মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৪৩
হাজী শেখ রাইসুদ্দিন আহম্মদ (শিক্ষানুরাগী, মানবদরদী, ময়না)
ভাস্করব্রত পতি
'আজকে তোমার স্মরণীয় রজত জুবিলি
আশীর্বাদ যে করব তোমায় বল কী বলি?
ছাত্রেরা সব সুছাত্র হোক, হোক প্রতিভাবান
গুণী সকল শিক্ষক হোন উদার মহাপ্রাণ।
প্রতিষ্ঠাতার আকাঙ্খা হোক নিত্য রূপায়িত।
গৌরব হও সবার এবং সকলে হোন প্রীত।
জয়ে যশে সমুন্নত থাকবে তোমার শির
ছায়া আমি দেখছি সুদূর হীরক জয়ন্তীর'।
পল্লিকবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক তাঁর আশীর্বাণীতে এভাবে একটি বিদ্যালয়ের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে যাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, তিনিই এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি হাজী শেখ রাইসুদ্দিন আহম্মদ।
হাজী শেখ রাইসুদ্দিন আহম্মদ ছিলেন দানবীর মানুষ। তাঁর অকাতর দান লাভ করেছে এলাকার অসংখ্য গরীব দুঃখী মানুষজন। সেসময় তা ছিল অত্যন্ত নজরকাড়া ঘটনা। শুধু তাই নয়, এলাকায় শিক্ষার প্রসারে গড়ে তুললেন একটা আস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। রামচন্দ্রপুর রাইসুদ্দিন উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয় তাঁরই প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়। সেই ১৯৪৫ সালে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা খরচ করেছিলেন এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য।
বহু বছর আগে বর্গী তথা মারাঠীরা বাংলা বিহার উড়িষ্যা আক্রমণ করলে দেশরক্ষার জন্য নবাব বাহাদুর বিভিন্ন জেলা থেকে সৈন্য সংগ্রহের চেষ্টা করেন। তখন এই হাজী শেখ রাইসুদ্দিন আহম্মদের উর্দ্ধতন ষষ্ঠ পুরুষ শেখ জসিমুদ্দিনসহ অন্যান্য পূর্বপুরুষগণ, সেনাপতি ও সৈন্যগণ বিহারের ছাপরা থেকে বাংলাদেশে আসেন। তাঁদের সহায়তায় বর্গী হামলা প্রতিহত করা সম্ভব হয়। রাইসুদ্দিন আহম্মদের পূর্বপুরুষরা এরাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বসবাসের অনুমতি পান। যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ব্যক্তিরা হয়ে উঠলেন সাধারণ শ্রমজীবী এবং কৃষিজীবী। হাজী শেখ রাইসুদ্দিন আহম্মদ প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় 'রামচন্দ্রপুর রাইসুদ্দিন উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়'
সেসময় হাজী শেখ রাইসুদ্দিন আহম্মদের পিতামহের পিতামহ শেখ আনিসুদ্দিন (১৭৬০) পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পাঁশকুড়া থানায় একটি গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। শেখ আনিসুদ্দিনের বাবা ছিলেন শেখ কশিমুদ্দিন (১৭৩৮) এবং দাদু ছিলেন শেখ জসিমুদ্দিন (১৭১০)। এই শেখ আনিসুদ্দিনের ছেলে শেখ নকিমুদ্দিন (১৭৮৫) বিবাহসূত্রে এবং মায়ের থেকে প্রাপ্য সম্পত্তিসূত্রে পাঁশকুড়া থানার গোটপোতা গ্রামে বসবাস করতে থাকেন। এরপর শেখ নকিমুদ্দিন পাঁশকুড়া থানার বিজয়রামচক গ্রামে হাপিজুদ্দিন মল্লিকের বোনকে বিয়ে করেছিলেন। শেখ নকিমুদ্দিনের তিনপুত্র - শেখ জামালুদ্দিন, শেখ বদিরুদ্দিন ও শেখ জাহিরুদ্দিন। শেখ নকিমুদ্দিন অকালে মারা গেলে তাঁর নাবালক পুত্ররা এবং স্ত্রী ভাইয়ের বাড়িতে বিজয়রামচকে চলে আসেন। কিন্তু নাবালক ছেলেদের রেখে মাও হঠাৎ চলে গেলেন পরপারে। নাবালক ছেলেদের দুঃখ দুর্দশার জীবন শুরু হল। অবশেষে তাঁরা নানা ঝড়ঝাপ্টা সামলে বড় হয়। শেখ বদিরুদ্দিন (১৮১৫) ময়না থানার রামচন্দ্রপুর গ্রামে নিয়ামত মল্লিকের বড় মেয়ে মোসাম্মাত বিবিজান বেগমকে বিয়ে করে রামচন্দ্রপুর গ্রামে বসবাস শুরু করেন।
এই শেখ বদরুদ্দিন ছিলেন রাইসুদ্দিন আহম্মদের পিতামহ। তাঁর তিনজন ছেলে -- তিনকৌড়ি, আনিসুদ্দিন এবং শামসুদ্দিন। ছোট ছেলে শেখ শামসুদ্দিন (১৮৫০) তমলুক থানার শিমুলিয়া গ্রামের মুন্সী হবিবুল্লার বড় মেয়ে মোসাম্মাত সাহিদান বেগমকে বিয়ে করেন। এই শামসুদ্দিন ও সাহিদানের পুত্র হলেন হাজী শেখ রাইসুদ্দিন আহম্মদ (১৮৮৬ - ১৯৫৫)।
পূর্ব মেদিনীপুরের ময়নার রামচন্দ্রপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৬ সালের ২ রা সেপ্টেম্বর (১২৯৩ বঙ্গাব্দের ১০ ই আশ্বিন রবিবার)। গ্রামের পাঠশালায় পড়াশোনা শুরু হয় তাঁর। বৃন্দাবনচক গ্রামের কৈলাশচন্দ্র পট্টনায়ক ছিলেন তাঁর শিক্ষক। আমৃত্যু তাঁকে গুরু হিসেবে শ্রদ্ধা জানাতে কুন্ঠিত হননি। ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর কলকাতায় জ্যেষ্ঠতাতের কাছে থেকে পড়াশুনার ব্যবস্থা করা হয়। ১৮৯৭ এর জানুয়ারী মাসে সিটি কলিজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন তিনি। এখান থেকে ১৯০৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯০৭ এ কলেজ থেকে এফ.এ. পরীক্ষা দিয়েছিলেন। অতি দরিদ্র পরিবারের সদস্য হয়েও সেসময় নানা বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে এফ. এ. (এখনকার উচ্চ মাধ্যমিক) পরীক্ষায় বসেন। এরপর এই যোগ্যতায় চাকরি পাওয়া ব্যাপার ছিলনা। কিন্তু তিনি তা করেননি। মানসিকভাবে অত্যন্ত স্বাধীনচেতা এই মানুষটি সরকারি চাকরির পথে পা মাড়াননি। চেয়েছিলেন স্বাধীনভাবে নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে। সেটাই করেছিলেন শেষে।
বিদ্যালয়ের অন্যান্যদের সঙ্গে উপবিষ্ট হাজী শেখ রাইসুদ্দিন আহম্মদ
১৩২০ সালে রাইসুদ্দিন তমলুক থানার পদমপুর গ্রামের মৌলভী শেখ আমিনুদ্দিনের কন্যা মোসাম্মাৎ মহমুদা বেগমকে বিয়ে করেন। শেখ মনসুর আহম্মদ, শেখ মহবুব আহম্মদ ও দুই কন্যা সাহাজাদি বেগম ও হাজেরা বেগমরা ছিলেন তাঁর সন্তানাদি। তাঁদের নিয়ে ভরাট সংসার। একসময় তিনি পুলিশ সাব ইন্সপেক্টরের পদে চাকরি পেয়েছিলেন। কিন্তু এই চাকুরীর উপর তাঁর শ্রদ্ধা না থাকায় এই কাজে যোগ দেননি। এরপর আর কোনও সরকারি চাকরি জোটেনি। ১৯০৯ সালে ইস্টার্ণ লাইফ ইন্সিওরেন্স কোম্পানি লিমিটেড ও ইস্টার্ণ ব্যাঙ্কিং করপোরেশন লিমিটেড নামক কোম্পানিতে কাজ করতে শুরু করেন। নিজের কর্মদক্ষতাকে পাথেয় করে তিনি এই কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেকটর পদে বসতে পেরেছিলেন। একদিন এই কোম্পানিও বন্ধ হয়ে গেল। ফলে ১৯১৬ সালের জানুয়ারিতে সিঙ্গার সিউইং মেসিন কোম্পানির কলকাতার প্রধান কার্যালয়ে চাকরি পান। এই সিঙ্গার কোম্পানিতে যুক্ত থাকাকালীন ১৯২৪ এর আগষ্টে তিনি দক্ষিণ ২৪ পরগণার ফলতা মোকামে বর্মা অয়েল কোম্পানির এজেন্ট নিযুক্ত হন। এরপর থেকেই তিনি আর্থিক ভাবে বলীয়ান হয়ে উঠতে থাকেন। সকলেই তাঁর কাজের দক্ষতার প্রতি আসক্ত ছিলেন।
১৯৩১ সালের ফেব্রুয়ারীতে তাঁর বাবার মৃত্যুর পর তিনি চাকরি ছেড়ে দিতে চাইলেন। তখন তিনি এই কোম্পানির স্টক ইনচার্জ ছিলেন। যদিও তাঁর পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়নি। তাঁকে আরও কিছুকাল কাজ করার জন্য কোম্পানি অনুরোধ জানায়। ১৯৩২ এর জুলাই মাস থেকে পুরোপুরি নিজ ব্যবসা শুরু করেন। হয়ে ওঠেন একজন সুদক্ষ ব্যবসায়ী। এই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ১৯৫২ পর্যন্ত রমরমিয়ে চলার পর অবশেষে বন্ধ হয়ে যায়। আসলে ১৯৫০ সালে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। যাবতীয় পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে ছেলে মনসুর আহম্মদের উপর। কিন্তু তাঁর কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। ফলে অচিরেই বন্ধ হয়ে যায় কোম্পানি। এরমধ্যে ১৯৩৯ সালে মক্কা গিয়ে হজ করে 'হাজী' উপাধি লাভ করেছেন।
কেবলমাত্র জনশিক্ষার প্রসারে তাঁর অনবদ্য ভূমিকা ছিলনা। তিনি রামচন্দ্রপুর গ্রামে একটি পোষ্ট অফিস স্থাপনের ক্ষেত্রেও দারুণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। খোদ পোষ্টাল ডিপার্টমেন্ট তাঁকে এজন্য সাধুবাদ জানাতে কুন্ঠা করেনি। । ১৯৪৭ এর ১২ ই এপ্রিল পোষ্টাল ডিপার্টমেন্ট তাঁকে এজন্য লিখেছে --
Sir
With reference of your letter dated the 6 th April 1947 I have the honour to say that necessary orders for opening the proposed post office at Ramchandrapur have already been issued. The new office will be opened as soon as necessary forms, seals etc. are received. During the brief interim period, existing arrangements for delivery and booking will continue.
ড. সুকুমার মাইতি এই মহানুভব ব্যক্তির জীবন সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, 'প্রতি বছর ১০ ই মাঘ তিনি জাকাত দিতেন তাঁর সমূহ সম্পত্তির মূল্য ও আয়ের মোট পরিমাণের শতকরা দু'টাকা পঞ্চাশ হিসাবে। দিতেন বিধবা, পিতৃমাতৃহীন নিরাশ্রয় ব্যক্তি দীন দরিদ্র অন্নহীন প্রমুখ ব্যক্তিকে। যাতে অভাবের তাড়নায় কেউ চুরি ডাকাতি না করে, সেজন্যও তিনি জাকাত দিতেন বিভিন্ন সময়ে। শেষ জীবনে তিনি এমন ইচ্ছাও প্রকাশ করে গেছেন তাঁর উত্তরাধিকারীরাও যেন তাঁর বিষয় সম্পত্তি ভোগকালে একটি সুনির্দিষ্ট হারে জাকাত দিয়ে সম্পদ ভোগ করেন'। তাঁর ইচ্ছানুসারেই প্রতিবছর ৮ ই ফেব্রুয়ারি রামচন্দ্রপুর রাইসুদ্দিন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্মদিন পালিত হয় যথাযোগ্য মর্যাদা সহকারে।
হাজী শেখ রাইসুদ্দিন আহম্মদ
১৩৪৯ সালের প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের ফলে পঞ্চাশ সালে যে মন্বন্তর দেখা দেয় সে সময় গ্রামবাসীরা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল। তখন তিনি তাঁদের পেটের ভাত জোগাড়ের জন্য নিজের খরচে দুটি আলাদা লঙ্গরখানা স্থাপন করেন। একটি মুসলিমদের জন্য এবং অন্যটি হিন্দুদের জন্য। এ ঘটনা আসলে তাঁর দরাজ হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। তিনি ছিলেন সাক্ষাৎ দেবদূত। সেই ঘটনার কথা উল্লেখ করে ড. সুকুমার মাইতি লিখেছেন, 'এই মানবদরদী মানুষটির আরও একটি চিন্তাশীল মনের পরিচয় পাওয়া যায় ১৯৪৬-১৯৪৭ এর হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার সময়ে। কলকাতা তথা দেশের অন্যত্র এই দাঙ্গা কেমন ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল, তা সকলেরই জানা। এ সময়ে গ্রামের অন্যান্য মুসলমান তাদের ইতিকর্তব্য নির্বাচনের জন্য অত্যন্ত গোপনে রাইসুদ্দিন আহম্মদের সঙ্গে দেখা করে। রাইসুদ্দিনই ছিলেন তখন ওইসব লোকের কাছে একমাত্র নির্ভরস্থল। সেদিনের সব মুসলমানই ভেবে এসেছিল তারা গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবে। আর রাইসুদ্দিন তা সমর্থন করবেন। তিনি সেদিন মুসলমানদের অস্থির চিত্ততার পরিচয় পেয়ে বলেছিলেন, তোমরা তোমাদের গ্রামেই থাক। ধীরস্থিরভাবেই থাক। কোনও উত্তেজনার অংশভাগী হবে না। যা ঘটছে, তা সাময়িক। এমন একদিন আসবে, যে দিন আমরা সবাই আবার ভাই ভাই হয়ে মিলেমিশে বাস করতে পারব। তাঁর এই পরামর্শ সকলেই মাথা পেতে নিয়েছিল'। শেষ জীবনে তিনি 'জোবেদা জোহরা' নামে একটি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস লিখেছেন। এই মহাপুরুষের প্রয়াণ ঘটে ১৯৫৫ সালের ১০ ই অক্টোবর।
🍂
0 Comments