চঞ্চল দাশগুপ্ত
বেড়ালের নাম সুকুমারী ।বড় সাধ করে কে যেন নাম রেখেছিল বলা কঠিন । নাদুস নুদুস খয়রী সাদা ছোপ ধরা রঙ । হেলে দুলে এবাড়ি ও বাড়ি ঘুরে বেড়ায় । খাওয়ার পরে একটু কাঁটা একটু এঁটো ভাত যে যেমন দেয় তাই খেয়ে শান্ত হয়ে নীলুদার আমগাছ তলায় ঘুমিয়ে থাকে । ওভাবে মাঝে মাঝে একটু ভালো মাছ ভাত দিতে পারে । তা দেবে না । আমরা বেড়াল বলে কী ভালো খেতে ইচ্ছে করতে পারে না । প্রায়ই সুকুমারীর মাথা গরম হয়ে যায় । ওঁর মা বলে , আমরা বেড়াল অত রাগ করতে নেই । যা দিচ্ছে তাই খেয়ে খুশী থাক । তোর বড্ড মেজাজ হয়েছে । কেন যে তোর এত মেজাজ ভুঝি না । সুকুমারী কোনো উত্তর করে না , ঘোফ ফুলিয়ে বসে থাকে ।
সেদিন অনাসৃষ্টি কান্ডটা ঘটে গেল । নীলুদা বাজার থেকে জবরদস্ত ইলিশ মাছ এনে খবরের কাগজ নিয়ে বসেছেন । বাড়িতে মিস্ত্রি লেগেছে । অনেক ব্যস্ততা বউদির দেওয়া লিকার চায়ের গ্লাস হাতে নিয়ে বারান্দায় বসে ভাবছেন এখন কী কী করবেন । পুব দিকের রোদ গায়ে এসে পরেছে । এবার শীত বেশ জাগিয়ে পরেছে । গতবছরও ডিসেম্বর এ শীত ছিল না । ঘড়িতে প্রায় দশটা । নীলুদা হাঁক দিয়ে বলল, মাছ দেখেছো ? পাঁচশো টাকা কেজি । সর্ষে বাটা দিয়ে করতো ।
কখন আর দেখবো । আজ সীমা আসেনি। এতক্ষনে বাসন মেজে উঠলাম । বৌদি উত্তর দেয় ।
নীলুদা বুঝল হাওয়া গরম আর কোনো কথা বলার দরকার নেই ।
হঠাৎ পাশের বাড়ির তানু পিসি চিৎকার করে বলল , টুপু দেখতো সুকুমারী তোর বারান্দায় থেকে কি যেন নিয়ে এল । পিসি সবার আভিভাবক । সকাল বিকেল আসা যাওয়া করে । কখনও এক কাপ চা খায় । কখনও খায়না । কথা বলে চলে যায় ।
সুকুমারীর এসব কথায় কান দেবার সময় নেই । কলঘড়ে শান বাধানো চত্বরের শেষ প্রান্তে বসে তার কাজ করে যাচ্ছে । বহুদিন পর এরকম নধরকান্তি মাছ কপালে জুটেছে । কী যে সাধ । টুপু রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে কলপাড়ে এসে চক্ষুচরকগাছ , হারামজাদা বেড়ালটার কান্ড দেখেছেন গোটা মাছটা নিয়ে বসেছে । অসভ্য জানোয়ার তোকে খাওয়াই তবু তোর লোভ যায় না । আজ তোকে মজা দেখাব । নীলুদা লাফ দিয়ে এল , আর একটু হলে চায়ের গ্লাস উলটে গায়ে পরে যাচ্ছিল ।- কী হয়েছে ?
আর কী হয়েছে , তোমার আদরের বেড়াল কী করেছে দেখো ।
সুকুমারী একটা দুঃসাহসিক কান্ড করে ফেলেছে । ও কিন্তু এরকম্ নয় । দরজার বাইরে থেকে সময় মত ডাকা ডাকি করে । তারপর যা জোটে তাই খেয়ে চলে যায় । আজ আর লোভ সামলাতে পারেনি । তাই অঘটন ঘটে গেল । সুকুমারী মাছ টায় দুচারটে আচর- কামড় বসিয়েছে ব্যাস তারপর তো হৈ হৈ রৈ রৈ কান্ড । টুপু বউদির বেজায় তাড়া খেয়ে সুকুমারী পাঁচিল টপকে নিখিল খুঁড়োর কলা বাগানে বসে হাঁপাতে থাকে । -ধ্যুস দিনটা বরবাদ হয়ে্ গেল । সাতসকালে যা কান্ড হয়ে গেল । মাছটাও জুটল না – বদনাম হয়ে গেল । এতদিনের নিশ্চিত আস্থানাটা নড়বড়ে হয়ে গেল ।
টুপু বউদি থামেনি , আবার আসিস কোনোদিন । দেব কোমর ভেঙ্গে । এতদিন তোকে খাওয়ানো আমার ঘাট হয়েছে । আঁচড়ে কামড়ে ওটা ফেলে গেছিস কেন নিয়ে যা ।
সুকুমারী ভাবে মন্দ বলেনি । কিন্তু আনবে কেমন করে । ওখানে টুপু কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । থাক বাবা আর ওদিকে যাবার দরকার নেই । সুকুমারীর মা এসে বলে , সাতদিন অন্য এলাকায় চলে যা ।
নীলুদা আরো এককদম এগিয়ে , উঠোন থেকে একটা আঁধলা ইট নিয়ে ছুড়লো সুকুমারীর দিকে । আজ একটা কিছু করতে হবে । ওকে একটা উপযুক্ত শাস্তি না দিতে পারলে টুপুর কাছে প্রেস্টিজ থাকবে না ।
সুকুমারী নিখিলখুড়োর পুকুরঘাটে বসে ছিল – মারল এক লাফ । নীলুদার আধলা ইট পরল খুড়ির ঘাটে ভেজানো কড়াইয়ের উপর । ব্যাস আর যায় কোথায়–কড়াই ভেসে চলে গেল মাঝ পুকুরে । টুপু এবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল , সুকুমারীকে ছেড়ে সব রাগ গিয়ে পরল নীলুদার উপর , তোমার মত বেআক্কেল লোক আর একজনও নেই । কোন ক্ষমতা নেই একটা আঁধলা ইট ছুড়লেন । অসভ্য জানোয়ারটার ধারে কাছে লাগল না । নীলুদাও কম যায় না ,বেশি কথা বলো না । আমার মেজাজ গরম হয়ে গেছে । এখুনি আমি আশ্রমে চলে যাব । একবছর ফিরব না ।
রাখ তোমার মেজাজ । খুড়ির কড়াই উদ্ধার কর তারপর যেদিকে ইচ্ছেযাও ।
অগত্যা নীলুদা একটা লাঠি নিয়ে পাঁচিল টপকে পুকুর ঘাটে গেল । কড়াই কাছে আসার বদলে চলে গেল আরো দুরে । নীলুদা ভাবছে এবার কী হবে । পাঁচিলের ওপাশে দাঁড়িয়ে টুপু বলল ,অত ভাবছ কী নেমে পর পুকুরে ।
নীলুদা একবার টুপুর মুখের দিকে একবার জলের দিকে তাকাল ।
সুকুমারী একটু দুরে চুপ করে বসে সব দেখছিল বেশ হয়েছে , আমাকে এত হেনস্থা করা । আমি বিড়াল বলে কোনো মান সন্মান নেই । এবার ঠান্ডা জলে ডুব দে । হোক তোর জ্বর । নীলুদা বলল তোকে আমি ছাড়ব না । তোকে এলাকা ছাড়া করব । তোর ঠাং ভাঙব । তোর সাহসের বলিহারি ।
ওদিক থেকে ভূটান চীৎকার করে , বাবা সারে দশটা বেজে গেছে ,
কিন্তু – আমার কাজটার কথা মনে আছে ।
পুকুরে কনকনে ঠান্ডা জলে একটু একটু করে নামে নীলুদা ।মনে মনে
দু- চারটে জবরদস্ত গালমন্দ নিখিল খুড়ো কে দিয়ে দেয় । পুকুরের চারিদিকে এত কলাগাছ বসাতে কে বলেছিল তোমাকে । পুকুরে এক ফোটাও রোদ পরে না । বেজায় ঠাণ্ডা জল । কলা হলে একটাও দাও না । সব খুড়ো খুড়িতে খাও ।
জলঠান্ডা হোক আর বরফ হোক জলে নামতে হল ।খুড়ির কড়াই উদ্ধার হল । তখন নীলুদার শরীরে কম্প ধরে গেছে । বেশ খানিকটা দুরে বসে সুকুমারী সব কিছু দেখে ফ্যাচ ফ্যাচ করে হাসতে থাকে ।
এর মধ্যে আরো একটা কান্ড ঘটে গেল । যে মাছটা টুপু বেজায় বিক্রমে সুকুমারীর মুখ থেকে উদ্ধার করেছিল , কড়াই কান্ডের মধ্যে সুকুমারীর এক বন্ধু সেটাকে রান্নাঘর থেকে নিয়ে গিয়ে বেজায় আনন্দে ভোজন পর্ব শেষ করল ।
ভুটান বলল , একদিন না হয় ওঁরা খেয়েছে । রোজ তো আমরা খাই ।
টুপু ধমক দিয়ে বলল , চুপ কর তোর আর বড়দের মধ্যে কথা বলতে হবে না ।
কুস্তিখেলা
অভীক মুখোপাধ্যায়
সকাল সকাল পু-এর দেখ, মুখ হয়েছে হাঁড়ি,
বন্ধুরা কেউ আসবে না আজ, এত তো মুস্কিল হল ভারী।
কার সঙ্গে খেল্বে পু? রান্নবাটি, পুতুলখেলা?
হচ্ছে মনে বৃথাই যাবে এই ছুটির দিনের সকালবেলা।
ঠিক তখনই মাথায় পু-এর এল একটা ভাবনা,
না হয় দাদার সঙ্গে একটু খেলেই দেখা যাক না।
পু-এর দাদা পুকুবাবু বোনের এক কথাতেই রাজি,
আজ জমবে খেলা বোনের সাথেই, রাখতে পার বাজি।
আজ যে হবে কম্পিটিসান, কুস্তি কুস্তি খেলা,
পুতুলগুলো লড়বে তাতে, এক এক করে পালা।
পু-এর একটা পুতুল আছে, যার নাম জয়মালা,
ঠিক হল যে আজ প্রথমে ওটারই হবে পালা।
দেখতে দেখতে বারান্দায় তৈরি কুস্তির রিং,
প্রথমে জয়মালার সাথে লড়বে পুতুল, নাম ঝগড়ু সিং।
ঘন্টা নেড়ে পুকুবাবু করাল শুরু লড়াই,
জয়মালাই জিতবে বলে করছে পু বড়াই।
ঝগড়ু সিং এর আক্রমণে হল এমন ওলট পালট
জয়মালাটার ঠ্যাং ভেঙে তো বাঁধাল চুলোট মালোট।
চখের জলে ভাসছে যে পু, কোলে তার জয়মালা,
পুকুবাবু দিচ্ছে দুয়ো, ওকে , ডাকছে লেংড়িমালা।
নির্মল স্যারের ক্লাস (১)
প্রকৃতির ছেলে গোপাল
ধ্রুবজ্যোতি দে
“গোপালের মায়ের নাম কিন্তু প্রকৃতি নয়, শশীমুখী। তবু কেন গোপালকে প্রকৃতির ছেলে বললাম তা জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে একশ বছরেরও আগে।” - এই বলে নির্মল স্যার একটু থামলেন। তারপর বলতে থাকলেন…
“ভারত তখন ইংরেজদের শাসনে, বাংলাও ভাগ হয়নি। সেই অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুরের একটি গ্রাম লোনসিং। গোপালচন্দ্র সেই গ্রামের ছেলে। পাশ করে সেখানকার একটি ছোটদের স্কুলে পড়ান। এক বর্ষার বিকেল। স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। অনবরত বৃষ্টি পড়ছে। গোপালচন্দ্র স্কুলের বারান্দায় বসে আর দু’তিন জন সহকর্মীর সঙ্গে গল্প করছেন। স্কুলের অল্প দূরে অনেকটা খোলা মাঠ। তার মাঝে একটু জলা মত জায়গা। এমন সময়, হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া উঠলো। শুরু হয়ে গেল মুষলধারে বৃষ্টি। আকাশের আলো কমে গেছে। দূরে মাঠের মাঝখানে, মাটি থেকে প্রায় তিন চার হাত উঁচুতে বৃষ্টির মধ্যেই হঠাৎ যেন একটা আগুনের গোলা দাউ দাউ করে জ্বলে এলোমেলোভাবে ছুটোছুটি করে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ওটা আলেয়ার আলো বলেই সবাই জানে। আর তা ভূতের কাণ্ড না হয়ে যায় না – এই ছিল অনেকের মত। যাঁরা ভূত মানেন না তাঁরাও বোঝাতে পারছিলেন না কেন ঐ আলো। তখন একজন বলেন, তর্ক না করে গ্রামের দক্ষিণে পাঁচীর মায়ের পোড়ো ভিটেতে গেলেই বুঝতে পারবেন ভূত আছে কিনা। সেখানে কেউ থাকে না অথচ রাতের অন্ধকারে ভিটেতে আলো জ্বালে কে? গোপাল বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী কিছুই নন, শুধু কারণ জানতে আগ্রহী। তাই তিনি জানালেন দু’এক জন সঙ্গী পেলে এক রাতে পাঁচীর মায়ের ভিটেতে যাবেন। কয়েকদিন ধরে বুঝিয়ে অনেক চেষ্টায় দু’জনকে পাঁচীর মায়ের ভিটেতে যেতে রাজী করালেন।
সেদিন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। অনবরত টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। ছাতা, লণ্ঠন নিয়ে তিনজন ঝোপঝাড় জঙ্গলে ঘেরা কাদা মাখা পিছল পথ দিয়ে পাঁচীর মায়ের পোড়ো ভিটেতে পৌঁছালেন। চারদিকের বড় বড় গাছের ছায়ায় মেঘলা রাতের অন্ধকার যেন জমাট বেঁধে রয়েছে। জন মানুষ নেই। খুব দূরে দু’একখানা ঘর দেখা যায়। চারপাশে শুধু ব্যাঙের ডাক আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ। কেমন যেন একটা গা ছমছমে ভাব। একটা ঝোপের আড়াল থেকে দেখলেন সেই জমাট বাঁধা অন্ধকারের মধ্যে যেন একটা অস্পষ্ট আলোর রেখা। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে একটু এগিয়ে দেখলেন বেশ স্পষ্ট ও উজ্জ্বল আলো। একজন সঙ্গী সাহস রাখতে না পেরে চলে গেলেন। ইতিমধ্যে ঐ আলোটা যেন হঠাৎ নিভে গিয়ে আবার দপ্ করে জ্বলে উঠলো। এরকম ক্রমাগত হতে দেখে গোপালের একমাত্র সঙ্গী দাঁড়িয়ে পড়ে ফিরে যাওয়ার জন্য বলতে লাগলেন। কিন্তু গোপালের মনে হল ভূত নয়, অন্য কিছু ব্যাপার হবে। তাই সাহস করে একাই পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন।”
নির্মল স্যার আবার থামলেন। ছাত্রছাত্রীদের উৎকণ্ঠিত মুখগুলি দেখলেন। শনিবারে পঞ্চম শ্রেণীর শেষ ক্লাস। নির্মলবাবু ওদের পড়ান ‘আমাদের পরিবেশ’। তাঁর মনে হয়েছে এই বিষয়টি কেবল ক্লাস ঘরে বসে বই খুলে পড়ানো সঠিক নয়। তাই ইচ্ছা করেই ওদের এই শেষ ক্লাসটি রুটিনে নিয়েছেন। এখন পড়ানোর কথা প্রথম পর্যায়ক্রমে ‘ভৌত পরিবেশ’ এককের শেষ ধারণা ‘জীববৈচিত্র্য’। এর আগে ভৌত পরিবেশে ‘মাটি’ পড়াতে গিয়ে ওদের দিয়ে হাতে কলমে মাটির উপাদান পরীক্ষা করিয়েছেন। উপএকক ‘স্থানীয় জলাশয়’ পড়াতে গিয়ে ক্লাসে না বসিয়ে ওদের নিয়ে গ্রাম ঘেঁষা এই আধা শহর এলাকার জলাশয়গুলির বৈশিষ্ট্য বোঝাতে বেরিয়ে পড়েছিলেন। তারপর যার যার বাসায় পৌঁছে দিয়ে ঘরে ফিরেছিলেন। আজ দুপুরে বৃষ্টি শুরু হলে ছেলেমেয়েরা বায়না ধরেছিল গল্পের ক্লাস হবে। সমস্বরে বলেছিল, “ভূতের গল্প”। অতঃপর গোপালের গল্পের অবতারণা। নির্মলবাবু আর একবার তাকালেন ওদের দিকে। অধীর মুখগুলির মধ্যে থেকে মিঠু বলে উঠল, “তারপর”?
“তারপর গোপালচন্দ্র সঙ্গীর অনুরোধ উপেক্ষা করে আরও খানিকটা এগিয়ে দেখলেন কাঠকয়লা পুড়ে যেরকম গনগনে আগুনের আলো হয় সেইরকম আলো। কিন্তু কোনও শিখা নেই, তেজ নেই, কেমন যেন স্নিগ্ধ নীলাভ আলো। অথচ সেই আলোতে আশপাশের ঘাস পাতাগুলি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। একটা গাছের কাটা গুঁড়ি থেকে এই আলো আসছে। মনে হল গোটা গুঁড়িটাই যেন জ্বলছে। গুঁড়িটার সামনে একটা বড় কচুগাছ। তার পাতা হাওয়ায় আন্দোলিত হয়ে ওপর নীচে ওঠা নামা করে গুঁড়িটাকে মাঝে মাঝে আড়াল করছে। বোঝা গেল এই হল আলো জ্বলতে নিভতে দেখার কারণ। এবার গোপালচন্দ্র গুঁড়িটা থেকে কয়েকটা কাঠের টুকরো ভেঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এলেন।”
সুবল জিজ্ঞাসা করে, “আগের দিনের আলোটা তবে কী ছিল স্যার?” স্বপ্না ধমক দেয়, “থামতো, স্যার পরে বলবেন।” মিঠু আবার বলে, “ও স্যার, বলুন না তারপরে কী হল? কাঠের টুকরোগুলো নিয়ে কী করলেন?”
নির্মলবাবু আবার বলতে শুরু করলেন;- “গোপালচন্দ্র টুকরোগুলো বাড়িতে এনে রাখলেন। ওগুলো সারারাত নীলাভ আলো দিল। কিন্তু দিনের বেলা কোনও আলো নেই। দু’দিন পরে রাতেও আর আলো পাওয়া গেল না। এর কয়েকদিন বাদে গোপালচন্দ্র একটা বড় পুকুর পাড়ে রাতের বেলা ঐরকম অসংখ্য নীলাভ আলোর বিন্দু দেখতে পেলেন। দূর থেকে জোনাকি মনে হলেও কাছে গিয়ে দেখলেন তা নয়, আলোকবিন্দুগুলি স্থির। কতগুলি লতাগাছের গোড়া থেকে এইরকম আলো আসছে। কিছু লতাপাতা তুলে বাড়িতে এনে বাতির নিচে রেখে দেখলেন আলো নেই। ফের ঘর অন্ধকার করতেই আলো দেখা গেল। কিন্তু পরদিন রাতে আর আলো পাওয়া গেল না। লক্ষ করে দেখলেন লতাপাতাগুলি শুকনো হয়ে গেছে। তখন জল ছিটিয়ে দেখা গেল দশ পনের মিনিট পরে আবার আলো দিতে শুরু করেছে এবং আরও কিছুদিন তারা আলো দিল। এরপর তিনি রাতের দিকে জলা জঙ্গলে খুঁজে বেড়াতে লাগলেন কী কী গাছ থেকে এইরকম আলো পাওয়া যায়। আর সেইসব গাছ এনে ভাল করে পরীক্ষা করে তাই নিয়ে সেই সময়ের বিখ্যাত মাসিক পত্রিকা ‘প্রবাসী’তে একটি লেখা পাঠালেন। সেই লেখা পড়ে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু তাঁকে ডেকে পাঠান।”
সুবল আবার বলে, “স্যার…”। নির্মলবাবু বলেন, “হ্যাঁ সুবল, প্রথম দিনে দেখা আলেয়ার আলো হল জলার মধ্যে গাছপাতা পচে তৈরি হওয়া একধরণের গ্যাস যা বুদ্বুদ হয়ে উঠে এলে বাতাসে লেগে জ্বলে ওঠে। গাছের আলো অন্যরকম।” মিতা জানতে চায়, “জগদীশচন্দ্র কী ওনাকে বকে দিলেন?”
নির্মলবাবুর উত্তর, “না, জগদীশচন্দ্রের পরামর্শে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বসু বিজ্ঞান মন্দিরে গোপালচন্দ্র গবেষণার কাজে যোগ দিলেন। কলেজে পড়ার সময়ে কীভাবে বিজ্ঞানের পরীক্ষা নিরীক্ষা হয় তা শিখেছিলেন। এখানে বিজ্ঞানের গবেষণা কীভাবে হয় তা শিখতে লাগলেন। আর কোনও গাছ কীভাবে আলো দেয় তারও পরীক্ষা শুরু করলেন। এর আগে ঐ আলো দেওয়া কাঠের টুকরোর কয়েকটা বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়েছিলেন। সেখানে সেগুলি পুড়িয়ে উপাদান পরীক্ষা করে কিছুই পাওয়া যায়নি। বসু বিজ্ঞান মন্দিরে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে আলো দেওয়া লতাপাতা রেখে গোপালচন্দ্র দেখলেন তাদের ভিতরে অসংখ্য সরু সরু সুতোর মত জিনিস রয়েছে। এগুলি আসলে এক ধরনের ছত্রাকের সুতো, যা দিয়ে তারা বংশ বিস্তার করে। এগুলো জল পেলে ঐরকম ঠাণ্ডা নীলাভ আলো দেয়। একবার কোলকাতার একটা গলিতে আবর্জনায় পড়ে থাকা চিংড়ির খোসার মধ্যে আলো দেখে তুলে এনে জীবাণু চিহ্নিত করেছিলেন।”
স্বপ্না জিজ্ঞাসা করে, “স্যার, উনি যে রাত্তির বেলা জলা জঙ্গলে আলো দেওয়া গাছ খুঁজতেন, ভয় করতো না?” নির্মলবাবু বললেন, “গোপালচন্দ্র ছোটবেলা থেকেই ঐরকম। কোনও অজানা বিষয়ে কৌতূহল হলে শেষ না দেখে ছাড়তেন না। ছোট ছোট জিনিসেও কৌতূহল ছিল ওনার। পিঁপড়ে, মাকড়সা, ফড়িং, প্রজাপতি, সব পোকামাকড় নিয়ে ছিল তাঁর দারুণ কৌতূহল। বইও লিখেছেন এদের নিয়ে। প্রকৃতির সবকিছু খেয়াল করতেন, খুঁটিয়ে দেখতেন। ওনার আরও গল্প পরে বলব।”
এবার তপন আবদার করে, “স্যার, আমাদের ঐরকম আলো দেওয়া গাছ দেখাবেন?” নির্মলবাবু বিব্রত হয়ে বলেন, “কোথায় পাবো রে। সেরকম জলা জঙ্গল এখানে কোথাও আছে নাকি। তবে ছবি দেখাতে পারি। মহারাষ্ট্রের ভীমশঙ্কর সংরক্ষিত বনের সব গাছপালা বর্ষাকালে এইরকম আলো দেয়।” এই বলে মোবাইল খুলে নির্মলবাবু ওদের একে একে ছবি ও ভিডিও দেখালেন। অবাক বিস্ময়ে তারা বলে উঠল, “ইস্, যদি যাওয়া যেত!” নির্মলবাবু বললেন, “বড় হয়ে যাবি। বৃষ্টি ধরেছে, এখন সবাই বাড়ি চল।” তারপর দারোয়ানকে স্কুলে তালা দিতে বলে সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
পাঠপ্রতিক্রিয়া
মলয় সরকার
জ্বলদর্চি ছোটবেলা ১৭৯ পড়ে যেমন লাগল-
ভীষণ আহত যেমন হয়েছিলাম, মৌসুমীর পরিচালনায় অত সুন্দর পত্রিকা জ্বলদর্চি ছোটবেলা বন্ধ হয়ে যেতে, তার থেকেও খুশী হলাম এর পুনঃপ্রকাশ দেখে।
একটা কথা মনে পড়ল, যে সমস্ত গাছ বা প্রাণী একটু দীর্ঘ সুপ্তির জগতে প্রবেশ করে, তারা যখন পুনর্জাগরণের অবস্থায় আসে, তাদের মধ্যে নতুন এক প্রাণের উন্মাদনা বা প্রাণশক্তির চঞ্চলতা দেখা যায়। আমরা সেই আশায় রইলাম এটির ক্ষেত্রেও।
এবার আসি পত্রিকার কথায়। প্রচ্ছদের ব্যাপারে,বুতে গেলে বলতে হয়, শ্রী ঋপণ আর্য, এই পত্রিকার মর্মবাণীর অভ্যন্তরে পৌঁছে গেছেন।তাই সৃষ্টি হয় এমন প্রচ্ছদ। মনে পড়ে যায় নিজের গ্রামে কাটানো ছেলেবেলার দিনগুলোর কথা। আজ এই জীবনের শেষ দিকে এসে কখন যেন হারিয়ে যাই সেই দিনগুলোতে–
পত্রিকার ভিতরে ঢুকতেই, প্রথমেই মৌসুমীর লেখায় চোখ পড়তেই ভেসে ওঠে ওর হাসি হাসি গল্পবলা মুখ। ঠিক সেই ছেলেবেলার ঠাকুমা- দিদিমার মত একরাশ গল্পের ঝুলি নিয়ে যেন বসে ডাকছে সবাইকে, আয় আয়, গল্প শুনবি আয়–
আরণ্যক এক অদ্ভুত মনকাড়া দৃশ্য এঁকেছেন কবিতায়।’ সব রয়েছে মা শুধু নেই, চিরুণিতে মা'র চুল’'- এই একটা লাইনই মনটাকে ধূসর করে তোলে।যদিও তার পরে মনে আনন্দ দিতে চেয়েছেন, মাতৃহারার দুঃখ ভুলিয়ে, তবুও চোখের কোণে জল টলটল করতেই থাকে।
শতদ্রু মজুমদারের গল্প মোটামুটি ঠিকঠাক তবে রাজর্ষি শীতের ছবি, সব দিক তাকিয়ে বেশ ভালই এঁকেছে।
আরিয়া মুখার্জি গল্পটা লিখেছে নিজের মনে রাঙিয়ে, বেশ বোঝা যাচ্ছে। ভালই বেশ।
চন্দ্রনাথ শেঠের ‘উবু দশ’ ভালই লাগল।
তানিয়ার গল্পটি অনেকেরই জানা তবু এসব গল্প শুধু ছোটদের নয়, বড়দেরও উৎসাহ দেয়। তবে, লেখাটির বানানের প্রতি আরও যত্নবান হওয়া উচিত ছিল।ছোটদের সামনে সাধ্যমত ভুল বানান উপস্থাপনা ঠিক নয়। সারাজীবন তো ওরা চতুর্দিকে ভুল বানানের ভিড়েই থাকবে। তাই ছোটবেলা থেকে যদি ঠিক-ভুলের বোধটা ঠিকভাবে তৈরী হয়, অন্ততঃ ভাষা- বেচারী এত অশুদ্ধতার ক্ষত থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে।
নয়ন বসুর গল্পে কিছুটা ধোঁয়া ধোঁয়া লাগল। কাজেই খুব ভাল লেগেছে এটা বলতে পারব না।
তবে সব মিলিয়ে পত্রিকাটির পুনর্জীবন আমাকে একটা নতুন জীবনের আনন্দ দিয়েছে, যদিও পরবর্তী সংখ্যার জন্য এখন থেকে একসপ্তাহ নয়, একমা-স সময় অপেক্ষা করতে হবে।
তবুও–
0 Comments