বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৬০
পেঁপে
ভাস্করব্রত পতি
পেঁপে যেন অমৃতপূর্ণ তৃপ্তির ভাণ্ড, তাই এটি ক্ষীরগাত্রা এবং মহাফলা। পেঁপের সব গুণই অমৃতের মত। তাই তার নাম "অমৃতা"। সংস্কৃতে পাই --
'অমৃতং শিশিরে বহিঃ অমৃতং প্রিয় দর্শনম্।
অমৃতং রাজসম্মানং অমৃতং ক্ষীর ভোজনম্'॥
পেঁপের অন্য নাম 'অমৃততুম্বী'। এ প্রসঙ্গে আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য লিখেছেন, 'আমাদের সংস্কার আছে এই "অমৃত"টাই এসেছিলো স্বর্গ' থেকে, সেটা কুম্ভে ঢুকে কখনও হরিদ্বারে, কখনও প্রয়াগে ঘোরাফেরা ক'রছে, তারই সন্ধানে শত সহস্র সাধুসন্তেরও দর্শন আমরা পেয়ে থাকি। আবার ওটা যখন তুম্বে প্রবেশ ক'রে আমাদের কাছে প্রকাশমান, তখন তার বাহক ধারক রূপে এসেছিলেন অদিতির পুত্রেরা। আজ আমরা সেইটাই ভোগ ক'রছি। এই তুম্বের গর্ভে কত কি সম্পদ লুকিয়ে আছে সেটার সন্ধান তো চ'লেছে এবং তারও কিছু কিছু মিলেছে'।
পেঁপেকে সংস্কৃতে পপীতা, পপোতা, হিন্দিতে পেপিয়া, গুজরাটিতে পপায়ী, অসমীয়া ও ফার্সিতে অম্বালহিন্ডি, ক্যানারিজে পপ্যান গয়ে, তামিলে পপায়ী, মালয়লমে কম্পলম, তেলুগুতে ৰপৈয়া পড়ু, ওড়িয়াতে ভণ্ডা, অমৃতভণ্ডা, পাঞ্জাবীতে অরন্ড, খরগুজা, ইংরেজিতে Pop, Papaw, Pa-pend Tree বলা হয়। চট্টগ্রাম অঞ্চলে এটি "হঁইয়া" নামে পরিচিত। পেঁপেকে ইউনানী চিকিৎসার ভাষায় বলা হয় পাপিতা এবং আরানড খরবূযা। এছাড়াও আয়ুর্বেদিক ভাষায় বলা হয় অমৃততুম্বী। পেঁপে সম্পর্কে ভেষজকারদের বর্ণনায় মেলে --
'অমৃতা চামৃততুম্বীচ ক্ষীরগাতা মহাফলা।
শ্যামলা স্বর্ণকুম্ভা চ রসপত্রী মধুস্তনা।
ক্ষীরশক্তি বিলিঙ্গা চ নির্য্যাসঃ গর্ভঘাতকঃ
নলবৃন্ত-পতত্রাচ করপত্রাঙ্গগুলি সমা।
অপরু ফলনির্য্যাসঃ তিক্তঃ বীর্য্যে শীতো লঘুঃ।
উদর-ক্রিমি মেহাশো হাদরাধ্যান নাশকৃৎ।
পেঁপে কাঁচা অবস্থায় শ্যামবর্ণ, আবার পেকে গেলে স্বর্ণকুম্ভ। পেঁপের রস অন্যতম পাচকরস। তাই বলা হয় রসপত্রী। পেঁপের পেটের মধ্যে থাকে শত শত বীজ, তাই শতবীজা। পেঁপের ফল এবং গাছের কাণ্ডের রসের মধ্যে রয়েছে বীর্যশক্তি। তাই এর নাম ক্ষীরশক্তি। এই রস গর্ভপাত করতে পারে। পেঁপে পাতার বোঁটাগুলি ফাঁপা নলের মত, তাই তার নাম নলবৃন্তা। কান কটকট করলে বা কানে রস হলে এই পেঁপে ডাঁটার এক প্রান্ত কানের মধ্যে রেখে অন্য প্রান্তে প্রদীপের শিখার গরম উত্তাপ দেওয়া হয়।
পেঁপের বিজ্ঞানসম্মত নাম Carica papaya। এটি Caricaceae পরিবারের অন্তর্গত। এই পেঁপেকে কাঁচা অবস্থায় সবজি এবং পাকা অবস্থায় ফল হিসাবে খাওয়া হয়। নিউগিনি হল পেঁপের আদি বাসস্থান। ভারতের বুকে ১৬ শ শতাব্দীতে পর্তুগীজরা প্রথম আমদানি করেছিল বলে জানা যায়। পেঁপের কিছু উন্নত প্রজাতি হল -- Sunberry, Eco Berry Papaya, Iceberry F1 Hybrid Papaya, Greenberry F1 Hybrid Papaya, রেড লেডি ৭৮৬, পুসা বামন, পুসা ম্যাজেস্টি, কো ১, কো ৩, কো ৬, ব্লুস্টেম, ছোট পেঁপে, যশোরি,শাহী পেঁপে, রাচি, নউন ইউ, কাশিমপুরী, হানি ডিউ, কুর্গ মধু শিশির, সূর্যোদয় একক, ওয়াশিংটন সহ, পিঙ্ক ফ্লেশ মিষ্টি ইত্যাদি। মালচিং পদ্ধতিতে পেঁপে চাষ চলছে। এই পদ্ধতিতে পলিথিনের পরিবর্তে এক বিশেষ ধরনের কাগজের ব্যবহার করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে সচেষ্ট বিজ্ঞানীরা।
পেঁপের কাণ্ড এবং কাঁচা ফলে সাদা তরুক্ষীর থাকে। এই তরুক্ষীরে থাকে প্রচুর পরিমাণে হজমকারী এনজাইম প্যাপাইন। যা গ্রামবাংলায় বাতাসার সাথে খাওয়ানো হয়। এরফলে পেটের রোগ কমে। পাতায় থাকে অ্যালকালয়েড, গ্লুকোসাইড এবং ফলে থাকে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন। পেঁপের মধ্যে যেসব উপাদান পাওয়া যায়, সেগুলির মধ্যে রয়েছে নানা ধরনের ভিটামিন, যেমন -- vitamin A, thiamine, riboflavin, niacin and ascorbic acid। এছাড়াও পাওয়া যায় Sucrose, invert sugar, papain, malic acid, salts of tartaric and citric acids, a resinous substance এবং pectins। পেঁপে কাটলেই তার ভেতর থেকে সাদা দুধের মতো রস তরুক্ষীর বেরিয়ে আসে। এই বিষয় নিয়ে ফরিদপুরে শোনা যায় --
'গলা কাটলি ধলা রক্ত
ফল মনোহারী
এই কথা যে কইতে পারবে
বুদ্ধি বলিহারী'।
খুলনা এলাকায় এই বিষয় নিয়ে অন্যভাবে বলতে শোনা যায় --
'ধলা কাটলি ধলা রক্ত
রক্ত মনিহার
এই শ্লোকটা যে কতি পারবে
মালচিং পদ্ধতিতে পেঁপে চাষ
পেঁপে গাছের পাতার প্রান্তগুলি খাঁজকাটা হয়ে থাকে। আর পাতাগুলি গোলাকার হয়। যা গোল ছাতার মতো। পেঁপে পাতার আকৃতি অনেকটা ঠিক হাতের চেটোর মতো। সেখানে আঙ্গুলগুলো প্রসারিত করে রাখা হয়েছে। এ নিয়েই মেদিনীপুর এলাকার লোককবির ছড়ায় মেলে --
'চিরিক চিরিক পাতা
গোলমরিচের ছাতা
আমার বাড়ি যাতা
ঠাণ্ডা পানি খাতা'।
চট্টগ্রাম এলাকায় পেঁপে নিয়ে শোনা যায় --
'গাছ ছালুয়া পাতা চালুআ
পাকা পেঁপে
পাকা পেঁপের বীজগুলি কালো রঙের হয়। আর ভেতরটা লালরঙের হয়। পেঁপের এই বীজের মধ্যে রয়েছে carbohydrate 15.5% fatty oil 25.3%, Protein 24.3%, ash 8.8%, volatile oil 0.09%, a glycoside, caricin ও enzyme (myrosin)। এর বাইরে পাওয়া যায় unsaturated acids (oleic and linoleic), carpuae-mine and saturated acids (palmitic, stearic, arachidic)। কাঁচা পেঁপেকে যুবাকাল এবং পাকা পেঁপেকে বুড়াকালের সাথে তুলনা করে সিলেটের কবিদের ছড়ায় পাই --
'হাটিম টিম হাটিম টিম
ভিতরে তার কালো ডিম।
যুবত কালো কালো
বুড়া কালো শইল্লো (শরীর) লালা'।
সুনামগঞ্জের লোকেদের মুখে শোনা যায় --
'বারে কালা বীচি কালা
মাঝে কালা পাকলে লালা'।
পেঁপেকে কেন্দ্র করে কুমিল্লাতে পাই --
'উপরে কালা ভিতরে লাল
তাহার ভিতরে গুল্লির টান'।
পেঁপে খুব উপকারী ফল। বিভিন্ন রোগের উপশমে খুব প্রয়োজনীয় ফল। ক্রিমিরোগ, মাসিক ঋতু বন্ধ, প্রবল জ্বর, আমাশয়, রক্তার্শ, যকৃৎ বৃদ্ধি, পেট ফাঁপা, রসবহ স্রোতে খুব কার্যকরী পেঁপে। ডেঙ্গু রোগের উপশমে পেঁপে পাতার রস হল মহৌষধ। পে'পের ফল, পাতা ও বীজ থেকে Carpaine নামক একপ্রকার alkaloid পাওয়া যায়। এটিও মানব দেহের খুব উপকারী। আবৃত্তিতেও পেঁপেকে কাজে লাগাতে দেখা যায়। 'টাং টুইস্টারে' আবৃত্তিকাররা শেখায় 'পাখি পাকা পেঁপে পেড়ে পেড়ে খায়'। যা বেশ জনপ্রিয়।
🍂
1 Comments
সত্যি, আমি জানি পেঁপে পাতার রস আমার ছেলের জীবন বাঁচিয়েছে যখন একিউট ডেঙ্গু হয়েছিল।
ReplyDeleteজয় পেঁপের জয়!