জ্বলদর্চি

মঙ্গলকাব্যের উৎস সন্ধানে /রাজীব শ্রাবণ

মঙ্গলকাব্যের উৎস সন্ধানে 

রাজীব শ্রাবণ 

এখনও পর্যন্ত সব সাহিত্য সমালোচকই বাংলা কাব্যসাহিত্যের ইতিহাসে মঙ্গলকাব্যসমূহকে এক পরমাশ্চর্য সংযোজনা বলে চিহ্নিত করেছেন। তাঁদের মতে আদিম বাংলাকাব্যের অন্ধকারাচ্ছন্ন বন্ধুর গলিপথে মঙ্গলসাহিত্যের কাব্যদ্যুতি প্রতিফলিত হয়ে সেই গলির কালিমাকে বহুদূর পর্যন্ত ঝলকিত করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, গলির গণ্ডীকে ভেঙে বাংলাকাব্যের অযুত সম্ভাবনাকে বিপুল বর্ণচ্ছটায় দিগন্ত বিস্তারি করে দিয়েছে। কিন্তু এই মঙ্গলকাব্যের সাথে ‘মঙ্গল’ নামটি যুক্ত থাকবার ফলে সাধারণের মনে এই প্রশ্ন জাগা অত্যন্ত স্বাভাবিক যে, সুদূর অতীতে এই নামকরণের পিছনে কোন প্রচ্ছন্ন ঐতিহাসিক ইঙ্গিত ছিল কিনা। এবিষয়ে অতীতে বাংলা মঙ্গলকাব্যের ঐতিহাসিক আশুতোষ ভট্টাচার্য রাগ-রাগিণীর দিক থেকে আলোচনা করে মঙ্গলকাব্যের সাথে ‘মঙ্গল’ শব্দটির যে ঘনিষ্ট সংযোগ রয়েছে, সেকথা বলতে গিয়ে জানিয়েছিলেন—
“দেখিতে পাওয়া যায় যে, প্রাচীন ভারতীয় সংগীতের রাগ-রাগিণীর মধ্যে ‘মঙ্গল রাগ’ অন্যতম। ... প্রাচীন ও মধ্যযুগের পদ্য-সাহিত্য মাত্রই গানের উদ্দেশ্যে রচিত হইয়াছিল, মঙ্গল সাহিত্যও ইহার ব্যতিক্রম ছিল না। এই জন্যই মনে হইতে পারে, আদ্যোপান্ত মঙ্গলরাগে কিংবা প্রধানতঃ মঙ্গলরাগে যাহা গীত হইত, তাহাই সাধারণভাবে মঙ্গলগান বলিয়া অভিহিত হইত।”
একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাওয়া যায় যে, আশুতোষ ভট্টাচার্য তাঁর উপরোক্ত মন্তব্যের মধ্যে নিশ্চিতভাবে ও নিঃসংশয় হয়ে এবিষয়ে কিছু বলতে পারেননি, তাঁর বক্তব্যের মধ্যে ‘সম্ভাবতঃ’–এর রেশ মিশ্রিত থেকে গিয়েছিল। কারণ, এবিষয়ে একটা স্থির-নিশ্চয় ভিত্তিভূমির উপরে দণ্ডায়মান হয়ে থেকেও এধরণের মন্তব্য ঘোষণার পিছনে যে দুর্বলতা ছিল, সেবিষয়ে আশুতোষ ভট্টাচার্য নিজেও পূর্ণমাত্রায় অভিহিত ছিলেন। সুদূর অতীতের বাংলায় মঙ্গলকাব্য শুধুমাত্র মঙ্গলসুরেই গীত হত না, এর মাঝে প্রচুর পরিমাণে পাঁচালীর সুরও মিশে থাকত। কিন্তু—
“ক্রমে পাঁচালীর উপর মঙ্গলরাগের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বশতঃই সম্ভবতঃ ইহা মঙ্গল নামে পরিচিত হইতে থাকে।”
এরপরে ‘মঙ্গল’ নামের উৎপত্তি সম্পর্কে নিজের বিচারসহ মন্তব্য করতে গিয়ে আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছিলেন—
“কোনও অপ্রিয় বিষয় বা নামকে অনেক সময় সম্পূর্ণ বিপরীতার্থক শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এই প্রবৃত্তিকে ইংরেজিতে euphemism বলে। মঙ্গলকাব্যের দেবতার চরিত্র মাত্রই অমঙ্গলকারী (malignant)। অতএব ইহাদের অমঙ্গলকারিণী শক্তিকে প্রশমিত (pacify) করিবার কিংবা মনোমধ্যে ইহার বিষয় স্থান না দিবার প্রবৃত্তি হইতেও তাঁহাদিগকে মাহাত্ম্যসূচক গীতিতে মঙ্গলগান বলিয়া উল্লেখ করা হইতে পারে। বসন্ত রোগের নিদারুণ অন্তর্দাহের জালার মধ্যেও মানসিক শান্তি লাভ করিবার জন্য এই রোগের অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে এই কারণেই ‘শীতলা’ বলিয়া উল্লেখ করা হয়। কালক্রমে সকল শ্রেণীর দেবতার মাহাত্ম্যকীর্তনই মঙ্গল নামে পরিচয় লাভ করে।”
অন্যদিকে ‘মঙ্গল’ নামের উৎপত্তি সম্পর্কে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘চণ্ডীমঙ্গল-বোধিনী’ গ্রন্থে বলেছিলেন—
“যে গানে মঙ্গলকারী দেবতার মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়, যে গান মঙ্গল সুরে গাওয়া হয়, যে গান যাত্রা বা মেলায় গাওয়া হয় (হিন্দীতে মঙ্গল শব্দের অর্থ মেলা, যাত্রা বা গমন) তাকেই মঙ্গলকাব্য বলা হ’য়ে থাকে।”
পরবর্তী সময়ে তাঁর এই মন্তব্যের উপরে ভিত্তি করেই সাহিত্য সমালোচক ভূদেব চৌধুরী জানিয়েছিলেন—
“মঙ্গল কাব্যসমূহের আভ্যন্তরিক প্রমাণ অনুসরণ করে বলা চলে, যে দেবতার আরাধনা, মাহাত্ম্য-কীর্তন এমন কি, শ্রবনেও মঙ্গল হয়, এবং বিপরীতটিতে অমঙ্গল হয়, যে কাব্য মঙ্গলাধার,—এমন কি, যে কাব্য ঘরে রাখলেও মঙ্গল হয়, তাই মঙ্গল কাব্য।”
অনেকের মতে মঙ্গলকাব্য বিষয়ে মানুষের এই অন্ধবিশ্বাস প্রাচীনকালের ধর্মান্ধতার সুযোগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
তবে বাংলার ইতিহাসের ঠিক কোন শুভলগ্নে মঙ্গলকাব্যের প্রথম উন্মেষ ঘটেছিল, সেকথা এখন আর নিশ্চিত করে বলা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। কিন্তু খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকেই এধরণের কাব্য যে একটি বিশেষ রূপ পরিগ্রহ করে গণমানসের হৃদয়ানন্দের উৎসভূমি হয়ে উঠেছিল, এবিষয়ে গবেষকরা অনেকেই একমত বুলে দেখতে পাওয়া যায়। ইতিহাস বলে যে, বহু আগে থেকেই এই লৌকিক দেব-দেবীদের মহিমা পাঁচালীর আকারে—অপূর্ণ কাব্যে এবং অপূর্ণ ভাষায় লেখা হলেও, মূলতঃ খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর ‘যুগ-প্লাবী প্রয়োজন-প্রভাবে’ এই অপূর্ণ পাঁচালী গাথাই সুসম্পূর্ণ মঙ্গলকাব্যের রূপ পরিগ্রহ করে অনন্যসুন্দর দীপ্তিতে ভাস্বর হয়ে উঠেছিল। সেই পাঁচালী থেকে মঙ্গলকাব্যে রূপান্তরের পিছনে প্রধানতঃ দুটি কারণ তীব্র বেগ সঞ্চার করেছিল বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করে থাকেন। সেগুলোর মধ্যে প্রথম এবং প্রধান কারণ ছিল, তৎকালীন সময়ের বাংলার রাজনৈতিক বিপর্যয়। তখন দীর্ঘদিন ধরে অনায়াস-লভ্য সুখ-সম্ভোগে মত্ত থেকে আপামর বাঙালির শক্তিমত্ততায় ঘুণ ধরে গিয়েছিল, এবং তাঁরা পঙ্গু ও ক্লীব হয়ে পড়েছিলেন। তাছাড়া ওই সময়েই অভিজাত এবং অনভিজাত বাঙালির মধ্যে এক দুরতিক্রমী ধ্বংসোদ্দীপক ব্যবধান রচিত হওয়ায় বাঙালির জমাট শক্তির ধ্বংস সাধনের পথ অধিকতর প্রশস্ত হয়ে গিয়েছিল। এরপরে পলায়নী মনোবৃত্তিতে এবং নৈতিক ব্যাভিচারে ক্ষীয়মান বাঙালির ধ্বংসমুখীনতার ওপরে তুর্কী আক্রমণের প্রচণ্ড আঘাত নেমে এসেছিল। সেযুগের দুর্বল বাঙালির পক্ষে বীর্যবান তুর্কীদের সেই সুতীব্র আক্রমণ রোধ করা কোনক্রমেই সম্ভব হয়নি। সুতরাং সেই ধ্বংস-যজ্ঞকে তখনকার নিবীর্য বাঙালি মাথা পেতে গ্রহণ করে নিয়েছিল এবং রাজনৈতিক জীবন থেকে বাঙালির নির্বাসন ঘটেছিল। এরপরে দেখতে দেখতে আঘাতের পর আঘাতে বাঙালির চলমান জীবন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে হয়েছিল; এবং তখনই প্রথম আত্মরক্ষার সুস্পষ্ট প্রয়োজনবোধে নিজেদের পলায়নপর মনোবৃত্তিকে দূরে সরিয়ে রেখে শিথিল জাতীয়-চেতনাকে একটা সুদৃঢ় ভিত্তিভূমিতে প্রতিষ্ঠিত করবার সচেতন প্রয়াস বাঙালির মধ্যে দেখা দিয়েছিল। এরফলস্বরূপ সমকালীন রাজনৈতিক জীবন থেকে অপসারিত হয়ে ধর্মীয় জীবনের নব জাগৃতিতে বাঙালি নিজের সমুদয় প্রচেষ্টাকে নিয়োজিত করেছিল। ফলে আগের অপূর্ণ পাঁচালী গাথাগুলি তখন যেমন সম্পূর্ণ কাব্যে রূপান্তরিত হয়েছিল, তেমনি দুর্বলের সহায়ক হিসেবে একজন শক্তি-দেবতার প্রয়োজনও সেই সময়ে সুতীব্ররূপে অনুভূত হয়েছিল। আর এরপরেই সেযুগের বিভীষিকাগ্রস্ত হীনসর্বস্ব বাঙালির চেতনাদ্বারে মঙ্গল দেব-দেবীরা তাঁদের সর্বপ্রকার প্রচণ্ড শক্তিযজ্ঞের বিপুল আয়োজন নিয়ে দেখা দিয়েছিলেন। ফলে অতীতে এই লৌকিক দেবদেবীদের কাহিনী যা আগে পাঁচালী আকারে লিখিত হয়েছিল, সেটাই তখন পরম শ্রদ্ধায় বহুজনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা মঙ্গলকাব্যের বিপুল সম্ভাবনায় আত্মপ্রকাশ করেছিল।
অন্যদিকে মঙ্গলকাব্য সৃষ্টির দ্বিতীয় কারণটি তুর্কী আক্রমণের ধ্বংসস্তূপের ওপরে উচ্চ-নীচ ও অভিজাত-অনভিজাতের মিলন-সাধনের মধ্যে নিহিত রয়েছে বলে দেখা যায়। এর আগে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পরিচালকরা রাজশক্তির আনুকূল্যে অভিজাত-অনভিজাতদের মধ্যে বিপুল ভেদরেখা বজায় রেখে ব্রাহ্মণ্যধর্মকে পরিচালনা করলেও আক্রমণোত্তর যুগে রাজশক্তির আনুকূল্য হারিয়ে তাঁরা বিশেষভাবে অনুভব করতে পেরেছিলেন যে, তখন গণশক্তির সাহায্য না পেলে এই ধর্মকে বহাল তবিয়তে বাঁচিয়ে রাখাই সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে পড়বে। আর তাই তাঁরা তৎকালীন গণজীবনের লৌকিক সংস্কার,  তাঁদের ধর্মবিশ্বাস এমনকি তাঁদের দেবদেবীকেও নিজের আভিজাত্যের অন্তর্ভুক্ত করতে সম্মত হয়েছিলেন। এরফলে যে ভেদরেখা এর আগে অভিজাত-অনভিজাতের মধ্যে শতযোজন ব্যবধান রচনা করেছিল—সেটা তখন ভেঙে গিয়েছিল। সেই প্রথম বাংলায় আর্য-অনার্য উভয় সম্প্রদায় মিলনভূমির শ্রীক্ষেত্রে সম্মিলিত হয়েছিল। তখনকার সেই আর্যীকরণের মধ্যে যেসব লৌকিক দেবদেবীরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে মনসা, চণ্ডী এবং ধর্মঠাকুরই প্রধান ছিলেন। আর তারপরেই সেই হীনবীর্য দুর্বলরা সম্মিলিত ও সম্প্রদায়গতভাবে যে যাঁর নিজের শক্তি দেবতার কাছে তাঁদের ঐকান্তিক প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। পরিশেষে এক একজন দেবদেবীকে নিয়ে এক একটি সম্প্রদায় প্রচণ্ড-শক্তি উদ্দীপক কাহিনী রচনায় উন্মাদ হয়ে উঠেছিল, এবং মঙ্গলকাব্যসমূহ নিজের প্রদীপ্ত মহিমায় বাংলা সাহিত্যে দেখা দিয়েছিল।
গবেষকদের মতে, মঙ্গলকাব্যের কাহিনী-বিন্যাস পূর্ব সংস্কারাগত (conventional) ছিল। অর্থাৎ, মঙ্গলকাব্যের আগে বাংলাকাব্যের যে রূপায়ণ পদ্ধতি গড়ে উঠেছিল, পরবর্তী সময়ের কবিরা সেই বাঁধাধরা পথেই নিজেদের কাহিনীকে বিন্যস্ত করেছিলেন, তাঁরা কোন দ্বিতীয় পথে পদচারণা করেন নি। পূর্বসংস্কারগত এই রূপায়ণ-পদ্ধতি অনুযায়ী গবেষকরা সবধরণের মঙ্গলকাব্যকে প্রধানতঃ চারভাগে বিভক্ত করেছেন বলে দেখা যায়; যথা—বন্দনা, গ্রন্থোৎপত্তির কারণ, দেবখণ্ড এবং নরখণ্ড।
এর মধ্যে বন্দনা খণ্ডে শুধুমাত্র বিশেষ কোন শক্তিদেবতারই বন্দনা-গান করা হয়নি, উপরন্তু সব ধরণের দেবদেবীর মহিমা কীর্তনও করা হয়েছিল। বাংলা মঙ্গলকাব্যগুলি যদিও সাম্প্রদায়িক উৎস থেকেই জন্মলাভ করেছিল, কিন্তু তবুও এই বন্দনা অংশে এক অসাম্প্রদায়িক উদার মনোভাব বর্তমান রয়েছে বলে দেখা যায়।

🍂

গ্রন্থোৎপত্তির কারণ খণ্ডে সব মঙ্গলকবিরাই কোন বিশেষ দেবতা বা দেবীর স্বপ্নাদেশকেই বিশেষ মঙ্গলগ্রন্থ রচনার কারণ বলে নির্দেশ করেছিলেন। গ্রন্থরচনার অন্তরালে দেবদেবীর স্বপ্নাদেশের অবতারণা আসলে অতীতের দেব-নির্ভর ধর্মান্ধ গণমানসকে জয় করবার একটি বিশেষ সুবিধাজনক পন্থা ছিল। এই খণ্ডের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল কবির আত্মপরিচয়। গ্রন্থোৎপত্তির কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে মঙ্গলকাব্যের সব কবিই নিজের জন্মসন, নিজের পরিচয়, বাসস্থান, বংশ ইত্যাদি বিষয়ে পরিপূর্ণ বিবরণ প্রদান করেছিলেন, যেসব পরবর্তীকালে ঐতিহাসিকদের পক্ষে বিশেষ উপকারের কারণ হয়েছিল।
মঙ্গলকাব্যের তৃতীয়াংশ হল দেবখণ্ড। এই খণ্ডে সাধারণতঃ যা কিছু বর্ণীত হয়েছিল, সেসবের মধ্যে প্রধান ছিল—সৃষ্টি-রহস্য কথন, দক্ষপ্রজাপতির শিবহীন যজ্ঞ, সতীর-দেহত্যাগ, হিমালয়-গৃহে নবরূপে জন্মলাভ, মদন ভস্ম, উমার তপস্যা, গৌরীর বিবাহ, কৈলাসে হর-গৌরীর কোন্দল, শিবের ভিক্ষা যাত্রা ইত্যাদি। এই অংশের শিবের একচ্ছত্র প্রাধান্যটি বিশেষরূপে লক্ষ্যণীয়। বাংলার ইতিহাসে শুধু নয়, ভারতের ইতিহাসেও শিব আদি-অন্তহীন এক অদ্ভুত পরমাশ্চর্য দেবতা—যেন গ্রামের প্রান্তসীমায় অবস্থিত একটি সুবিশাল বটবৃক্ষ, সেটা ‘কত কালের কেউ না তাহা জানে’ কিন্তু যুগ যুগ ধরে বংশ পরাম্পরায় সকলেই এর ছায়াতলে সান্ত্বনা ও শান্তি লাভ করে আসছেন। সৃষ্টির আদিমতম যুগ থেকেই এই আপনভোলা দেবতাটি নিজের অলক্ষ্যেই সবার উপরে নিজের প্রভাব বিস্তার করেছেন। আর তাই স্বর্গের সব দেবতার উপরেই শিবের স্থান। এমনকি শিবের এই অভিনব প্রভাব মানুষের ওপরেও বর্তমান বলে দেখা যায়। মানুষ যখন আর্য-অনার্য বিভাগে সব দেবদেবীগণকে ভাগ বাঁটোয়ারা করে আর্য-অনার্য রূপ দান করেছিল, তখনও শিবকে কিন্তু কোন গুপ্ত গণ্ডীর মধ্যে সীমিত করবার দুঃসাহস কারো হয়নি। শিব বরাবরই হিন্দুসমাজের সব স্তরের উপরেই নিজের প্রভাবটি বজায় রেখেছিলেন। তাই আর্যপুরাণে তাঁর যেমন প্রতিষ্ঠা দেখা যায়, বাংলার লোকজীবনেও তাঁর অনুরূপ প্রভাবও বর্তমান রয়েছে বলেই দেখা যায়। শিব যেন উভয় সমাজেরই সর্বসাধারণের সমাজ-সম্পত্তি। অতীতে বাংলা মঙ্গলকাব্যের শিবের এই আত্যন্তিক প্রভাব উভয় সমাজের ঘনিষ্টতাকে অধিকতর নিবিড় করে দিয়েছিল। আর তাই অনার্য দেবতাদের আর্য-ঐতিহ্য প্রদানের জন্যে সব মঙ্গলকাব্যেরই পৌরাণিক খণ্ডে শিবদেবতার অবতারণা করা হয়েছিল। পৌরাণিক-সংস্কৃতির সাথে লোকসংস্কৃতির মিলন-পটভূমি রচনায় মঙ্গলকাব্যে শিবের মহান প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল।
মঙ্গলকাব্যের সর্বশেষাংশের নাম হল নরখণ্ড। গবেষকদের মতে এই খণ্ডই হল মঙ্গলকাব্যের সর্বশ্রেষ্ঠ অংশ। এতে দেখা যায় যে, কোন স্বর্গলোকবাসী এবং বাসিনী কোন বিশেষ মঙ্গল-দেবতা কর্তৃক শাপগ্রস্ত হয়ে মর্তে অবতীর্ণ হন এবং উক্ত দেবতা বা দেবীর পূজাপ্রচার ও প্রতিষ্ঠা করে স্ব-শরীরে স্বর্গারোহণ করেন। মঙ্গলকাব্যের এই অংশেই তৎকালীন সমাজ জীবনের ছবি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়। ‘বারমাস্যা’-নায়ক কিংবা নায়িকা কর্তৃক বারো মাসের দুঃখ বর্ণনা, এবং চৌতিশা-বিপদগ্রস্ত নায়ক কিংবা নায়িকা কর্তৃক চৌত্রিশ অক্ষরে আলোচ্য দেবতার স্তবগান—এই অংশের এক অমূল্য সম্পদ। এছাড়াও নায়ক দর্শনে নারীদের পতিনিন্দা, রন্ধন প্রণালী, কাঁচুলী বা কারুকলা-সমৃদ্ধ বক্ষাবরণ নির্মাণও এই অংশের এক অপরিহার্য অঙ্গ বলে গবেষকরা মনে করে থাকেন।

Post a Comment

0 Comments