জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণ এবং স্টার থিয়েটার/রাজীব শ্রাবণ

শ্রীরামকৃষ্ণ এবং স্টার থিয়েটার

রাজীব শ্রাবণ 


রাত পোহালেই কল্পতরু উৎসব। সে কথা আমরা জানি। আমরা এখন ঠাকুরের অন্য এক গল্প কথা বলব।  আপাত অজানা এক কাহিনি। 
সময়টা ঊনবিংশ শতাব্দী। বাংলার সমাজজীবনে ব্রাত্য নট-নটীদের অভিনয় দর্শন করবার ছলে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব পাঁচদিন কলকাতার ৬৮ নং বিডন স্ট্রিটের স্টার থিয়েটারে নিজের ভক্তদের সঙ্গে শুভ পদার্পণ করে বঙ্গরঙ্গমঞ্চ ও সমগ্র অভিনেতৃসমাজকে চিরতরে ধন্য করেছিলেন। সেই পাঁচ দিনে স্টার থিয়েটারে তিনি ছোট-বড় মিলিয়ে ভিন্নধর্মী পাঁচটি নাটক ও একটি প্রহসনের অভিনয় দেখেছিলেন। সেই পাঁচটি নাটকই নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষ লিখিত ছিল ও প্রহসনটি রসরাজ অমৃতলাল বসু রচনা করেছিলেন। গিরিশচন্দ্রের লেখা সেই পাঁচটি নাটকের মধ্যে দুটি ভগবদ্ভক্তিমূলক বা ভক্তিরসাত্মক চরিত নাটক ছিল; যথা—‘চৈতন্যলীলা’ ও চৈতন্যলীলার দ্বিতীয় ভাগ বা ‘নিমাই সন্ন্যাস’। আর বাকি তিনটি নাটক ছিল পৌরাণিক; যথা—‘দক্ষযজ্ঞ’, ‘প্রহ্লাদচরিত্র’ এবং ‘বৃষকেতু’। অন্যদিকে অমৃতলাল বসু লিখিত স্মরণীয় প্রহসনটি ছিল ‘বিবাহ-বিভ্রাট’।
মাস্টারমশাই শ্রীম বা মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত শ্রীরামকৃষ্ণের শেষজীবনের চার বছরের কিছু বেশি সময় ধরে তাঁর দিনলিপিকর ছিলেন। দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণকে তিনি প্রথম ১৮৮২ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি বা ১২৮৮ বঙ্গাব্দের ১৫ই ফাল্গুন তারিখের ফাল্গুনী শুক্লা নবমী তিথির এক সন্ধ্যাবেলায় দর্শন করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের পার্থিব দেহাবসানের এগারো বছর পরে শ্রীম সর্বপ্রথম এই দিনপঞ্জী অবলম্বনে ইংরেজি ভাষায় তাঁর উপদেশাবলী সম্বলিত ‘GOSPEL OF SRI RAMAKRISHNA’ নামের পর পর দুটি ক্ষুদ্র পুস্তিকা ১৮৯৭ সালের সেপ্টেম্বর ও নভেম্বর মাসে মুদ্রিত করেছিলেন। এরপরে স্বামী বিবেকানন্দ ও অন্যান্য রামকৃষ্ণ ভক্তদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি উপরোক্ত নামেই ১৯০৭ সালে বৃহদাকারে পুনরায় একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। তারপরে ভক্তপ্রবর রামচন্দ্র দত্তের ঐকান্তিক অনুরোধে তিনি পূর্বোক্ত দিনলিপির সাহায্যে বাংলাভাষায় ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’ নামক গ্রন্থটি রচনা করতে ব্রতী হয়েছিলেন। মোট পাঁচটি খণ্ডে বিভক্ত এই কথামৃত গ্রন্থটি আজও শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের শেষপর্বের একটি অসাধারণ আকরগ্রন্থ হিসেবে সর্বসাধারণের কাছে অত্যন্ত সুপরিচিত। রামকৃষ্ণের সাথে মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের প্রথম সাক্ষাতের দিন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরা এতে একের পর এক বিন্যস্ত করা হয়েছে বলে দেখা যায়। এই গ্রন্থের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ ভাগটি যথাক্রমে ১৯০২, ১৯০৪, ১৯০৮ ও ১৯১০ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল এবং এর শেষ অংশ ‘পঞ্চম ভাগ’–এর পান্ডুলিপি আগে তৈরি করা হয়ে গেলেও সেটি অবশেষে ১৯৩২ সালে মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের মৃত্যুর কয়েক মাস পরে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছিল। এই ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’ গ্রন্থে ভক্তদের সঙ্গে নিয়ে কলকাতার স্টার থিয়েটারে শ্রীরামকৃষ্ণের তিন দিনে তিনটি নাটক ও প্রহসন দেখবার উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে প্রথম দিন, অর্থাৎ—১৮৮৪ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর বা ১২৯১ বঙ্গাব্দের ৬ই আশ্বিন তারিখের রবিবার শারদীয়া দেবীপক্ষের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে তিনি গিরিশচন্দ্রের রচিত ও সেযুগের সর্বজনপ্রশংসিত ভগবদ্ভক্তিমূলক বা ভক্তিরসাত্মক চরিত নাটক ‘চৈতন্যলীলা’ দেখেছিলেন। (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, দ্বিতীয় ভাগ, চতুর্দশ খণ্ড; প্রথম, চতুর্থ থেকে অষ্টম পরিচ্ছেদ, একাদশ সংস্করণ; ১৩৫৬ বঙ্গাব্দ; পৃ: ১০৯-১০, ১১৪-১২৩) এরপরে দ্বিতীয় দিন, অর্থাৎ—১৮৮৪ সালের ১৪ই ডিসেম্বর বা ১২৯১ বঙ্গাব্দের ৩০শে অগ্রহায়ণ তারিখের কৃষ্ণা দ্বাদশী তিথিতে তিনি স্বল্পায়তনের পৌরাণিক নাটক ‘প্রহ্লাদচরিত্র’ দেখেছিলেন। তবে সেদিন রাতে ‘প্রহ্লাদচরিত্র’ নাটকটির ঠিক পরেই স্টার থিয়েটারে অমৃতলালের ‘বিবাহ-বিভ্রাট’ প্রহসনটি অভিনীত হলেও তিনি সেটা দেখেননি। এর কারণ হিসেবে তিনি, পরমান্ন ও শুক্তনির সঙ্গে যথাক্রমে ‘প্রহ্লাদচরিত্র’ ও ‘বিবাহবিভ্রাট’ নাটকের তুলনা করে পরমান্নের পরে শুক্তনি আহার করা অনুচিত বলে শেষের অভিনয়কে তখন সম্পূর্ণভাবে বর্জন করেছিলেন বলে জানিয়েছিলেন। (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, তৃতীয় ভাগ, একাদশ খণ্ড; প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ পরিচ্ছেদ, নবম সংস্করণ; ১৩৫৬ বঙ্গাব্দ; পৃ: ১০৬-০৭ ও ১১৪) তবে এরপরে তৃতীয় দিন, অর্থাৎ—১৮৮৫ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি বা ১২৯১ বঙ্গাব্দের ১৫ই ফাল্গুন তারিখের বুধবার শুক্লা একাদশী তিথিতে তিনি গিরিশচন্দ্রের ক্ষুদ্র পৌরাণিক নাটক ‘বৃষকেতু’ দেখবার পরে কিন্তু অমৃতলালের মঞ্চসফল প্রহসন ‘বিবাহ-বিভ্রাট’ দর্শন করেছিলেন। (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, পঞ্চম ভাগ, সপ্তদশ খণ্ড; প্রথম ও তৃতীয় পরিচ্ছেদ, ষষ্ঠ সংস্করণ; ১৩৫৬ বঙ্গাব্দ; পৃ: ১৩৯ ও ১৪৫-৪৮)
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, কথামৃত গ্রন্থে শ্রীরামকৃষ্ণের ১৪ই ডিসেম্বর রবিবার ‘প্রহ্লাদচরিত্র’ এবং ২৫শে ফেব্রুয়ারি বুধবার ‘বৃষকেতু’ ও ‘বিবাহবিভ্রাট’—এই যুগল অভিনয় দেখবার উল্লেখ থাকলেও এতে কিন্তু এই দু’দিনের মাঝখানের—১৮৮৪ সালের ২৮শে ডিসেম্বর বা ১২৯১ বঙ্গাব্দের ১৪ই পৌষ রবিবার শুক্লা একাদশী তিথি থেকে শুরু করে ১৮৮৫ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বা ১২৯১ বঙ্গাব্দের ১১ই ফাল্গুন শনিবার শুক্লা সপ্তমী তিথি পর্যন্ত মোট ছাপ্পান্ন দিনের কোনও দিনপঞ্জী পাওয়া যায় না। কিন্তু অন্যান্য সূত্র থেকে জানা যায় যে, কথামৃতের এই দিনলিপিহীন ছাপ্পান্ন দিনের মধ্যে গিরিশচন্দ্রের ভগবদ্ভক্তিমূলক বা ভক্তিরসাত্মক দ্বিতীয় চরিত নাটক চৈতন্যলীলার দ্বিতীয় ভাগ বা ‘নিমাই সন্ন্যাস’ বিডন স্ট্রিটের স্টার থিয়েটারে প্রথম অভিনীত হয়েছিল এবং শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের ভক্তদের সাথে নিয়ে সেই অভিনয়ও দেখেছিলেন। আবার এই সময়ের মধ্যেই তিনি এই একই থিয়েটারে উদ্বোধন রজনীতে গিরিশচন্দ্রের লিখিত ও সেযুগের মঞ্চসফল পৌরাণিক নাটক ‘দক্ষযজ্ঞ’র অভিনয়ও দেখেছিলেন। এমনকি তাঁর এই নাটক দুটি দেখবার পূর্ণাঙ্গ বিবরণও তৎকালীন শ্রীরামকৃষ্ণ-পরিমণ্ডলের অন্যান্য লেখকদের রচনা থেকেও জানতে পারা যায়।

🍂

শ্রীরামকৃষ্ণের ত্যাগীভক্ত লাটু মহারাজ, যিনি নিজের সন্ন্যাসজীবনে স্বামী অদ্ভুতানন্দ নামে পরিচিত হয়েছিলেন, তিনি ভক্তদের সঙ্গে নিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের ‘নিমাই সন্ন্যাস’ ও ‘দক্ষযজ্ঞ’ নাটকের অভিনয় দেখবার উল্লেখ, চন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায় রচিত তাঁর আত্মচরিতমূলক গ্রন্থ ‘শ্রীশ্রীলাটু মহারজের স্মৃতিকথা’য় করেছিলেন (সেবক-জীবন, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৩৬০ বঙ্গাব্দ, পৃ: ১৫৫-৫৭); এবং রামকৃষ্ণের গৃহীভক্ত বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল তাঁর ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ-লীলামৃত’ গ্রন্থে রামকৃষ্ণের ‘দক্ষযজ্ঞ’ নাটকটি দেখবার কথা বলেছিলেন (পঞ্চম পরিচ্ছেদ, পরিশিষ্ট–৩: গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৩৪৩ বঙ্গাব্দ, পৃ: ৩৩৮-৪০)। এছাড়াও নাট্যকার গিরিশচন্দ্র নিজেই তাঁর তিনটি প্রবন্ধে (১—ভগবান শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব, গিরিশ-গ্রন্থাবলী, তৃতীয় ভাগ, সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ বা দানিবাবু কর্তৃক প্রকাশিত, কার্তিক, ১৩৩৫ বঙ্গাব্দ, পৃ- ২৭৪; ২—পরমহংসদেবের শিষ্য-স্নেহ, গিরিশ-গ্রন্থাবলী, তৃতীয় ভাগ, সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ বা দানিবাবু কর্তৃক প্রকাশিত, কার্তিক, ১৩৩৫ বঙ্গাব্দ, পৃ: ২৭৮-৭৯; ৩—রামদাদা, গিরিশ-গ্রন্থাবলী, ষষ্ঠ ভাগ, সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ বা দানিবাবু কর্তৃক প্রকাশিত, আষাঢ়, ১৩৩৬ বঙ্গাব্দ, পৃ: ৩১৬-১৭) ভক্তপ্রবর রামচন্দ্র দত্ত তাঁর ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জীবনবৃত্তান্ত’ গ্রন্থে (অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ, বীরভক্ত গিরিশচন্দ্র, প্রথম প্রকাশ: জুলাই ১৮৯০ সাল, নবম সংস্করণ: ১৪০২ বঙ্গাব্দ, December 1995, পৃ: ১৩৭-৩৮), গৃহী তাপস মহেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘শ্রীমৎ বিবেকানন্দ স্বামীজীর জীবনের ঘটনাবলী’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে (প্রথম সংস্করণ: অগ্রহায়ণ ১৩৩২ বঙ্গাব্দ, পঞ্চম মুদ্রণ: ২৩শে জ্যৈষ্ঠ ১৩৯৪ সাল, ৭ই জুন ১৯৮৭ সাল, পৃ: ৭১-৭৪) এবং গিরিশচন্দ্রের জীবনের শেষ পনেরো বছরের পার্শ্বচর ও লিপিকর অবিনাশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত ‘গিরিশচন্দ্র’ নামক জীবনীগ্রন্থে (ত্রয়োত্রিংশ পরিচ্ছেদ, প্রথম প্রকাশ: কার্তিক ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ, দে’জ সংস্করণ: ১৯৭৭ সাল, পৃ- ২১০) শ্রীরামকৃষ্ণের ‘নিমাই সন্ন্যাস’ নাটকটি দেখবার কথা লিখেছিলেন। কিন্তু লাটু মহারাজ, বৈকুণ্ঠনাথ, গিরিশচন্দ্র, রামচন্দ্র, মহেন্দ্রনাথ ও অবিনাশচন্দ্র—প্রমুখ কোনও লেখকই যেহেতু তাঁদের বিবরণগুলিতে শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তদের সঙ্গে নিয়ে নাটক দুটির অভিনয় দেখবার ইংরেজি বা বাংলা সাল-তারিখ-বার প্রভৃতির কথা লেখেন নি, শুধুমাত্র ঘটনাগুলি বিবৃত করেছিলেন, সেহেতু তাঁদের কোন লেখা থেকে এই দুটি ঘটনার সঠিক তারিখ নির্ণয় করা অসম্ভব বলেই দেখা যায়। তবে এবিষয়ে তাঁদের লেখা রচনাগুলি পর্যালোচনা করলে, সমকালীন বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনগুলির প্রতি নজর দিলে, এবং শ্রীরামকৃষ্ণ-সান্নিধ্যে গিরিশ-মানস বিবর্তনের ধারাকে অনুসরণ করলে একথা নির্দ্বিধায় বলা চলে যে, তিনি ‘নিমাই সন্ন্যাস’ নাটকটি দেখবার পরে নিশ্চিতভাবে ‘দক্ষযজ্ঞ’ নাটকটিও দেখেছিলেন; এবং কথামৃতে অনুল্লিখিত দিনপঞ্জীর ছাপ্পান্ন দিনের মধ্যেই এসব ঘটনা ঘটেছিল।
সুতরাং কলকাতার স্টার থিয়েটারে শ্রীরামকৃষ্ণের নাটকের অভিনয় দেখবার সময়ের ব্যাপ্তির ইতিহাস মাত্র পাঁচ মাস পাঁচ দিনের, অর্থাৎ—১৮৮৪ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর তারিখের রবিবার থেকে শুরু করে ১৮৮৫ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি তারিখের বুধবার—এর বেশি নয় বলেই দেখা যায়। আর তার এই অভিনয় দর্শনকে সাল তারিখের ক্রমানুসারে সাজালে যেটা দাঁড়ায়, সেটা নিম্নরূপ হয়—
‘চৈতন্যলীলা’ → ১৮৮৪ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর,
‘প্রহ্লাদচরিত্র’ → ১৮৮৪ সালের ১৪ই ডিসেম্বর,
চৈতন্যলীলার দ্বিতীয় ভাগ বা ‘নিমাই সন্ন্যাস’ → অজ্ঞাত,
‘দক্ষযজ্ঞ’ → অজ্ঞাত,
‘বৃষকেতু’ ও ‘বিবাহবিভ্রাট’ → ১৮৮৫ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি।
প্রসঙ্গতঃ একথাও স্মরণীয় যে, ১৮৮৫ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি তারিখে স্টার থিয়েটারে শ্রীরামকৃষ্ণের যুগল নাটকের অভিনয় দেখবার রাতটিই সেখানে তাঁর শেষ পদার্পণ ছিল, এরপরে আর কোনদিনই তিনি সেখানে যাননি। এর অব্যবহিত পরেই তাঁর গলদেশের রোগ ধরা পড়েছিল এবং সেই রোগের চিকিৎসার জন্য তাঁকে দক্ষিণেশ্বর থেকে স্থানান্তরিত হয়ে বলরাম-ভবন হয়ে প্রথমে শ্যামপুকুরের দোতলা ভাড়াবাড়িতে ও শেষে কাশীপুরের উদ্যানবাটীতে বসবাস করতে হয়েছিল।
স্টার থিয়েটারের বিভিন্ন অভিনয় রজনীতে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর ভক্তদের মধ্যে—মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বাবুরাম ঘোষ (স্বামী প্রেমানন্দ), কালীপ্রসাদ চন্দ্র (স্বামী অভেদানন্দ), নারায়ণ, দেবেন্দ্রনাথ মজুমদার, রাখতুরাম বা লাটু (স্বামী অদ্ভুতানন্দ), যোগীন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী (স্বামী যোগানন্দ), নরেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বামী বিবেকানন্দ), যতীন দেব প্রমুখরা বিভিন্ন  সময়ে উপস্থিত ছিলেন। প্রসঙ্গতঃ একথাও উল্লেখ্য যে, আলোচ্য পাঁচদিনের মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণ সেখানে নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্রকে শুধুমাত্র একবার একটি চরিত্রে অভিনয় করতে দেখেছিলেন; আর সেই চরিত্রটি ছিল সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার মানসপুত্র আত্মম্ভরী মহারাজ প্রজাপতি দক্ষের। কারণ, সেযুগের রঙ্গমঞ্চের বিভিন্ন কাজকর্ম, বিশেষ করে নাটক রচনা ও অভিনয়ের মহড়ায় ব্যস্ত থাকবার জন্য গিরিশচন্দ্র তখন ‘দক্ষযজ্ঞ’ ছাড়া অন্য কোনও নতুন নাটকে বিডন স্ট্রিটের স্টার থিয়েটারে অভিনয় করতে সমর্থ হননি। তবে নটি বিনোদিনীকে সেখানেই শ্রীরামকৃষ্ণ কিন্তু পাঁচটি অভিনয় রজনীতে ছ’টি ভিন্নধর্মী ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখেছিলেন। সেই ছ’টি ভূমিকার মধ্যে তিনটি পুরুষ ও তিনটি নারী চরিত্র ছিল; যথাক্রমে—নিমাই (চৈতন্যলীলা), প্রহ্লাদ (প্রহ্লাদচরিত্র), চৈতন্য (নিমাই সন্ন্যাস), সতী (দক্ষযজ্ঞ), পদ্মাবতী (বৃষকেতু) ও বিলাসিনী কারফরমা (বিবাহবিভ্রাট)। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ‘বিবাহবিভ্রাট’ নাটকে ইংরেজি শিক্ষিতা উগ্র আধুনিকা বিলাসিনী কারফরমা আদতে একেকজন নারী হলেও তাঁর পোষাক-পরিচ্ছদ কিন্তু তৎকালীন সাহেবদের মতোই পুরুষোচিত ছিল। সমকালীন সমস্ত নথি থেকেই জানা যায় যে, বিনোদিনীর চরিত্রানুগ অঙ্গসজ্জার (Make-up) পারদর্শিতা অসাধারণ ছিল। তিনি তাঁর অভিনেয় চরিত্রের অঙ্গসজ্জা এমনভাবে করতে পারতেন যে অতি পরিচিত ব্যক্তিরও তখন তাঁকে চেনবার সাধ্য হত না। তিনি তাঁর প্রথম আত্মজীবনীতে নিজেই যেমন নিজের এই দক্ষতার কথা বলেছিলেন (আমার কথা বা বিনোদিনীর কথা, শেষ-সীমা, নব সংস্করণঃ সন্ ১৩২০, পৃ: ৯৫-৯৭), তেমনি গিরিশচন্দ্র ঘোষও এই গ্রন্থের ভূমিকায় ‘বঙ্গ-রঙ্গালয়ে শ্রীমতী বিনোদিনী’ শিরোনামের প্রবন্ধে এবিষয়ে তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন (গিরিশ-গ্রন্থাবলী, নবম ভাগ, সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ বা দানিবাবু কর্তৃক প্রকাশিত, আশ্বিন, ১৩৩৭ বঙ্গাব্দ, পৃ- ৩০৩)। বিনোদিনী তখন অনেক সময়েই নিজের অভিনেয় চরিত্রোপযোগী অঙ্গসজ্জা করে বাড়ি থেকে থিয়েটারে প্রবেশ করতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের গলদেশের রোগের চিকিৎসার জন্য কলকাতার ৫৫নং শ্যামপুকুর স্ট্রিটের ভাড়াবাড়িতে বসবাস করবার সময়ে বিনোদিনী সেখানে একবার তাঁকে দর্শনের আশায় অত্যন্ত উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠলে ভক্ত কালীপদ ঘোষের (দানা কালী) পরামর্শে ১৮৮৫ সালের ১০ই অক্টোবর বা ১২৯২ বঙ্গাব্দের ২৫শে আশ্বিন তারিখে শনিবার তিনি যখন সেই সাহেবী পোষাকের অন্তরালে আত্মগোপন করে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তখন সেখানে উপস্থিত দ্বাররক্ষক শ্রীরামকৃষ্ণভক্ত নিত্যনিরঞ্জন ঘোষ বা পরবর্তী সন্ন্যাসজীবনের স্বামী নিরঞ্জনানন্দও তাঁকে চিনতে পারেন নি। কিন্তু রঙ্গপ্রিয় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে তাঁর এই ফাঁকি দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ধরা পড়ে গিয়েছিল। (শ্রীরামকৃষ্ণের অন্ত্যলীলা, প্রথম খণ্ড, স্বামী প্রভানন্দ, চতুর্থ প্রকাশ: জ্যৈষ্ঠ ১৪০৩ বঙ্গাব্দ, May 1996, পৃ: ৩৯ ও ৪২) তবে সেটা বিনোদিনীকে বুঝতে পেরে, নাকি এর সাত মাস চোদ্দ দিন আগে তাঁর দেখা ‘বিবাহবিভ্রাট’ নাটকের বিলাসিনী কারফরমাকে চিনতে পেরে, নাকি সেদিনের ছদ্মবেশী বিনোদিনীর সাথে ওই নাটকের চরিত্রের পোষাক ও রূপসজ্জার মিল দেখতে পেয়ে—সেকথা কোন সূত্র থেকে জানা যায় না।

Post a Comment

0 Comments