গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত
বংশীবাবুর খবর এলো পর্ব ২
শেষ পর্যন্ত যাক আজ একটা খবর হয়েছে । মোটামুটি জম্পেস খবরই বলা যায়। সেলেব হলে এতক্ষণে এক্স ওয়াই জেড সব চ্যানেল, মিডিয়া ফেটে পড়ত খবরে, বিদ্যুদ্বেগে হ্যাশটাগাটাগি হত ইন্টারনেটে। বংশী ছোটখাট মানুষ তবু তো ম্যালিগনেন্সি বলে কথা। মানে শীগিগিরী আরো খবর হবে। নানা রকম টেস্ট, হাসপাতালে ভর্তি। ইন্সিওরেন্স একবার রাগ করে দেন নি, পরে আর পলিসি রিনিউ করেনি। অতএব সরকারী হাসপাতাল। আমেরিকা থেকে ছেলের দুশ্চিন্তা, ঘন ঘন গুগল কল। কেমো, রেডিও থেরাপী, ডিগডিগে কন্ডেমড সেলের আসামীর মত চেহারা, কেশহীন মাথা। তারপর আনন্দের রাজেশ খান্নার মত জিন্দগী বলে গান গাইতে ফেননিভ সমুদ্রগোধূলিতে হাঁটা। সেটা হবে না, কারণ মুম্বাই আর কে নিয়ে যাবে, বেলেঘাটার লেকে গিয়ে চেষ্টা করা যেতে পারে। বংশী গানটা গাইতে যান একবার। কিন্তু লাইনগুলো মনে পড়ে না। জানলাটা সমুদ্রতট ভেবে জোরে হাঁটতে গিয়ে দড়াম করে খাটের কোণায় হাঁটু দিয়ে মারেন। ঈশ্বর যাকে মারেন তাকে শুধু রিপোর্ট দিয়ে মারেন না, হাঁটুতে বাড়ি দিয়েও মারেন। বংশীর হাসি পায় এই তীক্ষ্ণ ব্যথার মধ্যেও। খেয়াল হয় বাড়িতে মুভ কবেই শেষ হয়ে গেছে, এখন ব্যথা এনজয় করা ছাড়া গতি নেই।
বস, এবারে এই খবরটা সমাজ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে হবে। বেশী ইতসাহ হলে বংশী নিজেকে বস বলে সম্বোধন করে থাকেন। বন্ধুদের গ্রুপে দিলে সবাই হই হই করবে নিশ্চয়, কিন্তু যদি না করে? তা হলে তো পুরো অসুখটাই বৃথা হয়ে যাবে, তার চেয়ে একটা দুটো কেস স্টাডি করে দেখা যাক, কে কি ভাবে খবরটা নেয়। খুব উৎসাহ নিয়ে বংশীবাবু পিং করতে বসেন তাঁর অশুভ সংবাদ পাবলিক করার জন্য।
🍂
প্রথম পিং করব চ্যাটারজীকে। ব্যাটা পাঁচ বছর খুব জ্বালিয়েছে। ফেসবুক হোয়াতে রোজ নানা রকম ছবি, আর ছোট ছোট ক্যাপশান, আর নীচে লাইন দিয়ে লাইক আর লাভ ইমোজি। আজ চায়না কাল সানিভেল তো পরশু পহেলগাঁও। আর বংশীর যাওয়া বলতে বছরে একবার বাসন্তী হাইওয়ে ধরে ৪০ কিমি পিকনিকের বিতানবীথি, নবাব বাড়ি ইত্যাদি বাঙ্গালী রেসরট হাউস। বংশীর কোনদিন কিছু পোস্ট করাই হল না আজ পর্যন্ত। এবার হবে।
হোয়াটসাপটা খুলতে তর সয় না। সেখানে তাকিয়ে আছে শয়ে শয়ে মেসেজ, জানা অজানার। সুইগি কারলোন মহান নেতার দৈনিক চিন্তন আর এইচআরের মেসেজ, ইওর পে স্লিপ ইস রেডি। এইচআরও আজকাল নিজে নাকি কিছু লেখে না সব চ্যাটজিপিটিকে দিয়ে লেখায়।
হ্যাঁ এইতো চ্যাটারজী। দুতিন মাস খবর নেই। তার আগে বুরজ খলিফার ছবি। হঠাৎ বৃষ্টিতে দুবাই ডুবে যেতে ঠিক যেন এক অতিকায় লাইট হাউস। ফরওয়ার্ড করা। হুঁ হুঁ এবারে আমি যে খবরটি দেব তা তোমাকে ভায়া শেয়ার করতেই হবে। ব্যাস এক ঘণ্টাতেই আমি হয়ে যাবো ভাইরাল। উত্তেজনায় কপালে ঘাম ফোটে বিন্দু বিন্দু। এই লিখলাম, এবারে সেন্ড। মেসেজটা হুস আওয়াজ করে তীরের মত বেরিয়ে যায়। বংশী কল্পনা করেন, মহাভারতের সেই জোদ্ধার কথা যিনি একটি তীর ছুঁড়লে তার থেকে বেরিয়া আসতো হাজার হাজার তীর, ঠিক যেন রাশিয়ান মিসাইল। এই এক্তি মেসেজ এখন তীরের মত গিয়ে বিঁধবে কত জনের কাছে কে জানে।
“আর কতদিন? মিলন হবে কতদিনে, আমার মনের মানুষের সনে। বুঝলে হে চ্যাটারজী, আমার ক্যান্সার।“
পাঠিয়ে দিয়ে মনটা শান্ত বিগ বাস্কেটের পাঁউরুটি হয়ে যায় বংশীর। এবারে চুপচাপ অপেক্ষা। জানলা দিয়ে হালকা বৃষ্টির গন্ধ আসছে। পেট্রিকর। কালই সাপ্তাহিকের একটা গল্প পড়ে শেখা এই নামটা। মাটির গভীরে লুকিয়ে থাকা ব্যাকটিরিয়া আর ভাইরাস হাল্কা বৃষ্টির ফোঁটাকে ভেলা করে ভেসে বেড়ায়। তাড়াতাড়ি জানলাটা দড়াম করে বন্ধ করে বংশী। এই সময়ে ইমিউনিটি কমে যায়। মরলে বড় রোগে মরব। ভুলভাল ভাইরাস ডেন্গু সেপ্টিক, লেপটো পছন্দ নয়। জীবনটা এতদিন ছিল মিয়োনো চানাচুরভাজা। যাওয়াটা হোক বেশ জমকালো। সেই চাওয়াটাও কি টু মাচ?
একটা করে মুহূর্ত কাটে বংশীর যেন এক একটা প্রহর। আপেক্ষিকতা। একেই বলে আসল অপেক্ষিকতা। যত আসতে দেরী তত সময়ও রবারের মত বাড়ে। একটা টুং। শুধু একটা টুং বাজুক। পিং করুক কেউ। দুবার চেক করেন ফোনে সাউন্ড অফ কিনা। ততক্ষণ চিঁড়ে জলে ভিজিয়ে বাটিতে তোলেন বংশী। আজকের লাঞ্চ। পাতলা চিঁড়ে সহজেই ভেজে। বংশীর মত। একবার ভালোবাসি শুনেই পায়ের কাছে নরম বেড়াল। নীনা অর্পিতা লাবণি। আকাশে হাতটা একবার এমনিই নেড়ে বলে ওঠেন ধুর। ঘরে কাটানো স্লিম দৈ মাখে চিঁড়েতে। কান কিন্তু ফোনের দিকে। সুদামের উপদেশমত এই ডায়েট জঘন্য লাগে। আস্তে আস্তে খান। ঘড়ির কাঁটা ঘোরে। রোদ পুবের জানলা থেকে আততায়ীর ছুরির মত ঘুরে এসে পশ্চিমের জানলায় আবার মুখোমুখি। এবার তার রঙ স্থির বহমান লাল।
সন্ধে সাতটা। এখনো নো রিপ্লাই? হোয়ার জানলায় এখনো দুটো কালো টিক। নীল আর হয় না। চাটুজ্জের কি হলো? গ্রুপের সবচেয়ে ব্যস্ত মেম্বার। সাড়া শব্দ নেই। নাহ বংশী চ্যাটারজীর ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। আর একজনকে চেষ্টা করা যাক। ললিতা, ললিতা বিশ্বনাথন পুরনো সহকর্মী। মাঝে মাঝে হঠাৎ খোঁজ নেয়। নতুন কি প্রোজেক্ট করছেন? জাভা ভালো না পাইথন? ওনামের শোভাযাত্রার ছবি পাঠায়। বলে সব মাতাল ছোটলোকদের মিছিল ভদ্রমহিলারা যায় না। তবু ছবি তোলে। পাঠায়। বংশী উত্তরে পাড়ার কালীপুজার প্যান্ডেলের ছবি পাঠান। চীনা এলইডির সামিয়ানা। মনে পড়ে ছোটবেলার কবিতা, চৌধুরীদের সামিয়ানা, বাইরে সেদিন হল আনা। যাক সে কথা, ললিতাকেও জানানো দরকার। হঠাৎ কবে আবার মেসেজ করবে। উত্তর না পেয়ে ভাববে অভদ্র। ও তো জানবেনা …
“ললিতা হাউ আর ইউ। ছবি আঁকছো? অর্কিডের ছবিটা শেষ হলো? এ আই নিয়ে কাজ করছো না কি? আমি এখন আর নতুন প্রোজেক্ট ভাবছি না। একটা খবর জানলে তোমার মজা লাগবে। না আমার প্রজেক্টের ফান্ডিং না। ও আর হল না, অপরিচিত অসংখ্য বাঙালি বুদ্ধিজীবির খাতায় আমারো নাম উঠে গেল। একটা কথা বলি। আমার জানো তো ক্যান্সার। “
সবটা এক নিঃশ্বাসে লিখে ফেলে বংশী সেন্ড টিপে দেয়। এবার নিশ্চয় উত্তর আসবে। দুঃখ পাবে? কে জানে। ক্যাজুয়াল প্রোফেশানাল পরিচয়। একটু হয়ত পাবে। পাবে বইকি। নৈলে আর ক্যান্সার হয়ে লাভ কি? গ্যাস্ট্রাইটিস হলেই হতো।
দুটো হলো। উত্তর আসবেই। দেখা যাক। বংশী পায়চারী করেন লিভিং রুমে। টিভিটা চলতে থাকে। বড় বড় জ্ঞানী গুণীরা দেশের ভালো মন্দ নিয়ে জোর আলোচনা করেন। শুনতে ভালো লাগে। বলা যায় নেশার মত। রোজ এই পায়চারী করতে করতে টিভি শোনা। মনে হয় দেশটা জীবন্ত। নরওয়ে বা সুইডেনের মত নিশ্চুপ ডিপ্রেসড না। বংশীর কি ডিপ্রেসড লাগছে! মোটেই না। এই পজিটিভ দেখেও না। একে বলে পজিটিভ মাইন্ড সেট। হোয়াতে উত্তর আসার অপেক্ষা করতে করতে বংশী ঘুমিয়ে পড়ে।
ঘুমের মধ্যে চাচারিয়ার আবির্ভাব হয় অযাচিতভাবে। একটি রিক্সাতে যাচ্ছেন ভিনোদজি হঠাৎ চারটে পাড়ার কুকুর কে জানে কেন রিক্সাটাকে তাড়া করে। রিক্সাগুলো বিদ্যুৎ চালিত হলেও বেশিজোরে যেতে পারে না অদ্ভুত এমন গঠন। কিন্তু কুকুরদের আওয়াজ শুনে ভিনোদ চাচারিয়ার মেয়ের বুকের আশ্রয়ে থাকা ছোট্ট বেড়ালছানাটি দুবার মিউমিউ করে ওঠে। তারপর হঠাৎ ফ্যাঁসফ্যাঁস করে ভীষণ রাগ দেখিয়ে তিড়িং করে একটা লাফ দেয় সোজা পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক লোকাল দাদানেতা গোস্বামীবাবুর গায়ে। নেতা যাচ্ছিলেন আসন্ন পুরসভা ভোটের মিটিংএ। কিন্তু তাঁর গায়ে বেড়াল গিয়ে পড়ে ও তিনি ধরাশায়ী হন। স্বপ্নের ঘটনা ব্যকরণ বা ক্যাপশান ছাড়া ছবির মত ঘটতে থাকে, কোন লজিক ছাড়াই।
চাচারিয়া আর গোস্বামী বিপরীত পার্টির লোক। তর্ক বিতর্ক থেকে বেন্গলী ঐতিহ্যমত হাতাহাতি শুরু হয় একটু পরেই। বংশীর বাড়ীর সামনে এই দেখে বংশী আর স্থির থাকতে না পেরে দৌড়ে হাতাহাতি থামাতে যান। দুই যুযুধান উটকো থার্ড পার্টির ভোট কাটাকাটি সহ্য না করতে পেরে দুজনেই ধাক্কা মারেন। বংশী পড়ে যায়, নাকের পাশ দিয়ে গড়িয়ে আসে ছোট্ট রক্তের এক ধারা। এই সুযোগ। বংশী আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। ট্রাজিক নায়কের মত হাত দিয়ে রক্তের ধারাটা মুছে বলে ,
জানেন আমি ক্যান্সার পেশেন্ট। আমাকে মারলেন। আপনারা কি মানুষ?
পেশেন্ট তো হসপিটালে যাও না চাঁদু। চাচরিয়া সকালের অপ্মান এখনো ভোলেন নি। এগিয়ে এসে ছেঁড়া কুর্তার হাতাটা গুটিয়ে আবার সজোরে এক ধাক্কা লাগান।
ঘুমটা ভেঙে যায়। নাকের পাশে হাত দিয়ে দেখেন রক্ত নয়। হাল্কা অশ্রুধারা। বালিশটা ভিজে গেছে। পজিটিভ হওয়ার দুঃখের থেকে বেশি কষ্ট লাগে এখনো হোয়ার কালো টিক দুটি কালোই হয়ে আছে। নীল আর হয় নি।
0 Comments