেহাই নাই। অক্কা পেয়ে যেতে হবে।
সারসকে কিছু না বলেই, টুক করে জলে ডুব দিয়ে দিল ব্যাঙ। ডালটা এসে পড়ল সারসের মাথায়। ঘাড়-মাথা ভেঙে, মরেই গেল বেচারা।
ব্যাপার দেখে, আশপাশের সারসগুলো দৌড়ে এলো যখন, তাদের বাবা আর বেঁচে নাই। সেসময়েই আবার ব্যাঙ ভেসে উঠেছে। চোখ তুলে দেখল, সারসের প্রাণহীন দেহটা ভাসছে জলের উপর। ব্যাঙ হায়-হায় করে উঠল দেখে।
🍂
অমনি সারসগুলো রে-রে করে তেড়ে এল তার দিকে—তবে রে, নেমকহারাম! সামান্য কৃতজ্ঞতাও নাই তোর? এই একটু আগে, আমাদের বাবাই প্রাণ বাঁচাল তোর। তা নইলে, এখন তো তোর সাপের পেটে থাকবার কথা। আর তুই কি না, মাথার উপর অতবড় বিপদ দেখেও, একবার বললি না বাবাকে? নিজেই চুপচাপ সরে পড়লি? আজ তোর একদিন কি, আমাদের একদিন।
ব্যাঙ গেল বেজায় ঘাবড়ে। পাঁচ-সাতটা সারস তেড়ে আসছে তার দিকে। ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে সবাই মিলে। ভাবনা চিন্তার সময় নাই আর। ঝুপ করে এক ডুব। ডুব সাঁতারে যতটা পারল সরে পড়ল বেচারা। আর এ পাড়ায় নয়। সোজা নিজের ডেরা দিকে সাঁতরাতে লাগল ব্যাঙটা।
সারসগুলো চেঁচাতে লাগল—কোথায় পালাবি, বেয়াক্কেলে? কত দূরে পালাবি? আজ না হয় বেঁচে গেলি। কিন্তু যেদিন যেখানে দেখবো, গিলে খাব তোকে।
সারসের বউ খুব কাঁদছে, সে বিড়বিড় করে বলল—শুধু তোকে নয়। তোর ছেলেপুলে, নাতিপুতি সবাইকে খাবো এবার থেকে। পাড়াপড়শি বলে আর বেয়াত করব না কোন দিন।
সবাই মিলে সারসের মরা শরীরটাকে নিয়ে গেল পাড়ের দিকে। একটা প্যাপিরাস গাছের শিকড়ের ফাঁকে সমাধি দেওয়া হোল দেহটা।
পরে, সেই গাছটার তলায় একটা শালুক জন্মেছিল। গোলাপি রঙের ফুল ফুটতে শালুকটাতে। পরোপকারী সারসকে শালুক ফুলের সম্মান দিয়েছিলেন বিধাতা। আফ্রিকা দেশ জুড়ে, মানুষজন বিশ্বাস করে, গোলাপী শালুক আর কেউ নয়। সেই বুড়ো সারসকেই শালুক করে গড়েছেন বিধাতা। অন্যের বিপদে এগিয়ে এসেছিল সারস, এটা তারই পুরষ্কার।
দিন নেই রাত নেই, ব্যাঙেদের ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙর ডাকে কান ঝালাপালা হয়। কিন্তু সারসেরা শান্ত সুবোধ। গলায় রা-টি নাই তাদের। তবে, কেউ কোনদিন যদি সেই পাপিরাস গাছটার তলায় গিয়ে দাঁড়ায়, একটা গুনগুন সুর হয়ত কানে যেতে পারে ঃ
THE SONG OF THE GREY HERON
(SEKANYOLYA)
MARSH flowers are my curtain,
Soft rushes my bed, The green feathered papyrus
Waves over my head.
Dark grey are the shadows,
Dark brown is the pool,
The soft moonlight above me
Shines silver and cool.
The night wind croons while I slumber,
The ripples rock me to sleep,
The most beautiful place in this beautiful world
Is my home in the marshes deep.
প্যাপিরাসের শীতল ছায়া শয্যা গড়ি শ্যাওলা নরম
গভীর জলায় বসত করি জীবন জুড়ে সুখ তো পরম।
রাতের বেলায় শীতল বায়ু বাঁকা চাঁদের মিষ্টি আলো
দিন কেটে যায় বেজায় ভালো।
কে গায় সেই গান? সেই বুড়ো সারস? না কি, অন্য কেউ, সে রহস্যের কিনারা হয়নি আজও।
0 Comments