জ্বলদর্চি

ও আমার চন্দ্রমল্লিকা বুঝি চন্দ্র দেখেছে/মিলি ঘোষ

 ও আমার চন্দ্রমল্লিকা বুঝি চন্দ্র দেখেছে

মিলি ঘোষ   


নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখলেন, 

   কী শীত কী শীত দাদা
   কী শীত কী শীত,
   দিবস যদি বা কাটে 
   কাটে না নিশীথ।

কিন্তু কিছু মানুষ থাকেন, যাঁদের নিশীথে যাইও না ফুলবনে বলিলেও শুনিবেন না। ফুলবন যে তাঁদের কর্মক্ষেত্র। অবশ্য সেটা একদিন। যেদিন তাঁদের ব্যাংক একাউন্ট শারীরিক জড়তা কাটিয়ে শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন লাগল নাচন গাইতেও দ্বিধা করে না। ফুলবন শুধু সেই দিন । সে আমলকি বন থাক আর না থাক। বাকি ২৯ দিন নিজেরাই নিজেদের জিজ্ঞাসা করেন, "উট কি কাঁটা বাছিয়া খায়?" 

প্রায়ান্ধকার ভোরে এমন অনেক মানুষের পদধ্বনি আমি বহু বছর ধরে শুনে আসছি বালাপোষের ভেতর থেকে। চোখ না খুলেই তাঁদের জানাই সংগ্রামী অভিনন্দন। এই অভিনন্দন তাঁদের কান পর্যন্ত পৌঁছয় না। হৃদয় স্পর্শ করা তো দূরের কথা। কারণ আমরা তখন শীতের আমেজ নিতে ব্যস্ত। একবার করে ঘড়ির দিকে তাকানো আর গায়ের বস্তুটি টেনে মুড়ি দিয়ে ঘুমোনোর স্বাদ নিয়ে চলেছি। পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেলেই আমি তখন ঠিক আমি, অনুভূতিহীন, স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক অবিকল মানুষের মতো দেখতে এক আশ্চর্য জীব।

খোলা আকাশের নিচে যাদের জীবন কাটে, তাদের শীতকালীন অবস্থা টেনে এনে পরিবেশ ভারী করতে চাই না। আর্থিক, সামাজিক ও মানসিক ফারাক যতদিন না দূর হবে আমি আপনি চেষ্টা করেও কিছু করতে পারব না। যা পারব তা সাময়িক এবং প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। তা ছাড়া এক শ্রেণীর মানুষ কোনওদিন চাইবে না এই ফারাক দূর হোক। সবাই যদি বাড়ি গাড়ি হোটেল রিসর্টের মালিক হয়, বাড়ি বানাবে কে? খুব সামান্য অর্থের বিনিময়ে ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেবে কে? তাই অসাম্য থাকবেই। 

"বাড়ি কেমন?" 
"শুয়ে চাঁদ বসে চাঁদ।" 

এটাও কাম্য। শীতের ফুটপাথে ছেঁড়া কাঁথা গায় শুয়ে চাঁদ দেখা মানুষগুলোর সঙ্গে অশিক্ষার যে একটা সম্পর্ক আছে, বলাই বাহুল্য। আর ঠিক সেটাই তো দরকার। কারণ, শিক্ষা প্রশ্ন করতে শেখায়। কাজেই কে ভোরের কাঁপুনি সহ্য করছে শীতবস্ত্র ছাড়া আর কার ওয়ার্ডরোবের দরজা খুলে দেশী বিদেশি শীতের পোশাক ঝাঁপিয়ে পড়ে মেঝেতে আমাদের দেখার দরকার নেই। তারচেয়ে 'এই তো বেশ আছি'র জীবন আমাদের অনেক বেশি মানসিক শান্তি দেয়। 

🍂

শীতকালের সাথে খাদ্যের একটা অবিচ্ছ্যেদ্য সম্পর্ক আছে, কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যা প্রায় অপরিবর্তনীয়। যে বার্গার বা কেক খায়, সে কিন্তু নলেন গুড়ের পিঠে, পায়েস, মিষ্টি কিছুই বাদ দেয় না। নব আনন্দে জাগার সঙ্গে পুরানো সেই দিনের কথাও সে ভুলতে নারাজ। প্রজন্মের পর প্রজন্মকে এক সূত্রে গেঁথে রাখার অনেকটাই কৃতিত্ব এই শীতকালীন খাদ্যবস্তুর। 

কথাটা মানবেন না বেশিরভাগ লোক। তবু বলছি। ছোটবেলাতে ফিরে যেতে আমার মন চায় না, কারণ এক পা এক পা করে আমাকে আবার বড়বেলাতেই ফিরে আসতে হবে। আমার যেদিন ভেসে গেছে চোখের জলে  তাকে আমি আর ফিরিয়ে আনতে চাই না। একবারও পিছন ঘুরে দেখতে চাই না, কতটা সিঁড়ি ফেলে এসেছি। 'ফেলে এসেছি' শব্দ দুটোই ঠিকঠাক মনে হলো। থামতে বললেই থেমে যাব। কিন্তু নামতে নারাজ। যমরাজ এসে বেল বাজালে হয়তো বলবো বিকেলে আসুন, কাজ শেষ হয়নি। কিন্তু লালমহোনবাবুর  মতো 'এক মিনিট' বলে সরবতে চুমুক দিতে পারব না।   তবু ছোটবেলার শীতে সেই উন্মাদের মতো খেলার দিনগুলোর কথা ভুলতে পারি না। শীতের প্রধান আকর্ষণ ছিল খেলা। মাঠ পাইনি, রাস্তায় খেলেছি। দেওয়ালে পিঠ ঘষে গেছে, তবু খেলা বন্ধ হয়নি। জীবনের আর এক নামই ছিল খেলা। যে স্বাদ থেকে বঞ্চিত আজকের প্রজন্ম। কারণটা শুধু মাঠের অভাব নয়, আমাদের মানসিকতাও অনেকটাই দায়ী। 

শীতের পার্কস্ট্রিট আমাকে কোনোদিনও টানেনি। তার চেয়ে বেঁচে থাক আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব বইমেলা। কিন্তু বইমেলা এলে অনিমেষ মাধবীলতার স্রষ্টার জন্য মন বড় ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে। সমাজের এই উত্তাল সময়ে  মনে পড়ে, বিপ্লবের আর এক নাম মাধবীলতা। 

সমরেশবাবু, খুব প্রয়োজন ছিল এখনই চলে যাবার? আমি দ্বিধা করছি দেখে নিজে থেকে ডেকে কথা বললেন। কত কথা বলার ছিল। কিছুই বলতে পারলাম না। তিনি বলে গেলেন, আমি শুধু ঢেউ গুণে গেলাম। গত বছর থেকে বইমেলা সমরেশহীন। 

একবার বিশেষ কাজে শান্তিনিকেতন গেছিলাম। রাজকোষে তখন রাজার মুকুট ছিল, আসলটাই। দিনে শান্তিনিকেতন ঘুরে দেখা আর রাতে কনকনে ঠান্ডার মধ্যে ক্যাম্প ফায়ারে আমাদের অনুষ্ঠান, সঙ্গীত ও নৃত্য জগতের মহান মহিয়সীদের উপস্থিতিতে। ভোরে উঠে বেরোতে হতো। পিছনের জানলা খুললে দেখতাম ওই কাক ভোরে সাঁওতালরা তাঁদের ছবির মতো বাড়ি ঘর ঝকঝকে পরিষ্কার করে নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। দেখে আপনেই মাথা নত হতো। না পাওয়ার সুখে গরবিনী আমি শান্তিনিকেতনের সেই দিনগুলোকে ভুলতে পারিনি, ভুলতে চাইনি।

তবু পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনার মতো শীতকাল আমাদের সারা বছরের অপেক্ষা। মনের প্রতিটি শিরা উপশিরায় দোল দিয়ে যায় শীত। শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনির উদাসী বিকেল হাতছানি দেয় সন্ধ্যা নামার আগে। কান পাতলে শোনা যায় ঝরা পাতাদের গান। শীতের ভূমিকা বসন্তের আগমন বার্তা বয়ে আনা নয়, শীত স্বমহিমায় বিরাজিত। তবে শীত বড়ো অভিমানী অথবা সাবধানী। 

কবির ভাষায়, 
     কে মোরে ফিরাবে অনাদরে 
   কে মোরে ডাকিবে কাছে 
  কাহার প্রেমের বেদনায়
আমার মূল্য আছে ...
    
 কিন্তু আমরা তাকে সাদরেই আমন্ত্রণ জানাতে চাই। ছায়া ছায়া রোদ্দুরে গা ভাসানোর অপেক্ষায় থাকি সারা বছর। ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিই বাগান। কিন্তু শীত ক্ষণিকের অতিথি। পরিপূর্ণ ভালোবাসায় সে বিশ্বাসী নয়। 

তাই মনের দুঃখ মনে রেখেই বলি,
  .. হৃদয়ে হৃদয়ে আধো পরিচয়,
  আধখানি কথা সাঙ্গ নাহি হয়,  
লাজে ভয়ে ত্রাসে আধো বিশ্বাসে।
    শুধু আধখানি ভালোবাসা।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments