অ্যাঙ্গোলা (আফ্রিকা)
গণ্ডারের চামড়ায় ছাই ছাই রঙ
চিন্ময় দাশ
সে অনেক অ-নে-ক কাল আগের কথা। সবে দু’-একজন মানুষ জন্মেছে পৃথিবীতে। তারা ছাড়া বনে পাহাড়ে গুহায়, নদী-সাগরের জলেও তখন কত রকমের জীব। আসলে মানুষ তো এসেছে অনেক কাল আগে।
তখন সবাই সবাইর ভাষা বুঝতে পারত। ভাবের আদান-প্রদান হোত সবার মধ্যেই। অনেক কাল আগে এসেছে। তাতেই খেয়েদেয়ে, লড়াই করে কী করে বেঁচে থাকতে হয়, টিকে থাকতে হয়—সে সব কায়দা-কানুন তারা শিখে ফেলেছে।
ফলে, গায়ে-গতরে তাদের অনেকেরই চেহারা বেশ বিশাল। দেখলেই বুক কেঁপে যায়, এরকম। সেই সাথে সবাই বেশ বলশালী বটে।
আফ্রিকা দেশে যে লোকটা প্রথম এসেছিল, তার নাম ধরা যাক—স্যাম। বনের লাগোয়া একটা ফাঁকা যায়গায় তার ডেরা। জগতের অনেক আদব-কায়দা জানা হয়ে ওঠেনি তখনও তার। এক এক করে নানা জনের কাছ থেকে নানা রকম কলা-কৌশল শিখে নিতে হয় স্যামকে। নইলে, এই বন-পাহাড়ের দেশে টিকে থাকা সম্ভব নয়।
সেসময় সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ছিল আগুনের। আগুন জ্বালাবার কৌশল জানত কেবল গণ্ডার। কী করে সাঁতার কাটতে হয় নদী বা সাগরের জলে, যাতে মাছ শিকারের সুবিধা হয়-- এটা ভালো জানে ভোঁদড়। বনে তো গাছে গাছে নানা রকমের ফল। কোনটা খাওয়া যাবে, কোনটা নয়, সেটা না জানা থাকলে বিপদ। কত রকমের শাক-পাতাও আছে চার দিকে। তার ভিতর কোনটা ছোঁয়াও যাবে না-- বানররাই এসব জানে সবচেয়ে ভালো।
ভোঁদড় আর বানরেরা সেসব কলাকৌশল শিখিয়ে দিয়েছে স্যামকে। বেশ খুশি মনেই শিখিয়েছে তারা। কিন্তু যত ঝামেলা গণ্ডারকে নিয়ে। আগুনের কথা উঠলেই তার মুখে কুলুপ। কিছুতেই মুখ খুলবে না সে।
একদিন সকাল সকাল গণ্ডারের ডেরায় গিয়ে হাজির হয়েছে স্যাম। সকালবেলায় মনমেজাজ ভালো থাকে সবারই। সেই ভরসায় এসেছে সে। বলল—বিশেষ করে রাতের বেলায় ঠাণ্ডা আর অন্ধকারে ভারি মুশকিল হয়। দোহাই তোমার! আগুণ কী করে জ্বালাতে হয়, সেটুকু বলে দাও আমাকে।
🍂
গণ্ডার তো কিছুতেই বলবে না কাউকে, আগুন কী করে জ্বালাতে হয়। সবাই যদি জেনে যায়, তার গুমোর থাকবে না তখন। সে খেঁকিয়ে উঠল—সবে ঘুম থেকে উঠে একটু আয়েস করছি। তুই এসে ঘ্যানর ঘ্যানর শুরু করে দিলি। আমেজটাই নষ্ট করে দিলি সক্কালবেলার।
--না, মানে ভারি অসুবিধায় পড়তে হয় তো আমাদের। তাই তোমার কাছে আসা।
গণ্ডার হুঙ্কার দিয়ে উঠল—কিচ্ছু জানি না আমি। ভাগ এখান থেকে। খবরদার আমার এখান মাড়াবি না। এই বলে দিলাম।
মজার ব্যাপার হোল, যতবার গণ্ডারটা মিথ্যে কথা বলে, নিজেই ঝামেলায় পড়ে যায়। ইয়াব্বড় একটা শিঙ আছে গণ্ডারের। নাকের উপর আস্ত একটা খাঁড়ার মত উঁচিয়ে থাকে সেটা। মিথ্যে কথা বললেই, ভয়ানক চুলকাতে থাকে শিঙটা। এতবড় ভারি চেহার গণ্ডারের। কিন্তু পা দু’-জোড়া এই একটুকুন। শিং আর নাক চুলকালে, কিচ্ছু করার থাকে না বেচারার। নাকের নাগাল পায় না তার পাগুলো।
কিন্তু এত চুলকায় যে সহ্য করা যায় না। অগত্যা কোনও একটা গাছের কাছে যায় গণ্ডার। গাছের গায়ে কষে রগড়াতে থাকে নাক আর শিঙ। জোর ঠেলা খেয়ে গাছটা পড়েই যায় শেষ কালে। তখন সেটাকে আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে দেয়।
এদিকে স্যামও নাছোড়বান্দা। যে করেই হোক আগুন জ্বালানোর কৌশলটা তাকে জানতেই হবে। কথা আদায় করতেই হবে গণ্ডারের মুখ থেকে। দু’দিন ছাড়া, গণ্ডারের ডেরায় গিয়ে হাজির হয় স্যাম।
কিন্তু ঐ যাওয়াই সার। লাভের লাভ কিছুই হয় না তাতে। একথা ওকথা বলে তাকে হাঁকিয়ে দেয় গণ্ডার। সেই সাথে প্রত্যেক বার নাক আর শিঙের ভয়ানক চুলকানি শুরু হয়ে যায়। আর, প্রত্যেক বারই একই ঘটনা। চুলকাতে শুরু করলেই, গাছের কাছে ছুটবে গণ্ডার। ঘষাঘষি করে ভেঙে ফেলবে গাছটাকে। শেষে পুড়িয়ে দেবে আগুন জ্বেলে। এটা নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে বনে।
দেখতে দেখতে ছাইয়ের মস্ত এক গাদা গড়ে উঠছে গণ্ডারের ডেরার গায়ে। হবে নাই বা কেন? বলতে গেল প্রায়ই আসছে স্যাম। প্রায়ই গাছে নাক ঘষাঘষি। প্রায়ই একটা করে গাছ পোড়ানো। ছাইয়ের গাদা তো হবেই সেখানে।
একদিনের ঘটনা। সেদিনও সকালেই চলে এসেছে স্যাম। ডাকতে লেগেছে—গণ্ডার দাদা, গণ্ডার দাদা। দয়া করে কৌশলটা বলো আমাদের। সবাই যে মারা পড়বো এবার।
আসলে হয়েছে কী, সারা রাত শীতে ভারি কষ্ট গিয়েছে বাড়ির সবার। তাই একটু বেশি সকালেই চলে এসেছে স্যাম। গণ্ডার তখন ঘুমাচ্ছিল। ঘুম ভেঙে যেতেই, মেজাজ গিয়েছে বিগড়ে। বেরিয়ে এসেই এক হুঙ্কার—তবে রে হতভাগা। আজ তোকে মজা দেখিয়ে ছাড়ব।
বলেই তেড়ে এসেছে স্যামের দিকে। গণ্ডারের মাথার শিঙটা তো যেমন শক্তপোক্ত, তেমনই ভারি সূঁচালো। বাগে পেলে বাঘ, সিংহ বা নেকড়ে—কাউকেই রেয়াত করে না সে। এক গুঁতোয় পেট এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। নাড়িভুঁড়িও বেরিয়ে আসে তাতে।
এসব জানা হয়ে গেছে স্যামের। যেই না গণ্ডার তেড়ে আসতে শুরু করেছে, লম্বা দৌড় লাগিয়েছে স্যাম। দরকার নাই আমার আগুনে। আগে তো প্রাণটা বাঁচাই।
কিন্তু সবে কয়েক পা গিয়েছে, পিছনে ধপাস করে একটা শব্দ। পিছন ফিরে গণ্ডারকে চোখে পড়লা না স্যামের। তার বদলে দেখল, গণ্ডারের ডেরার সামনে, কোথা থেকে একটা ছাইয়ের মেঘ গজিয়ে উঠেছে।
হয়েছে কী, গণ্ডার তো দৌড় শুরু করেছিল স্যামকে পাকড়াও করবে বলে। সবে দু’-চার পা ফেলেছে, অমনি ধপাস। গাছের আধপোড়া গুঁড়ি পড়েছিল গাদার সামনে। খেয়াল করেনি। হোঁচট খেয়েছে, আর আছাড় খেয়ে পড়েছে। পড়বি তো পড়, ছাইয়ের গাদাটার ওপরেই।
দৌড় বন্ধ হয়ে গেছে স্যামের। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে পিছনের দিকে। হোলটা কী? কোথায় উবে গেল গণ্ডারটা?
একটু বাদেই দেখল ছাইয়ের গাদাটা নড়ছে। কিছু বাদে, তা থেকে যে উঠে দাঁড়াল তাকে গণ্ডার বলে চেনাই দায় তখন। কী সুন্দর ধবধবে সাদা রঙ ছিল জীবটার! আর এখন?
পুরো শরীরটা ছাই মাখা বেচারার। সাদা রঙের সামান্য চিহ্নটুকুও নাই শরীরের কোথাও। নাকে মুখে চোখে ছাই ঢুকে গিয়েছিল। চোখগুলো কেমন ছোট্ট কুতকুতে হয়ে গিয়েছে। আর গায়ের রঙ তো বলবার নয়। ম্যাড়মেড়ে ছাইয়ের রঙ সারা শরীর জুড়ে।
স্যাম জানতে পারেনি আর একটা বদলও হয়ে গিয়েছে গণ্ডারের। চোখের জোরও কমে গিয়েছে বেচারার।
তাই আজও আগের মতো আর খর দৃষ্টি নাই গণ্ডারের চোখে। আর, তার গায়ের ছাই ছাই রঙ? সে তো দুনিয়া শুদ্ধ সবাই জানে।
স্যাম তো হাল ছাড়বার পাত্র নয়। কাজ হাসিল না হওয়া পর্যন্ত, লেগে থাকতে জানে সে। তার ফলেই, একদিন আগুন জ্বালাবার কায়দা-কৌশলও জেনে নিয়েছিল সে।
0 Comments