শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৮৩ / সালেহা খাতুন
আর একটি মুখ এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে স্মৃতিপটে। অধ্যাপক অপর্ণীতা ভট্টাচার্যের বিচলিত মুখ। রায় নার্সিংহোম থেকে হাতে অপারেশানের পর যেদিন ছাড়া পেলাম, হাতে ইয়া বড়ো ব্যান্ডেজ নিয়ে বেরিয়ে আসছি; দেখি সামনেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে ও। বাইশ দিন লিভ(নিয়মানুযায়ী বাইশ দিন লিভ নিলেও চুয়াল্লিশ দিনের মেডিকেল লিভ হলো) নেওয়ার পর যখন পুনরায় কলেজে জয়েন করি, এক হাতেই সব কাজ করতে থাকি। তখন অপর্ণীতার প্রতিদিনের কাজ ছিল, আমার শাড়ির আঁচলটা ঠিকঠাক সেট করে পিন করে দেওয়া। মুখে বলতো, “তোর ঢাঁই কিলো হাতের খবর কী?”পুরো হাত মোড়া যেতো না, কাঁধের কাছে তোলা যেতো না; ডাক্তারের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকি। তিনি বলেন, “প্লাস্টার করে ঝুলিয়ে দিলে ভালো হতো বুঝি! তিন মাস পড়ে থাকতেন। তাড়াতাড়ি যাতে কর্মক্ষেত্রে ফিরতে পারেন তাই অপারেশান করে দিলাম। একমাসেই জয়েন করতে পারলেন”।
কর্মক্ষেত্রের কলিগরা অনেকে কোয়ার্টারে দেখা করতে এলেন। স্বাভাবিক পোশাকও পরতে পারি না। বোন একা একাই ওর বাচ্চাকে নিয়ে মেদিনীপুর চলে এলো। কাঁচি দিয়ে সব কটা ড্রেসের হাতা কেটে ফেলে দিয়ে ফিতে বেঁধে সহজ করে পরার উপযোগী করে দিল। দিদির দেখভালে কয়েকটি দিন কাটিয়ে ফিরে গেল নিজের সংসারে। কিন্তু মন দিতে পারছে না সংসারে দিদির কষ্টের কথা ভেবে। ওর বর ওকে বুঝিয়ে বললো, “দিদিকে একটা নার্স রাখতে বলো”। এক ঘর এক বিছানায় আমাদের শৈশব কৈশোর এবং যৌবনেরও কিছু সময় ভাইবোনে একসঙ্গে কাটে, তারপর আমাদের প্রায় সবারই ঠিকানা যায় বদলে। আলাদা আলাদা সংসার হয় প্রত্যেকের। বাস্তবের প্রখরতায় আমরা জটিল হয়ে গেলেও বোনের মন এমনই নরম যে প্রায়ই মানুষের দুঃখ কষ্টে কাতর হয়ে প’ড়ে মাঝেমাঝে ভারসাম্য রক্ষা করতে কঠিন অধ্যাবসায়ে ওকে কাটাতে হয়। অত্যন্ত দরদী মন ওর। আমার সংসারটাকে মোটামুটি থিতু করে দিয়ে গেল, একমাসের সংসার চালানোর রসদও পাঠিয়ে দিল।
মা কয়েকটা দিন সংসারের হাল ধরলেন। কিন্তু যে বাড়ির কর্ত্রী তিনি, সেখানে তাঁর উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি। তিনিও ফিরে গেলেন। এবার নার্সিং থেকে শুরু করে যাবতীয় দায়িত্ব চাপলো সালাউদ্দিনের ওপর। আমার একহাতের সঙ্গে অপরহাতের সহযোগিতায় হাত বাড়ালেন তিনি। মেয়ের স্কুলে যাওয়ার জন্য চুল বিনুনি করে দেওয়া, আমার চুল বেঁধে দেওয়া এসবে হিমসিম খেতে থাকলেন। তখন আমি চুল কেটে ফেলে ছোটো করে নিলাম। শুধু আঁচড়ে নিলেই চলবে। বাঁধতে হবে না, অতএব দুইহাত লাগবে না। কলেজে কলিগরা অনেকেই তখন বলতেন আমাকে নজরুল ইসলামের মতো দেখতে লাগছে।
রোগ দুর্ভোগ এসব নিয়ে বিলাসিতা করার সময় নেই। ২০১২ তে এন. এস. এস. থেকে অব্যাহতি মিললেও চলে এলো এডুকেশন বিভাগের কোঅর্ডিনেটরের দায়িত্ব। তখন পূর্ণ সময়ের কোনো অধ্যাপক নেই। দুজন অতিথি অধ্যাপক নিয়ে বিভাগ চলছে। স্বাগত বিজলী এবং পাপিয়া প্রামাণিক তখন পড়াচ্ছেন। ওঁদের নিয়ে রুটিন করা, ক্লাসের হিসেব রাখা, সেমিনার করা, এডুকেশনাল ট্যুরে নিয়ে যাওয়া, পত্রিকা প্রকাশ করা, ডিপার্টমেন্ট প্রোফাইল বানানো নানান কাজে মগ্ন হয়ে গেলাম। এসব কাজে দক্ষতার থেকেও বড়ো কথা অনেকটা সময় দিতে হয়। ২০১৪ থেকে যখন কলেজ অটোনমাস হয়ে গেল, তখন নিজেদের সিলেবাসও বানাতে হলো। এডুকেশনের অনেক এক্সটার্নাল অধ্যাপকের সঙ্গে যোগাযোগ হলো, কাজ করলাম। শিখলাম অনেক কিছু। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড.নিমাই চাঁদ মাইতির অনেক আইডিয়া আমাকে প্রাণিত করেছে। বর্তমানে হিজলি কলেজের অধ্যক্ষ ড. আশিস কুমার দণ্ডপাতেরও প্রভূত সহায়তা পেয়েছি এডুকেশন বিভাগ পরিচালনায়। মেদিনীপুর কলেজের এডুকেশন বিভাগের প্রথম সিলেবাস ওয়ার্কশপ করি ২০১৪ – এর আঠাশ জুন। প্রথম বি ও এস মিটিং অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪- বারো সেপ্টেম্বর।
তখন মাল্টিটাস্কিং-এ খুব একটা বেগ পেতাম না। বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বও নিতে হলো ২০১৪ থেকে। তাহলে হাতে রইলো বাংলা বিভাগ, শিক্ষাবিজ্ঞান বিভাগ, ইক্যুয়াল অপরচুনিটি সেন্টার ও আরো নানান দায়িত্ব। চল্লিশে পড়েছি। থরো বডি চেকআপ করালাম ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক হসপিটালে। ড. পুষাণ কুণ্ডুকে দেখালাম। তিনি বললেন আলট্রাসাউন্ড আপনি মেদিনীপুরের স্পন্দনেই করে নিন। বেশি ছোটাছুটি করতে হবে না। রিপোর্টের কয়েকটি তথ্য নিজে নিজে উদ্ধার করতে পারলেও এক জায়গায় আটকে গেলাম। ডাক্তারকে সেকথা বলায় তিনি বললেন, “সব যদি আপনি উদ্ধার করে নেবেন, তাহলে আমরা এতোদিন পড়াশোনা করলাম কেন?” বুঝলাম সবজান্তা আর হামবড়া জাতি আমরা কত ক্ষুদ্র জ্ঞান নিয়ে নিজেকে জাহির করতে ব্যস্ত থাকি।
🍂
২০১৪ তে কলেজ স্বশাসিত হওয়ার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৩ তে বাংলা বিভাগে এম.এ.-এর পঠনপাঠন শুরু হয়ে গিয়েছিল। এম.এ.- এর শিক্ষার্থীদের ডিসার্টেশান পেপারের কাজে নির্দেশনা দিতে হতো। অনেক ধৈর্য সহকারে তাদের বোঝাতে হতো গবেষণাপত্র কীভাবে লিখতে হবে। বর্তমানে দশ-বারো বছরে একশোরও বেশি শিক্ষার্থীকে সে কাজে সহায়তা করতে হয়েছে। আমরা বিভাগে অধ্যাপকরা ভাগ করে নিতাম এই দায়িত্ব। এদের মধ্যে অনেকেই অত্যন্ত মৌলিক কাজ করেছে। সবার কথা হয়তো মনে নেই। তবে অনেকের সঙ্গে আজও যোগাযোগ আছে। তাদের কয়েকজনকে বেশ মনে আছে। সুদীপা কাজ করেছিল জ্যোতির্ময়ী দেবীর “এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা” উপন্যাসে দেশভাগ প্রসঙ্গ নিয়ে, প্রদীপ করেছিল অন্নদাশঙ্করের “ক্রান্তদর্শী” উপন্যাস নিয়ে, সাগর করেছিল সমরেশ বসুর “সুচাঁদের স্বদেশযাত্রা” উপন্যাস নিয়ে। পল্লবী রবীন্দ্রনাথের নাটকে গান নিয়ে মৌলিক কাজ করেছিল। আসলে ও নিজে ভালো গান করে। এখন দেখি ক্ষুদ্র শিশুকে নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। গান বজায় রেখেছে কিনা সেটা আর জানা হয়নি। মণিমালা রবীন্দ্রনাথের চিত্রভাবনা খুব সুন্দর করে উপস্থাপন করেছিল। এক্সটার্নাল এক্সামিনার অধ্যাপক রাজ্যেশ্বর সিনহা ওর প্রশংসা করেছিলেন। আমাদের বিভাগে বিশেষ পত্র বা স্পেশাল পেপার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ভাষাতত্ত্বের ওপর কাজ করেছিল যারা তাদের মধ্যে অরুণকে মনে আছে। যত্ন সহকারে ও কাজ করেছিল। একশোজনের সবার গবেষণাপত্রের কথা এখানে বলা হয়তো সম্ভব হবে না তবে দুজন বেশ অন্যরকম কাজ করেছিল।
প্রিয়া দিগার কাজ করে হামিরউদ্দিন মিদ্যার ছোটোগল্প নিয়ে।
একজন সৌতম সাঁতরা আর একজন প্রিয়া দিগার। ২০১৭ সালে আমার ছাত্র শ্রীমান সৌতম সাঁতরা এম.এ.তে "নলিনী বেরার গল্পে প্রান্তিক মানুষ" শিরোনামায় ডিসার্টেশান পেপার নির্মাণ করে।(নলিনী বেরার "সেরা পঞ্চাশটি গল্প" গ্রন্থ থেকে বেছে নেয়-বোরজ,বাঘাতঙ্ক,জলের মানুষ ডাঙার মানুষ,টি আই প্যারেড,অঙ্গনওয়াড়ি গল্প পাঁচটি)প্রকৃত গবেষকের সমস্ত গুণই প্রকাশ পেয়েছে ওর এই গবেষণাপত্রে। এই কাজে সাহিত্যিক নলিনী বেরা মহাশয়ের সঙ্গে ও সরাসরি কথা বলে নিজেকে আরো সমৃদ্ধ করে নিয়েছিল।ওর গবেষণাপত্র নির্মাণের নির্দেশক রূপে গবেষণাপত্রটি খুঁটিয়ে পাঠ করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।আমি চমৎকৃত হয়েছিলাম।তাই মেদিনীপুর কলেজ থেকে যখন আনন্দ পুরস্কার প্রাপ্তিতে নলিনী বেরা মহাশয়কে সংবর্ধনা দেওয়া হয় আমরা ডেকে নিয়েছিলাম সৌতমকে। ওর মনোগ্রাহী বক্তব্য সবার মন ছুঁয়ে ছিল। আমার সে ছাত্র এখনও কোনো প্রথাগত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয় নি ঠিকই তবে গৃহশিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে পড়াশোনার জগতেই আছে। আর ভালোবাসে গাছপালা, ফুলফল এবং পশুপাখিকে। আমার শিক্ষার্থীদের সবসময় ইতিবাচক ভাবনা চিন্তা করতেই বলি। চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। আমি একজন এমপ্লয়ি মাত্র। কোনো এমপ্লয়ার নই। ওদের মন ভেঙে দেওয়ার কোনো অধিকার আমার নেই। তাই যখন বিভিন্ন শপিংমলে, জুয়েলার্সে, ব্যবসার কাজে, বিউটিপার্লারে, বুটিকে ও আরো বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত থেকে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উদযাপন করতে দেখি, নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারি।
আশা আমি ছাড়ি না। কেননা আমার ক্লাসরুমে বসা শিক্ষার্থী ড.শান্তি সরেন পড়াচ্ছে প্রেসিডেন্সিতে, শুদ্ধসত্ত্ব পড়াচ্ছে পিংলা কলেজে, অরূপ পড়াচ্ছে একটি গভর্নমেন্ট কলেজে, জিতমোহন পড়াচ্ছে মালদার হরিশচন্দ্রপুর কলেজে আর স্কুলে তো অজস্র ছাত্রছাত্রী পড়াচ্ছে।
এতোদিনের অধ্যাপনা জীবনে মোটামুটি একটা অভিজ্ঞতা লাভ করেছি, কাকে দিয়ে কেমন গবেষণা করাতে পারবো। ২০২৪-এ প্রিয়া দিগারকে গাইড করি “হামিরউদ্দিন মিদ্যার ছোটোগল্পে প্রান্তিক জীবন” নিয়ে কাজ করতে। ও লেখকের সঙ্গে ফোনে কথা বলে অনেক তথ্য সংগ্রহ করে কাজটি সম্পূর্ণ করে।"মাঠরাখা"র প্রতিটি গল্প গভীরভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিল একারণেই।
0 Comments