লাশটের বগী শেষ পর্ব
ভাবতে ভাবতেই হঠাত প্রচন্ড ঝাঁকুনি। স্বপ্নের জাল ছিঁড়ে চোখ সটান খুলে গেল সুকুমারের। দেখলেন সামনের ওপরের বাংক থেকে একটা ব্রিফকেস তাঁর দিকে ছুটে আসছে একটা এস্টিরয়েডের মত। দুহাত দিয়ে আটকালেন কিন্তু আইপ্যাডটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। ওপাশে দুই ব্যাবসায়ী গড়িয়ে পড়লেন কামরার মাঝখানে। বোধহয় তেমন লাগে নি কিন্তু উঠতে আর পারছেন না। দুজনেই ভয়ে রাম নাম করতে শুরু করলেন। দুটো সুটকেস সামনের দিক থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে তাঁর পাশ দিয়ে কামরার অন্য প্রান্তে চলে গেল।
এক্সিডেন্ট? তাঁর ট্রেনেও? প্রোবাবিলিটি থিওরি ফেল করে গেল! সুকুমার অংক নিয়ে পড়াশোনা করেন নি তাই জানতেন না, দশবার হেড পড়ার পরেও টেল পড়ার সম্ভাবনা কিন্তু ৫০-৫০। দুর্ঘটনা একবার ঘটলেও আবার ঘটতেই পারে। বিশেষ করে যদি সিগন্যালিং সিস্টেম ফেল করে। বিশেষ করে যদি সিগন্যালিং সিস্টেম সারাবার লোক আসতে তিন দিন লাগে। বিশেষ করে যদি সিগন্যাল খারাপ ও তার জন্য দরকারি ইন্সট্রাকশান দেওয়াটা দরকারি মনে না করে কেউ। বিশেষ করে, যাক সুকুমারও জানেন না, রেলের কলঙ্কিত চালকরাও জানেন না অত কথা।
সুকুমার দেখলেন জানলা দিয়ে, মাটি অনেকটা নীচে। তাঁদের কামরাটা ঝুলছে প্রায় ১০ ফিট ওপরে। সামনের কামরাটা গড়িয়ে শুয়ে পড়েছে, আর ওঁর কামরাটি সামনের কামরার ওপর উঠে গেছে একটা ডাইনোসরের মত, সেখান থেকে অনেক দূর দেখা যাচ্ছে। অনেক লোকের গলার আওয়াজ দৌড়ে দৌড়ে আসছে তাঁদের দিকে। সুকুমার খেয়াল করলেন, বাইরে শস্যশ্যামলা বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত, অনেক লোক সেখান থেকে দৌড়ে আসছে রেল লাইনের দিকে।
🍂
রিয়া একটা এস ইউ ভি চালায় কলকাতায়। তাতে করে মাল পত্র যাওয়া আসাও করে কিন্তু প্রধান কারণ হচ্ছে রিয়ার ভয় করে ছোট গাড়ীকে সবাই ইচ্ছে করে ধাক্কা মারবে, কলকাতার রাস্তায় এটাই নাকি নিয়ম। আর এস ইউ ভি থেকে নাকি রাস্তার অনেক ওপর থেকে সবটা দেখা যায়, মনে হয় রাস্তাটা আমার সম্পূর্ণ আয়ত্তে। সুকুমারের সেরকম মনে হল উপরে ওঠা কামরা থেকে চারপাশটা দেখে। রিয়া যদি দেখত খুশি হত। তিনি এই এস ইউভি ট্রেনে চেপে বেশ সন্তুষ্ট বোধ করলেন। শুধু ভাঙ্গা আইপ্যাডটার জন্য একটু দুঃখ হল। একটা নতুন প্লটের ছক কষছিলেন, মার্ডার, রেপ আর রাজনীতির একটা সলিড পাঁচন। এখন লোকে খুব খাচ্ছে। তবে এক্সিডেন্ট নিয়ে একটা নতুন গল্প লেখা যাবে, সেটাও একটা পাওনা।
বেশ খানিকটা সময় ঐ ভাবে কেটে গেছে, সুকুমার চুপচাপ বসে। দুই ব্যবসায়ী গড়িয়ে গড়িয়ে উঠতেও পারছে না আবার বসতেও পারছে না। তারা একপাশে টিকটিকির মত আটকে হাত দিয়ে ধরে রয়েছে সীটের ধারটা আঁকড়ে গুছিয়ে নিয়েছে। তারা আবার হিন্দীতে শেয়ার নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। আইপ্যাডটা থাকলে বেশ ছবি তুলে রাখা যেত, সঙ্গে একটা অন দি স্পট রিপোরট, ইউ টিউবে দিয়ে দিলে খুব ভাইরাল হত। আপাতত সুকুমার রিয়ার কথাই বসে বসে ভাবতে লাগলেন। রিয়া আমার বৌ, মানে স্ত্রী মানে ওয়াইফ। মানে ঠিক কি? রিয়া কি আমার কথা ভাবে? ডাস শি এভার থিঙ্ক অফ মি? না সেই ক্লাস নাইনে লেখা পাশের বাড়ীর কমলাকে লেখা প্রেমপত্র পড়ার পর থেকেই এখনো আমাকে সন্দেহ করে যায়। চিঠিগুলো সুকুমার লিখেছিলেন কিন্তু পাঠাবার সাহস হয় নি কোনদিন। লুকিয়ে রাখতেন একটা ব্রীফ কেসে, অনেক পান্ডুলিপির মধ্যে। রিয়া ঠিক খোঁজ পেয়ে গিয়েছিল, মেয়েদের কাছে কিছু লুকানো যায় না। কিছুটা বোঝাবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন সুকুমার।
আস্তে আস্তে বেরোবার চেষ্টা করুন দরজা দিয়ে, কারা যেন চেঁচিয়ে উঠল। পাশে একটা বিরাট বুল্ডোজারের মত জিনিষ, ট্রেনের দরজায় লাগিয়েছে। যাক আমাদের উদ্ধার করা হচ্ছে তাহলে। ব্যবসায়ী দুজন এক মুহূর্ত দেরী না করে হামাগুড়ি দিয়ে চল্লেন গেটের দিকে। সুকুমার হাসলেন। তিনি কখনো আগে যেতে পারেন না। অন্য কেউ ঠিক চলে যায়। কমলা এখন দিল্লীতে থাকে, ওর হাসব্যান্ড বড় রেলের কন্ট্র্যাক্টর। থাক ওরা সুখেই থাক।
এম্বুলেন্সে করে সবাইকে নিয়ে যাওয়া হল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। চেক আপের জন্য। যদিও এ সি গাড়ীর কারো কিছু হয় নি, সবাই সুস্থ, টুক টাক ছড়ে যাওয়া বা মাথায় ঠোকা খাওয়া ছাড়া। সুকুমারকে প্রথমে একজন নারসদিদি এসে চেক করলেন। প্রেসার, টেম্পারেচার সব নিয়ম মত মাপা হল, আজকাল করোনার পরে সবার অক্সিজেন মাপা হয়, যদিও দুর্ঘটনায় অক্সিজেন কি করে কমবে তা সুকুমারের মাথায় এলো না। নার্সটি চটপটে, এবং খিটখিটে। সুকুমার করুণ চোখ করে বসে রইলেন যতক্ষণ না তাঁর সময় আসে। বসে ভাবতে লাগলেন, মিস হয়ে যাওয়া চিকেন কাটলেটের কথা, পুরস্কার সভায় বলার জন্য একটা বক্তৃতা লিখে এনেছিলেন, কাগজে। সেটা আর পড়া হল না।
বসে থাকতে থাকতেই দেখলেন বাইরে বেশ ভীড় জমছে ধীরে ধীরে। বেশ কিছু লোক বসে আছে। তাদের অনেকেরই মাথায় হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ। একটু পরেই একের পর এক আসতে শুরু করল স্ট্রেচার। স্ট্রেচারে নানা রকম নানা বয়সী ভাঙা চোরা মানুষ। কাতরানি, কান্না আর আর্তনাদে চারদিকটা ভরে উঠতে লাগল। দুজন নার্স আর একজন ছোট ডাক্তার হিমসিম খেতে শুরু করল, হঠাত এত পেশেন্ট সামলাতে গিয়ে। সুকুমারের খিদে পাচ্ছিল, খালি পেট, গা গুলিয়ে উঠতে লাগল মাঝে মাঝে। কিন্তু যতক্ষণ না রিলিজ হবেন ততক্ষণ কিছু করার নেই। শোনা গেল, রেল থেকেই বাসের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, তাঁদের নিয়ে যাওয়া হবে কাছের বড় শহরে। সেখান থেকে খাতায় নাম ধাম লিখে রিলিজ করা দেওয়া হবে। দুই ব্যবসায়ীর আগেই চেক আপ হয়ে গেছে, তাঁরা দুটো চেয়ার দখল করে নিয়ে আবার শেয়ার নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করলেন। ঝোলা থেকে বার করে দুটি পরোটা আর এক প্যাকেট সেও চিবোতে থাকলেন সুখে, সুকুমার জুল জুল করে ঐ প্যাকেটের দিকেই তাকিয়ে আছেন দেখে দুজনে একটু ঘুরে বসলেন।
হঠাত হই হই করে একটা প্রবল আওয়াজ উঠল ভীড়ের মধ্যে। কি ব্যাপার, নাকি এবার সব ডেড বডি গুলো আসছে, সেগুলো গুনতি হবে তারপর লরী করে নিয়ে যাওয়া হবে শহরের মর্গে। সেখান থেকেই লোকে খুঁজে নিতে পারবেন তাঁদের নিহত পরিজনদের।
এটা কোন কামরার? সুকুমার এক রেলের কর্মী খাতা নিয়ে দৌড়চ্ছিল, তার কাছে জানতে চাইলেন, কৌতূহল তো স্বাভাবিক।
কর্মীটি যেতে যেতে বলে গেল,
-ঐ লাশটের বগী। যত লাশ তো ওখানেই। এক্সিডেন্ট হলেই যা হয়।
হঠাত বিদ্যুচ্ছটার মত একটা স্পারক হল সুকুমারের মাথায়। শমিত তো লাশটের বগীতেই ছিল না। ওর কাছে একটা বিস্কুটের প্যাকেট ছিল। যাঃ ছেলেটার নীট পরীক্ষা তাহলে আর দেওয়া হল না।
পায়ে পায়ে এগিয়ে ভীড় টপকিয়ে একটু উঁকি দিলেন। অনেক লোক মোবাইল নিয়ে ফটো তুলছিল। একজন পুলিশ একটি একটি করে মুখ খুলে তার ফোনে রেকর্ড করে রাখছিল। আজকাল এসব খুব সুবিধে। সুকুমার ঠেলা ঠেলি করাতে একটু বিরক্ত হলেন সেই পুলিশ
-কি ব্যাপার ঠেলছেন কেন? আপনার কেউ আছে নাকি এখানে? আপনার গায়ে তো দেখছি এসি কামরার নাম্বার সাঁটা, এখানে কি করছেন?
সুকুমারের ততক্ষণ চোখে পড়ে গেছে একটা বাজারের ব্যাগ, তার গায়ে লেখা পিপিপি পান মশালা। হলুদ আর নীল দিয়ে। তার ওপর অনেকটা লাল ছোপ, যেন কোন বিরাট ব্যক্তি পানের পিক ফেলে গেছেন।
-কি স্যার আপনার কেউ আছে কি এখানে?
-না না, আমার কে আর থাকবে। এমনি দেখছিলাম।
সুকুমার ধীরে ধীরে সেখান থেকে সরে যান। কেউ হাঁকতে থাকে, লাশটের বগী ২২, লাশটার বগী ২৫, লাশটের বগী ৫০…
0 Comments