যে সব কথা লেখা হয় না-২
সুমনা সাহা
লেখাজোখা আরম্ভ হওয়ার অনেক অনেক আগের কথা। তখন ভাবিইনি যে কোনকালে আমিও লিখব! গল্প শুনতে বড্ড ভালবাসতাম। একটা ভাতের দলাও গলা দিয়ে নামত না, অনর্গল গল্প না বললে। মা হাঁপিয়ে যেত। মায়ের নিজেরও ছিল পড়ার নেশা। সংসারের কাজকর্ম, চারটি সন্তানের লেখাপড়া, বইয়ে মলাট দেওয়া, আজ এর সর্দি তো কাল তার পেট খারাপ। আমাদের বড় দুই বোনকে বাড়িতে এসে রোজ পড়তে বসানোর জন্য এলেন এক নতুন দিদিমণি। ছোট দু’বোন তখনও দুধভাত। মানে ওদের পড়াশুনোর পালা শুরু হয়নি। আমি কালো স্লেটে সাদা চক পেন্সিল দিয়ে স্বরবর্ণ, ব্যাঞ্জনবর্ণ লেখা শিখছি। হাতে ধরে শেখাতেন ছায়া দিদিমণি। তিনি তখনও অবিবাহিতা। আমাদের যতটুকু পড়াতেন, তার থেকে অনেক বেশি গল্প বলতে হত। এটাই ছিল টিউশন-এর প্রাথমিক শর্ত। এখন মনে নেই, তবে কোনও এক জন্মদিনে, সম্ভবত ছায়া দিদিমণি কিম্বা অন্য কোনও আত্মীয় দুটো গল্পের বই উপহার দিয়েছিল—‘রাক্ষস খোক্কস দত্যি দানো’ এবং ‘পারস্য দেশের উপকথা’। চওড়া বাঁধানো বই দুটোর প্রচ্ছদে নানা চমকপ্রদ রঙিন ছবি! ওহ, সে কি রোমাঞ্চ! সারা দিন বই দুটো নিয়ে অজস্র বার প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত উলটে পালটে ছবি দেখা। পড়তে তো তখনও শিখিনি? ছায়া দিদিমণি রোজ অক্ষর লেখা প্র্যাকটিস করার পর পড়ে শোনাবেন, কথা দিলেন। সেই বই দুটো যেন ‘হাথক দর্পণ মাথক ফুল’ হয়ে উঠল। ঘুমাতে যাওয়ার সময় বালিশের পাশে নিয়ে শুই, ঘুম থেকে উঠেই আবার পাতা উলটে উলটে ছবি দেখি।
কিছুতেই আর পুরনো হয় না। এক একটা গল্প কত শত বার যে শুনলাম, তবুও আশ মেটে না। ক্রমে বানান করে একটু একটু পড়তে শিখলাম। ঘর হ’তে শুধু দুই পা ফেলিয়া রাস্তার ওপাড়েই একটি ছোট্ট স্কুল—‘আধুনিক শিক্ষালয়’। সেখানেই ভর্তি করে দেওয়া হল। পড়তে শিখে গেছি, অতএব জন্মদিন ও অন্যান্য অবসরে বই উপহার পেতে আরম্ভ করলাম। বলা বাহুল্য যে সেটা আমারই আবদারে। এরপর ধীরে ধীরে সিন্ধবাদ নাবিকের গল্প, ঘ্যাঘাসুরের কাহিনী, টুনটুনির বই, ছোটদের আরব্য রজনী এইসমস্ত বই উপহার পেতে আরম্ভ করেছিলাম। দিনরাতগুলো যেন ওইসব রঙিন ছবির দেশে ঘুরে বেড়াত। গল্পগুলো শোনার পরে ছোট বোনদের কাছে অভিনয় করে দেখানোটাও দিদি হিসেবে আমার কর্তব্য হয়ে উঠেছিল। স্কুলে যাতায়াত করতে করতেই সেসময় ছবি আঁকার নেশা হয়েছিল।
পড়াশুনায় খুব ভাল ছিলাম, মেধাবী ছাত্রী হিসেবে দিদিমণিরা প্রশংসা করতেন আর স্কুলের বন্ধুরাও খুব ভালবাসত। গোপা নামের এক সহপাঠিনীর কথা মনে পড়ে, নিজের প্যাস্টেল কালারের বাক্স আমাকে দিয়ে আনন্দ পেত। আমার রঙের বাক্সে যেসব রঙ আছে, অন্য বন্ধুদের বাক্সয় আরও অন্য অন্য কিছু রঙের পেন্সিল আছে। ক্যামেল-এর রঙ পেন্সিল একটু হালকা শেডের হত। আরেকটা কি কম্পানির রঙ পেন্সিল ছিল মনে নেই, তার রঙ বেশ গাঢ়। গোপা আমাকে ওর সব রঙ দিয়ে দিত, আমি খুশি হলে ওর খুব আনন্দ। এই সময় ছায়া দিদিমণির বিয়ে হয়ে গেল। আর পড়াতে পারবে না। মা দুশ্চিন্তায় পড়ল। অনেক খোঁজ খবর নিয়ে পাড়ারই এক দিদি, সে তখন এম এ পড়ছে, তাকে আমাদের সন্ধ্যাবেলা একটু পড়া দেখিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে সে রাজি হয়ে গেল। দেবযানী দিদিমণি, আমাদের দ্বিতীয় গৃহশিক্ষিকা। ভারি শান্ত আর মিষ্টি ছিল সে। তার ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ আর বিশাল একটা হাতখোপা মনে পড়ে। আমার কথায় কিছু বাঙাল টান ছিল, বাড়িতে শুনে শুনে বাচ্চারা যেমন শেখে। দেবযানী দিদিমণি সেসব কথার শুদ্ধ কলকাত্তাইয়া উচ্চারণ শেখালো। তারপর গল্প ভালবাসি জেনে আমাকে এনে দিল ‘পদি পিসির বর্মী বাক্স।’ কিন্তু পড়ে শোনানোর সময় তার নেই। মা-কে বলেছিল, “রাত্রে ঘুমানোর আগে ওদের একটু করে পড়ে শোনাবেন।” মা-র রোজ সময় হত না। কিছুটা পড়তে না পারার ক্ষোভে বা অন্য কি কারণে জানি না, বইয়ের ভিতরে প্রচুর চিত্রকর্মের নমুনা রেখেছিলাম। প্রত্যেক পাতায় রঙ পেন্সিলে প্রাণভরে ছবি এঁকে ভরিয়ে দিয়েছি। সেই বই যখন দিদিমণি ফেরত চাইলো, পাতা উলটে দেখে তার যে অবস্থা হল, সেই ব্যাথাতুরা মুখ আমি কোনদিন ভুলব না। যেন তাকে কেউ খুব মেরেছে। এত কষ্ট পেয়েছিল। মুখ টুখ লাল হয়ে গেল। বার বার কেবল বলতে লাগলো, “তোমাকে আমি খুব ভাল মেয়ে ভেবেছিলাম, বইটাকে এভাবে নোংরা করবে জানলে আমি কখনও তোমাকে বই দিতাম না! আমি আর তোমাদের পড়াব না!” পড়াবে না তো পড়াবেই না, কিছুতেই না। মায়ের কত অনুরোধ কানেই নিল না। মা বলল, “ওরা বাচ্চা তো, ছেলেমানুষী করে ফেলেছে। আর করবে না। আমি খুব বকে দেব। তুই দুঃখ পাস না।” কিন্তু তার দুঃখ মিটল না। সে ‘পদি পিসির বর্মী বাক্স’ বুকে চেপে বুকভরা অভিমান নিয়ে চলে গেল। এর কতকাল পরে আমি বইকে যখের ধনের মত আগলে যত্ন করে রাখতে শিখলাম। একটি পাতাও ভাঁজ করি না, একটি দাগও দিই না—দশ বছর পরেও বই যেন এখনই কিনে আনা নতুন বই। কিন্তু সেই অবস্থারও পরিবর্তন হল আরও পরে। তখন রীতিমত আন্ডারলাইন করে, নানা বাক্যাংশে ব্র্যাকেট দিয়ে, নিচে ফুটনোট লিখে বই পড়তাম। পরিবর্তনই জীবনের ধর্ম।
এরপর আমার বইয়ের নেশা হয়ে গেল। সন্ধান পেলাম, আমাদের ফ্ল্যাটেই আরেক দিদি থাকে, সেও খুব পড়ুয়া, আর তারও নাকি অনেক বইয়ের কালেকশন। ব্যাস, গল্পের লোভে সেই দিদির বাড়িতে যাতায়াত শুরু হল। সেই দিদি তখন আর্ট কলেজের ছাত্রী। বই ছাড়াও তার আঁকা ছবি দেখার নেশা হয়ে গিয়েছিল। বিরাট বড় বড় চার্ট পেপারের উপর পেন্সিলের সূক্ষ্ম স্কেচ—দুর্গাপুজো, দোল, হাওড়া স্টেশন—চমৎকার সব ছবি। সেই দিদির নামও ছিল শিল্পী। ওদের বাড়িতে ছিল দুটো পোষা খরগোশ। ওদের খাওয়াদাওয়া থেকে আরম্ভ করে কথাবার্তা সব কিছু আমাদের বাড়ির থেকে সম্পূর্ণ অন্যরকম। ভিন্ন সংস্কৃতি আস্বাদনের নেশা হয়ে গেল। দিদি একদিন আমাকে গুপ্তধন হ্যান্ডওভারের মত হাতে ধরিয়ে দিল ‘রুশদেশের উপকথা’। বলল, “এটা কিন্তু ভাইয়ের বই, ভিতরে দাগ দিবি না। পড়া হয়ে গেলে ফেরত দিবি। নাহলে খোকন আমাকে আস্ত রাখবে না!” ওই খোকন দা-কে আমরা আড়ালে বলতাম ‘বম্বে খোকন’। বেশ ভয়ও পেতাম। রাগী ছিল। কিন্তু এক একদিন লোডশেডিং হয়ে গেলে নিচের রোয়াকে কোমর দুলিয়ে নাচত, আর গান গাইত—“বোম্বাই সে আয়া মেরা দোস্ত, দোস্তকো সেলাম করো। রাত কো খাও পিও, দিনভর আরাম করো। ওয়াও ওয়াও ওয়া ওয়াও ওয়াও ওয়া বাও বাও বাও বাও।” তাই ‘বম্বে খোকন’। এহেন নামকরণ ছাড়া উপায়ও ছিল না। আমার নিজের দাদাও তো খোকন, আরেকজন ছিল ওপাশের চারতলায় ‘কানা খোকন’, ছোটবেলায় ডাংগুলি খেলতে গিয়ে যার একটা চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এছাড়াও নাটা খোকন, ছোট খোকন ছিল। আমাদের ছোটবেলায় পড়া বইয়ের মধ্যে বোধহয় সবচেয়ে প্রিয় ছিল ‘রুশদেশের উপকথা’। এক একটা গল্প হাজার বার পড়েছি, ক্লান্তিহীন আওড়াতাম ‘ছোট্ট গোল রুটি চলছি গুটি গুটি’, কিম্বা ‘শিবকা বুড়কা যাদু কা লেড়কা, চেকনাই ঘোড়া, সামনে এসে দাঁড়া।’ সেই বই আর বম্বে খোকনকে ফেরত দেওয়া হয়নি, আজও রয়ে গেছে আমার কাছে, যার প্রথম পৃষ্ঠায় মোটা হরফে লেখা, “এই বইয়ের মালিক –।”
এরপর ছাপার অক্ষরের খিদে তৈরি হল। ভাত-ডাল-মাছ-তরকারির মতোই গল্পের বই চাইই চাই। অতএব ব্যবস্থা করা হল সেইমত, কাগজওয়ালা ঘরে দিয়ে যেত, ‘শুকতারা’, ‘চাঁদমামা’, পুজোসংখ্যার আনন্দমেলাও। আধুনিক শিক্ষালয় থেকে বারুইপাড়ায় রামকৃষ্ণ সারদা মিশন শিক্ষামন্দির, তারপর প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে রাজকুমারী মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুলে ক্লাস ফাইভে এডমিশন। পেলাম স্কুল লাইব্রেরির গল্পের বইয়ের খনির সন্ধান। একে একে পড়তে আরম্ভ করলাম শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্রের বই, তার সঙ্গেই নারায়ণ সান্যালের তিমি তিমিঙ্গিল, বিশ্বাসঘাতক, প্যারাবোলা স্যার। তাই বলে পড়াশুনোয় ফাঁকি দিইনি। পাঠ্য বই ও অবসরের পাঠ—দুইই চলছিল সমান্তরাল দুটি নদীর মত।
0 Comments