শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৮৫ / সালেহা খাতুন
জুড়ে থাকা,বেঁধে বেঁধে থাকা সব ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। বন্ধুত্ব হয় সমানে সমানে। সম মনোভাবে। সহাধ্যায়ী নন, এমন অনেকের সাথেই নিজের একশো শতাংশ দিয়েও মালা গাঁথতে পারিনি। সূত্র ছিন্ন হয়ে গেছে। অনেকেই কঠিন মাইন্ড গেম খেলেছেন, যাতে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে আত্মবিলাপ করি। কারো কারো কাছে গ্যাসলাইটিং-এর শিকার হয়েছি। কোনো রকম অন্যায় না করলেও অনেকে গিল্ট ফিল করিয়েছেন। আমাকে দিয়ে তাঁদের কার্যোদ্ধার হয়ে গেলে আমার আবেগ নিয়ে খেলা করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে যখনই মুষড়ে পড়েছি আমার ঘরের লোকেরা আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। সামর্থ্য অনুযায়ী ঘুরে বেড়িয়েছি পাহাড় সমুদ্র জল জঙ্গলের নানান জায়গায়।বঙ্গোপসাগরকে লক্ষ করে পরিক্রমণ করেছি দীঘা,পুরী,চাঁদিপুর,বকখালি,
হরিপুর,শঙ্করপুর,তাজপুর,বিচিত্রপুর,
গোপালপুর,মন্দারমণি ইত্যাদি। গেছি গ্যাংটক, পেলিং, দলমা, শুশুনিয়া, অযোধ্যা, বাঘমুণ্ডি, পঞ্চলিঙ্গেশ্বর, নীলগিরি, দারিংবাড়ি তথা পূর্বঘাট ও হিমালয় পর্বতমালার নানান অংশে। পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলা কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর,এবং মালদা বাদে প্রায় সর্বত্র পরিক্রমা করেছি। সিকিম, বিহার,ঝাড়খণ্ড,ওড়িশা অন্ধপ্রদেশ পাশাপাশি কয়েকটি রাজ্যের দেখেছি রূপ। এজন্যই মনে মনে ভাবি যাঁরা পক্ষে থাকেন তাঁরাই এগিয়ে যেতে সাহায্য করেন, একথা যেমন সর্বৈব সত্য তেমনি পদে পদে যাঁরা আঘাত হানেন তাঁরাও অনেকাংশে এগিয়ে যেতে বাধ্য করেন। জেদ বাড়িয়ে দেন। বারেক তাঁরা মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছিলেন,তাই তা নিরসনের নিমিত্তে কয়েকটি স্থানে ঘোরা হয়ে গেল।
🍂
শিক্ষার্থীদের নিয়ে এডুকেশনাল ট্যুর বা ফিল্ড সার্ভের মাধ্যমেও ঘুরে এসেছি নানা জায়গায়। সেই সব অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান, ঐতিহাসিক গুরুত্ব, জীবন-জীবিকা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, বিশ্বাস-সংস্কার আরো বিভিন্ন বিষয়ে ঐসব অঞ্চলের মানুষ জনের সঙ্গে কথা বলে সংগ্রহ করেছি অনেক তথ্য। আমি আসার পর দু’হাজার দুই-তিন সালে বিভাগ থেকে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া হয় ঘাটশিলায়। মনে আছে সেসময় যেতে পারিনি। পিয়াসা তখন নিতান্তই শিশু। বছর তিনেক বয়স হতে যাওয়া শুরু করি।
প্রথম যাই গুড়গুড়িপালে। জল ও জঙ্গলঘেরা অপূর্ব এক মায়াময় স্থান সেটি। শ্রীচেতা মৈত্রেয়ীদের ব্যাচকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বীতশোকবাবু সস্ত্রীক গিয়েছিলেন। আমি গিয়েছিলাম কন্যাসহ। এসেছি জলের ধারে বলে স্যারের কবিতা আওড়ে যাচ্ছিলাম আমরা। ছোটোদের সাথে স্যারের দোস্তি খুব তাড়াতাড়ি হতো। কী একটা কথা উঠতে কেউ একজন বলে, “স্যার চলে যাচ্ছি”। স্যার কথাটি নিয়ে জাগলারি খেলতে খেলতে বলছিলেন, “চলে চলেই তো যাবে”। আমার মেয়ে প্রতিবাদ করে বলে, “না বসে বসেও যাওয়া যায়”। বলে কীভাবে বসে বসে যেতে হয় নিখুঁতভাবে দেখিয়ে দেয়। সবাই হাসতে থাকি। তবে গুড়গুড়িপালে হাতির উপদ্রব তখনও ছিল। বনদপ্তরকে জানিয়ে তবে যাওয়া হয়েছিল।
পরে গিয়েছিলাম গড় মান্দারণে। যে গড় মান্দারণের একটি দুর্গের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের “দুর্গেশনন্দিনী” উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে। “দুর্গেশনন্দিনী”র প্রথম খণ্ডের পঞ্চম পরিচ্ছেদের নামই “গড় মান্দারণ”। সেখানে রয়েছে সৈয়দ ইসমাইল গাজীর সমাধি। হুগলি এবং বর্ধমান জেলার সীমান্তে এই গড় মান্দারণের অবস্থান। মনে আছে সেবার গিয়েছিল সুমিতাদের ব্যাচ। একটি সারাদিন হৈ হৈ করে কেটে গেল। সন্ধেতে ঘরে ফেরা। আমি সপরিবারে গিয়েছিলাম। কেননা আমি শিক্ষার্থীদের নিয়ে ব্যস্ত থাকলে মেয়েকে ঠিকঠাক দেখভাল করতে পারবো না।
এর আগে একবার শিক্ষার্থীদের বিভাগ থেকে কর্ণগড় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেবার দেবযানীর বিয়েতে কলকাতা যেতে হয়েছিল বলে, আমি অনুপস্থিত ছিলাম। এক-দুবার ফিল্ড সার্ভে বন্ধ ছিল। জঙ্গলমহল তখন উত্তাল থাকায় প্রশাসনের অনুমোদন মেলেনি। দু’হাজার এগারোতে রঞ্জিতদের ব্যাচকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পিংলার নয়াগ্রামে। পটচিত্র নিয়ে ফিল্ড সার্ভে করতে। ওখানে আরো অনেক গবেষকের সঙ্গে দেখা হয়। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের এক অধ্যাপকের সঙ্গে আলাপ হয়।
সেবার এক কাণ্ড ঘটে। বীতশোকবাবুর সঙ্গে আমার কন্যা ঘুরছিল। আমি শিক্ষার্থীদের নিয়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ অমরদা জিজ্ঞেস করলেন, “সালেহাদি আপনার মেয়ে কোথায়?” বললাম স্যারের সঙ্গে আছে। ওমা স্যারের সঙ্গে তো নেই! সব শিক্ষার্থীরাও চলে এসেছে। কারোর সঙ্গেই আমার মেয়ে নেই। প্রায় বজ্রাঘাত হলো। মাথা ঠাণ্ডা রাখাই দায়। আমি যেখানে ওকে বীতশোকবাবুর সঙ্গে ছেড়েছিলাম, ছুটে গেলাম সেখানে। আর সবাই বিভিন্ন দিকে খুঁজতে লাগলো। আমি ঠিক সেই জায়গাতেই মেয়েকে পেলাম। দেখি ঐ এলাকার আর একটি বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে একটি ঘরের পেছনে বসে খেলছে। প্রাণ ফিরে পেলাম। সুস্নাতদার পুত্র কন্যা সুশ্রুত এবং সৌবর্ণাও সেবার এসেছিল। পৌষ সংক্রান্তির দিন আমরা গিয়েছিলাম। একটি মেলাতেও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ওরা খুব ভালো সময় কাটায়। সেবছরই বীতশোকবাবু রিটায়ার করেন। তাঁর সঙ্গে এটাই ছিল শেষ ফিল্ড সার্ভে।
পরের বার আমরা যাই জিনশহরে। যেখানে একটি প্রাচীন জৈন মন্দির আছে। কাঁসাইয়ের তীরে অবস্থিত উর্বর এই অঞ্চলে নানান সবজির চাষ হয়। বড়ো বড়ো বেগুন ওখান থেকেই কিনে ফিল্ড সার্ভের রান্নাবান্নাতে কাজে লাগানো হয়। ছেলেমেয়েরা চাষীদের সঙ্গে এমনই জমিয়ে ফেলে যে তাঁরা ওদের নানান সবজি উপহার দেন। তাই বিভাগ থেকে প্রায় পাঁচ কেজি বেগুন কিনে নেওয়া হয়। কিছুটা ক্ষতিপূরণের নিমিত্তে। তোতা সোনালীরা সেবার গিয়েছিল।
একবার যাওয়া হয় কলসীভাঙায়। বড়ো কলসীভাঙা, ছোটো কলসীভাঙা - অপূর্ব সব নাম। ওখানকার একটি স্কুলে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হয় । যোগাযোগ করেন অমরদা। তবে নয়ার ঘটনার পর একদিনের ফিল্ড সার্ভেতে মেয়েকে আর সঙ্গে নিতাম না। আর ফিল্ড সার্ভেতে প্রচুর হাঁটাহাঁটি করতে হয়। সারাদিন রোদে ঘুরে মাইগ্রেনে আক্রান্ত হওয়া অবধারিত ছিল।
লালগড়ে যাওয়া হয়েছিল বারদুয়েক। একবার লোকসংস্কৃতির ক্ষেত্র সমীক্ষায়। আর একবার এম.এ. – এর ভাষা সমীক্ষায়। প্রথমবার লালগড় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সাগর প্রণবেশ, স্বপন, পার্থজিতদের। টুসু পরবে এলাকার লোকজনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। বিখ্যাত নেতাইয়েও যাওয়া হয় । আর যেবার ভাষা সমীক্ষায় যাওয়া হয় সেবার আমি শিক্ষার্থীদের সঙ্গ ছেড়ে বাজারে গিয়ে শুঁটকি মাছের নাম শিখছিলাম। একই জিনিসের নাম অঞ্চলভেদে কীভাবে বদলে যায় দেখছিলাম। যাকে আমরা থোড় বলি কিছু কিছু অঞ্চলে তাকে বলে মাজা। কোথাও বা বলে চুপসি । নটেশাককে বলে খোসলা। গরুর গলায় ছোটো একটি কাষ্ঠ খণ্ড ঝুলতে দেখে নাম জানলাম, ওটিকে বলে জোড়খা। এর ফলে গরু বেশি জোরে ছুটতে পারবে না।
বিষ্ণুপুরে এডুকেশন বিভাগকে একবার নিয়ে গিয়েছিলাম। সেবার স্বাগত,আমি আর অপর্ণীতা ছিলাম শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। মোনালিসা হোটেলে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। বাংলার এম.এ.-এর একটি ব্যাচকেও পরে বাংলা বিভাগ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সপরিবারে একবার গিয়েছিলাম। পরে অপর্ণীতা আমি বিষ্ণুপুরের রামানন্দ কলেজে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বক্তৃতা দিতে গিয়ে আবারও যাই। ওখানকার মিউজিয়ামটিতে এবার যাই। আগের তিনবার যখনই যাই, কোনো না কোনো কারণে মিউজিয়ামের দ্বার রুদ্ধ ছিল।
গুড়গুড়িপালে
মোগলমারিতে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এক বছর। ওখানকার গুণী মানুষদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ে মানসিক আদানপ্রদান হয়। কুমারীগ্রাম, ঘাটশিলা, বেলপাহাড়ি, ঝাড়গ্রাম, তপোবন, বিদিশা, খোয়াবগাঁ ,পাথরা আরো নানান স্থানে শিক্ষার্থীদের ফিল্ড সার্ভেতে নিয়ে যাওয়া হয়। পাথরার ইয়াসিন পাঠানের কথা স্বপ্নময় চক্রবর্তীর “হলদে গোলাপ” উপন্যাসে আছে। এম.এ.- র স্পেশাল পেপারে উপন্যাসটি আমি পড়াই , শিক্ষার্থীদের যেমন সে সন্ধান দিয়েছিলাম তেমনি সরাসরি ইয়াসিন পাঠানকেও সে তথ্য দিই। একথা জেনে তিনি আপ্লুত হন। উপন্যাসের পাতা থেকে বাস্তবের মানুষকে শিক্ষার্থীরা যখন চোখে দেখে তখন তা এক অন্য মাত্রা পায়।
নীলাঞ্জনা আর আমি এক বছর আমাদের কলেজের বাংলা বিভাগের এম.এ.- এর রবীন্দ্র সাহিত্য স্পেশাল পেপারের শিক্ষার্থীদের জোড়াসাঁকোতে নিয়ে গিয়েছিলাম। রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান দেখে ওরা যারপরনাই আনন্দিত। তবে দু’হাজার তেরোতে নন্দ, সৌতম, সুদেষ্ণা - এদের ব্যাচকে শান্তিনিকেতন নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সপরিবারে সেবার যাই। ঐবারের অভিজ্ঞতা থেকে আমি আর একদমই সম্মত হই না শিক্ষার্থীদের নিয়ে দূরে কোথাও একাধিক দিনের জন্য যেতে। মেদিনীপুর থেকে শিরোমণি ধরে হাওড়া পৌঁছে, যখন রামপুরহাট ধরেছি; ট্রেন প্রায় ছাড়বো ছাড়বো লিস্ট মিলিয়ে দেখি দুজন ছাত্র মিসিং। ড্রাইভারকে অনুরোধ করে ছুটতে থাকি, ছাত্র দুজনকে খুঁজতে খুঁজতে চোদ্দো নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে দেখি টিকিট চেকার ওদের আটকে রেখেছে। খুব রেগে গিয়ে চেকারদের রিজার্ভেশন টিকিট দেখিয়ে ওদের নিয়ে ট্রেনে উঠি। ওদের মধ্যে একজনের নাম ছিল প্রসেনজিৎ। খুব লম্বা ছেলেটি। এই যে দলছুট হয়ে যাওয়া, ওটাই কি ওর ভবিতব্য ছিল। করোনার সময় এক ছাত্র জানায় প্রসেনজিৎ স্বেচ্ছায় ইহজগত ত্যাগ করেছে।
শান্তিনিকেতনে পৌঁছেও ওদের ওপর তীক্ষ্ণ নজরদারি করেও একদিন ঝকমারির শেষ ছিল না। রাতে ভুবনডাঙা থেকে তেরোটি রিকশায় তিনজন করে চাপিয়ে ওদের নিয়ে যখন লজে বা হোটেলে ফিরছি একটি রিকশা আর ফেরে না। মদ্যপ রিকশাওয়ালা তিনটি মেয়েকে অন্য একটি হোটেলে পৌঁছে দেয়। লোকাল লোকজনের জন্য এবং আমার স্মার্ট কন্যা সুদেষ্ণার বুদ্ধিতে ওদের ফিরে পাই। এজন্য বিভাগে আমি জানিয়ে দিয়েছি সকাল ছটায় কলেজ থেকে বেরিয়ে সন্ধে ছটায় কলেজে ফিরে আসবো। ফিল্ড সার্ভে হবে একদিনের। তার উপর বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের সবার আর্থিক সামর্থ্য সমান নয়। লাঞ্চ ডিনারের সংখ্যা বাড়লে খরচও অনেক বেড়ে যাবে। আমার কথা তোয়াক্কা না করার ফল মুর্শিদাবাদ ভ্রমণের কাহিনি। যা সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেলে দেখে লজ্জা পেয়েছিলাম।
2 Comments
👍👍
ReplyDelete👍
Delete