সুপ্রিয়া মুর্মু
ঝুমুর বা ঝুমার হল ছোট নাগপুর মালভূমিতে প্রচলিত লোকসঙ্গীতের একটি রুপ যা মূলত ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং ওড়িশার উওরাঞ্চলে।
ঝুমুর নাচ পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর, বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া জেলাসহ বিভিন্ন জেলায় দেখা যায়। ঝুমুর গান ও নাচ একসঙ্গে পরিবেশিত হয়। ঝুমুর গান প্রাচীন ধারার লোকসঙ্গীত। আদিতে এটি আদিবাসীদের গান ছিল, বিশেষ করে সাঁওতালদের।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তী সময়টিকে ধরা হচ্ছে ঝুমুরের আধুনিক যুগ হিসেবে। এই সময়ে দেশীয় রাজা ও জমিদাররা ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ায় এককালের জনপ্রিয় ঝুমুর শিল্পীরা পৃষ্ঠপোষকতা হারান। ফলে লৌকিক বা দরবারি ঝুমুর হিসেবে যা পরিচিত হয়েছিল মধ্যযুগে সেই নামটি কিন্তু সার্থকতা হারায়।
🍂
ঝুমুর গান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, পূর্ব মেদিনীপুর ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা, ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সাঁওতাল পরগনা , সিংভূম, রাঁচি, হাজারিবাগ, পালামৌ, গিরিডি, ধানবাদ ও বোকারো জেলা ও উড়িষ্যা রাজ্যের ময়ূরভঞ্জ, সুন্দরগড়, কেঁওনঝাড় ও সম্বলপুর জেলা ইত্যাদি এক বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রচলিত।
ঝুমুর গানের ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র হল মান্দার, ঢোল, নাগারা, বাঁসুরি। এই নৃত্যশৈলীতে মনোরঞ্জনকারীরা সারিবদ্ধভাবে হাত ধরে দাঁড়ায়, গান গায়,নাচ করে এবং গানের সাথে সাথে সময়মত লাফ দেয়, ডিগবাজী খায়।
ঝুমুর নৃত্য আসামের চা উপজাতি সম্প্রদায়ের একটি ঐতিহ্যবাহী নৃত্য। এছাড়াও ঝুমুর একটি লোকসঙ্গীতের রুপ। এটি সাধারণত শরৎ ঋতুতে অল্পবয়সী মেয়েদের দ্বারা সঞ্চালিত হয়, পুরুষ সঙ্গীতজ্ঞদের সাথে।
ঝুমুর গান ও নাচ বিখ্যাত কারণ এটি একটি প্রাচীন লোকসঙ্গীতের ধারা এবং এতে গান, নাচ, তাল ও গায়নশৈলী একসঙ্গে থাকে। বতর্মানে ঝুমুর অঞ্চল বলতে বোঝায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর, বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়খণ্ড রাজ্য, বিহারের মালভূম অঞ্চল। ঝুমুর গানের ব্যাপ্তি বিশাল।
দরকারি ঝুমুর গানের শিল্পী মিহিরলাল সিংহ দেও ১৯৩৯ সালে পুরুলিয়া জেলার কেন্দা থানার অন্তর্গত রাজানওয়াগর গ্রামে জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।তিনি ঝুমুর গান ও লোকসঙ্গীতের ধারায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। ২০১৮সালের ১৮ই জানুয়ারি রাজনওয়াগড়ের বাড়িতে ৭৭ বছর বয়সে বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১ টা নাগাদ তিনি মারা যান।
ঝুমুরকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু সুর ও তালের প্রচলন হয়েছিল যার মধ্যে অধিকাংশের অস্তিত্ব বর্তমানে নেই। তবে ডহরওয়া, পতরতুলা, বেঁগাড়ি, পাটিয়া মেধা, রিঁঝামাঠা, ঝুমরা, ঝুমটা, একডাঁড়িয়া, গোলোয়ারি, নাগপুরিয়া, তামাড়িয়া, শিখারিয়া, পাঁচপরগনিয়া, মুদিআরি প্রভৃতি সুরের অস্তিত্ব বর্তমানে রয়েছে। এখনও সাঁওতালদের মধ্যে এ গানের জনপ্রিয়তা রয়েছে। ঝুমুর গানের প্রেমভাব ও সুরের লালিত্যে বাংলার সাধারণ শ্রেনীর মানুষের মধ্যেও এটি বিস্তার লাভ করেছে।
0 Comments