জ্বলদর্চি

কুল/ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৫৭

কুল

ভাস্করব্রত পতি

কাহিনি অনুসারে, বিদ্যার দেবী সরস্বতীকে তুষ্ট করার লক্ষ্যে মহামুনি ব্যাসদেব তপস্যা শুরু করেন বদ্রিকাশ্রমে। তখন দেবী সরস্বতী তাঁকে বলেন, তাঁর তপস্যার স্থানের কাছে একটি কুলবীজ রয়েছে। এই কুলবীজ অঙ্কুরিত হয়ে একদিন বড়সড় গাছ হয়ে উঠবে। তারপর যেদিন সেই গাছ থেকে কুল পেকে ব্যাসদেবের মাথায় পড়বে, সেদিনই তাঁর তপস্যা পূরণ হবে। তখন ব্যাসদেব শুরু করেন তপস্যা। এইভাবে চলতে চলতে একদিন ব্যাসদেবের মাথায় একটি পাকা কুল পড়ল। তখন ব্যাসদেব বুঝলেন যে তাঁর তপস্যা সম্পন্ন হয়েছে এবং দেবী সরস্বতী সন্তুষ্ট হয়েছেন। সেই দিনটি ছিল বসন্ত পঞ্চমী। এরপর ব্যাসদেব দেবী সরস্বতীকে সেই কুল নিবেদন করে পুজো দিলেন। সেইসাথে ব্রহ্মসূত্র রচনা শুরু করলেন। তাই মেনে চলা হয় যে, সরস্বতী পূজা না হলে কুল খাওয়া চলেনা। আর দেবী সরস্বতীর পূজায় প্রসাদ হিসেবে কুল দেওয়ার প্রথা চলে আসছে। বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটিতে মা সারদা দেবীকে সরস্বতী পুজোর দিন দুপুরবেলা অন্নভোগে কুলের চাটনি দেওয়ার রীতি প্রচলিত আছে। 
কুলের রাশি, ছবি -- নবকুমার মাইতি

যদিও সরস্বতী পূজার আগে কুল খেতে বারণ করার পেছনে অন্য কারণ রয়েছে বলে মনে করা হয়। কুল খেলে রক্তে ইয়োসিনোফিল বেড়ে গিয়ে সর্দি কাশি হতে পারে শীতকালে। আর সরস্বতী পূজার আগে কুল পরিপুষ্ট হয়না। কাঁচা এবং কষা থাকে। তখন খেলে শরীর খারাপ করতে পারে। তাই কুল খেতে নিষেধ করা হয় সরস্বতী পূজার আগে। 
কুলগাছের তলায় ছোটবেলার স্মৃতি, ছবি -- নরসিংহ দাস

কুলকে সংস্কৃতে বদর, বদরী বলে। বিখ্যাত চরক সংহিতায় (চরকমুনি কৃত, ১ ম শতাব্দী) এই বদর কূলের কথা উল্লিখিত হয়েছে। এর সূত্রের চতুর্থ অধ্যায়ে কুলকে 'হৃদ্য' বলা হ'য়েছে। যা খুব স্বাদু এবং হৃদ উপকারক। হিন্দুশাস্ত্র মতে কৈলাস পর্বতে অবস্থিত কুলগাছ বা বদরি বৃক্ষের মূল থেকেই পবিত্র গঙ্গানদীর উৎপত্তি হয়েছে। কুলগাছ ভগবান বিষ্ণুর কাছে খুব প্রিয় এবং পবিত্র বৃক্ষ। তাই ভগবান বিষ্ণুর অন্য নাম বদ্রীনাথ। অর্থাৎ বদরিবৃক্ষের ভগবান। তীর্থক্ষেত্র বদ্রীনাথের নামকরণও এই বদরি বৃক্ষ বা বদ্রীবৃক্ষ থেকেই উদ্ভুত। অথর্ববেদ অনুসারে, মৃতদেহের সঙ্গে এই বদ্রীবৃক্ষের তথা কুল গাছের ডাল বেঁধে দিলে, মৃতের আত্মা আর তাঁর বাড়িতে ফিরে আসেনা। 
কুল ভরা গাছ, ছবি -- নরসিংহ দাস

মহাভারতের ৯/৪১ অধ্যায়ে বদরতীর্থ অথবা বদরিকা তীর্থের প্রশংসা পাওয়া যায়। সুপ্রাচীনকালে মুনি ঋষিদের কঠোর তপস্যার অন্যতম স্থান হল বদরতীর্থ। যা মর্ত্যলোকের শ্রেষ্ঠ দেবস্থান বদরিনাথ বা বদরিনারায়ণ। আর শ্রেষ্ঠতম ঋষি হলেন বাদরায়ণ। রামায়ণেও বদরীবৃক্ষের কথা রয়েছে। শ্রী রামচন্দ্র যখন সীতাকে খুঁজতে ছিলেন, তখন দেখা পেলেন এই কুলগাছের। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে কুলগাছ জানায় সীতাকে রাবণ ধরে নিয়ে গিয়েছে। আর বাধা দেওয়ায় তাঁর দেহ ক্ষত বিক্ষত করেছে রাবণ। সীতাকে বাঁচানোর জন্য কুলগাছের এই প্রচেষ্টা দেখে শ্রীরামচন্দ্র খুশি হয়ে বরদান করে বললেন, এখন থেকে তোমার দেহ শক্ত সামর্থ্য হবে। সেই থেকে কুলগাছ শক্তিশালী হয়ে উঠল। মাটির তলায় সামান্য শেকড় থাকলেও কুলগাছ থেকে ফের নতুন পাতা গজিয়ে ওঠে। তাছাড়া রামচন্দ্রের বরে কুলগাছের কাণ্ড খুব শক্তপোক্ত। 

আবার মুসলিম সভ্যতায় পাঁচ পীর এবং সমুদ্রের দেবতা হয়ে উঠেছেন 'বদর'। মাঝিরা নৌকায় করে মাছ ধরতে যাওয়ার সময় নিরাপদে তীরে ফিরে আসার কামনায় এই বদর দেবতার নাম স্মরণ করে। রূপনারায়ণ নদের মাঝিদের মুখে শোনা যায় 'দুনিয়ার পীর বদর বদর' বলতে। নদী তীরবর্তী বিবর্তিত আর্যবংশীয়দের মুখে স্নানের সময় 'বদর বদর' বলতে শোনা যেত। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য লিখেছেন, 'বৈদিক শব্দাভিধানে মহামতি যাস্ক বদ ধাতুকে স্থৈর্য অর্থ ক'রেছেন, আর সেই ধাতুর উত্তরে অরচ্ প্রত্যয় ক'রে ব'লেছেন- বদর অর্থে স্থৈর্য'-সাধক'। 
বাজারে এভাবেই বিক্রি হয় কুল ভর্তি প্যাকেট

'শ্রীমদ্ বসন্ত! 
ভবদভ্যুদয়ে চ বৃক্ষাঃ 
কে পত্র পুষ্প ফলশালিন এব ন স্যুঃ। 
অস্মাকমল্প তপসাং বদরীতরূণাং 
ভ্রষ্টং ফলং চির শিখাস্তু জনৈ বিলূনাঃ'॥
অর্থাৎ - ওহে শ্রীমান বসন্ত! তোমার অভ্যুদয়ে কোন্ বৃক্ষই বা পত্রে পুষ্পে ফলে শোভিত না হয়, কিন্তু হতভাগ্য বদরীতরুর ভাগ্য এমনি যে, প্রথমে সমুদয় ফলভ্রষ্ট হয়, অবশেষে চিরজাত শাখাপল্লবের শোভা বিনষ্ট হয়।

কুলগাছ আলাদা করে পূজা না পেলেও দেবাদিদেব মহাদেব এবং দেবরাজ ইন্দ্রের পূজাতে অর্ঘ্য হিসেবে কুল নিবেদন করা হয়। দেওয়ালির সময় গোরুপূজা এবং চাঁদবাঁধানিতে বয়ের কুলের পাতা উপচার হিসেবে দেওয়া হয়। শিখধর্মে কুলগাছের কথা লেখা নেই। কিন্তু অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে থাকাথাকা কুলগাছটি শিখ ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র বৃক্ষ হিসেবে বিবেচিত হয়। শিখদের বিশ্বাস যে, এখানকার এই কুলবৃক্ষ যাবতীয় দুঃখ দুর্দশার অবসান ঘটাতে সক্ষম। কারাকোরাম পর্বতমালা এলাকায় পুরুষেরা তাঁদের মাথার টুপিতে কুল সহ কুলের ডাল গুঁজে রাখে। তাঁদের বিশ্বাস, এই কুলের গন্ধে সুন্দরী মহিলারা এসে তাঁদের প্রেমে পড়বে। 

এছাড়া কুলকে হিন্দিতে বের, মারাঠীতে বোর, গুজরাটিতে মেটা বোরডী, কন্নড়ে বেরণ, তেলুগুতে রংঘ, ওড়িয়াতে কুড়ি, অসমীয়াতে সীদরন বঙ্গ বলা হয়। এছাড়াও বরুই, রাজবদর, বজ্রকণ্টক, বৃত্ত ফল, দৃঢ় বীজ, সুক্ষাপত্র, দুষ্পর্শ, শবরাহার, ভুবদরী (ভু'ই কূল), শেঁয়াকুল, কর্কন্ধ, শৃগাল কোলি, টোপাকুল নামেও পরিচিত। ষোড়শ শতকের ভাবমিশ্রের (১৫-১৬ শতক, অনুবাদক -- কালীশচন্দ্র সেন, ১২৯৪) সংকলিত গ্রন্থ ভাবপ্রকাশে আছে রাজবদর এর নাম। এর অন্য নাম পৃথু ফল, তনু বীজ, মধুর ফল। 

শুক্ল যজুর্বেদের ১৯/২২ সূক্তে সৌত্রামনী যাগে উল্লিখিত আছে --
'ধানানাং রূপং কুবলং পরীবাপস্য গোধূমাঃ 
সন্ত্বনাং রূপং বদরং উপ বাকাঃ করম্ভস্য'।। 
এখানে 'কুবল' এবং 'বদর' নামের উল্লেখ রয়েছে। যদিও এগুলি একই প্রজাতির। কুবল অর্থে কোমল এবং মধুর। এই কুবলের বিজ্ঞানসম্মত নাম নাম Ziziphus sativa Geartn। একসময় এর নাম ছিল Ziziphus vulgaris।আর বদরের বিজ্ঞানসম্মত নাম -- Ziziphus jujuba Lam। 
এছাড়াও আরেকটি আহার্য বস্তু কর্কন্ধুর কথা মেলে --
'পয়সো রূপং যদ্য বাবা দধ্নো রূপং কর্কন্ধুনি। 
সোমস্য রূপং বাজিনং সোমস্য রূপং মামিক্ষা'।।
কর্কন্ধ বা কর্কন্ধুকে সংস্কৃতে বলে 'শৃগাল কোলি'। গ্রামবাংলায় অবশ্য সবাই চেনে শেঁয়াকুল বা শেকুল বা শিঁয়াকুল। এই কুল নাকি শেয়াল খায়, তাই এরকম নাম। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Ziziphus oenoplia Mill। কুল হল Rhamnaceae পরিবারভুক্ত। ভূবদরী নামেও একপ্রকার কুলের সন্ধান পাওয়া যায়। যার বিজ্ঞানসম্মত নাম Ziziphus nummularia W & A। ঠিক এরকম আরেকটি কুল গাছে মাটিতে লুটিয়ে চলে। মেদিনীপুর এলাকায় বেশি দেখা যায়। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Ziziphus minima। 

কুল গাছের কাণ্ডের রেখা বন্ধুর। পাতাগুলো গোলাকার। উপরের পৃষ্ঠ মোলায়েম এবং নিচের পূষ্ঠ লোমশ। চৈত্র মাসে গাছের ডাল কেটে দিলে প্রচুর ফল জন্মায়।শীতকালেই ফল জন্মায়। অম্লমধুর স্বাদের কুল সকলের খুব প্রিয়। দুপুরের মিঠে রোদে নুন লঙ্কা মাখিয়ে টোপাকুলের চাঁটের স্বাদ অসাধারণ। আর কুলের আচার তো যেন স্বর্গের অমৃত। বাজারে মেলে নারিকেল কুল। যা সাধারণ কুলের চেয়ে বড় আকারের হয়। এর স্বাদ বেশ সুমিষ্ট। নারিকেলের মত বড় আকারের বলে এরকম নাম। এছাড়াও রয়েছে বোম্বাই কুল। এটিও কূলের চেয়ে একটু বড় আকারের হয়। টক স্বাদ খুব কম। গ্রামাঞ্চলে যত্রতত্র জন্মায় সেঁয়াকুল। এটির কাণ্ডের গায়ে ভালোই কাঁটা থাকে। এই কুল কচিকাঁচাদের কাছে খুব আকর্ষণীয়। খুব ছোট ছোট ফল হয়। 

লোকগবেষক শিক্ষক নরসিংহ দাস হারানো শৈশবে কুল পাড়ার স্মৃতি নিয়ে লিখেছেন, 'কিছু স্মৃতি ফিরিয়ে নিয়ে যায় ছোটবেলায়... মনে পড়ে -- স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফেরার পথে, রাস্তায় কাছেই কুল গাছ থেকে কুল পেড়ে, খেয়ে, ব্যাগে ভরে নিয়ে না গেলে মনটা উসখুস করতো... কুল খেয়ে খেয়ে জিভের অবস্থা কসাটে ও ব্যাজার হয়ে যাওয়া... বেশি খেলে একটু পেট কামড়ানো... মজার ব্যাপার হলো অনেকগুলো কুল‌ খাওয়ায় পর শেষের কুলের বীজটাকে মুখের মধ্যে যতক্ষণ রাখা যায়, ততক্ষন রাখা... শেষে ঐ বীজটাই হয়তো বলে বসতো -- ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি...!'

কুলের মতো পরিচিত এই ফল নিয়ে প্রবাদ আছে বেশকিছু। খুব তেজাল প্রকৃতির কিছু, কিন্তু ধিকিধিকি জ্বলে। অর্থাৎ 'তালপুকুর, কিন্তু ঘটি ডোবেনা'। কুলকে সামনে রেখে তা বোঝাতে বলা হয়ে থাকে 'কুলকাঠের আগুন'। অযাত্রা বোঝাতে বলা হয় 'কুল কলাই, পথের বালাই'। কুল নিয়ে আরও কিছু প্রবাদের ব্যবহার দেখা যায় -- 'কুল পাড়ে, পরে খায় / কাঁদতে কাঁদতে ঘরে যায়', 'কুলগাছ থাকলে অনেকে নাড়া দেয়', 'কুল তো নয় কুলের আঁটি / নরম নয়, দাঁতে কাটি', 'কুল আর জল, নীচে করে স্থল', 'কুল নিয়ে কি ধুয়ে খাবো / চুল নিয়ে কি পেতে শোবো' ইত্যাদি। বাঙালি মেনে চলে, 'তাল তেঁতুল কুল / এই তিন বংশ করে নির্মূল'। তাই গেরস্থের ভিটায় এই তিন ধরনের গাছ লাগানো হয়না বংশলোপের ভয়ে। 

ভেষজ হিসেবে কুলের ব্যবহার রয়েছে। কুলের নির্যাস নাকি লিভার ক্যানসার প্রতিরোধ করতে পারে। Hep G 2-হিউম্যান হেপাটোমা কোষ (Human Heptoma cells) এর সক্রিয়তা কমিয়ে লিভার ক্যানসার প্রশমন করে কুলের রস। বসন্ত রোগের প্রতিষেধক বলা হয় কুলের বীজকে। পেটে বায়ু এবং অরুচি হলে, হৃদরোগের উপশমে, অতিসারে, সাদাস্রাব, রক্তস্রাব, বাত পিত্তের নিরসনে, খাই খাই রোগে, রক্ত আমাশয়ে, ফোঁড়ায়, প্লীহা রোগে, মাথার যন্ত্রনা উপশমে, মেদ রোগে, অর্শের যন্ত্রনার নিরাময়ে, জননেন্দ্রীয়ের মুখে চুলকানি হলে কুলের ফল, বীজ, গাছের ছাল, মূল এবং পাতার ভূমিকা বেশ আশাপ্রদ। নিউরোপ্রোটেকটিভ (Neuroprotective) হিসেবে ব্যবহার করা হয় কুলকে।

🍂

Post a Comment

0 Comments