জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় /সাতান্নতম পর্ব /আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় 
সাতান্নতম পর্ব 
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী 

বাইরে তখন ঝরা পাতার মর্মর, দিন বড়ো হচ্ছে।সূর্য ক্রমশঃ হেলে পড়ছে দক্ষিণায়ন থেকে উত্তরায়ণের পথে।শীতের জড়তা কাটিয়ে নতুন ফল-ফুল-পাতার উজ্জ্বল্যে পৃথিবী নিজেকে সাজাতে চাইছে আবার।‌জ্যাঠামশাই বলতেন,দক্ষিণায়ন দেবতাদের বিশ্রামের সময়।উত্তরায়ণ এলে তাঁদের জাগরণ,তাই হয়তো নবপ্রাণ সমারোহে সৃষ্টির উল্লাস;গাছে গাছে নব দূর্বাদল-শ্যাম পত্রমুকুল,এখানে ওখানে বাসক ফুটছে,কূলগাছে থোকা থোকা কূল,মৌমাছিরা চাক বানাতে ব্যস্ত,সরস্বতী পুজোর সময় হয়ে এলো।
সজনে গাছের তলাটিও সারাদিন ভরে থাকে ঘিয়ে রঙের অপরূপ গন্ধবিলাসী ফুলের ভারে,চোখ ও ভিভ দুইয়েরই আনন্দ হয়ে।
মাঝে মাঝে হাওয়ার দোলায় পুকুরপাড়ের বাঁশবনে বাঁশির শিহরণ, শিরীষ ডালে পাতার কাঁপন,অনাগত বসন্তের উতলা আহ্বান।

বৃদ্ধা তাকিয়ে থাকেন জানলা পারের আকাশের দিকে।এসময় আকাশটা বেশ নীলই থাকে।দৃশ্যমানতার অনেক ওপরে নীলের বুকে একটি চক্রাকার বিন্দুর মতো চিল উড়ছে। নিঃসঙ্গ,একা, কিন্তু গতি তার বিরামহীন। বিরজার নিজের মতোই নয় কি!
দীর্ঘায়িত নিঃশ্বাস পতনের মতো,এমন অলসক্ষণে, কতো কথা মনে পড়ে, নিত্যদিনের ব্যস্ততায় চাপা পড়ে থাকা প্রাত্যহিক তুচ্ছতা ও খুনসুটির স্বার্থ,দ্বেষ,হিংসে, ভালোবাসা,আবেগ,স্ক্ষলন,মানুষী দূর্বলতা…আরও কতো কি! 
সারাজীবন তো নানারকম ভাবেই জীবন কাটালেন, জানেন,বোঝেন সব।তবু কখনও কখনও সবার মধ্যে থেকেও যে বড়ো একা লাগে,বড্ডো উদাসীও।সদা ব্যস্ততার মাঝেও মনে হয়, দুদন্ড কারো কাছে আঁচল পেতে বসি,একটু শান্তি,একটু বিশ্রাম।
কিন্তু সে জন কোথায়?

তবে, এখন তো এমন ভাববিলাসী হলে তাঁর চলবে না, অনেকদিন পরে,সংসারের দায়িত্বের খুটিনাটি তাঁকে আবার ডেকেছে,সাড়া যে তাঁকে দিতেই হবে।
অতয়েব,একটির পরে একটি বাক্সের ডালা উঠলো,প্রায় বছরভ’র আটকে থাকা বন্ধ ভ্যাপসা হাওয়া বেরিয়ে তাঁদেরও যেন দক্ষিণায়ন যাত্রা শুরু হলো।

🍂

 
জানলা পারের চলকে আসা রোদে একে একে ডানা মেললো এ বাড়ির সমস্ত জমি জায়গার দলিল, শ্বশুর বাবার আশীর্বাদী দানপত্র,মেয়েদের বিয়ের পাটিপত্র(সেকালে বিয়ের আগে দুপক্ষের মুরুব্বিরা একসঙ্গে বসে দেনা-পাওনা,আচার-অনুষ্ঠানের লিখিত চুক্তি করতেন,তাকেই পাটি পত্র বলা হতো। তখনকার দিনে পাটিপত্র ছাড়া বিয়েই হতো না),জ্যাঠাইমার শ্রাদ্ধশান্তির ফর্দ,জ্যাঠামশাই য়ে রং নিজের হাতে লেখা;
কবেকার যেন বাসন্তী পুজোর হিসাব,জ্যাঠাইমার সেই বন্ধকী খেরো খাতা…আরও কতো কি!
সারা ঘর,সারা মন জুড়ে উড়তে লাগলো তারা।এমন সময়েই হঠাৎ হাওয়ায় কোথা থেকে যেন একখানি শুকনো পাতা উড়ে এসে পড়লো কোলের প’রে। চমকে উঠলেন বৃদ্ধা!...
স্মৃতি,স্মৃতি।ঐ যে তলায় দেখা যাচ্ছে সেই তাঁর বই কয়টি, শ্বশুরবাড়ির দানপত্রের চাইতেও আদরভ’রে যেগুলি আগলে রেখেছিলেন জীবনভ’র।
অনেকদিন ছোঁওয়া হয়নি ওদের।একটু ছুঁতে ইচ্ছে হলো।
ঐ স্পর্শটুকুই যে নিভৃত স্বামীসঙ্গ তাঁর,বিজন প্রেমালাপ…
ভাবতে ভাবতে আঙুল ছুঁলো তস্য পুরনো কয়েকটি বইয়ের পাতায়,যার পাতায় পাতায় আজও অমলিন কোন এক ভুলে যাওয়া সময়ের কোন এক মেধাবী ছাত্রের কলমের আঁচড়।
মানুষ চলে যায়,পিছে পড়ে থাকে তার সম্পদ,তার স্মৃতি,আগলে রাখে তার প্রিয়জনেরা।

তিনি যখন চলে যাবেন,এমন করেই তাঁর কথা ভাববে কি কেউ,কে জানে!
ইদানিং কি যে হয়েছে,শরীরটা মোটামুটি ভালো থাকলেও মন যেন তাতে সায় দেয় না। দীর্ঘদিন বিছানাবন্দী থাকার জন্যই হোক,বা বয়সের জন্যই হোক,কেমন যেন এক নিস্পৃহ নিরাসক্তি তাঁর শরীর মনে ছেয়ে পড়ছে ক্রমাগত।
পারেন না তা নয়, এখনও টুকটাক কাজকর্ম চেষ্টা করলে করতেই পারেন, কিন্তু কিছুই করতে ইচ্ছে হয় না যেন। পরিজনদের তুলনা নেই, তাদের অনলস সেবা ও যত্নেই আবার ফিরে এসেছেন জীবনে,তবে বেশ বুঝতে পারেন মনে মনে,নিভে যাওয়ার আগে এ শুধুমাত্র কিছুক্ষণের জন্য পুনরায় জ্বলে ওঠা…
মাঝরাতে বুকে চাপ লাগে,জানলা পারের হাওয়ায় হাওয়ায় কার বা কাদের যেন অশরীরী ডাক,দূর আকাশের ছায়াপথের আলোয় বৈতরণী পারের আহ্বান…
সময় যে হয়ে এলো,আর দেরী নেই। 
তাই হয়তো যতটা পারেন,দুহাত বাড়িয়ে কুড়িয়ে নিতে চান জীবন সঞ্চয়। 

এই যে এই ছোট্ট বাচ্চাটি তার দুহাত বাড়িয়ে জীবনাধিক আসঙ্গ স্পৃহায় ঘিরে রাখছে তাঁর মন, এই যে নতুন বৌটি তার হৃদয় ভরা আগ্রহ নিয়ে শিখতে চাইছে সংসারের হাজার খুঁটিনাটি, এই যে চারিদিকের অনন্ত ঐশ্বর্যময় পৃথিবী তার রূপ রস গন্ধ বর্ণ নিয়ে মাতিয়ে তুলছে অনুভবীর হৃদয়,এসব যে বড়ো মায়া!এ বন্ধন যে কাটাতেই হবে তাঁকে। মেঘের নির্ভারতায় ভাসতে হবে শুধু,নাড়া বাঁধার দায় যে তাঁর ফুরিয়েছে।

জীবন তো অনেক কিছুই দিল তাঁকে। চলে যাওয়ার সময় মায়া রাখতে নেই। যতখানি আদরে জড়িয়ে ছিলেন, ততখানি আদরেই ছাড়তে হবে সব, ঠিক যেমনভাবে সকালের সোনা রোদ খেজুর রসের জিরাণে ঘন হয়ে বিকেলের কমলা গোধূলিতে পৌঁছায়, ভোরের ভৈরবীর তান সমে নামে গভীর রাতের বেহাগ বন্দিসে; ঠিক সেভাবেই।
অলস মদিরাচ্ছান্ন চোখে তাকিয়ে দেখলেন,জানলার বাইরের শিরীষ গাছটিতে ফুলের সমারোহ। চৈতালী উতল বাতাসে ঝরঝর উড়ে যাচ্ছে পাতা-ফুল,বাতাসে বুনো ফুলের অজানা সৌরভ।বারান্দায় হেলে পড়া রোদের দিকে তাকিয়ে শ্বাস ছাড়ার মতো স্বস্তিতে বৃদ্ধা উচ্চারণ করলেন নিভৃতে,
‘এমন একান্ত করে চাওয়া,এও সত্য যত। 
এমন একান্ত ছেড়ে যাওয়া,সেও সেই মতো…’
অভিমান হয়,বড্ডো অভিমান।কার প্রতি,কেন,কে জানে!..(ক্রমশঃ)

Post a Comment

0 Comments