লাশটের বগী পর্ব ১
কিছুদিন হলো তেমন কোন খবর হচ্ছে না। নিয়মমত নিউজ রুম সারাক্ষণ গমগম করবে, এঙ্কররা ফ্যাশানেবল কোট প্যান্ট পরে সেজে গুজে এসেই তীক্ষ্ণ স্বরে নানারকম প্রশ্ন করতে থাকবেন আর শুরু হয়ে যাবে তুলকালাম কলরব। যাকে প্রাকৃত ভাষায় বলা যায় চিল চীৎকার। জ্ঞানী গুণী অতিথিরা যুদ্ধপ্রস্তুত হয়েই থাকবেন আর নোট নিতে থাকবেন কি অস্ত্রে বিপক্ষকে বিদ্ধ করা যায়। চাবি ঘোরাতেই যেন হই হই করে সকলে নেমে পড়েন তর্কের আসরে। এ ওর বাপান্ত করা থেকে শুরু করে, হাতাহাতি, দাড়ি টানাটানি এমনকি শাড়ীও বাদ যায় নি। এই একরকম ধ্যাত্তেরিকা চলতে থাকে প্রতিদিন। নাটকের মঞ্চগুলো মাছি তাড়াচ্ছে, বাঞ্ছারাম তার বাগান ছেড়ে চলে গেছেন অকুল নদীর ঐ পারে। ভালোমানুষ এখন অক্সিমরন হয়ে গেছে, কারো উৎসাহ নেই। সব উৎসাহ ঐ টিভির নাট্যরঙ্গে। রোজ সন্ধেয় এক কাপ চা আর চানাচুর নিয়ে বসে গেলেই হল। টিকিট কাটতে হয় না, বাসে ঝুলেও যেতে হয় না বা গাড়ী পারকিং নিয়ে কলকাতা শহরের রহস্যময় আইনকানুনের পাকদন্ডী টপকাতেও হয় না। এই আসরে সবাই ব্যোমকেশ, সবাই বিপ্লবী, সবাই দেশের সনাতন মহান ঐতিহ্যের যোদ্ধা।
আজকের টপিক বোধহয় এঞ্জিনীয়ারিং। বিদ্দ্বজ্জনদের মস্তিষ্কঝটিকা প্রবল বেগে বহমান। রেলে কেন এত দুর্ঘটনা হচ্ছে আজকাল? কদিন আগেই একটা হয়ে গেছে উত্তরবঙ্গ লাইনে, সেটা কার দোষ কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না, এবং ঠিকমত চাপাবার একটা ঘাড় পাওয়া যাচ্ছে না। অবশ্যই অগ্নিবর্ষী নেতা শ্রীশ্যামল ভট্টাচার্যের কাছে এটা কোন ব্যাপার নয়। তিনি নিশ্চিত যে কোন অঘটন বর্তমান সরকারেরই দোষ। তাঁদের দম্ভে ও পাপেই এত অশান্তি, দুর্ঘটনা। তাঁদের সবচেয়ে বড় পাপ অবশ্যই শ্রী শ্যামলদের দলকে গোহারান হারিয়ে ক্ষমতা দখল করা। তিনি থামতেই অবসরপ্রাপ্ত রেলের আধিকারিক মতামত দিতে শুরু করলেন, দুর্ঘটনা রোখা কক্ষনই সম্ভব নয়। কারণ ভবিতব্য কে খন্ডিতে পারে। কেউ বা সোচ্চার ড্রাইভারদের মাধ্বীপ্রীতি নিয়ে, কারো ধারণা সব দুর্ঘটনাই তো আসলে স্যাবোটাজ। কে স্যাবোটাজ করতে পারে তার নানারকম থিওরি আছে, কাউকে না পেলে হাতে পেন্সিলের মত লুকিয়ে রাখা কোন এক সম্প্রদায় তো আছেই। এক বিদগ্ধ সাহিত্যিক প্রশ্ন তুললেন এসব ভিন্ন গ্রহের জীবদের কাজ নয়ত? উনি কল্পবিজ্ঞানের নামকরা লেখক, আজকাল বিভিন্ন আলোচনা সভায় উনি আসছেন, ক্রিপ্টো আর এ আই নিয়ে এত হইচই চলছে, ফলে অনেক মানুষ এখন এসব ব্যাপারে মাথা ঘামাতে শুরু করেছে। সবাই হা হা করে হাসলেন, কেউ আবার ভৌত জগত ছেড়ে ভৌতিক সম্ভাবনার কথা শুরু করতেই এঙ্করের টনক নড়ল। তাঁর খেয়াল হল আধঘণ্টা জোর আলোচনা হবার পর, সবাই একটু ক্লান্ত। এঙ্কর একটা ছোট্ট বিজ্ঞাপন বিরতি নিলেন।
🍂
সুকুমার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে একগ্লাস জল খেলেন, সঙ্গে একটা তাল মিছরির দানা। শ্লেষ্মা দূর হয় তাতে। সুকুমার খুব মন দিয়ে শুনছিলেন এতক্ষণ বসে বসে। কারণ এই ঘটনাতে তিনি নিজেই ছিলেন। টিভি দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাচ্ছিল শনিবারের সেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা।
দিনটা ছিল শনিবার ১৫ই জুন। আকাশটা ছিল গোলমেলে। সকাল থেকে মাঝে মাঝে মেঘ করছিল আবার হঠাৎ মেঘ ফেটে বেরিয়ে আসছিল তীব্র রোদ। সুকুমারের গলাটা রাত থেকে ধরে আছে। তার ওপর যদি বক্তৃতা দিতে হয়, তাই চটপট পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন একটা তালমিছরির কৌটো। তাড়াতাড়ি হাঁটায় মিছরির দানাগুলো পকেটে খটখট শব্দ করছিল, কিন্তু সুকুমারের খুব তাড়া। ট্রেন আসতে আর মাত্র ১৫ মিনিট দেরী, মিস করলে চলবে না। কলকাতায় আজ সন্ধের মধ্যে পৌঁছতেই হবে। সন্ধে সাড়ে সাতটায় পুরস্কার বিতরণী সভা। ট্রেন ঠিক সময়ে পৌঁছলে, সেখান থেকে হাঁটাপথে একবার প্রকাশকের সঙ্গে দেখা সেরে একটু তাগাদা দিতে হবে। একটা বই তারা পুরো একবছর রেখে দিয়েছে, ছাপেও না আবার ছাড়েও না। এখন বলছে নাকি বইমেলায় ছাপবে। এর পরে একটু কফিহাউসে কফির সঙ্গে ওদের বিখ্যাত চিকেন কাটলেট খাবার অভীপ্সা, ওই কাটলেটের ওপর সুকুমারের খুব লোভ। পুরস্কারদাতারা পুরস্কার দেবেন বলেছেন, কিন্তু সেখানে খাওয়া দাওয়ার কোন কথা নেই। বড়জোর কাগজের কাপে চা। আগে থেকে পেট ভরা থাকলে, বক্তৃতা দিতে হলে গলার জোরটা বজায় থাকবে।
সুকুমার অনেকদিন ধরেই লেখালিখি করছেন। ওনার মত এটা সাহিত্যসেবা। এখানে ওখানে গল্প কবিতা পাঠান মাঝে মাঝে। শখ করে কিছু গল্প ছাপাতে দিয়েছেন। নিজেরই পয়সায়, নইলে এই কলকাতা থেকে এত দূরে মফস্বলের লেখকের লেখার কে আর খবর রাখে। সচ্ছল সংসার, পয়সার তেমন অভাব নেই, বলা যায় যথেষ্টই আছে। দাদার কাপড়ের ব্যবসা। তিনি ব্যস্ত থাকেন এদিক ওদিক ঘুরতে, খুব করিতকর্মা। প্যাকিং করানো, কারিগরদের সঙ্গে কথা বলা, বড় বড় কলকাতার দোকান থেকে অরডার তুলতে, পেমেন্টের তাগাদা সব দাদার কাজ।
সুকুমার অত পারেন না, একটু সুখী আয়েসী, বাংলায় বিএ করার পরে চাকরি বাকরির খোঁজ করতে হয় নি, দাদা এসে বসিয়ে দিয়েছেন গদিতে। এখন দাদার অফিসে বসেন। অথরিটি ফিগার। দোকানের ভিতরের কাজ দেখেন বিভূতিদা। সুকুমার শুধু বিল চেক করেন, আর টাকা গুনে নেন। আজকাল তো আবার কিউ আর কোড চালু হয়ে গেছে, খদ্দেররা প্যাঁক প্যাঁক করে ফোনে কি সব কি টেপেন, আর টাকা চলে যায় একাউন্টে। সুকুমার চেক করেন আর বিল কেটে দেন।
সুকুমারের বৌ রিয়া। এই দিকটা একটু গণ্ডগোল আছে তাঁর জীবনে। রিয়ার বুটিক আছে কলকাতায় দক্ষিণাপণে। বাড়ীর দোকানের কাপড় বেচে, তার সঙ্গে আরো অনেক ফ্যাশানের ডিজাইন। ভালোই চলে। ব্যস্ত মহিলা। সে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে সেখানেই থাকে। সুকুমারের বৌ, কিন্তু নামমাত্র। মাঝে মাঝে আসে আবার চলে যায়। ব্যাপারটা ঠিক বোঝানো মুশকিল, লোকে জানে, কেউ ঘাঁটায় না। তবে সুকুমার এ নিয়ে বেশী ভাবেন না। তাঁর অঢেল অবসর। তিনি লেখেন। আত্মীয় জ্ঞাতি মহলে সবাই একটু অনুকম্পাই করে থাকে। সুকুমার ডুবে থাকেন সাহিত্যসেবা নিয়ে।
আজ সুকুমার পরেছেন বুটিকের কুর্তা। কাঁধে শান্তিনিকেতন থেকে কেনা ঝোলা, তাতে এক কৃষ্ণবর্ণা যুবতী কুটিরের সামনে বসে, একটি হরিণশাবক কিছু খাচ্ছে। ঝোলায় একটা জলের বোতল। ছ ঘণ্টার রাস্তা। তারপর শিয়ালদা থেকে কলেজ স্ট্রীট। ঠিক আটটায় বইভব সংস্থা তাঁকে শ্রেষ্ঠ গল্পকারের পুরস্কার দেবে। মানপত্র। সংগে আর্থিক পুরস্কার। সেইগুলো ঝোলায় ভরে আনবেন। একবার রিয়াকে ফোনে জানাতে রিয়া যেন খুশিই হল। বলল ‘যাক তোমার লেখালিখিতে কিছু রোজগারও হচ্ছে এবার।‘
দৌড়তে দৌড়তে খেয়াল হল শমিত পিছিয়ে পড়ছে। দুজনেই একটা টোটো করে স্টেশনে নেমেছিলেন। শমিতের একটা বাজারের থলের মত ব্যাগ। তার গায়ে লেখা পিপিপি পান মশালা। হলুদ আর নীল দিয়ে কীসব অজানা ভাষাতে কিছু লেখা। ওগুলো নাকি মাদ্রাসী ভাষা। বিভূতিবাবুকে কাজে পাঠানো হয়েছিল চেন্নাই, সেখান থেকে আসার সময় এরকম অনেকগুলো ব্যাগে জিনিষপত্র বেঁধে এনেছিলেন। ব্যাগটাতে কাগজ পত্র। শমিত তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে একটা হোঁচট খেয়ে পড়েছে, একটু খোঁড়াচ্ছে, এখন ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে সুকুমারকে ধরার চেষ্টা করছে।
বিভূতিবাবুর ছেলে শমিত । কালকের দিন ওর জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন। নীটের পরীক্ষা আছে কাল। পড়াশোনায় ছেলেটা চিরকালই ভাল, ক্লাসে ফারস্ট না হলেও সেকেন্ড থারড হয়ে আসে। ফারস্ট হয় লোকাল এমেলের ছেলে। শমিত মোটেই এলেবেলে নয়, বেশ ব্রিলিয়ান্ট বয় কিন্তু লাজুক খুব। বিভূতিকাকু বার বার করে সুকুমারকে অনুরোধ করেছেন, ‘একটু খেয়াল রাখবেন। কলকাতায় একলা তো কখনো যায় নি, দেখবেন স্টেশনে ঠিকমত নামলো কিনা। স্টেশনে আমার শালা দিলীপ আসবে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে, প্লাটফর্ম নম্বর ফোনে জানিয়ে দিলেই হবে। দিলীপ ওকে নিয়ে যাবে। ছেলেটা বড্ড লাজুক, এই আমার চিন্তা, বাইরে গেলে একলা কি করে থাকবে?‘ বিভূতিবাবুর এই এক বদভ্যাস। সুযোগ হলেই নানা রকম দুশ্চিন্তার কথা লোকজনকে শোনানো।
টিকিটটা আগে থেকেই কেটে দিয়েছেন, জেনারাল বগি। সুকুমারের অবশ্য ফার্স্ট ক্লাস এসি। তাতে কি, একই ট্রেন তো, তাতেই বিভূতিকাকু আশ্বস্ত। সুকুমারও আবার ঝুট ঝামেলা ঠিক সামলাতে পারে না, দায়িত্ব নেওয়ার কথা ভাবলেই ওর অস্বস্তি হয়। গলা খুসখুস করে। কি আর করা, বিভূতিদার ছেলে, দাদাও বলে দিয়েছে, চোখে চোখে রাখিস, ঠিক যেন বিভূতিবাবুর আত্মীয়র হাতে জমা পড়ে।
কিন্তু স্টেশনে ঢুকেই দেখা গেল ঘোর বিপত্তি। সব ট্রেন বন্ধ।
0 Comments