জ্বলদর্চি

দীপ্তমানের রেডিও/ কমলিকা ভট্টাচার্য


দীপ্তমানের রেডিও 

কমলিকা ভট্টাচার্য


ঐ ঘটনার পর অনেকগুলো মাস কেটে গেছে। কালের নিয়মে সময় চারুর অভিমান ও অসহজতার ওপর কিছুটা হলেও প্রলেপ চাপিয়েছে। আর এদিকে রেডিও দীপ্তর মন থেকে অবচেতন মনের কালকুঠুরিতে অপূর্ণ বাসনার সাথে বন্দী হয়েছে। দীপ্ত চারুর ঘড়ি বন্দি জীবন টিকটিক করে চলছে ।

সেদিন হঠাৎ অফিস  বেরোনোর আগে চারু দেয়াল ঘড়িটার ঘণ্টার মতো বেজে উঠলো।

 "কাল সংক্রান্তি, ফেরার পথে দুটো নারকোল আর গুড় এনো।"

 আজ অনেকদিন পর চারুর গলায় আবদারের স্বর। দীপ্তর অমনোযোগী উদাসীন মন হতচকিত হয়ে ওঠার জন্য বেশ বড় ধাক্কা ।নিজেকে সামলে নিয়ে দীপ্ত কিছু বলার আগেই চারু বলে উঠলো "কাঞ্চন আর মিতালীকেও কাল ডেকেছি, অনেকদিন হয়ে গেল ওরাও তো আসেনি। "কাঞ্চন আর মিতালীর কথায় দীপ্তর হঠাৎ সজাগ হওয়া মনটা আবার গভীর গ্রীষ্মের দুপুরে দেওয়াল ঘড়ির ঘন্টার পর যেমন নিস্তব্ধতা চারদিকে গ্রাস করে সেই রকম নীরবতা দীপ্তর পুলকিত মনটাকে গ্রাস করল।

দেয়াল ঘড়িটায় ঢং ঢং করে আটটা বাজলো ।আর দেরি না করে উঠোনে পেঁপে গাছে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো সাইকেলের হ্যান্ডেলে লাঞ্চ ব্যাগটা ঝুলিয়ে ,প্যাডেল ঘুরিয়ে দীপ্ত চড়ে পড়লো তাতে, নিত্য নিয়মে মুখ থেকে বেরোলো "আমি আসি।"

সাইকেলটাতে অনেকদিন তেল দেওয়া হয়নি ক্যাচ ক্যাচ করে আওয়াজ হচ্ছে। দীপ্তর মনটাও আজ সেদিনের কথা মনে করে বড্ড খচখচ করছে ।সে জানে চারুর মত মেয়ের গায়ে হাত তুলে সে সেদিন ভালো করেনি ,সেদিন যে তার হঠাৎ কি হয়েছিল। দীপ্ত আজও মনে করে সেদিনের ঘটনাতে কারোর কোন দোষ ছিল না ।কাঞ্চন, দীপ্তর ছোটবেলার বন্ধু হলে কি হবে, ওর বিদ্রূপের হাসিতে কি ভীষণ তীক্ষ্ণধার, কারোর হৃদয়কে  চির করে রক্তপাত ঘটানোর জন্য যথেষ্ট। কি নির্দয় সে হাসি।

অনেকদিন পর চারুর এক বন্ধু ও তার বর আমেরিকা থেকে এসেছিল চারু সঙ্গে দেখা করার জন্য বাড়িতে। এদিকে মিতালীও চারুর বন্ধু তাই সেদিন কাঞ্চন আর মিতালীও তাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণে এসেছিল ।দীপ্তমানের অফিসে জরুরি কাজ থাকায় ছুটি না নিলেও তার তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার ছিল। দীপ্ত সেদিন অফিস থেকে বেরিয়ে মিষ্টির দোকান থেকে দামি দামি মিষ্টি সিঙ্গাড়া কেনে ।তারপর ভাবে ওরা আমেরিকায় থাকে, এসব রাস্তার তেলেভাজা জিনিস যদি না খায় ,তাই দামি কোম্পানির কেক , প্যাটিস কিনে নেয়। দীপ্তমানের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার সামান্য সরকারি অফিসের ক্লার্কের চাকরি। মাসের মাঝে এতটা খরচার বিলাসিতা তাকে মানায় না তবু চারুর একটা সম্মান আছে বন্ধুর কাছে ।চারুও খুব খুশি হবে। 

🍂

অধীর উৎসাহের সাথে দীপ্ত যখন বাড়ি ফেরে তখন সন্ধ্যা হব হব। বাড়ির উঠোনে পৌঁছে দীপ্ত অনুভব করে ঘরে যেন সন্ধ্যার অন্ধকার অনেক আগেই নেমেছে। কোথাও আলো নেই, এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ,সবাই চলে গেছে মনে হয়। খোলা বারান্দায় তক্তপোশের উপর, অন্ধকার ছায়ার  মতো  খোলা চুলে একলা বসে চারু। দীপ্ত বুঝতে পারে না কি হয়েছে, সাইকেলটা পেঁপে গাছে হেলান  দিয়ে রেখে খাবারের প্যাকেট গুলো নিয়ে চারুর সামনে এসে দাঁড়ায় । ধীরে ধীরে  জিজ্ঞাসা করে "ওরা কি চলে গেছে?"। চারুর জ্বলন্ত মনে হঠাৎ যেন ঘী পড়ে। সে ঝাঁঝিয়ে উঠে  "ভাঙ্গা রেডিও ভরা  ড্যাম ঘরে ,ইলেকট্রিক নেই ,ইন্টারনেট নেই ,এই মশার কামড়ে কে বসে থাকবে, আমি ছাড়া।"

দীপ্ত চমকে ওঠে এ যেন এক অন্য চারু, যাকে সে আগে দেখেনি,তার চারু শান্ত ,নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহলক্ষী নানা বিপরীত পরিস্থিতিতেও তার মুখে  হাসি লেগে থাকে।  এইরকম মুখ ঝামটানো ভাষা তো দূরের কথা। দীপ্ত বলে "আমি যে এতগুলো খাবার আনলাম"। চারু খাবারের প্যাকেটগুলো দীপ্তর হাত থেকে নিয়ে  ছুঁড়ে উঠোনে ফেলতে থাকে। দীপ্ত চারুকে অনেক থামাবার চেষ্টা করে কিন্তু অসফল হয়ে চারুর গালে এক চড় মেরে বসে। দীপ্তর এই অপ্রত্যাশিত আঘাতে চারু হতবাক হয়ে যায় ।তার চোখ থেকে অভিমানের জল গড়িয়ে পড়ে ,সে দৌড়ে উপরে চলে যায়। চারুকে থামাবার আগেই সন্তু ছুটে বাড়িতে ঢোকে ।

সন্তু দীপ্ত -চারুর একমাত্র সন্তান বাড়িতে ফিরে উঠোনের ওপর সিঙ্গাড়া,কল‌তলায় দামি‌ কেক এসব পড়ে থাকতে দেখে সে অবাক হয়ে যায়। ধীরে ধীরে খাবারগুলো বাঁচিয়ে দীপ্তর দিকে এগিয়ে আসে, শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করে "এই ভালো ভালো খাবার জিনিস গুলো মাটিতে  কে ফেলল ?",দীপ্ত তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলে "মার কি হয়েছে তুমি কি জানো? "।সন্তু নেহাত দশ বছরের বাচ্চা, সে বলে "বাবা! বোধহয় রেডিও নিয়ে কিছু বলেছে, বলছিল রেডিও মেকানিক্স ,কাঞ্চন আঙ্কেল খুব জোরে জোরে হাসছিল আর বলছিল মেকানিক্স না ছাই একটাও চলেনা। তবে বাবা যে আঙ্কেল টা আমেরিকা থেকে এসেছিল সে খুব ভালো সে বলছিল আমেরিকায় এসব পুরনো রেডিওর অনেক কদর ।জানো ওই আঙ্কেলটা আমাকে অনেক চকলেট দিয়েছে ।বলেছে ভালো করে পড়া করলে আমিও আমেরিকা যেতে পারব। বাবা তুমি একটা চকলেট খাবে?" দীপ্ত বলে "না ,তুমি বরং ওপরে গিয়ে মাকে নিচে  এসে তোমার জন্য খাবার বানিয়ে দিতে বল "।সন্তু ওপরে যায়।

দীপ্ত অফিসের জামা প্যান্টটা খুলে গামছা পরে উঠোনে নামে, উঠোনে ছড়িয়ে পড়ে থাকা খাবারগুলো কুড়োতে কুড়োতে ও ভাবে এত খাবার এইভাবে নষ্ট ।কলতলায় পড়ে থাকা কেকটা তুলতে তুলতে দীপ্তর মনে পড়ে ওর কত দিনের শখ জন্মদিনে কেক কাটবে।  গরিবের ঘরে জন্মদিন তো কোনদিন পালনই হয়নি তারপর কেক, তবে মা হাজারো অসুবিধার মধ্যে জন্মদিনে ওর জন্য পায়েস বানাতো,বলতে নেই মা মারা যাবার পর চারুও ওর জন্মদিনে পায়েস বানায়। দীপ্ত মনে মনে আন্দাজ করতে পারে চারুর রাগের কারণটা। কাঞ্চনের ঐ নির্দয় হাসি যার শিকার হয়েছে আজ চারু।

চারু সচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ,চারুর বাবাই এই বিয়ে ঠিক করেছিলেন তাদের অনেক ছোটবেলায়। তিনি ছিলেন দীপ্তর বাবার বন্ধু। দীপ্তর বাবা ছিলেন সামান্য স্কুল শিক্ষক, একদিন হঠাৎ তিনি চলে গেলেন ,দীপ্ত তখন সবে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে, গ্রামের বিধায়ক সুপারিশ করে পি ডব্লিউ ডি অফিসে  দীপ্তকে একটা ফোর্থ গ্রেডে চাকরি পাইয়ে দিল। তারপর অফিস আর নাইট কলেজে পড়ে গ্রাজুয়েশনটা দীপ্ত কোনমতে শেষ করে ,দীপ্তর ইঞ্জিনিয়ারিং করার খুব ইচ্ছে ছিল মাথাও ছিল কিন্তু সংসারের চাপে তা আর করা হয়নি। এদিকে চারু ইংলিশে এমএ দেখতে শুনতেও খারাপ নয় চাইলে ওর আরো ভালো বিয়ে হতে পারত ।ওর বাবা মারা যাবার পর বাবার কথা মতো দীপ্ত সঙ্গেই তার বিয়ে দিয়েছিলেন চারুর মা। চারুর বড় দিদি বোম্বেতে থাকে আর ওর ভাই দিল্লিতে বড় চাকরি করে। চারুর বিয়ের পর তার মা ও দিল্লিতে ছেলের কাছে থাকে বিয়ের পরে চারু একটা স্কুলে চাকরি পেয়েছিল। কিন্তু দীপ্তর মা অসুস্থ থাকায় সে নিজেই সেই চাকরি করেনি ।

বাবার সম্পত্তি বলতে তিন কাঠা জমির উপর এক চালার একটা ঘর ছাড়া আর কিছুই ছিল না ।দীপ্ত নিজের চেষ্টায় আজ অফিসে হেড ক্লার্ক হয়েছে।ওপরে একটা ঘরও বানিয়েছে ১০/১২ ,একটা খাট আর আলমারি রেখে সেই রকম জায়গা নেই ,তবুও জানলার ধারে একটা ছোট্ট টেবিলে তার সাধের রেডিও আর রেডিও ঠিক করার জিনিস।

রেডিওটি তার দাদুর এই রেডিও নিয়েই যত অশান্তি। চারু মুখে কিছু না বললেও রেডিওটার এই রকম জায়গা জুড়ে থাকাটা ওর খুব একটা পছন্দের নয়। মাঝে মাঝে বলে রেডিওটা টেবিলটা জড়ো করে রাখা এদিকে ছেলেটা মাটিতে বসে পড়ছে, ইঙ্গিতটা দীপ্ত বোঝে।

 দীপ্ত দেখে চিকেন প্যাটিস তুলসী মঞ্চের কাছে পড়ে ।সে তুলে সব জঞ্জালের বালতিতে রেখে দেয়। তারপর হ্যান্ড পাম্পের জলে বালতি ভরে তুলসী মঞ্চ ,উঠোন ধুয়ে স্নান সেরে ঠাকুরঘরে সন্ধ্যা দেখায়।

স্টেশনে পৌঁছে সাইকেল স্ট্যান্ডে সাইকেলটা রেখে বগলাকে বলে সাইকেলটার একটু সার্ভিসিং করে রাখতে।দীপ্ত হনহন করে প্লাটফর্মে পৌঁছয়।

 ৮:৩০ ,কল্যাণী লোকালে চড়ে বসে। প্রচণ্ড ভিড় ,বদ্রি বাবুর হাতে ব্যাগটা দেন ,উনি বলেন "আজ অনেকদিন বাদে এই ট্রেনে" ।দীপ্ত একটু হাসে কিছু বলে না। আজ তার মন জুড়ে খালি সেদিনের চিন্তা ।

সেদিন রাত্রে বিছানায় শুয়ে দীপ্ত রেডিওটার দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে। তবে সেদিন আর রেডিওটা অন করে না। না হলে প্রতিদিন সন্তু আর চারু ঘুমিয়ে গেলে দীপ্ত ধীরে ধীরে উঠে রেডিওটা অন করে। অন করলে রেডিওটার সুইচের একটা সবুজ  আলো জ্বলে ওঠে।দীপ্ত সেটার নাম দিয়েছে ম্যাজিক আই।সেই সামান্য আলোয় পুরো ঘর যেন এক স্বপ্নরাজ্যে পরিণত হয়।দীপ্ত সেই স্বপ্ন রাজ্যে হারিয়ে যায়।

সে স্বপ্নে চারিদিকে নানা রকমের  রেডিও দেখে ,এক একটা রেডিওর এক একটা বিশেষত্ব দীপ্তকে অবাক করে, রেডিওগুলো যেন তার সঙ্গে নানা কথা বলে। কিন্তু আজ তার এই স্বপ্ন আসে না। রেডিওর দিকে চেয়ে সে ভাবে রেডিওটা তার দাদুর স্মৃতি, পুরনো হলেও সেটা তার কাছে অনেক দামী ।এই রেডিও তার প্রকৃত বন্ধু। যখনই সে কোন সমস্যায় পড়েছে এই রেডিওটা ওর সাথ দেয়।

রেডিও খুলে দীপ্ত ওটাকে সারাতে শুরু করে আর ওর সমস্যার সমাধানের একটা না একটা উপায় পেয়েই যায়। রেডিওটাকে দীপ্ত সারিয়ে নিয়েছে অনেক দিন ।কিন্তু সে কথা আজ পর্যন্ত কাউকে বলেনি, বা বলবেই বা কার কাছে, এই বাড়িতে এই কথা শোনার কেউ নেই, রেডিওকে ঘিরে তার অনুভূতির কথা কেউ বোঝে না। সবার কাছে সেটা একটা পুরনো ভাঙ্গা অচল রেডিও খালি। কিন্তু দীপ্তর কাছে ওটা জীবন্ত ।একান্ত নিজস্ব একটা চাওয়া পাওয়ার জায়গা। যেটাকে আঁকড়ে সে বাঁচতে চায় ।দীপ্ত মনে মনে ভাবে সেটাকেও সবাই কেড়ে নিতে চায়। অভিমানের জল গড়িয়ে পড়ে ,বিছানার বালিশ ভিজে যায় কিন্তু আর নয়। 

সেদিন খুব ভোরে দীপ্ত বিছানা থেকে উঠে দালানে এসে দাঁড়ায় দূরের আকাশে সূর্যের আভা আলতো সবে প্রলেপের মত ।দীপ্ত আর দেরি করেনা ।চারু জেগে ওঠার আগেই রেডিওটাকে ব্যাগে ভরে বাজারের মুখে রদ্দি দোকানের সামনে রেখে আসে ।পিছন ঘুরে একবার ম্যাজিক আই এর দিকে দেখে ,মনে হয় যেন তারও চোখ থেকে জল ঝরে পড়ছে। 



শিয়ালদহ ট্রেন ঢুকছে, অফিস টাইমে ট্রেন থেকে নামার জন্য আলাদা করে নিজের চেষ্টার আর কোন দরকার হয় না।ভিড় ঠেলে নামিয়ে দিল দীপ্তকে ।অফিসে পৌঁছে আজ দীপ্ত কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছে না।কাজের মাঝেও আজ চারুর আবদার টা বারবার দীপ্তর মনকে উতলা করছে। প্রতিবছরের মতোই স্টেশনের ধারে জয়নগরের  মোয়ার দোকান লেগেছে। কিন্তু নারকেল আনতে স্টেশনের ধারের বাজারটাতে ঢুকতে হবে ।

মিস্টার মিত্র কে বলে আজ একটু আগেই বেরিয়ে পড়ল দীপ্ত ।বাজারে ঢুকে নারকেলের সাথে সাথে নতুন ছোট ছোট ফুলকপি, একসাথে তিনটে বাধা আর কিছু কড়াইশুঁটিও কিনে নিল। সংক্রান্তির দিন প্রতি বছরই চারু খিচুড়ি বানায় আর রাতে লুচি আর নলেন গুড় ,পাটিসাপটা পুলি পায়েস । রান্নার হাত চারুর বরাবরি খুব ভালো। আজ দীপ্তর মন জুড়ে শুধু চারুর স্পেশাল আবদারের ঘন্টা। সঙ্গে কিছু মোয়া আর বাদাম পাটালিও কিনে নেয় সে, সন্তু বাদাম পাটালি খেতে খুব ভালোবাসে।

 একটু বেশি খরচা হয়ে গেল কিন্তু আজ এতদিন পর চারুর আবদারের কাছে কিছুই নয় । ঘড়িতে সবে সাড়ে পাঁচটা ,ট্রেনে সেই রকম ভিড় হয়নি এখনো। ট্রেনে উঠে জানলার ধারে একটা জায়গা পেয়ে গেল সে।

ট্রেন স্টেশন ছেড়ে বাড়ির দিকে ছুটে চলেছে । দীপ্তর আজ বাড়ি ফেরার এক অদ্ভুত আবেগের টান। জানালার বাইরে তাকিয়ে সে স্বপ্ন দেখতে থাকে বাড়ি ফিরে সে আর চারু মুড়িতে কড়াইশুঁটি আর মোয়া মেখে বারান্দায় তক্তপোশে বসে  খাচ্ছে আর নানা কথায় হারিয়ে যাচ্ছে দুজনে।

স্টেশনে নেমে দীপ্ত তাড়াতাড়ি সাইকেল নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। সূর্য ডুব দিয়েছে তবু তার মৃদু আলোর আভা এখনো রয়ে গেছে। ঠিক যেমন দীপ্ত চারুর সম্পর্কের মত ।কাল আবার নতুন দিন শুরু হবে। হালকা ঠান্ডা হাওয়া চলছে। দীপ্তর মনটাও আজ অনেক হালকা লাগছে । রাগ অভিমানের আড়ালে একটা অপরাধবোধ ও দীপ্তকে কুরে কুরে খাচ্ছিল সেদিনের ঘটনার পর থেকে। 

বাড়ি পৌঁছে উঠোনে দীপ্ত সাইকেলটা রাখে কিন্তু বাড়িতে সেই আগের দিনের মতোই নিস্তব্ধতা । অজানা আশঙ্কায় দীপ্তর বুক কেঁপে ওঠে। কিন্তু উঠোনের মাঝে তুলসী মঞ্চের প্রদীপের আলো টিমটিম করে জ্বলছে। আজ আর সেদিনের নিস্তব্ধতার মাঝে কোথাও যেন একটা তফাৎ দীপ্ত অনুভব করে। হালকা হাওয়ায় ক্রমাগত কাঁপতে থাকা প্রদীপের শিখার মত  দীপ্তর মনের ভেতর অজানা দ্বিধার কম্পন, তবুও প্রদীপটি জ্বলছে। 

দীপ্ত কপি আর গুড়ের হাঁড়ির দড়ি ধরে স্খলিত পায়ে উঠোন পেরিয়ে রান্না ঘরে পৌঁছয় । রান্নাঘরের জানলা দিয়ে চাঁদের আলোর ফালি খানি মেঝেতে পড়েছে। রান্নাঘর পরিপাটি করে গুছানো । উনুনের ওপরে ঢাকা চাপা কিছু খাবার। চারুকে তো কোথাও দেখছি না । সন্তুর আজ টিউশন আছে। দীপ্ত রোজকার  অভ্যাস মত হাত পা ধুয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠে ।

অনেকক্ষণ ইলেকট্রিসিটি নেই মনে হয় চারু কি উপরে  শুয়ে আছে, শরীর ভালো নেই ?তবে শরীর ভালো না থাকলেও শুয়ে থাকার পাত্রী সে নয়। শোবার ঘরের দরজার একটা পাল্লা আলতো করে ভেজানো, হয়তো হাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে । হালকা হাতে দীপ্ত দরজাটা খোলে । চারু টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু একটা করছিল, দরজা খোলার শব্দে হতচকিতভাবে টেবিলের উপরে রাখা কিছু একটা কাপড় দিয়ে চাপা দিতে চায় । দূর থেকে আবছা আলোয় দীপ্ত কিছু আন্দাজ করতে পারে না। চারু ইতস্তত করে বলে "তুমি এসে গেছ কিচ্ছু টের পাইনি। আলো সেই যে কখন গেছে কখন আসবে কে জানে? "বলতে বলতে টেবিলের ওপরে রাখা কিছু একটা জিনিস সে আঁচল দিয়ে ঢাকতে চায়। দীপ্ত বলে "তুমি অন্ধকারে কি করছো ?এমার্জেন্সি লাইট টা তো টেবিলের ওপরেই রাখা আছে ,ওটাকে জ্বালাওনি কেন?" দীপ্ত এগিয়ে যায় টেবিলের দিকে । ১০/১২র এই শোয়ার ঘরে ৫/৭ এর খাট দেরাজ ,ড্রেসিং টেবিল আর জানলার ধারে এই টেবিলটা রেখে চলার মত জায়গা খুব অল্প। এমার্জেন্সি টা টেবিলের ওপর থেকে নিতে গিয়ে চারুর সঙ্গে দীপ্তর ধাক্কা লেগে যায় । কাপড়ের আঁচল সরে গিয়ে টেবিলের ওপরে রাখা দীপ্তর সেই পুরনো শখের রেডিও বেরিয়ে পড়ে। হালকা হাওয়ায় জানলাটা হঠাৎ করে খুলে যায় ।খোলা জানালা দিয়ে শুক্লপক্ষের জোছনার আলো টেবিলটাকে আলোকিত করে। দীপ্ত মুখ তুলে চারুর দিকে তাকায়। জোৎস্নার মৃদু আলোয় দীপ্ত দেখে চারুর মুখটা লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে উঠেছে ।সেই প্রথম দিনের পান পাতা সরিয়ে দেখা চারুর সেই মুখ। চারুর সরলতা মাখা মুখের হাসির ছটা যেন সারা ঘরটাতে ছড়িয়ে পড়েছে।১০/১২ ঘরটা যেন এক স্বপ্নময় দেশ হয়ে উঠেছে । দীপ্ত একভাবে চারুর দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারে না ।খালি ভাবে তার স্বপ্নের রেডিওর খবর চারু কি করে পেলো। চারু লজ্জায় চোখ নামায় ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে দীপ্তর বুকে মাথা রাখে ,সোহাগ ভরা গলায় বলে "তুমি কি আমায় ক্ষমা করেছো ,,"দীপ্ত তখনও সম্মহিত ,কোনোভাবে ঘোর কাটিয়ে চারুকে আরো নিজের কাছে টেনে নেয় হাতের বাঁধনে বাঁধে। ধীরে ধীরে দীপ্ত চারুকে জিজ্ঞাসা করে" এই রেডিও তুমি কোথায় পেলে?"

চারু বলে "কাল বাজার থেকে ফেরার পথে রদ্দি দোকানের সামনে দিয়ে আসার সময় দেখি তোমার রেডিওটা রদ্দি দোকানের ঐ বৃদ্ধ আঙ্কেল খুব সুন্দর করে নিজের দোকানে সাজিয়ে রেখেছে।

সেদিনের জন্য তুমি আমায় ক্ষমা করেছো তো, আমি কোনদিন তোমার রেডিও কে নিয়ে যে এত ভালো লাগা সেটা  বুঝিনি।"

দীপ্ত চারুকে বলে "ক্ষমা তো আমার চাওয়া উচিত, তুমি আমায় ক্ষমা কর।"

হঠাৎ ঘরে লাইটটা জ্বলে ওঠে আর রেডিওতে গান বেজে ওঠে "আমার পরাণ যাহা চায় তুমি তাই গো...।

চারু নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলে "এতক্ষণে লাইট এল আমি নিচে যাচ্ছি চা বানাতে, তুমি এসো। "দীপ্ত বলে, " কড়াইশুঁটি নিয়ে এসেছি ,একটু মুড়ি মাখো, আমি আসছি।"

দীপ্ত রেডিওটার ওপর আলতো করে হাত বোলায়। তারপর ভলিউম সুইচটা ঘুরিয়ে ভলিউমটা একটু বাড়ায় আর দেখে তার ম্যাজিক আই তার দিকে অপলকে চেয়ে মৃদু হাসছে।

পরের দিন সকাল বেলায় চারু খুব ব্যস্ত, কাঞ্চন আর মিতালীও আসবে । সাথে এতগুলো রান্না। দীপ্ত নারকেল দুটো ভেঙে রাখল। দীপ্তর মনে আজ এক অন্যরকমের প্রসন্নতা, সব প্রাপ্তির আনন্দ। সন্তু আজ সকাল থেকে রেডিওটাকে নিয়ে পড়েছে। নানা সুইচ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নানা রেডিও স্টেশন ধরার চেষ্টা করছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই কাঞ্চন আর মিতালী এসে গেল । সন্তু কাঞ্চনের হাতটা ধরে বলল "কাকু এক্ষুনি উপরে চল, তোমাকে একটা জিনিস দেখাবো", কাঞ্চন বলে"কিরে আবার কি দেখাবি" সন্তু বলে "চলই না উপরে দেখাবো যে বাবার সেই পুরনো রেডিওটা কত সুন্দর বাজে"। কাঞ্চন ঠাট্টার সুরে বলে উঠলো," তুই তো দেখছি বাপকা বেটা হয়েছিস "আর হা হা করে সেই নির্মম হাসি।

কিন্তু আজ কাঞ্চনের এই হাসি দীপ্তকে বিচলিত করল না অন্তরে কোন রক্তক্ষরণ ঘটালো না ।উঠোনে দাঁড়িয়ে চারু বলে উঠল "বাপের ছেলে তো বাপের মত হবে তাইনা আর কার মত হবে?" দীপ্ত চারুর দিকে তাকায় চারুর ঠোঁটের কোণে  গর্বের হাসি। চারুর চোখে তার চোখ মিলে যায় তাতে শুধু দীপ্তর জন্য প্রেম আর শ্রদ্ধা। চারুর গলার সুরের তারতম্যটা কাঞ্চনের কাছে প্রায় অপ্রত্যাশিত ঠেকে ।নিজেকে সামলে নেওয়ার আগেই দীপ্ত কাঞ্চনের হাত ধরে বলে "চল আজ তোকে আমার রেডিওতে প্রেমের গান শুনিয়েই ছাড়বো।"

এই কথা বলে দীপ্ত হা হা করে হেসে ওঠে ।সেই হাসি যেন আর থামতেই চায় না। দীপ্তর এই হাসি অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পাওয়ার পৈশাচিক হাসি নয় ,এ এক নিছক ভালো মানুষের মান অপমান আর আত্মসম্মানের লড়াইয়ে জয়ের তৃপ্তি মাত্র।

দীপ্ত কাঞ্চনকে নিয়ে উপরে যায়। রেডিওটা অন করে, রেডিওর ওপার থেকে পরিচিত কন্ঠে ভেসে আসে,

"বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও, মনের মাঝেতে চিরদিন তাকে ডেকে নিও.............. স্মৃতির পটেতে যত ব্যথা আছে ভুলে যেও, ভুলনা তারে ডেকে নিতে ..."

দীপ্ত মুগ্ধ হয়ে রেডিওর দিকে  তাকিয়ে থাকে, ম্যাজিক আই এর চোখেও যেন আজ এক অদ্ভুত সন্তুষ্টির খুশি, যে খুশি বলে যাচ্ছে  মানুষের সম্পর্কের জটিল টানাপোড়নের মাঝেও ভালোবাসার জয়ের উপলব্ধির কথা।

Post a Comment

3 Comments

  1. মধ্যবিত্ত জীবনের টানা পোড়েনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসার গল্প। ভালো লাগল।

    ReplyDelete
  2. কমলিকা ভট্টাচার্যFebruary 17, 2025

    অনেক ধন্যবাদ

    ReplyDelete
  3. কমলিকা ভট্টাচার্যFebruary 17, 2025

    অনেক ধন্যবাদ

    ReplyDelete