পুলককান্তি কর
অনেকক্ষণ ধরেই আকাশটা থম মেরে ছিল, কিন্তু চায়ের ভাঁড়টা ডাস্টবিনে ছুড়ে মারতে গিয়ে খেয়াল হল, বৃষ্টি পড়া শুরু হয়ে গেছে। বৃষ্টি জিনিসটা এমনিতে খারাপ না, বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস বয়, বাজ কড় কড় করে, চারপাশে ডালপালা হুটিয়ে লুটিয়ে ডানা ঝাপটায়- আমার বেশ লাগে। বারান্দায় বসে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বর্ষাকালে বৃষ্টি দেখা আমার একপ্রকার নেশাই , তবে কিনা এমন হঠাৎ একটা প্রয়োজনে রাস্তায় বেরিয়ে বৃষ্টিটা ততখানি আনন্দ দিল না। ছাতা বইবার অভ্যাস আমার কোনও কালেই ছিল না, এখনও নেই। এই ছোট চায়ের গুমটিতে নিজেকে বাঁচাবার কোনও উপায় নেই। অথচ আমাকে এখন যেতে হবে বিশ কিলোমিটার দূরে এবং বেশ ভদ্র বেশভূষাতেই। চায়ের দোকানী বলল, 'দাদা অকারণ ভিজছেন কেন ? এ বৃষ্টি এখন সহজে ছাড়বে না ! ওই ডানদিকে দৌড় লাগান -এক মিনিট দূরে একটা বড় মিষ্টির দোকান আছে। মালিক বেশ ভালো। মিষ্টি না কিনেও আপনি ওখানে একটু মাথা বাঁচাতে পারবেন!
ছেলেটি ভুল কিছুই বলছে না। কিন্তু বৃষ্টির ভয়ে দৌড়াতে কিছুতে মন সায় দিলো না। মানুষের কখন কিভাবে যে ছদ্ম অহং জেগে ওঠে, বোঝাও যায় না। এই গঞ্জে কে বা আমায় চেনে? আর দৌড়ালে অসুবিধাটাই বা কি! তবে মন বুঝতে চায় না অনেক কথাই। লম্বা লম্বা পা ফেলে যখন মিষ্টি দোকানে পৌঁছলাম, মাথা এবং জামাকাপড় বেশ খানিকটা ভিজে গেছে। সর্দি জ্বর লাগবে বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু এই অবস্থাতেও আমাকে যেতেই হবে। কাজের সন্ধান আছে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর বন্ধুরা সব বিভিন্ন কোম্পানিতে ঢুকে পড়লো, আমার আর পরের গোলামী করতে ইচ্ছে হলো না! মফস্বলের দিকে এখনও তো প্রমোটারী ততটা ঘাঁটি গাড়েনি। মানুষজন বাড়ি বানালে অনেকে তদারকীর জন্য লোক রাখে। পয়সা ওয়ালারা বি. ই ইঞ্জিনিয়ার খোঁজে; অনেকে আই. টি. আই তেই কাজ চালিয়ে নেয়। সত্যি কথা বলতে এইসব কাজ অভিজ্ঞ লোকজনই দেখে শুনে নিতে পারে। তবে কিনা এখন স্পেশালাইজেশনের যুগ। আমিও সুযোগটা নিই । বেশি না – বছরে দুটো বা তিনটে কাজ করি –তাতে সারা বছর আরামসে কেটে যায়। আমার সঞ্চয়ের বদরোগ নেই। টাকা ফুরোলে কাজের সন্ধানে নামি। আপাতত তাই যাওয়াটা জরুরী।
মিষ্টির দোকানটায় অনেক মানুষজন দাঁড়িয়ে, বৃষ্টি থেকে বাঁচতেই; তাই অধীর আগ্রহে সবাই আকাশের দিকে তাকিয়ে। একটি মেয়ের সাথে মাঝে মাঝেই চোখাচোখি হচ্ছে আমার– বিষয়টা মোটেও ভালো নয়, আমি তবু কিছুতেই তাকানো থেকে নিরস্ত হতে পারছি না। মেয়েটির বয়স তেইশ চব্বিশ। ও নিশ্চয়ই আগ্রহ থেকে আমায় তাকাচ্ছে না, সেই মুহূর্তে আমি তাকে দেখছি কিনা পরখ করতে গিয়েই হয়তো চোখাচোখি হচ্ছে। মেয়েটি ঠিক যেন কলেজ পড়ার বয়সের ঝিল্লি। ঝিলম চক্রবর্তী। আমার সাথেই পড়তো; এখন আমেরিকায় থাকে বোধহয়। বয়সের ব্যবধানটা না ভাবলে দিব্যি মা-মেয়ের বা দিদি-বোন হিসাবে চালিয়ে দেয়া যেত। এত মিলও যে হতে পারে, না দেখলে বোঝা যায় না। নিজেকে কঠিন ধমক দিলাম, আর তাকাবো না।
বেশ কিছুক্ষণ পরে খেয়াল করলাম, মেয়েটি আমার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে, হাসিহাসি মুখ করে বলল, ' আপনি কি আমায় চেনেন?'
খানিকটা বোকার মতন অপ্রতিভ হাসি দিয়ে বললাম, 'বোধহয় না।'
- তবে বারবার তাকাচ্ছিলেন যে!
ব্যাপারটা এক্ষুনি সামলে নেওয়া দরকার। এমন মিষ্টি কথায় জিজ্ঞেস করাটা একটা স্ট্রাটেজি হতে পারে– এক্ষুনি চেঁচিয়ে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে– ' আসলে আমার সাথে কলেজে একটি মেয়ে পড়তো, আপনাকে অবিকল সেরকম দেখতে– এত মিল– ’
- আমারও আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে; আমিও ভেবে উঠতে পারছি না, কোনও দিন কোথাও আমার আপনার সাথে দেখা হয়েছে কিনা!
- হয়নি বলেই তো মনে হয়।
মনে মনে ভাবলাম বলি, এইরকমটা আমার ক্ষেত্রে খুব হয়; অনেকে বলে পূর্ব জন্মের চেনা থাকলে এমনটা হতে পারে – কিন্তু মুখে বললাম না। তাহলে ভাবতে পারে মেয়ে পটানোর ফন্দি।
- তা আপনার বান্ধবীর নাম জানতে পারি?
- মিলিয়ে দেখবেন চেনা কিনা?
-দোষ কি?
- ঝিলম চক্রবর্তী। কেউ আছে আপনার মাসি পিসি বা দূর সম্পর্কের এই নামে?
- নাহ। হলে ভালো হত, আমিও ভাবতাম তাহলে, তাদের সাথে কোনও ফটোতে আপনাকে দেখেছি! এখন মনটা খচখচ করবে যতক্ষণ না এই সঠিক উত্তরটা পাচ্ছি!
- পাবেন না, ছেড়ে দিন। পৃথিবীতে নাকি ছ' জন মানুষ একই রকম দেখতে হয়! আপনি হয়তো সেরকম চেনা কারো সাথে গুলোচ্ছেন। সাব কনসাসে মুখটা জানান দিয়ে চলে যাচ্ছে বলে আপনার খটকা লাগছে ।
কথায় কথা বাড়তে থাকলো। বৃষ্টিও থামলো একসময়। জানা গেল মেয়েটির নাম নীলা। ওর আর আমার গন্তব্য একই। ও কলেজে বি.এ পড়ে। গল্প সিনেমার মতো ঝিল্লির সাথে ওর রিলেশান বেরোয় নি ঠিকই, তবে তার কাছাকাছি আর একটা ‘চমৎকার’ বেরোলো। যে বাড়ি যাচ্ছি, সেটি মেয়েটির দিদির বাড়ি। ভালোই হল, স্টেশনে নেমে বাড়ি খোঁজার ঝঞ্ঝাটটা রইল না। এর মধ্যে বাস এল। বৃষ্টির কারণে হোক বা যে কোনো কারণে বাসে পাশাপাশি বসার জায়গাটা হল। নীলা বেশ আলাপী; বলল ' আপনার বাড়িতে কে কে আছে?'
- আমি আর হাওয়া বাতাস।
- ওমা! সে কি কথা! আপনি বিয়ে থা করেননি? মস্ত আপসোস যেন ঝরে পড়লো ওর গলায়।
- করা হয়ে ওঠেনি!
-কেন? বাবা মা জোর করেন নি?
- ততদিন কেউ বেঁচে ছিলেন না নীলা!
- যাদের বাবা-মা নেই, তাদের কি বিয়ে হয় না?
- হবে না কেন? ইচ্ছে করলেই হয়।
- আপনার বুঝি ইচ্ছে নেই !
হাসলাম। এ কথার আর কী উত্তর দেব! একটু থেমে নীলা বলল, ' আপনি তো ইঞ্জিনিয়ার! বাংলায় ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের জন্য মেয়ের অভাব নেই নিখিলবাবু। আপনি একটা বিয়ে করে নেন বরং।'
অধিকাংশ মেয়েদের দেখেছি তারা ঠিক অবিবাহিত ব্যাপারটা মেনে নিতে পারে না। প্রায়ই স্বতঃ-প্রনোদিত হয়ে তারা বিয়ের জন্য ওকালতি করে, বিয়ের সদর্থক দিকটাকে সিদ্ধ করার প্রচেষ্টা করে। নীলাও এর ব্যতিক্রম নয়। শহরতলীর মেয়ে হওয়ার জন্য বোধহয় এই ব্যাপারটা আরো বেশী। এবার বেশ চোখ গোল গোল করে বলল, ' কলেজ জীবনে আপনার ক্রাশ ছিল না ? এমন হিরোর মত চেহারা!’
কথা ঘুরিয়ে বললাম, 'এই ক্রাশ শব্দটা বেশ চলছে আজকাল। তা তোমার নেই?'
- ক্রাশ খাওয়ার মত পুরুষ মানুষ এখানে কোথায় পাবো নিখিলবাবু? সব গেঁয়ো! এমন করে সামনে এসে লেজ নাড়ে, আমার তো বেশ চারপেয়ে মনে হয়!
- তা তোমার কেমন পছন্দ? শাহরুখ ?
- দূর! আমি আবার ওসব দূরের তারকায় মজি না। ওরা রুপোলি জগতের মানুষ, ওখানেই ভালো।
- তোমার পছন্দটি বললে না তো!
- আপনি চলতে পারেন!
মেয়েটি সাহস দেখে অবাক হলাম। মজার ছলেই কথাটা বলছে সে। তবে আমাদের সময়েও সদ্য আলাপ হওয়া কোনও পুরুষকে কোনও মেয়ে এমন কথা বলতে পারতো না। হয়তো আমাদের বয়সের অনেক ব্যবধান আছে বলেই মেয়েটি সাহস দেখাতে পারে। বললাম, 'আমার বয়স জানো?'
- ছেলেদের বয়স ততটা ম্যাটার করে না নিখিলবাবু! টাকাটা ম্যাটার করে।
🍂
- এ বিষয়ে দুটো কথা। আমার টাকা নেই; টাকা ফুরোলে কেবল আমি কাজ করি! দুনম্বর কথা হল, তুমি সেরকম মেয়ের দলে পড়ো বলে তো মনে হয় না!
- মুখ দেখে কি চরিত্র বোঝা যায় নিখিলবাবু? বিশেষ করে মেয়েদের?
- তুমি মেয়ে হয়ে যেরকম মেয়েদের বিজ্ঞাপন দিচ্ছ – অন্য মেয়ে শুনলে…
কথাটা ঘুরিয়ে নীলা বললো, 'আপনার কলেজ জীবন নিয়ে কিছু বললেন না তো!'
- বলার মত কিছু নেই নীলা!
- সত্যিই নেই? বিশ্বাস হয় না।
হঠাৎ করে ঝিল্লির কথা মনে হলো খুব। ঝিল্লির সাথে কি আমার খুব প্রেমের সম্পর্ক ছিল? কেউ কাউকে কখনও তেমনভাবে বলিনি। অন্যদের থেকে একটু বিশেষ ব্যাপার ছিল ঠিকই– কিন্তু সেটা একা একা কলেজ পালিয়ে নন্দন অ্যাকাডেমিতে যাওয়ার মতো ছিল না। আমাদের একটা ছোট্ট গ্রুপ ছিল, গেলে একসঙ্গে যেতাম। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর ঝিল্লি চাকরি নিয়ে উত্তরাখন্ড চলে গেল। তখন অবশ্য উত্তরাখণ্ড আলাদা রাজ্য হয়নি। আমি কলকাতায় রয়ে গেলাম। সে আমাকে ফোন করতো, চাকরিতে জয়েন করার জন্য পীড়াপিড়ি করতো। কে জানে হয়তো চাকরি করলে তার সাথে আমার বৈবাহিক কোন সম্পর্ক হলেও হতে পারতো! একদিন শুনলাম, ঝিল্লি আমেরিকা চলে যাচ্ছে, তার আগে তার সাথে একজনের বিয়ে হচ্ছে– সেও আমেরিকায় থাকে। তারপর তার সাথে আমার একবারই দেখা হয়েছিল বছর চারেক পর।
কথায় কথায় আমাদের গন্তব্য এসে গেলো। নীলা বলল – আপনার সাথে জামাইবাবুর কথা ফাইন্যাল হলে ভালো হয়!
- কেন?
- আপনার সাথে প্রায় দিনই দেখা হবে তাহলে! আমি তো রোজ কলেজ আসি!
- আমার সাথে দেখা করে কী করবে?
-বা রে ! লোকে দেখা হলে কি করে?
- কথা বলে।
-আপনিও বলবেন।
- আমি বেশি কথা বলতে পারি না।
- সে তো আপনাকে দেখেই বুঝেছি। বেশ তো! কথা বলবেন না– শুধু শুধু দেখা করবো ।আপনাকে আমার বেশ ভালো লেগেছে।
আমাদের সামাজিক পরিকাঠামো এমনই, কোনও মেয়ে এত বেশি প্রগলভা হলে তার চরিত্র নিয়ে সন্দেহ হয়। মেয়েটা কি গায়ে পড়া না কি সরল– এসব ভাবতে ভাবতে আমরা নীলার দিদির বাড়ি এসে উপস্থিত হলাম। দরজা খুলতেই 'মাসি' বলে ঝাঁপিয়ে পড়লো একটি বছর ছয়েকের মেয়ে গোলগোল, ফর্সা- মিষ্টি মতো মুখ। আমাকে দেখিয়ে বলল, 'এইটা কে?'
- ওটা একটা আঙ্কল! বলো ‘হাই আঙ্কল!’
- হাই আঙ্কল
‘থ্যাংক ইউ’ বললাম আমি। নীলার দিদি জামাইবাবু এলেন, কথাবার্তা ফাইন্যাল হল। টোটাল বাড়ি কমপ্লিট হওয়া পর্যন্ত তদারকি করব আমি। মাঝে মাঝেই বাচ্চাটি এসে 'টুকি' করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে সাহস করে নাগালের মধ্যে আসছে– আমি মিছিমিছি ধরার চেষ্টা করতেই সোঁ করে পালাচ্ছে। একটু আড়াল বুঝে নীলা বলল, 'আপনারও হতে পারতো , যদি সময়ে বিয়ে করতেন!'
আমি কিছু বললাম না। আমি একমনে বাচ্চাটিকে দেখতে লাগলাম। ঝিল্লির মেয়ের বয়সও তো ছয়ই হল। কী নাম রেখেছে ওর কে জানে? আমাকে ফোন করে একবার নাম দিতে বলেছিল, আমি উত্তর দিই নি।
-নীলা, এই মেয়েটির নাম কী?
- জামাইবাবু ডাকে ‘টিঙ্কু’ বলে, দিদি ডাকে ‘সোনা’।
- তুমি কি বলে ডাকো?
- ময়না।
- কেন? খাঁচায় পুষবো ভেবে?
- ওই ময়না পাখির মতো কল কল করে বলে! মেয়েটি ভারী মিষ্টি।
আমি আনমনে একবার ‘হুঁ' বললাম। নীলার জামাইবাবু জামাকাপড় বদলাতে গেছেন। এখনই সাইট-টা দেখিয়ে আনবেন। আমার মন চলে যাচ্ছে সেই নিউজার্সিতে; তখন ঝিল্লিরা ওখানেই থাকতো। এখন কোথায় থাকে কে জানে! একবার নিউজার্সি থেকে ফোন করে আমায় বলল, 'নিখিল তুই আগামী ১৫ ই মে থেকে ২০শে মে র মধ্যে কলকাতায় থাকবি?'
- আপাতত আছি। কেন বলতো ?
- একবার দেখা করব। ডেট আর টাইম বল।
- আমি তো তোর মত পাকা সাহেব নই, আমার হাতে আপাতত কোনও কাজও নেই, সব দিন বাড়ি আছি তোর যবে খুশি আয়।
১৮ তারিখ দিনটা মনে আছে। ওই দিন সকাল দশটা নাগাদ এল ও। অনেকটাই বদলে গেছে। একটু মোটা হয়েছে, একটু বেশি সাজগোজও চোখে পড়লো। নিজে বড় চাকরি করে– আলাদা একটা ছাপ তো থাকবেই। দুপুরে বাইরে লাঞ্চ করলাম, ঝিল্লি বলল, ‘বাগ বাজার থেকে হাওড়া লঞ্চে চড়বি?’
- আমার কোনও অসুবিধা নেই। চল।
বাগবাজারে এসে কী মনে করে বলল, ‘নিখিল, চল তোর বাড়ী যাই। তোর সাথে কিছু কথা আছে! ইনফ্যাক্ট তোর জন্যই এবার আমার কলকাতায় আসা।
- বেশ তো, বল না এখানে!
-না, বাড়ি চল।
বাড়ীতে এসে দীর্ঘ একটা শাওয়ার নিল ঝিল্লি। ওরা আজকাল এটাকে স্নান বলে না। আধভেজা চুল বুকের উপর ছড়িয়ে আমার কাছে এসে বলল 'নিখিল আমি জানি, তুই আমাকে ভালোবাসিস! সেই অধিকারে আজ একটা জিনিস চাইবো! বল ফেরাবি না!
- কি চাস বল!
- আগে কথা দিতে হবে!
- এ তো ছেলেমানুষী কথা ঝিল্লি!
-হোক না ছেলেমানুষী! তুই কথা দিলে তবেই আমি বলব।
- অনেকক্ষণ ঝোলাঝুলির শেষে বললাম, 'বেশ কথা দিলাম! বল, কি চাস?'
- একটু মুখ নীচু করে ঝিল্লি বলল, ' আমার একটা সন্তান চাই নিখিল। তুই ফেরাস না!
আকাশ থেকে পড়লাম। ' মানে ' ? তোর বর?''
- বর জানতে পারবে না!
- না, না এ অসম্ভব! মরালিটির প্রশ্ন।
-আমি সব দিক ভেবে দেখেছি নিখিল। এতে কোনও সমস্যা হবে না।
- কেন? তোর বর কি ইমপোটেন্ট নাকি ইনফার্টাইল!
- কোনটাই নয়। ওর রিপোর্ট টিপোর্ট সব নরমাল। ডাক্তার বলেছে– চেষ্টা চালিয়ে যান; না হওয়ার কিছু নেই।
- তা চেষ্টা চালা। সবে তো চার বছর হল বিয়ের!
- আমি জানি নিখিল, রমেনের থেকে আমার কোনও দিন প্রেগন্যান্সি আসবে না।
- কেন? এমনটা ভাবার কারণ?
- আমার দেহ ওকে চায় না।
- বাজে কথা রাখ ঝিল্পি। এরকম কিছু হয় না।
- হয় রে! বহু পুরুষ স্ত্রীর সব ঠিক থাকা সত্ত্বেও বাচ্চা কেন হয় না জানিস? মেয়েদের সারভিক্স ওই স্পার্মদের ভেতরে এন্ট্রি অ্যালাউ করে না ।
- এর চিকিৎসা নেই?
- এরকম ক্ষেত্রে আই. ইউ. আই বলে একটা প্রোসিডিওর আছে– ইনট্রা ইউটেরাইন ইনসেমিনেশন– এতে স্পার্ম থেকে বেছে বেছে বলিষ্ঠ একটিকে নিয়ে যন্ত্র দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় ইউটেরাসে – একধরনের পার্সিয়াল-ম্যানিপুলেশন।
- এতে অসুবিধে কি? করিয়ে নে!
- তোর কি মনে হয় না এটা আমার ইউটেরাসের উপর এক প্রকার রেপ অ্যাটেম্পট। ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে একজনকে জোর করে পাঠানো হচ্ছে ওর ডিম্বানুর সাথে মিলিত হওয়ার জন্য। আর তুই তো জানিস ম্যানুপুলেশন আমি দু’চক্ষে দেখতে পারিনা।
- তুই বলছিস বটে ঝিল্লি, আমি তো এর মধ্যে অন্যায় দেখি না। তোর সন্তান তো তোর স্বামীর থেকেই হওয়া উচিৎ।
- আমার তো তাতে আপত্তি ছিল না নিখিল। নরমালি হয়ে গেলে তো ল্যাঠা চুকেই যেত।
- বেশ তো, সন্তান না হয় নাই নিলি। কত জনের তো বাচ্চা হয় না !
- এত সহজে কি সব মেটে রে! রমেন ঠিক করেছে আর পাঁচ-ছ মাস দেখবে– নরমালি ট্রাই করে না হলে আই. ইউ. আই বা আই. ভি. এফ করাবে–
আমি সেটা কোনোভাবেই চাই না। তাই আগেই একবার চেষ্টা করে দেখতে চাই– আমার ইউটেরাস তোকে গ্রহণ করে কিনা!
- আঙ্কল, আমার জন্য চকোলেট নিয়ে আসোনি কেন? তাকিয়ে দেখলাম টিঙ্কু এবার ধরা দেওয়ার মেজাজেই আছে। আমি হাত বাড়ালাম না। বললাম, ‘পরের দিন আনবো। তুমি যে এখানে থাকবে আমি তো জানতাম না।'
- প্রমিস?
- প্রমিস।
কী মিষ্টি বাচ্চাটা! অনর্গল কলকল করে কথা বলে যায়। এই বয়সটা শুনেছি বাচ্চাদের খুব আনন্দের। সারাদিন শুধু হুটোপটি। ঝিল্পির মেয়েও নিশ্চয়ই এভাবে মাতিয়ে রাখে? অবশ্য ওদেশে ওরা তো এসময়ে ক্রেশে থাকে। বাবা-মা দুজনে চাকরি করে। মেয়েটা নিশ্চয়ই এসময় এরকমই দাপাদাপি করতে চায়। ক্রেশের আন্টিরা নিশ্চয় অ্যালাউ করে না। বুকের মধ্যে যেন মোচড় দিয়ে উঠল কোথাও। বোধহয় এটাই রক্তের টান। নিউজার্সিতে পৌঁছে যেদিন প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ এলো, সেদিনই কনফার্ম করেছিল ঝিল্লি– এটা আমারই সন্তান। ডেলিভারী হওয়ার পর একবার নাম দেওয়ার জন্য ফোন করেছিল। ব্যস। তার পর আর যোগাযোগ নেই অনেক বছর। যোগাযোগ না থাকাই মঙ্গল– সবার জন্য। নীলার শব্দ পেলাম, 'নিন চা নিন। ' দিদি বানায়নি, আমি বানিয়েছি। খেয়ে বলুন, কেমন হয়েছে!’
আমি আনমনে চায়ের কাপটা ধরে বললাম, 'কী যেন ডাকো তুমি মেয়েটিকে?
- ময়না!
- বড্ড সেকেলে! অন্যকিছু বলে তো ডাকতে পারতে।
- আপনি একটা নাম দিন তবে। তাই বলেই ডাকবো।
- নাম কি সবাই দিতে পারে?
- চা কেমন হয়েছে বললেন না তো।
- ভালো। খুব ভালো।
- জানেন তো, মা বলে, যে চা ভালো বানাতে পারে তার মন ভালো হয়।
- তাই বুঝি?
- তা নয় তো কি। আপনার কি মনে হয় আমি খারাপ?
এই লড়াই এ ঢুকতে ইচ্ছে করলো না। ঝিল্লির মেয়ের একটা নাম দিতে পারলে ভালো হত। ঝিল্লির 'ঝি' আর নিখিলের 'নি'– ঝিনি! রিনিঝিনি.... রিনিঝিনি.... শুধু ' ঝিনি কি হয়? তা নইলে 'ঝিনুক'? অস্ফুটে নিজের কানে কয়েকবার বললাম কথাটা! নীলা চুপচাপ দেখছিল আমাকে। বলল, 'কি বিড়বিড় করছেন?'
- তোমার জামাইবাবুকে ডাকো। এবার ফিরতে হবে তো!
- আমি আজকে আর কলেজ যাবো না, আপনার সঙ্গে ফিরবো কিন্তু। হাসলাম। এর অর্থ হ্যাঁ নাকি না– বুঝতে পারলাম না নিজেই।
0 Comments