জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় ছাপ্পান্নতম পর্ব /আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় 
ছাপ্পান্নতম পর্ব

আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী 


এদিকে মাঘ শেষ হয়ে ফাল্গুন পড়ে গেল। হু হু হাওয়া বওয়ার কাল। দিন বড়ো হচ্ছে,দুপুরের আড়ষ্টতায় আলসেমির রেশ।
ঘরে ঘরে বড়ি দেওয়ার তাড়া,ধান কাটার পরে ঠা ঠা মাঠে বোনা খেসারী আর ছোলাকলাইয়েও শুঁটি ধরেছে বেশ।নতুন গুড় আর ক্ষেত থেকে সদ্য ছেঁড়া এই টাটকা কলাই দিয়ে মুড়ি খাওয়া এসময়ে গাঁয়ের মানুষের আদরের বিলাসিতা। মেয়েগুলোর সব বিয়ে হয়ে গেছে তাই,নাহলে এসময়…
খানিক মৃদু হাসি খেলে গেল বিরজার মুখে। ইদানিং দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়ার পরে খোকাকে নিয়ে শুয়ে থাকেন বিরজা,মুখে দোক্তা পানের খিলি। সারাজীবন কোন নেশা না থাকলেও আজকাল ভাত খাওয়ার পরে নতুন বৌমার সেজে দেওয়া একখানি পান খেতে তাঁর মন্দ লাগে না।
দিন কয়েক হলো, বাচ্চাটার গায়ে হালকা হালকা জ্বর, সারাদিন কান্নাকাটি করছে,খাওয়ায় রুচি নেই, ঋতু বদলের সময় বাচ্চা কাচ্চাদের যেমন হয়, তেমনই…
আজ সকালে বৌমাকে ওর জন্য লাল বাসক পাতা,ধনন্বরী ও তুলসীপাতার সঙ্গে,যষ্টিমধু ও শুকনো আদা ছেঁচে,সুঁট-পিপুল মিশিয়ে নতুন মাটির হাঁড়িতে সেদ্ধ করে পাঁচন বানাতে শিখিয়েছেন,মধু দিয়ে মেড়ে তা খাইয়েওছেন।
বাইরের ওষুধ পাতি তো আছেই,তবে এই সব দেশীয় ভেষজ যে কতোখানি উপকারী এবং শরীরের পক্ষে হিতকর,তা আজকালকার মানুষেরা জানেই না। ভাগ্যিস এখনও তাঁর কথা এবাড়ির সবাই শোনে…

ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও হঠাৎ কেঁদে উঠলো খোকা।
পিঠে হাতের চাপড় দিয়েও ঘুম পাড়াতে না পেরে,উঠে বসে কোলে নিলেন তাকে, এই ভ’র দুপুরবেলা…ওর মা যে কোথায় গেল!

🍂

এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দোলন দিতে লাগলেন ধীরে। আবার ঘুমিয়ে পড়লো মুখে হাত পুরে। ঘুমন্ত খোকার দিকে তাকিয়ে মনে পড়লো ওর বাবার কথা।ওর বাবাও তো এমন করেই ঘুমোতো।
সে কি আর আজকের কথা!আজ থেকে হয়তো ত্রিশ বছর আগের কথা হবে।
তখন বিরজারও ছিল নবীন বয়স,গায়ে অসুরের শক্তি।রোগাভোগা ছোটবৌদিদির পরপর দুটি পুত্র সন্তান জন্মের পরে বড়ো কাহিল অবস্থা। একবার ছোটটি পড়লো বিষম জ্বরে। ডাক্তার বদ্যি করতে জেরবার হয়ে পড়লো তার মা,অপেক্ষাকৃত বড়োটির দিকে তাকাবার সময় তার তখন ছিল না।
যৌথ পরিবার,মেজবৌদিদির কল্যাণে ঘরভর্তি মেয়ের মাঝে ছেলে দুটি তখন যেন সবার নয়নের মনি।একটু বড়ো হয়ে ওঠা দিদিরাই আগলাতো ভাইকে, সারাদিন কোলে কাঁখে। সারাদিনের অনেক কাজের মাঝেও তিনি কেবল সময়মতো খাওয়াতেন তাকে,ভাত খেতে চাইতো না তেমন,দুধের সঙ্গে সাবু,কখনো মুড়িগুঁড়ো অথবা বিস্কুট।রাতে কোলের কাছে নিয়ে শুতেন,গল্প বলে বলে ঘুম পাড়াতেন। দুবছরের ছেলে ঘুমের ঘোরে আঁকড়ে ধরতো তাঁকে,সন্তান পিয়াসী যুবতীর বুক ভরে উঠতো প্রাপ্তির দাক্ষিণ্যে।পরে পরে,ছোটটি সুস্থ হলে, তার মা মাঝে মাঝে কাছে ডাকতো যখন তাকে,বাচ্চাটি যেতেই চাইতো না।এমন কি,কোথাও বেড়াতে গেলেও পিসিমার সঙ্গই সে বেশি পছন্দ করতো।তা সে সারা রাত জেগে যাত্রা দেখতে যাওয়া বা তীর্থ করতে যাওয়া,যাই হোক।
তাঁরও এক অদ্ভুত অধিকারবোধ তৈরি হয়েছিল তাকে ঘিরে।তার খাওয়া,তার জামাকাপড়, পড়াশোনা সবই ছিল পিসিমা নির্ভর।
এমনকি,বড়ো হয়ে বিয়ে দেওয়ার পরেও তার বৌটিকে নিজের পুত্রবধুই ভাবেন,বড়ো খামখেয়ালি ছেলেমানুষ মেয়েটি!
তাকে ধীরে ধীরে এ বাড়ির উপযুক্ত করে তোলার দায়িত্বও যেন নিয়েছেন বেলাশেষে।
এসে থেকেই বড়ো আদরকাড়া বাপ-মরা মেয়েটা;বড়ো সরল।মনে তত মারপ্যাঁচ নেই।তার ওপর যেদিন থেকে ঐ রূপোর ঝিনুক পেয়েছে বললো,কি যেন এক বাড়তি মায়া জমা হয়েছে ওর জন্য।ও না জানুক, তিনি তো জানেন,ঐ ঝিনুক কার!কি তার ইতিহাস!...
নাঃ! আর দেরি করে কাজ নেই,আজ সন্ধ্যেতেই ওকে সব বুঝিয়ে দিতে হবে,ভেবে খোকাকে শুইয়ে এগিয়ে গেলেন ঘরের অন্যপ্রান্তে সাজিয়ে রাখা ট্রাঙ্কগুলির দিকে। সেখানেই তো গচ্ছিত আছে তাঁর সারাজীবনের জমিয়ে রাখা সব সম্পদ।দিয়ে যেতে হবে তো !...
 জীবন যে কখন কি খেলা খেলে কার সঙ্গে,কার চাল কতোদিন কোন ঘরে মাপা থাকে,কে জানে…
ভাবতে ভাবতেই খোকাকে বিছানায় শুইয়ে জানলার ধারের ট্রাঙ্ক গুলির কাছে পৌঁছলেন বিরজা। বৌদিদিদের পুরনো শাড়ির পাড় সাজিয়ে পরপর সেলাই করে ঢাকনা বানিয়েছিলেন কবেই, মাঝেমধ্যেই কাচাকুচি,ঝাড়াঝাড়ির জন্য তখনও বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে সেগুলি।তা নাহলে, কবেকার সব জিনিস।

কি যেন এক অসীম মায়ায় পুরনো সব বাক্সগুলিতে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে, শেষে ডালা খুললেন একটির।
একঝলক স্মৃতি যেন ন্যাপথলিনের গন্ধ বয়ে নাকে লাগলো তাঁর।
পরপর সাজানো শাড়ি,শাল,চাদর,শায়া-ব্লাউজের নীচে টুকিটাকি কতো কি!
একেবারে নীচে পুরনো গামছা জড়ানো ফেঁসে যাওয়া বেনারসীটি, মাত্র একবারই পরার সৌভাগ্য হয়েছিল যেটি।
কলকাতায়,বাবা ঠাকুরের সঙ্গে আলাপ করতে এসেছিলেন তাঁদের ছেলের মাষ্টারমশাই, তিনি নাকি খুব বিখ্যাত মানুষ;প্রমথনাথ বিশী।
ভেতর ঘরে ডাকা হয়েছিল তাঁকে,লুচি-পায়েস খাওয়ার নেমন্তন্ন।
তিনিই বৌমার মুখ দেখে আগুন রঙের শাড়িখানি দিয়েছিলেন,বেনারস থেকে আনানো,প্রিয় ছাত্রের নববধূর জন্য।শাশুড়ির নির্দেশে সেইটি পরে,যখন লুচির থালা নামিয়ে তাঁকে প্রণাম করতে গিয়েছিল বিরজা, চামড়া বাঁধাই করা সোনার জলে নাম লেখা গীতাঞ্জলি তার হাতে ধরিয়ে তিনি আশীর্বাদ করেছিলেন,
’এটিকে জীবনে ধারন করো’।
ঠিক মনে নেই, আরও কেউ পাশে ছিল কি! মুগ্ধ চোখে আপন বধূকে দেখেছিল কি!
মনে নেই, কিচ্ছু মনে নেই। শুধু মনে আছে,বড়ো বৌমা যখন প্রথমবার মা হয়, বংশের প্রথম সন্তান হিরন্ময়ীকে মুখ দেখে দিয়েছিলেন অনেক অনেক অলস প্রহরে বুকে জড়িয়ে রাখা সেই আশ্রয়ধনটি,বড়ো খোকা বড্ডো খুশি হয়েছিল, আজও ওর বিয়ের আলমারীতে সযত্নে তোলা আছে সেটি, দেখেছেন এইটুকু মনে আছে তাঁর।
আজকাল বড়ো স্মৃতি বিভ্রম হচ্ছে…একাল-ওকালের কথা গুলিয়ে ফেলছেন যেন…(ক্রমশঃ)

Post a Comment

1 Comments

  1. আহা কি মায়াময়!

    ReplyDelete