জ্বলদর্চি

অমৃত কুম্ভের সন্ধানে (পরিচালনা ---দিলীপ রায়)/তনুশ্রী ভট্টাচার্য

চলচ্চিত্র পর্ব ---৩
অমৃত কুম্ভের সন্ধানে

পরিচালনা -দিলীপ রায়


তনুশ্রী ভট্টাচার্য 

বর্তমান ২০২৫ সালের  মহাকুম্ভমেলার প্রেক্ষাপটে ফিরে দেখতে ইচ্ছে হয় ১৯৮২সালে তৈরী 'কালকূট' সমরেশ বসুর  কালজয়ী উপন্যাস 'অমৃতকুম্ভের সন্ধানে' র চলচ্চিত্রায়ণ ,ঐ একই নামে।উপন্যাস টি লেখা হয়েছিল আরো আগে ১৯৫৩ সালে। কালকূট ছদ্মনামে তিনি ধারাবাহিক লিখেছিলেন দেশ পত্রিকায় এবং সেটি  তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। পরে অভিনেত্রী সংঘ প্রযোজিত দিলীপ রায় পরিচালিত সিনেমাটিও অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। বস্তুত সিনেমাটি  মেলায় স্নানেচ্ছু  মানুষের একটি ধারাবিবরণী যেখানে বিবিধ   জীবনদর্শন  বিভিন্ন আঙ্গিকে  ধরা আছে।  কুম্ভযোগে গঙ্গাযমুনা সরস্বতীর সঙ্গমে  প্রয়াগ বা এলাহাবাদ গিয়ে স্নান করে সব পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া বা পুণ্য অর্জন করার যে বিশ্বাস ভারতবাসী বা বিশেষ করে বাঙালী এবং বিহার উত্তরপ্রদেশের মানুষের মনের মধ্যে প্রোথিত আছে তারই একটি বর্ণময় সেলুলয়েড উপস্থাপনা।  কলকাতার একজন সাংবাদিক চলেছেন কুম্ভস্নানের ওপর রিপোর্ট  লিখতে‌ সে অর্থে স্নান বা মোক্ষলাভের ঊদ্দেশে নয় । হাওড়া স্টেশন থেকে এলাহাবাদ যাওয়া পর্যন্ত বিচিত্র মানুষের সঙ্গে তার তাৎক্ষণিক পরিচয় এবং সেই পরিচয়ের একটা একটা আলাদা আলাদা  তাৎপর্য তার এই রিপোর্টারের পেশাকে  সমৃদ্ধ করছে । তিনি বলছেন মানুষকে জানতে আর নিজেকে চিনতে তিনি কুম্ভমেলায় যাচ্ছেন।এই যাত্রাপথের সব অচেনা মানুষ কেমন যেন অল্প ক্ষণ আর অল্প কথাবার্তায় তাঁর কাছে তাদের মনের কথা, মনের ব্যথা, ব্যর্থতা,ইচ্ছা, আকাঙ্খা সমস্যা অকপটে বলে চলেছে। তিনিও তাদের সেই যাত্রার মানসিক সঙ্গী হয়ে উঠছেন, ভরসাস্থল হয়ে উঠছেন ।তিনি তখন  আর কেবল নিছক সাংবাদিক নয় তিনি একজন দার্শনিক। কালকুটের উপন্যাস আধারিত চিত্রনাট্যটি মূলানুগ। সেই সঙ্গমেই শ্যুটিং হয়তো। কারণ বর্তমান  কুম্ভমেলায় ভ্রমণকারী প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে ঐ জায়গা সঙ্গমস্থল তাঁবু  বা দ্বারগুলো  বুঝতে পারছি এবং  সিনেমায় দেখানো ঐ স্থান গুলো আজো  অটুট। সেই কেল্লা যা মোঘল স্থাপত্যের নিদর্শন বহন করে চলেছে। আজো।

আর ঘটনার মিল আজো একই। চলচিত্রটি শেষ হচ্ছে সেই মর্মান্তিক পদপিষ্ট  দুর্ঘটনা দিয়ে  যা এই  ২০২৫ সালের মহাকুম্ভমেলায় প্রথম পর্বেই ঘটে গেছে।পুন্যলোভী মানুষ গুলো এসেছিল পুন্যের আশায় মোক্ষলাভের আশায় কেউ বা ফিরল বাড়ি আহত হয়ে, কেউ কেউ আর ফিরলই না।  এক বৃদ্ধের তিন স্ত্রী এসেছিল সধবা, ফিরে যাচ্ছে বৈধব্যের চিহ্ন নিয়ে। তবে বাহ্যিক  বিপর্যয়ের পাশে পাশে জীবনের আকুতি ,জীবনকে ভালোবাসা ,সেই  অদৃশ্য শক্তির প্রতি নিবেদন , আঁধারের পথ থেকে আলো দেখতে চাওয়ার প্রার্থনা---  চুম্বকের মতো টেনে রাখে --কারণ এটাই ত জীবনের কাছে জীবনের চাওয়া। এক বধূ যখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে  নিজেকে বিক্রি করে পয়সা উপায় করতে চায় বা চুরি করে তখন ঘৃণা হলেও পরে যখন জানা যায় সে তার বৃদ্ধ শ্বশুরমশাইয়ের ভরণপোষণ করতে এটা করতে বাধ্য হচ্ছে তখন জীবনের বিষাদ আর মায়া একাকার হয়ে যায়। এক পিতা চলেছে কন্যাকে খুঁজতে,এক স্ত্রী  খুঁজতে বেরিয়েছে তার হয়তো সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়া স্বামীকে, এক জোয়ান ছেলে যাচ্ছে কুম্ভস্নানের পুন্যে তার কারখানার লকআউট  উঠে যাবে--এই আশায়, একজনের অর্শ সেরে যাবে সেই বিশ্বাসে, একজন তার  জ্ঞানত কৃত  পাপ ধুতে ---এরই নাম অমৃতের সন্ধান। এসবেরপাশেই অন্ত:সলিলা সরস্বতী নদীর অদৃশ্য প্রবাহের মতো বয়ে চলেছে আশিবছরের বৃদ্ধের তরুণী ভার্যা র মন। কোনো এক ক্ষণিকের   চেতনায় সে এই সুদর্শন  বাঙালী যুবক  সাংবাদিকের   কাছে জানতে চায় তাকে সে মনে রাখবে কি না  এবং একটি সুগন্ধী আগরবাতি তার হাতে তুলে দেয়। সিনেমার ভাষায় একটি পার্ফেক্ট মন্তাজ দৃশ্যটি কারণ পরের দৃশ্যেই এক   অন্ধ মুসলিম  মানুষ সেই সুগন্ধের দ্বারাই তাকে বাঙালী বলে চিনে নেয় কারণ তার স্ত্রী ও বাঙালী এবং ঐ ধূপের সুগন্ধ তার পরিচিত। অদ্ভুত সমাপতন। আর এখানেই  গাঝাড়া দিয়ে উঠে বসে বলতে হয় --এরই নাম ভারতবর্ষ --+ভাইসব। হাঁক দিয়ে বলতে হয় ----হে পৃথিবী-- চিনে রাখো এই ভারতবর্ষকে।এখানের মানুষ জীবনকে ভালোবাসে --জীবন বিহীন ধর্মকে নয়। এখানেই রচিত হয় জীবনের প্যানোরামা।     এখানে যেমন বলরাম,  লক্ষীদাসীর   মতো চরিত্র আছে, আছে মধুসূদন দত্তের কবিতা মুখস্থ রাখা এক প্রবাসী বাঙালী হোটেল ম্যানেজার, আছে সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসিনী হতে চাওয়া এক গৃহবধূ---সবাই কিছু খুঁজছে, কিছু খুঁজতে এসেছে এই কুম্ভমেলায় প্রয়াগপ্রান্তে। সেইসময়ের অসম্ভব আদৃত প্রবাদপ্রতিম  আনন্দময়ী মাকেও দেখানো হয়েছে।, 

অমৃত কুম্ভের সন্ধানে ----সাংবাদিক খুঁজতে এসেছিলেন ভারতের হৃদয়। অসংখ্য মানুষের মধ্যে   তাই তার কুম্ভ পূর্ণ হয়েছে  বিচিত্র মানুষের সংস্পর্শে। কিন্তু সত্যিই যারা অমৃতের সন্ধানে স্নান করতে এসেছিলেন তাদের সবার অমৃতের সন্ধান পাওয়া হলো কি? সঙ্গমের জলে যখন বেওয়ারিশ মৃতদেহ কুকুরের খাদ্য হচ্ছে তখন কোনটা অমৃত আর কোনটা কালকূট গরল ---কে তার উত্তর দেবে? 
তবে উত্তর ত চাই না আমরা ---উত্তর খোঁজাই ত জীবনের ধর্ম। জীবন ত এক খোঁজ ---সেই খোঁজে অমৃতের সন্ধান পেতে পারেন অথবা গরলের সন্ধানও পাওয়া যেতে পারে। সেই খোঁজার  তাগিদ টাই ত  অমৃতসমান।

অসাধারণ ফটোগ্রাফি এবং ক্যামেরার  কুশলতা  আউটডোর শ্যুটিং, নাগা সাধুদের মিছিল ঘোড়া বা উটের ওপর চেপে সাধুদের স্নানে যাওয়ার দৃশ্য,   অভিনয় ,প্লট ---সব মিলিয়ে একটা পিরিয়ড পিস এই 'অমৃত কুম্ভের সন্ধানে' সিনেমাটি। N.F.D.C. কৃত সাবটাইটেল ---In Quest of The Jar of  Nectar. ২০২৫ এ  মহাকুম্ভের এই যোগে ফিরে দেখা যেতেই পারে এই কালজয়ী উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ।

🍂

Post a Comment

0 Comments