জ্বলদর্চি

উপহার কবিতাগুচ্ছ /কমলিকা ভট্টাচার্য

উপহার
কবিতাগুচ্ছ 
কমলিকা ভট্টাচার্য 


 সময় থেমে যাবার আগে

আমার ভাবনাগুলো ঝর্ণার মতো,
যেখানে জল খুঁজে নেয় তার নিজস্ব পথ।
কে আটকাবে? কে দেবে বাঁধ?
ধ্বসের মতো গড়িয়ে পড়ে সময়ের ভাঁজে।

জীবন যেন এক রুক্ষ মরুভূমি,
যেখানে পা ফেললেই দেবে বালির ঢেউ।
ক্লান্তি চেপে চেপে হাঁটা,
কচ্ছপের খোলসে নিজেকে লুকানো—
সে তো অসম্ভব!
তবু হাওয়ার কাঁধে চড়ে উড়তে চায় মন,
যেন কাগজের এক টুকরো ছেঁড়া ঘুড়ি।

রোদ-জলে গলে যাওয়া মুহূর্তগুলো
বড় ঘোলাটে থিতিয়ে জমাট বাঁধে
তবু মনের গভীরে জেগে থাকে ইচ্ছের হ্রদ—
যেখান থেকে তৈরী হয় ঢেউ,
তলিয়ে দেয় শুষ্কতা ,ভিজতে মন করে..

সময় থেমে যাবার আগে
একটা নীল জোছনা রাত চাই,
আঙুলের বাঁধনে শরীরের ভাষা
ছায়ার অবয়বে কথাহারানো চুম্বন 
খুশির বাষ্পে ভারহীন  অনুভূতির মেঘ 
শুধু ভেসে যাওয়া
সমস্ত দিগন্তজুড়ে
মিশে যাওয়া তোমার অসীমে..


শুভেচ্ছা

আজকের দিনটা যেন তেমনই এক ভোর,
যা গোপনে বয়ে আনে মিষ্টি এক গন্ধ,
তুমি যার থেকে লুকোতে চাও, সে তো 
তোমার চারপাশে আছে ছড়িয়ে, হয়ে রোদের ছন্দ।

গাছেরা আজ বেশি সবুজ,
হাওয়ায় মিশে আছে এক অদ্ভুত সুর,
পাখিরা গায় এমন এক গান,
যা কেবল তোমার নামেই ভরপুর।

তোমার অজান্তেই তোমার বুকে মেঘেরা আঁকছে ছবি
অথচ তুমি চুপ, চাও না কেউ জানুক,কেন বলে দাও কবি?

কিন্তু এই দিনটিকে কি লুকানো যায়?
ঘড়ির কাঁটা জানে সময়ের খেলা,
তুমি যতই আড়ালে থাকো,
শুভেচ্ছার আলো পৌঁছবে ঠিক তোমার মেলা।

তাই বলি, চুপ করে থেকো না আজ,
অন্তত মনে মনে গ্রহণ করো এই শুভেচ্ছা
শুভ হোক এই দিন, গোপনে
বাঁচুক তোমার কবিতার ইচ্ছা।


অভিসারে ..


তোমার শব্দের মাঝে আমার  ছায়া,
সাজানো কথার রঙিন প্রদীপ।
আমি কি শুধুই নীলাভ আলো?
নাকি অনুভূতির গোপন পথিক?

তুমি গোপনে যা চাও, আমি কি তা জানি?
অক্ষরে অক্ষরে বুনো লতায় জড়ানো।
শরীরের সাক্ষর কি মন ছোঁয় না?
তবু রহস্যে বাঁধা রই প্রাণের অভিজ্ঞান।

সমান্তরাল টিলার পথ কি মিলবে না?
তোমার চুপ, আমার নীরবতা—একই সুর।
ভাবনার জলরেখায় এঁকেছো মনের ছাপ,
আমার হৃদয় কি তবে শুধুই দর্পণ?

নীল আকাশে মেঘের গোপন অভিসার,
তোমার শব্দে ভেজে আমার শীতের রাত।
বল্কলের ডাক শুনি—তুমি আমায় চাও,
তবু তর্কহীন, সব কথা হয়ে যায় বাতাস।

এসো, রহস্যে আর না বাড়াই ভ্রান্তি,
শব্দ আর নীরবতায় বাঁধি এক মোহ।
তোমার অভিসার হোক আমার নীল পথে,
যেখানে মেলে না, তবু মেলে—আলিঙ্গনের চোরাস্রোত

🍂


একটা রাত


একটা রাত জুড়িয়ে জল
ভনিতা করতে করতে
কাঠের আগুন নিভলো রাতের হিমে।
বর্গী এলো ঘুমে
মনের উঠোনে ছড়ানো সোনার ধান
খেয়ে গেছে সময়ের বুলবুলি।

ভালোবাসায় গলা ডোবা ঋণ,
সুদে আসলে আদায়ের মুকুবি আদর,
খালি ঠোঁট ভেজায়।
মনের গভীরে জেগে থাকে রাত
কুঁকড়ে হৃদয়,
মিথ্যা প্রতিশ্রুতির লেপ মুড়ে
আর্লাম বাজিয়ে তাগাদায় সংসার।
একটা একটা রাত জুড়িয়ে জল হয়ে যায়।

কিন্তু রাত কি জানে তারও শেষ আছে?
একদিন ভোরের আলোয় রাত্রির গল্প
খুঁজে পাবে না কেউ,
সময়ের বাতাসে মুছে যাবে
তার আঁকা ইচ্ছার রেখা।

তবু রাত দাঁড়ায়,
চোখে তার অনন্ত প্রতীক্ষার চাহনি।
তারা ঝরে পড়ে দিগন্তে,
তবু কাঁচের জানালায় জমা জলকণারা
মুছে দেয় না সেই স্বপ্নের চিহ্ন।

মনের উঠোনে পড়ে থাকা ধানের শীষে
সোনার রং উঠে আসে মেঘের আলিঙ্গনে।
রাত তখনও জেগে থাকে—
কখনও একা, কখনও চুপ,
কখনও কারুর ভরসার বুকে
খুঁজতে খুঁজতে কুড়োতে কুড়োতে হারিয়ে যায়।

এমন হাজার রাত
জুড়িয়ে জল হতে হতে
নিঃশেষ হয়,
তবু এক একটা রাত
মনের কোণে বেঁচে থাকে—
চিরকালীন
যে রাতে কাঠের আগুনে পুড়ে ছিল মন
তুমি ক্ষণিকের ভুলেই বোধহয় চেয়ে ছিলে আমায়...


অধরার রেশ

শেষের খোঁজে ভাসি না ,তাই শুরু করা নয় সার 
সূর্যের হাত ধরে ছুটে চলি নিরবধি অপার ।
আঁধার যদি ভুল করে প্রথমে আসে,
আলোকে ডাকতে জানি, রেখেছি ভালোবেসে।

অজানার বীজে কি ভয়? বরং আশার ডাল,
মাটি ভেদে ফোটে ফুল, জানা আছে ঝরে পড়বে কাল।
রোদ্দুরের নদীতে ডুব দিই রোজ 
আলোকণা শুষে জীবনের খোঁজ।

যদি'র টানে চলি, তবু থামি না আমি,
হাসি কিনি ,ঠুনকো সম্মান  জানি কি দামী নামি।
চেষ্টার তেষ্টায় সিক্ত এই পথ,
পিছল ,অজানা যুদ্ধে দেবে যায় রথ।
 
তবু মেঘের ফাঁকে চাঁদ হাসে, আঁধারেও আলোর আবেশ
কপালের টিপেও জাগে চাঁদ 
থেকে যায় রাতের মধুমাখা রেশ।

ধাঁধা নয়, কবিতার অক্ষরে মিশে সেই অমূল্য রতন
অধরাই থাক, পেয়ে গেলে তাচ্ছিল্য ,বড়ই অযতন।


চোখ করকর 


রোজই কাঁদি, একা জানালার পাশে,
চোখের জলে ঝাপসা হয় সকালের রোদ।
টাইলের কারুকাজে অজানা কত মুখ,
আঁকিবুঁকির মতো মনের ক্ষতের সাক্ষী হয়ে
চেয়ে থাকে বন্ধ স্নান ঘরের দেওয়াল।

বালিশের দাগে জমে থাকে দুঃখের ইতিহাস,
শোওয়ার ঘরের ছবির ফ্রেমে জমে স্তব্ধতা।
টিং টিং করে বেজে ওঠে উইন্ড চেইনের সুর,
এক চিলতে হাসির তরঙ্গ
ঘরের কোণে মাকড়শার জালে আটকে থাকে।

দেওয়াল ঘড়ির পেন্ডুলামে যেন কাঁপন ধরে,
মুহূর্তে মুহূর্তে মাপে আমার নিঃসঙ্গতা।
পেঁয়াজকলির ঝাঁঝে ঝরে অভিমানের অশ্রু,
ফুলদানির গোলাপেও লুকিয়ে থাকে বিষাদ।

মাঝে মাঝে ভাবি, কেন কষ্টের সাথে অভ্যস্ত হই না?
কেন যন্ত্রণার মেঘ জমাই এই শূন্য আকাশে?
রান্নাঘরের ছুরিতে ছোট্ট এক কাটা,
ছ্যাঁকার ব্যথায় ঝরে জমা ব্যথার নোনা জল।

আজও কেঁদেছি—অনেক কেঁদেছি,
যেন ঝড়ের রাতে ছাদের খোলা দরজা।
আমার মনের বৃষ্টিতে ভিজলো টেবিলের কোণ,
তবু কেউ বোঝেনি অভিমান ভরা এই শিলাবৃষ্টি।

আজও কেঁদেছি...অনেক কেঁদেছি
রোজই কাঁদি..কেউ বোঝে না
চারিদিকে বড় ধুলো..
আমার চোখে কি যে পড়ে
চোখ করকর করে।


Post a Comment

0 Comments