জ্বলদর্চি

প্রেম দিবস /গৌতম বাড়ই

অঙ্কন সৌজন্য: এম.আলি

প্রেম দিবস 
গৌতম বাড়ই 

'ভ্যালেন্টাইনস ডে' বা একটু রসিয়ে সোজা কথা বললে আদতে তো 'প্রেম দিবস'। কিন্তু মানুষ কখনও সোচ্চার হয়ে বলে না প্রেমের কথা। হিংসা বা জিঘাংসা কিংবা বৈরীতা যেমন ক্রুদ্ধ গলায় কল্লোল আর কলরবে উচ্চারিত হয়। প্রেমের বাণী, প্রেমের শব্দ নীরব থাকে সেখানে। প্রেম একবার নয়, বহুবার আসে নীরবে। প্রেমের মাধুর্য তো সেখানেই। ভালোবাসার রঙ হল লাল, এ লাল হৃদয়ের প্রকোষ্ঠে রক্তের প্রবাহধারা  লাল বলে আসেনি। এসেছিল এক রক্তাক্ত ইতিহাসের পথ ধরে। এক হৃদয়বিদারক ঘটনা থেকে। 

তাহলে আমরা একবার ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে পিছন দিকে হাঁটি। আসলে মজার কথা কী এই ইতিহাস নামক বস্তুটি, বা তাকে প্রাণ দান করে যদি একজন মানুষ হিসেবে কল্পনা করি,  সে সময়ের ফাঁক ফোঁকরে তার সময়ের সত্যি কথাগুলো ঠিক গুঁজে রাখে। আর সময়ের ধারায় তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে, সমস্ত কানে কানে ঠিক পৌঁছে যায়। পৃথিবীর সৃষ্টির ইতিহাস যদি সাত কোটি বছর হয়, তাহলে আজ থেকে মাত্র পনের'শ বছর আগে পঞ্চম শতাব্দীর প্রায় শেষের দিকে পোপ গেলাসিয়াস ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে 'ভ্যালেন্টাইনস ডে' বলে ঘোষণা করেছিলেন।‌ তখন প্রেম দিবস নয়, একজন মানবপ্রেমী মানুষের সাথে জড়িয়ে যাওয়া একটি বিশেষ দিন। তবে দিনটির গায়ে ভ্যালেন্টাইন কেন? কারণ ভ্যালেন্টাইন একজন খ্রিস্টধর্মের যাজক ও চিকিৎসক। রোম দেশের বাসিন্দা ছিলেন, খ্রিস্টধর্ম প্রচার ও মানবসেবার জন্য রোমের সমকালীন শাসক সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে বন্দী করেন কারাগারে। যাঁর জীবনটাই উৎসর্গ করা আছে মানুষের জন্য , তাই কারাগারেও বন্দী থাকাকালীন চিকিৎসা করে এক দৃষ্টিহীন মহিলার। দৃষ্টি ফিরিয়ে দেন তার। আর এতে ভ্যালেন্টাইনের জনপ্রিয়তা এতই বৃদ্ধি পায় দেশে, সম্রাট ক্লডিয়াস এতে রুষ্ট হয়ে ক্রোধে ফেটে পড়েন। নিশ্চিহ্ন করতে হবে এমন বেয়াকুব বেয়াদব মানবপ্রেমীকে। ভ্যালেন্টাইন এর মৃত্যুদণ্ড দিলেন। আর সেই দিনটি ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি। ভ্যালেন্টাইনকে হত্যা করে তিনি কী ভালবাসাকে নিশ্চিহ্ন করতে পারলেন এ পৃথিবী থেকে? কেউ কখনও পারেনি। বিয়োগান্তক হলেও প্রেম চির স্মরণীয়। চির অমর। তাই আজ দেশে দেশে ওই ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটি পালিত হচ্ছে তাঁকে স্মরণ করে প্রেম দিবস হিসেবে।‌

🍂

আমরা ধ্বংস করি নিজেদের প্রতিটি মুহূর্তে, ভুলে যাই তারপর। মানুষের শোণিত ধারায় সতত প্রবহমান ধ্বংসবীজ। তাই তো মানুষ নিষ্ঠুর। প্রতিহিংসাপরায়ণ। এই নিষ্ঠুরতা চিরদিন চলে আসছে। এর মাঝেও আলাদা করে এই যে প্রেম দিবস, এই যে তার আন্তর্জাতিকতা, আসুক সে বিশ্বায়ন, উদারীকরণ অর্থনীতির হাত ধরে, আমি দেশে দেশে, এমন কী আমাদের  প্রতিবেশী দেশগুলোতেও এত ধ্বংসলীলা আর নিষ্ঠুরতার মাঝে তাকে বরণ করব না? আহ্বান করব না? যতই থাকুক আমাদের নিজস্ব এক ভালবাসার দিবস সরস্বতী পুজোর দিন, প্রেমের জন্য আরও একটা দিন বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ুক না! 

প্রেম কী চায় কিছু? কিছুই চায় না সে। সে চায় সৃষ্টি করতে।

"নাই আমাদের কনকচাঁপার কুঞ্জ
বনবীথিকায় কীর্ণ বকুলপুঞ্জ। 
হঠাৎ কখন সন্ধ্যাবেলায় 
নামহারা ফুল গন্ধ এলায়, 
প্রভাতবেলায় হেলা ভরে করে 
অরুণকিরণে তুচ্ছ ....
নাই আমাদের সঞ্চিত ধনরত্ন,
নাই রে ঘরের লালনললিত যত্ন। "

সে চায় পৃথিবীর এ প্রকৃতির  তলে অনুভব করি, ঘোষণা করি প্রেমের ---
"এসো গোলাপের গালচে বিছোই 
ভিসুভিয়াসের গাত্রে 
আকাশের তলে পাশাপাশি শুয়ে রই 
চন্দ্রবিহীন উল্কাপাতের রাত্রে।"

প্রেম কী সময়ের সাথে স্থিতু হয়ে আসে? না কি রাতের সব তারা থাকে দিনের আলোর গভীরে। প্রেম গভীর আর ব্যাঞ্জনাময় হয়ে বয়সের গভীরেও। যে বয়স পেছনে না হেঁটে এগিয়ে চলে সামনে। একটা প্রকাশ্য চুম্বন, একটি ভালোবাসার দীপ্ত প্রকাশ। একটি প্রকাশ্য শ্লীলতাহানি সমাজ ধ্বংসকারী। প্রতিবাদ হোক ধ্বংসের, সৃষ্টির নয়। সৃজনশীলতা প্রেমেরই অন্য এক রূপ। প্রেম চিরকাল কাম্য। প্রেম দিবসের জয়ধ্বনি হোক। যেখানে ধর্মীয় গোঁড়ামি আর মৌলবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, সেখানে প্রেমও বাধাপ্রাপ্ত হয়। বিধিনিষেধের জালে আটকা পড়ে, আজ থেকে হাজার দেড়েক বছর আগে যা ছিল, এখনও তাই। 


এত এত দিবসের মাঝে না হয় একটা দিন শুধু প্রেমের জন্য বরাদ্দ থাকল। প্রেমময় হয়ে রইলো সারাদিন, রেশ থেকে গেল বছরের পর বছর ধরে। এসো তবে উষাকালের শুধু জয়ধ্বনি নয়, জীবনের গোধূলি লগ্নেও প্রেমের প্রকাশ থাকবে না! মনে হয় প্রেম তখন আরও গভীর, আরও মনোরম। 


স্নিগ্ধতা থেকে মানুষের জন্ম, ঠিক যেন প্রত্যুষের অরুণোদয়। স্নিগ্ধতা মেখেই মানুষের প্রস্থান, অস্তাচলের সূর্যের বেলাশেষে। এর মাঝে পরে থাকে প্রেম অপ্রেম হিংসা বিদ্বেষ কাম অকাম দেহী বিদেহী অনন্ত আত্মার পথের পাঁচালী। তবুও বলব বেলাশেষেই অপার্থিব সৌন্দর্যে আমাদের মনপ্রাণ ভরে ওঠে। কারণ, তখনই তো আমরা এক পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠি। শুধু ভালো থেকো বন্ধু আগামী দিনগুলোতে। এই আমার খোলা চিঠি তোমাদের বা আপনাদের। হয়ত গোলাপের দিন, এসেছে প্রেম উপস্থাপনার দিন,আসছে নতুন করে জন্মানো ভালোবাসার ভ্যালেন্টাইন দিন। নতুন করেই হোক না, সে তো মনে করিয়ে দেবার জন্যই জন্মাচ্ছে, আমাদের প্রত্যেকের ক্ষয়িষ্ণু ভালোবাসা যেন আবার জেগে ওঠে ভালোবাসার নতুন এক ফিনিক্স পাখি হয়ে সময়ের ধ্বংসস্তূপে খন্ডহরের অন্দর থেকে।
শেষ।

Post a Comment

0 Comments